Image default
কী ও কেন

দীর্ঘ সময় পানিতে থাকলে হাত-পা কেন কুঁচকে যায়? জানুন বৈজ্ঞানিক কারণ

দীর্ঘ সময় গোসল বা সাঁতারের পর আপনার হাত-পায়ের আঙুল কি কিশমিশের মতো হয়ে যায়? এটি শুধু পানি শোষণের ফল নয়, এর পেছনে লুকিয়ে আছে আপনার স্নায়ুতন্ত্রের এক অবিশ্বাস্য কৌশল। জানুন, কেন আমাদের শরীর সচেতনভাবেই এই পরিবর্তনটি ঘটায়।

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এমন কিছু সাধারণ ঘটনা থাকে, যা আমরা প্রায়শই খেয়াল করি, কিন্তু তার পেছনের কারণ নিয়ে হয়তো সেভাবে ভাবি না। দীর্ঘ সময় ধরে গোসল করা, সুইমিং পুলে সাঁতার কাটা বা থালা-বাসন ধোয়ার পর আমাদের হাতের এবং পায়ের আঙুলের দিকে তাকালে যে পরিবর্তনটি সবচেয়ে বেশি চোখে পড়ে, তা হলো ত্বক কুঁচকে যাওয়া। আঙুলের ডগাগুলো দেখতে অনেকটা কিশমিশ বা শুকনো ফলের মতো হয়ে যায়, যা পানি থেকে উঠে আসার কিছুক্ষণ পরেই আবার স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে।

এর পেছনে আসল রহস্যটা কী? কেন শুধু হাত এবং পায়ের আঙুলের ডগাই এভাবে কুঁচকে যায়, শরীরের অন্য জায়গার চামড়া নয়? 

পুরনো ভুল ধারণা: অসমোসিস বা অভিস্রবণ তত্ত্ব

বহু বছর ধরে, বিজ্ঞানীরা এবং সাধারণ মানুষ বিশ্বাস করতেন যে, পানিতে আঙুল কুঁচকে যাওয়ার কারণ হলো অসমোসিস (Osmosis) বা অভিস্রবণ প্রক্রিয়া। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, আমাদের ত্বকের বাইরের স্তরটি (এপিডার্মিস) একটি অর্ধ-ভেদ্য ঝিল্লির মতো কাজ করে। যখন আমরা দীর্ঘ সময় পানিতে থাকি, তখন অসমোসিস প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাইরের পানি ত্বকের কোষের ভেতরে প্রবেশ করে। এর ফলে, কোষগুলো পানি শোষণ করে ফুলে ওঠে, কিন্তু ত্বকের ভেতরের স্তরের সাথে লেগে থাকায়, বাইরের স্তরটি আয়তনে বেড়ে গিয়ে ভাঁজ হয়ে যায় বা কুঁচকে যায়।

অসমোসিস প্রক্রিয়া

এই ধারণাটি শুনতে যৌক্তিক মনে হলেও, এর কয়েকটি বড় সীমাবদ্ধতা রয়েছে:

  • কেন শুধু হাত-পায়ের আঙুল? যদি অসমোসিসই কারণ হতো, তাহলে আমাদের শরীরের সমস্ত ত্বকই একইভাবে কুঁচকে যাওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে, এটি শুধুমাত্র হাতের আঙুল এবং পায়ের আঙুলের ডগাতেই সবচেয়ে বেশি দেখা যায়।
  • স্নায়ু ক্ষতিগ্রস্ত হলে কী হয়? চিকিৎসকরা লক্ষ্য করেন যে, যেসব রোগীর আঙুলের স্নায়ু কোনো কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে, তাদের আঙুল দীর্ঘ সময় পানিতে রাখলেও আর কুঁচকে যায় না।

এই শেষ পর্যবেক্ষণটিই বিজ্ঞানীদের নতুন করে ভাবতে বাধ্য করে। 

আসল বৈজ্ঞানিক কারণ: স্নায়ুতন্ত্রের কারসাজি

আধুনিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, পানিতে আঙুল কুঁচকে যাওয়া আমাদের অটোনোমিক নার্ভাস সিস্টেম (Autonomic Nervous System) বা স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রের একটি নিয়ন্ত্রিত প্রতিক্রিয়া। এই স্নায়ুতন্ত্রটি আমাদের শরীরের সেইসব কাজ নিয়ন্ত্রণ করে, যা আমরা সচেতনভাবে করি না, যেমন হৃদস্পন্দন, শ্বাস-প্রশ্বাস এবং রক্তচাপ।

স্নায়ুতন্ত্র

যখন আমাদের হাত-পায়ের আঙুল দীর্ঘ সময় ধরে পানির সংস্পর্শে থাকে, তখন স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্র একটি বিশেষ সংকেত পাঠায়। এই সংকেতের প্রভাবে, আঙুলের ডগায় থাকা ক্ষুদ্র রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে যায়। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ভ্যাসোকনস্ট্রিকশন (Vasoconstriction)

প্রক্রিয়াটি কীভাবে কাজ করে?

