Image default
ঘটমান বর্তমান

আফগানিস্তান-পাকিস্তান যুদ্ধ: কী ঘটছে এবং কেন?

সীমান্ত কি শুধু একটি রেখা, নাকি দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চিরন্তন সংঘাতের উৎস? পাকিস্তান আফগান সীমান্তে সংঘর্ষ-এর বর্তমান অবস্থা বোঝার জন্য জানা প্রয়োজন এক শতাব্দী পুরোনো ইতিহাস। এই সীমান্ত যুদ্ধের কারণ খুঁজতে গেলে সামনে আসে ঐতিহাসিক ডুরান্ড রেখা, জঙ্গিগোষ্ঠী এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস। 

আফগানিস্তান এবং পাকিস্তানের সীমান্ত কেবল দুটি দেশের ভৌগোলিক বিভাজন নয়, এটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলে আসা জটিল ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন এবং আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিবাদের একটি জ্বলন্ত প্রতীক। সাম্প্রতিক সময়ে দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সামরিক সংঘাত এবং আফগান সীমান্ত সংঘর্ষ চরমে পৌঁছেছে, যা দক্ষিণ এশিয়ার শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য গুরুতর নিরাপত্তা ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। 

পাকিস্তান আফগান সীমান্তে সংঘর্ষ: ইতিহাস ও বর্তমান অবস্থা

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যকার সংঘাতের মূল কারণ হলো সেই ১৯ শতকে ব্রিটিশ ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে টানা বিতর্কিত ডুরান্ড রেখা (Durand Line)।

ডুরান্ড রেখা সমস্যা: ১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক টানা ২,৬৭০ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ডুরান্ড রেখাকে আফগানিস্তান কখনোই আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে পুরোপুরি মেনে নেয়নি। আফগানিস্তানের মতে, এটি ঐতিহাসিকভাবে পশতুনদের ভূমিকে কৃত্রিমভাবে ভাগ করেছে। এই অস্বীকৃতিই আফগান পাকিস্তান বিরোধ-এর প্রধানতম কারণ।

পশতুন উপজাতি

পশতুন প্রশ্ন (Pashtunistan): এই সীমান্ত রেখার উভয় পাশে বিপুল সংখ্যক পশতুন উপজাতি বসবাস করে। ঐতিহাসিকভাবে আফগান সরকার একটি ‘বৃহত্তর পশতুনিস্তান’ গঠনের দাবি জানিয়েছে, যা পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জ। পাকিস্তান এই রেখাকে আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে জোরপূর্বক প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যা আফগানিস্তান পাকিস্তান দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সংঘাত-কে ক্রমাগত তীব্র করে তুলেছে।

আফগানিস্তান পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ

এই দ্বিপক্ষীয় সংঘর্ষ-এর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ বলে যে, সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ‘নিরাপত্তার সমস্যা’। পাকিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক নীতিতে ঐতিহাসিকভাবেই আফগানিস্তানকে ভারতের বিরুদ্ধে একটি ‘কৌশলগত গভীরতা’ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে। অর্থাৎ, পাকিস্তানে কোনো সংঘাত শুরু হলে আফগানিস্তানকে নিরাপদ ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করা। এই নীতির ফলস্বরূপ পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে আফগানিস্তানে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে আগ্রহী ছিল।

আফগানিস্তান পাকিস্তান উভয় সীমান্তে সামরিক পাহারা

অন্যদিকে আফগানিস্তান, বিশেষ করে তালেবান শাসিত সরকার, এখন সম্পূর্ণভাবে বিদেশি প্রভাবমুক্ত হয়ে সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তারা পাকিস্তানের ‘গভীরতা কৌশল’ বা অন্য কোনো ধরনের হস্তক্ষেপকে মেনে নিতে নারাজ। এই দুটি বিপরীতমুখী আকাঙ্ক্ষাই বর্তমান আফগানিস্তান পাকিস্তান সংঘাতকে উস্কে দিচ্ছে।

সংঘাতের বর্তমান অনুঘটক: আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদ

সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রধান কারণ হলো আন্তঃসীমান্ত জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) এবং অন্যান্য বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী।

টিটিপি, যা ‘পাকিস্তানি তালেবান’ নামে পরিচিত, আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে হামলা চালাচ্ছে। পাকিস্তান মনে করে, আফগানিস্তানের তালেবান সরকার এই গোষ্ঠীগুলিকে আশ্রয় দিচ্ছে এবং তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। এই অভিযোগই বর্তমান পাকিস্তান অভিযান-এর মূল কারণ।

