গাজায় ১৫ মাস ধরে চলা ইসরায়েলের নির্বিচার হামলায় ৪৮ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়। এই পরিস্থিতিতে গাজাবাসীর মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছিল যুদ্ধবিরতি; ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা শুরু করেছিলেন তাঁরা। কিন্তু যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে নতুন ভাবে গাজায় হত্যাযজ্ঞ শুরু করেছে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকার। আর একারণেই ফিলিস্তিনে চলমান হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদে বিশ্বজুড়ে ইসরাইলের সব ধরনের পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে সাধারণ মুসলিম সমাজ। এর ফলে ইসরাইলি পণ্য বয়কটের আন্দোলন এবার গতিশীল হয়েছে। আর পশ্চিমা ব্র্যান্ডের জায়গায় স্থান পেয়েছে স্থানীয় পণ্যগুলো।
তবে, আমরা কিভাবে চিনবো ইসরায়েলী পণ্য? পণ্য বয়কটে আসলে কি লাভ বা ক্ষতি? ইসরায়েলি অর্থনীতিতে এর প্রভাব কি আসলেই পড়ে? পণ্য বয়কট করে আমরা নিজেদেরই ক্ষতি করে বসছি না তো?
বয়কট কী?
কোনো পণ্য, ব্যক্তি, সংস্থা বা দেশকে রাজনৈতিক, সামাজিক বা পরিবেশগত যে কোনো কারণে বর্জন করা, স্বেচ্ছায় সেবা নেয়া বা পণ্য কেনা থেকে বিরত থাকাকেই মূলত বয়কট বলা হয়। সোজা কথায়, বয়কট হলো কোনো একটি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বিরোধিতার কারণে নির্দিষ্ট কোনো পণ্য, মানুষ বা দেশকে বর্জন করা।
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন শুরুর পর বিশ্বের অনেক মুসলিম অধ্যুষিত দেশে ইসরাইল ও তাদের মিত্র পশ্চিমা দেশগুলোর মালিকানাধীন পণ্য বয়কটের হিড়িক পড়ে যায়। এমন প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য ছিলো, পশ্চিমা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রতিষ্ঠানগুলো বড় অংকের লোকসানে পড়লে টনক নড়বে সরকার প্রধানদের এবং বন্ধ হবে ইসরাইলকে সহায়তা দেয়া।
যেভাবে চেনা যাবে ইসরায়েলি পণ্য
কিন্তু ইসরায়েলী পণ্য আমরা চিনবো কিভাবে? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইসরায়েলি পণ্য শনাক্তের একটি পদ্ধতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর তা হলো বারকোড চেক। এক্ষেত্রে, বলা হচ্ছে, “ইসরাইলী পণ্য চেনার সহজ উপায় হলো বারকোডের শুরুতে যদি ৭২৯ এই তিনটি সংখ্যা থাকলে, বুঝে নিবেন এটা ইসরাইলী পণ্য”। এছাড়াও পণ্যের গায়ে ‘মেড ইন ইসরায়েল’ লেখা দ্বারা ইসরায়েলে উৎপাদিত পণ্য বোঝা যাবে।
তবে সঠিক তথ্য হলো, ৭২৯ প্রেফিক্স কোডের পণ্যটি ইসরায়েলে যেমন উৎপাদিত হতে পারে, তেমন ভিন্ন কোনো দেশেও উৎপাদিত হতে পারে। তাই নির্দিষ্ট করে বারকোডের প্রথম তিনটি সংখ্যা দ্বারা এটি জানা যায় না যে ঐ পণ্য কোথায় উৎপাদন করা হয়েছে। বরং, যে কোম্পানি ঐ পণ্য উৎপাদন করছে সেটি কোন দেশের তা বারকোডের প্রথম তিন সংখ্যা দ্বারা চিহ্নিত করা যায়।
তবে যদি বারকোডের প্রথম তিন সংখ্যা ৭২৯ এর পাশাপাশি পণ্যে নির্দিষ্ট করে Made in Israel লেখা থাকে, তাহলে তখন নির্দিষ্ট করে বলা যাবে ঐ পণ্যটি ইসরায়েলি কোম্পানির এবং ইসরায়েলে উৎপাদিত।
পণ্য, দেশ বা সংস্থাকে বয়কট করা কি আদৌ সম্ভব
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কোন পণ্য, দেশ বা সংস্থাকে বয়কট করা কি আদৌ সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। কিন্তু সেক্ষেত্রে যেই পণ্য বয়কট করতে আগ্রহী তার বিকল্প ব্যবস্থা আছে কি-না দেখতে হবে। বিকল্প ব্যবস্থা থাকলে চোখ বন্ধ করে সেই পণ্য বয়কট করা সম্ভব। যেমন- কোকাকোলার পরিবর্তে বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য পানীয় পান করছে। এক্ষেত্রে বয়কট করা সম্ভব হচ্ছে, কারণ বিকল্প ব্যবস্থা আছে।