১. আঙুলের ডগায় থাকা রক্তনালীগুলো যখন সংকুচিত হয়ে যায়, তখন সেই অঞ্চলে রক্ত প্রবাহ সাময়িকভাবে কমে যায়।

২. এর ফলে, ত্বকের ভেতরের স্তরের আয়তন কিছুটা কমে আসে।

৩. কিন্তু ত্বকের বাইরের স্তরটি (এপিডার্মিস) আগের মতোই থাকে। ভেতরের স্তরটি সংকুচিত হওয়ায়, বাইরের স্তরটি তার নিচের স্তরের সাথে খাপ খাওয়ানোর জন্য ভাঁজ হয়ে যায় বা কুঁচকে যায়।

সহজ কথায়, কুঁচকে যাওয়া ত্বক আসলে পানি শোষণ করে ফুলে ওঠার ফল নয়, বরং ভেতরের রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে যাওয়ার ফল। এই কারণেই, যে আঙুলের স্নায়ু ঠিকভাবে কাজ করে না, সেখানে মস্তিষ্ক থেকে সংকেত পৌঁছাতে পারে না এবং রক্তনালীও সংকুচিত হয় না। ফলে, তাদের আঙুলও পানিতে কুঁচকে যায় না।

কেন ত্বক সাদা হয়ে যায়?

একই কারণে, অর্থাৎ ভ্যাসোকনস্ট্রিকশন বা রক্তনালী সংকুচিত হয়ে যাওয়ার কারণে, ওই অঞ্চলে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। ত্বকের নিচে রক্তের প্রবাহ কম থাকায় চামড়াটি সাময়িকভাবে ফ্যাকাশে বা সাদা দেখায়।

বিবর্তনীয় সুবিধা: ভেজা পরিবেশে টিকে থাকার কৌশল

এখন প্রশ্ন হলো, আমাদের শরীর কেন এই অদ্ভুত কাজটি করে? বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন, এর পেছনে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিবর্তনীয় সুবিধা লুকিয়ে আছে, যা আমাদের পূর্বপুরুষদের টিকে থাকতে সাহায্য করত।

২০১৩ সালে নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী একটি যুগান্তকারী গবেষণা পরিচালনা করেন। তারা প্রমাণ করেন যে, কুঁচকে যাওয়া আঙুল ভেজা অবস্থায় কোনো জিনিসকে আঁকড়ে ধরতে অনেক বেশি সাহায্য করে।

  • গবেষণাটি কেমন ছিল? অংশগ্রহণকারীদের শুকনো এবং ভেজা মার্বেল এক পাত্র থেকে আরেক পাত্রে সরাতে বলা হয়। দেখা যায় যে, যাদের আঙুল পানিতে কুঁচকে গিয়েছিল, তারা ভেজা মার্বেলগুলোকে, যাদের আঙুল স্বাভাবিক ছিল, তাদের চেয়ে অনেক দ্রুত সরাতে পারছিলেন।
  • টায়ারের ট্রেডের সাথে তুলনা: বিজ্ঞানীরা এই কুঁচকে যাওয়া চামড়াকে গাড়ির টায়ারের ট্রেড বা খাঁজের সাথে তুলনা করেছেন। টায়ারের খাঁজগুলো যেমন ভেজা রাস্তা থেকে পানি সরিয়ে দিয়ে রাস্তাকে ভালোভাবে আঁকড়ে ধরতে (গ্রিপ) সাহায্য করে, ঠিক একইভাবে, আমাদের আঙুলের এই ভাঁজগুলো একটি চ্যানেলের মতো কাজ করে। এটি আঙুল এবং বস্তুর মধ্যবর্তী স্থান থেকে পানিকে দ্রুত সরিয়ে দেয়, যার ফলে আমরা ভেজা বস্তুকে আরও ভালোভাবে ধরতে পারি।

বিবর্তনীয় প্রেক্ষাপট:

একবার ভাবুন আমাদের আদিম পূর্বপুরুষদের কথা। তাদের হয়তো ভেজা শিলা বা পাথর বেয়ে উপরে উঠতে হতো, অথবা নদীর স্রোত থেকে খাবার সংগ্রহ করতে হতো। সেই পরিবেশে, ভেজা অবস্থায় হাত বা পায়ের গ্রিপ যদি সামান্যও ভালো হতো, তবে তা তাদের জন্য জীবন এবং মৃত্যুর মধ্যে পার্থক্য গড়ে দিতে পারত। কুঁচকে যাওয়া পায়ের আঙুল হয়তো তাদের ভেজা পাথরের উপর দিয়ে হাঁটার সময় পিছলে পড়া থেকে বাঁচাত।

এই উন্নত গ্রিপই সম্ভবত একটি বিবর্তনীয় বৈশিষ্ট্য হিসেবে আমাদের জিনে রয়ে গেছে, যা আজও দীর্ঘ সময় পানিতে থাকলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে।

যা একসময় একটি সাধারণ এবং বিরক্তিকর ঘটনা বলে মনে হতো, তা আসলে আমাদের শরীরের এক অসাধারণ এবং বুদ্ধিদীপ্ত অভিযোজনের উদাহরণ। পানিতে হাত-পা কুঁচকে যাওয়া শুধু একটি রাসায়নিক বিক্রিয়া নয়, এটি আমাদের স্নায়ুতন্ত্রের এক জটিল কার্যক্রম এবং আমাদের পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে পাওয়া এক বিবর্তনীয় উপহার। 

তথ্যসূত্র –

Related posts

পিঙ্ক ট্যাক্স- কেন নারীদের পণ্যের বেশি দাম দিতে হয়?

পোপ নির্বাচনের রহস্যময় পদ্ধতি- পোপ ফ্রান্সিসের পর যেভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন পোপ

ভুড়ি, ভাত আর বাঙালি: কেন আমাদের শরীরে এত সহজে চর্বি জমে?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More