‘”বাড়ির পাশে শ্মশানঘাট,সেথায় নাকি ভূতের ঠাট!
তেঁতুল গাছে শাকচুন্নি,দেখলেই সে ঝাঁপিয়ে ঝুনি!-লোকছড়া”
সন্ধ্যায় কাজ শেষে বন্ধুদের সাথে অ্যাকাডেমিক বিল্ডিং এর ছাদে গোল হয়ে বসলাম। ভূতের গল্প শুনানো হবে। সবাই কাছাকাছি জড়োসড়ো হয়ে বসলাম। যত সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের অন্ধকার বাড়তে থাকলো তত আমরা গল্পের গভীরে ঢুকতে থাকলাম। মনে হল যেন কোন বিল্ডিং এর ছাদে নয়, বরং গ্রামের মাটির বাড়ির উঠানে শুধুমাত্র চাঁদের আলোর নিচে আমরা সকলে একসাথে বসেছি ভূতের গল্প শুনতে।
বাংলার লোককাহিনি ও সংস্কৃতিতে ভূতের উপস্থিতি সুপ্রাচীন ও গভীর।তাই বাংলার জনবিশ্বাসে ভূতেরা নিতান্তই এক অনিবার্য চরিত্র। শত শত বছর ধরে বাংলার গ্রামাঞ্চলে ভূতের গল্প শোনা যায়, এই ভূতেরা কেবলমাত্র ভয় প্রদানের উপকরণ নয়; বরং তারা বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতিফলন।
বাংলার বিখ্যাত ভূতদের নাম ও তাদের গল্প
বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ভূতের কাহিনি বেশ জনপ্রিয়। গ্রামবাংলার ভূতেরা সাধারণত মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে মিশে থাকে এবং তাদের কাহিনিগুলো লোকসংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে। এভাবে বাংলায় বিভিন্ন ধরনের ভূতের বিচরণ হয়েছে। এমন কিছু পরিচিত-অপরিচিত ভূত ও তাদের গল্প হলঃ
মেছোভূত
মাছপ্রিয় এই ভূতেরা পুকুর, নদী বা জলাশয়ের ধারে বসবাস করে। জেলেদের নৌকা থেকে বা মানুষের রান্নাঘর থেকে মাছ চুরি করে খায়। বাজার থেকে মাছ কিনে ফেরার পথে মেছোভূতের পাল্লায় পড়ে মানুষ ভয় পায়।
পেত্নী
অল্পবয়সী, অবিবাহিতা কোনো মেয়ে অপঘাতে মারা গেলে পেত্নী হয়। সাধারণত কোনও মেয়ে অতৃপ্ত বাসনা নিয়ে অবিবাহিত অবস্থায় মারা গেলে, তার আত্মাকে পেতনি বলা হয়।এরা তেঁতুল বা শেওড়া গাছে বসবাস করে এবং মানুষের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। তাদের পায়ের গোড়ালি উল্টোদিকে ঘোরানো থাকে, যা তাদের চেনার প্রধান উপায়।বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের জনপ্রিয় ভূতদের মধ্যে পেত্নীর নাম শীর্ষে থাকে।
ডাইনি
এরা হলো জলজ্যান্ত নারী, যারা কালো যাদু এবং ডাকিনী বিদ্যাতে পারদর্শী। এরা ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের মেরে তাদের হাড় এবং মাংস খেয়ে নাকি একশো বছর বেঁচে থাকে।
ব্রহ্মদৈত্য
ব্রাহ্মণ মরে ব্রহ্মদৈত্য হয়। ব্রাহ্মণ পুরুষের আত্মা। পায়ে খড়ম চাপিয়ে, সাদা ধুতি পরে খট খট শব্দে হেঁটে বেড়ায়। তার থাকার প্রিয় স্থান বেলগাছ বা শিমুল গাছ। সাধারণত এরা মানুষের অনিষ্ট করে না, বরং উপকার করে,কিন্তু রাগলে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে।
পিশাচ
পিশাচ হলো বাংলার সবচেয়ে ভয়ংকর ভূতদের একটি। লোককাহিনি অনুসারে, এটি সাধারণত শ্মশানঘাটে বসবাস করে এবং মৃতদেহ ভক্ষণ করে। বাংলার ভয়ংকর ভূতের গল্পগুলোর মধ্যে পিশাচের উল্লেখ প্রায়ই পাওয়া যায়।
শাকচুন্নি
শাকচুন্নি হলো সাধারণত হিন্দু অল্পবয়সী নারীর আত্মা, যে বিয়ের পর অকালমৃত্যু বরণ করেছে। সংস্কৃত শব্দ শঙ্খচুর্নী থেকে এসেছে শাকচুন্নি। শাকচুন্নির গল্পগুলোতে বলা হয়, সে লাল শাড়ি পরে থাকে এবং সিঁদুরের গন্ধে আকৃষ্ট হয়। বাংলার লোককাহিনির জনপ্রিয় ভূত চরিত্রগুলোর মধ্যে এটি অন্যতম।