আবার অন্যদিকে বাংলাদেশের লাখ লাখ তরুণ-তরুণী ইসরাইলি মালিকানাধীন কোম্পানি ফাইভারে কর্মসংস্থান করেছে। আর তাই, ফ্রিল্যান্সাররা চাইলেই এখন বয়কটকে সমর্থন জানিয়ে ফাইভারে কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারবেন না। কারণ, এর বিকল্প বাংলাদেশে নেই, রাতারাতি তৈরি করাও সম্ভব হবে না।
আবার কোকাকোলা বয়কট করার জন্য কার্টুন ভর্তি কোকাকোলা কিনে মাটিতে ফেলে তা নষ্ট করার ভিডিও ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে। মজার বিষয় হলো এমনটি করলেও বয়কট সফল হবে না, বরং, উল্টো কোকের কোম্পানিকে বেশি লাভ করিয়ে দেয়া হবে।
তবে হতাশার কারণ নেই। ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত সকল কোম্পানি ও পণ্য বয়কটের মূল কারণ হলো দেশটিকে অর্থনৈতিক চাপে ফেলা। আর বয়কটের ফলে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সেই কোম্পানি বা ব্র্যান্ডগুলোকেও অনেকটাই ভুগতে হচ্ছে।
গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইসরাইলের পক্ষে সমর্থনের কারণে বয়কটের মুখে পড়েছে ম্যাকডোনাল্ডস। এটা প্রভাব ফেলেছে কোম্পানিটির বৈশ্বিক বিক্রিতে। আর তাই ব্যবসার সেই পতন ঠেকাতে ইসরাইলে থাকা ২২৫টি রেস্তোরাঁর সবই স্থানীয় ফ্র্যাঞ্চাইজি থেকে ফের কিনে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় ফাস্ট ফুড জায়ান্টটি। এছাড়াও, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ কুয়েত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানেও বয়কটের মুখে পড়ে ফাস্ট ফুড কোম্পানিটি।
ম্যাকডোনাল্ডস ছাড়াও ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংঘাতকে ঘিরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার মুখোমুখি অন্যান্য পশ্চিমা ব্র্যান্ড যেমন — কেএফসি, স্টারবাকস ও ইউনিলিভারও। বয়কটের প্রভাবে মরক্কোতে স্থায়ীভাবে বন্ধের কথা তোলে জনপ্রিয় আমেরিকান চেইন কফিশপ স্টারবাকস।
পণ্য বয়কট নাকি নিজেদের ক্ষতি- ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল
কিন্তু পণ্য বয়কট করতে গিয়ে কি বাংলাদেশ কোনভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে? কোনো দেশই শতভাগ স্বয়ংসম্পূর্ণ না। যতটুকু তার নিজের, ততটায় তারা বাকি পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল। বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে হোক অথবা আমাদের রফতানি পণ্যের জন্য বিদেশি বাজারে চাহিদা তৈরি করার মাধ্যমেই হোক না কেন, বাংলাদেশেরও উল্লেখযোগ্য অংশও বাকি পৃথিবীর ওপর নির্ভরশীল।
যখন একটি দেশকে বয়কট করা হবে, তার মানে সেই দেশের সঙ্গে সম্পর্ক সব দিক দিয়ে শেষ করার কথা ভাবতে হবে। বাংলাদেশ যদি যুক্তরাষ্ট্রকে বয়কট করতে চায়, তবে আমদানি-রপ্তানির হিসেবসহ, সে দেশে বাংলাদেশের কত সংখ্যক মানুষ কাজ করে, তার সঙ্গে যুক্ত রেমিট্যান্স, এমনকি বাংলাদেশে থাকা পরিবারের কথা চিন্তা করতে হবে। যেমন- ইসরাইল শিক্ষা, বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা-বাণিজ্যে এত উন্নত যে, বৈশ্বিকভাবে জনপ্রিয় প্রায় সবকিছুতেই ইসরাইলের শেয়ার আছে, যার মধ্যে অনেক কোম্পানি কিংবা ব্র্যান্ডের নাম আমরাও জানি না, কিংবা না জেনেই ব্যবহার করছি।
একটা জিনিসে অভ্যস্ত হয়ে গেলে, তা থেকে বিরত থাকা অসম্ভব। আবার, বিরত থাকলে পিছিয়ে পড়তে হবে প্রতিযোগিতার এ বিশ্বে। আর এ কারণে, ফাইভার ব্যবহার না করলে লস শুধু ইসরাইলের নয়, হাজার হাজার ব্যবহারকারীদেরও হবে।
সম্প্রতি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের দোকান ভাঙচুরের ঘটনাও আমাদের সামনে এমন একটি বাস্তবতা তুলে ধরেছে, যা গভীরভাবে বিশ্লেষণ না করলে দেখা যাবে দিন শেষে আমাদেরই ক্ষতি। যেমন— বাটা, ডোমিনোজ, কে এফ সি কিংবা পিৎজা হাট; এসব ব্র্যান্ডের দোকান ভাঙার ফলে প্রকৃত মালিকদের আদৌ কোন অর্থনৈতিক ক্ষতি হয় না!
কারণ- এই প্রতিষ্ঠানগুলোর বাংলাদেশে ব্যবসা পরিচালনার ধরন ‘ফ্র্যাঞ্চাইজি মডেল’-এর ওপর নির্ভরশীল। এই মডেলে, মূল কোম্পানি কেবলমাত্র ব্র্যান্ড নাম ও ব্যবসায়িক কাঠামো ব্যবহারের অনুমতি দেয়। আর স্থানীয় উদ্যোক্তারা নিজেদের বিনিয়োগেই এই ব্যবসা পরিচালনা করেন।
আর তাই, বাংলাদেশে বর্তমানে কে এফ সি ও পিৎজা হাটের সঙ্গে তাদের মূল কোম্পানির সরাসরি কোনও আর্থিক সম্পর্ক পর্যন্ত নেই। চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায়, মূল কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ এখন এই অঞ্চলে আর জড়িত নয়। ফলে এসব দোকান ভাঙার ফলে, ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন মূলত স্থানীয় বিনিয়োগকারী, দোকান মালিক ও কর্মচারীরা।
এই চিত্র আন্তর্জাতিক অনেক পণ্যের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, একসময় ‘কোকা কোলা’ বাংলাদেশে তৈরি ও বাজারজাত করতো প্রাণ গ্রুপ। পরবর্তীতে এটি কোকা কোলা ইন্টারন্যাশনালের হাতে এলেও, বয়কট আন্দোলনের সময় ব্যবসা পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় তুরস্ক-ভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের কাছে। অর্থাৎ, আমাদের বাজারে বিক্রি হওয়া আন্তর্জাতিক পণ্যের অধিকাংশই স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত, বাজারজাতকৃত এবং পরিচালিত। এমন অবস্থায় দোকান ভাঙচুর কিংবা ব্র্যান্ড ধ্বংস করে মূল কোম্পানিকে শাস্তি দেওয়ার চিন্তা কার্যত বিভ্রান্তিকর এবং উল্টো দেশীয় ব্যবসায়ী ও কর্মজীবীদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে উঠছে।
এখানে আরেকটি বিষয় ভাববার মতো। দেশে বিভিন্ন সময়ে যে ইসরায়েলি পণ্যের তালিকা ছড়িয়েছে, তার নির্ভরযোগ্যতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। কারণ, সেসব তালিকায় এমন অনেক ব্র্যান্ডের নাম রয়েছে, যাদের ইসরায়েলের সঙ্গে সরাসরি কোনও সংযোগ নেই। এমনকি সেই তালিকায় “বিকল্প পণ্যের” পরামর্শও থাকে, যা দেখে সন্দেহ জাগে—এই তালিকাগুলো কি ইচ্ছাকৃতভাবে বাজার প্রতিযোগিতা থেকে প্রতিপক্ষকে সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা? যদিও প্রমাণ নেই, তবে এ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করাই যায়।
সব মিলিয়ে আমাদের দরকার আরও তথ্যভিত্তিক ও সচেতন আচরণ। হুটহাট ভাঙচুর কিংবা গুজবে কান না দিয়ে আসল ক্ষতিগ্রস্ত কারা, এবং আমরা কাকে শাস্তি দিতে গিয়ে কাকে আঘাত করছি—তা আগে বুঝে নেওয়া জরুরি।
বয়কটের মাধ্যমে মানুষ নির্দিষ্ট কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান কিংবা ব্যক্তিদের মালিকদের যে বার্তা দিতে চায় তা দেয়া সম্ভব। বয়কটে সেই পণ্যের ব্যবসায় ধসও আনা সম্ভব। তবে তার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা থাকা অত্যন্ত জরুরি।
তথ্যসূত্রঃ
- https://www.prothomalo.com/world/middle-east/hh1qdlrfnt
- https://www.dailyjanakantha.com/national/news/790124
- https://www.somoynews.tv/news/2024-04-23/3CYvsUWs
- https://ekhon.tv/article/65fbc299129ae4d4c20ce5fc
- https://www.dailyjanakantha.com/national/news/790124