নিশি
রাতের বেলা পরিচিত মানুষের কণ্ঠস্বরে ডাকে। এই ডাক শুনে যদি কেউ সাড়া দেয়, তবে সে বিপদে পড়ে। তান্ত্রিকরা অন্যের ক্ষতি করার জন্য নিশি হয়ে ডাকে বলে বিশ্বাস করা হয়।
মামদো ভূত
মামদো ভূত হলো এমন ভূত যারা রাতে বাচ্চাদের তুলে নিয়ে যায়। বাংলার শিশুদের ভয় দেখানোর জন্য মামদো ভূতের গল্প বলা হয়। এই ভয় থেকে এই ভূতের অস্তিত্ব দিন দিন বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠে।
বাংলার লোককথায় ভূত ও তাদের পরিচয়
বাংলার ভূতের রহস্য নিয়ে অনেক লোককাহিনি প্রচলিত। বাংলার লোককথায় ভূতেরা বিভিন্ন রূপে উপস্থিত হয়।
পেঁচাপেঁচি
বাংলার বনে-জঙ্গলে জোড়া ধরে ঘুরে বেড়ায়। এরা সাধারণত বনে বিপদগ্রস্ত পর্যটকদের আক্রমণ করে এবং রক্ত পান করে।
শাকচুন্নি
বিবাহিতা নারী, যারা অল্প বয়সে মারা গেছে, তারা শাকচুন্নি হয়। এরা শাখা-সিঁদুর পরে এবং সাধারণত গ্রাম্য নারীদের আক্রমণ করে।
বোবা
ঘুমের মধ্যে মানুষকে আক্রমণ করে, যাতে মানুষ কথা বলতে বা নড়াচড়া করতে পারে না। আধুনিক বিজ্ঞানে একে স্লিপ প্যারালাইসিস বলা হয়।
বাংলার ভূতেরা কোথায় বেশি দেখা যায়?
গ্রামের মানুষজনের মধ্যে ভূতের উপস্থিতি নিয়ে নানা ধরনের বিশ্বাস ও গল্প প্রচলিত। বিশেষ করে, গ্রামের নির্জন স্থান, পুরনো গাছ বা জলাশয়ের ধারে ভূতের উপস্থিতির কথা শোনা যায়। আবার সাধারণত ভূতের গল্পগুলো শ্মশান, নদীর ধারে, পুরনো বাড়ি, গাছগাছালি ঘেরা এলাকা ও ফাঁকা রাস্তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের ভূতের ইতিহাসে কিছু নির্দিষ্ট এলাকা ভৌতিক বলে পরিচিত—
- সুন্দরবনের গভীর অরণ্য: অনেক মৎস্যজীবী দাবি করেন, তারা এখানে অলৌকিক কিছুর সম্মুখীন হয়েছেন।
- নদীর ধারে ও ঘাটে: বিশেষ করে পদ্মা, মেঘনা ও যমুনার ধারে ভূত দেখার গল্প শোনা যায়।
- পুরনো জমিদার বাড়ি: বাংলার লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, পুরনো জমিদার বাড়িগুলোতে ব্রহ্মদৈত্য বা অন্য আত্মার বসবাস থাকতে পারে।
বাংলার সবচেয়ে ভয়ংকর ভূতের গল্প
বাংলার সবচেয়ে ভয়ংকর ভূতের গল্পগুলোর মধ্যে রাজবাড়ীর কালো শাড়ির নারী, নিশির ডাক, ঠাকুরগাঁওয়ের রাতের আতঙ্ক, ও নোয়াখালীর কাটা মাথার ভূত বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। রাজবাড়ীর কালো শাড়ির নারী এক প্রতিশোধপরায়ণ বিধবার আত্মা, যে রাতে লাল আলোতে দেখা দেয়, এবং যার ছায়ায় পড়লে কেউ ফিরে আসে না। নিশির ডাক হলো এমন এক অলৌকিক ঘটনা যেখানে ভূত পরিচিত কণ্ঠে ডেকে মানুষকে অদৃশ্য করে দেয়। ঠাকুরগাঁওয়ে এক বৃদ্ধার ভূত রাতে মানুষের গলা চেপে ধরত, যা অনেকের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল। নোয়াখালীর কাটা মাথার ভূতের গল্পে বলা হয়, একদল চাষি রাতে একটি বিচ্ছিন্ন মাথাকে ঘুরতে দেখেছিল, যা আতঙ্ক ছড়িয়েছিল। এছাড়া, বাংলার লোককাহিনিতে ডাইনি ও মেছোভূতের কাহিনিও প্রচলিত, যেখানে ডাইনি শিশুদের রক্ত শোষণ করে আর মেছোভূত জেলেদের ডুবিয়ে মারে। এসব গল্প বাংলার লোকসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসা এক রহস্যময় ঐতিহ্য।
দক্ষিণ এশিয়ার লোককাহিনিতে ভূত ও আত্মা
দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ভূত ও আত্মা নিয়ে নানা ধরনের লোককাহিনি প্রচলিত। ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি দেশে ভূতের কাহিনিগুলো স্থানীয় সংস্কৃতি ও বিশ্বাসের সঙ্গে মিশে আছে। প্রতিটি অঞ্চলের ভূতের ধরণ, তাদের কার্যকলাপ ও বিশ্বাসের মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও, মূল ধারণা প্রায় একই।
বাংলার ভূত বনাম পশ্চিমা ভূতের পার্থক্য
বাংলার ভূতেরা সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো স্থানে সীমাবদ্ধ থাকে এবং বিশেষ কারণে মানুষের সামনে আসে। পশ্চিমা ভূতদের মতো তারা সর্বত্র বিচরণ করে না বা মানুষকে সরাসরি হত্যা করে না। পশ্চিমা হরর গল্পে ভূতেরা অনেক আধুনিক প্রযুক্তির সাথে মিশে গেছে, যেমন ‘The Conjuring’ বা ‘The Ring’-এর মতো সিনেমার ভূতেরা বিদ্যুৎ চালু-বন্ধ করতে পারে, কিন্তু বাংলার ভূতদের ক্ষমতা মূলত শারীরিক বা মানসিক ভয় দেখানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
ভূত নিয়ে বাংলা সংস্কৃতি ও বিশ্বাস
বাংলাদেশের ভূতের ইতিহাস মূলত লোকবিশ্বাস ও সংস্কৃতি দ্বারা গড়ে উঠেছে। গ্রামাঞ্চলে এখনও অনেক মানুষ ভূতে বিশ্বাস করেন। বাংলার লোকবিশ্বাস ও ভূতের প্রতি ভয়ের ফলে সমাজে কিছু অলৌকিক নিয়ম প্রচলিত রয়েছে, যেমন—
- সন্ধ্যার পর গাছতলায় না যাওয়া
- খালি বাড়িতে বেশি সময় না থাকা
- গভীর রাতে নির্জন জায়গায় একা না যাওয়া
ভূত হোক বাংলার কিংবা পশ্চিমের। এই ভূতের গল্পের মধ্যেই লুকিয়ে আছে যুগের যুগের মানুষের মনোভাব,বিশ্বাস ও কল্পনা। প্রত্যেকটা ভূত যেন আপনাকে কিছু বলতে চায়। তাদের গল্প আপনাকে বার বার কিছু জানাতে চায়। এই জানানোর ইচ্ছা থেকে পুরো গল্প শুনে ভয়ে শিউরে উঠা সবটুকুই এক অন্যরকম অনুভূতি।
বাংলার ভূত নিয়ে মজার ও অদ্ভুত কিছু তথ্য!
বাংলার ভূতের রহস্যময় দুনিয়া শুধু ভয়ংকর নয়, বরং কৌতূহলউদ্দীপকও!বাংলার ভূতেরা সামাজিক শ্রেণিভেদ মানে, নির্দিষ্ট পোশাক পরে, খাবার চুরি করে, এমনকি কিছু ভূত মানুষের উপকারও করে! চলুন, বাংলার ভূতদের নিয়ে কিছু অদ্ভুত ও মজার তথ্য জেনে নেওয়া যাক—
বাংলার ভূতদের বৈশিষ্ট্য:
ভূতেদেরও ‘কাস্ট সিস্টেম’ আছে: ব্রহ্মদৈত্য ব্রাহ্মণদের আত্মা, শাকচুন্নি ধনী পরিবারের বউদের আত্মা, আর পেত্নী নিম্নবিত্ত নারীদের আত্মা।
তেঁতুল গাছ ভূতদের প্রিয়: সন্ধ্যার পর তেঁতুল গাছের নিচে গেলে ভূতের কবলে পড়তে পারেন!
ভূতেরা পা উল্টো করে হাঁটে: ভূত চেনার সহজ উপায় হলো তাদের পায়ের গঠন দেখা—ওরা পেছন দিকে হাঁটে!
ভূতেরা খাবার চুরি করে: শাকচুন্নি ও পেত্নী বিশেষ করে মিষ্টি জাতীয় খাবার চুরি করতে ভালোবাসে।
ভূতেরা ধর্ম মানে: ধর্মীয় মন্ত্র শুনলে ভূত ভয় পায় এবং পালিয়ে যায়!
মামদো ভূত শুধু ভয় দেখায়: শিশুদের ঘুম পাড়ানোর জন্য মামদো ভূতের গল্প বলা হয়, কারণ সে কাউকে মারে না!
ভূতদেরও নির্দিষ্ট পোশাক আছে: শাকচুন্নি লাল শাড়ি, পেত্নী সাদা শাড়ি, আর ব্রহ্মদৈত্য ধুতি পরে।
বাংলার কিছু জায়গা ভৌতিক: যেমন—নরসিংদীর জাহাজ বাড়ি, ঢাকার বলধা গার্ডেন ও বরিশালের জমিদার বাড়ি।
সব ভূত ক্ষতিকর নয়: ব্রহ্মদৈত্য ভালো মানুষের উপকার করে ও বিপদে সাহায্যও করতে পারে!
ভূতদেরও নির্দিষ্ট এলাকা থাকে: নির্দিষ্ট ভূত শুধু তার নির্দিষ্ট জায়গায় থাকে, ওই এলাকা ছাড়লে সে আর ক্ষতি করতে পারে না!