পাকিস্তানের অভিযানের কারণ ও আফগানের প্রতিক্রিয়া

সাম্প্রতিক মাসগুলিতে আফগানিস্তান পাকিস্তান সীমান্ত যুদ্ধের কারণ ও প্রভাব বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, জঙ্গিগোষ্ঠী, বিশেষত টিটিপি-র হামলা পাকিস্তানে রেকর্ড সংখ্যক সামরিক ও বেসামরিক প্রাণহানি ঘটিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকার এবং সামরিক বাহিনী তাদের ‘সহ্যের সীমা’ অতিক্রম করেছে বলে মনে করে।

আফগানিস্তানে পাকিস্তানি আক্রমণ

 পাকিস্তানের অভিযানের কারণ:

    ১. পাকিস্তানের প্রধান লক্ষ্য হলো টিটিপি-র ঘাঁটিগুলো ধ্বংস করা, যা আফগান ভূখণ্ডের গভীরে বা সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থিত।

    ২. দেশের অভ্যন্তরে জনগণের ক্রমবর্ধমান চাপের কারণে পাকিস্তান সরকার জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হয়েছে।

    ৩. সামরিক অভিযানের মাধ্যমে আফগান তালেবান সরকারকে এই বার্তা দেওয়া যে, তারা যেন টিটিপি-কে হয় নির্মূল করে, নয়তো তাদের পাকিস্তান সীমান্তের কাছাকাছি থেকে সরিয়ে দেয়।

আফগান প্রতিক্রিয়া: 

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার কঠোরভাবে পাকিস্তানের সামরিক অভিযানের নিন্দা করেছে। আফগান প্রতিক্রিয়া-র মূল কথা হলো, এই ধরনের আক্রমণ তাদের সার্বভৌমত্বের উপর সরাসরি আঘাত।

    ১. তালেবান সরকার যুক্তি দেখিয়েছে, অন্য কোনো রাষ্ট্রের তাদের ভূখণ্ডে সামরিক অভিযান চালানোর অধিকার নেই।

    ২. তালেবান দাবি করে, তারা কোনো জঙ্গিগোষ্ঠীকে অন্য দেশে আক্রমণ করার জন্য তাদের ভূমি ব্যবহার করতে দেয় না। তাদের দাবি, পাকিস্তানের নিরাপত্তা সমস্যা একান্তই তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।

    ৩. বেশ কয়েকটি সংঘর্ষে আফগান তালেবান বাহিনী সীমান্তে পাকিস্তানি সেনাদের দিকে পাল্টা গুলি চালিয়েছে বা আর্টিলারি ব্যবহার করেছে, যা সীমান্ত যুদ্ধ-কে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

আফগানিস্তান-পাকিস্তান সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ ও তার প্রভাব

সংঘাত তীব্র হওয়ার কারণে প্রায়শই গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত ক্রসিং পয়েন্ট যেমন তোর্খাম এবং চমন বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। এই ক্রসিং পয়েন্টগুলি আফগানিস্তান এবং মধ্য এশিয়ার সাথে পাকিস্তানের বাণিজ্যের মূল পথ। ক্রসিং বন্ধের ফলে কোটি কোটি টাকার পণ্য আটকে থাকে, যার ফলে ব্যবসায়ীরা মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়।

এছাড়াও, আফগানিস্তান বর্তমানে একটি গভীর মানবিক সংকটের মধ্যে রয়েছে। সীমান্ত বন্ধ থাকলে খাদ্য, ঔষধ এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হয়, যা সাধারণ আফগান জনগণের জীবনকে আরও দুর্বিষহ করে তোলে। 

সংঘাতের এই জটিলতা কেবল টিটিপি বা ডুরান্ড রেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি আঞ্চলিক ক্ষমতার লড়াইও।

ভারত, ইরান এবং চীনের মতো আঞ্চলিক শক্তিগুলো এই দ্বন্দ্বে ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রভাবিত হচ্ছে। চীন তার CPEC (চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোর) প্রকল্পের নিরাপত্তার জন্য উদ্বিগ্ন, আর ইরান ও ভারতের আফগানিস্তানে নিজস্ব নিরাপত্তা স্বার্থ রয়েছে। এই বহুপাক্ষিক স্বার্থের সংঘাত আফগানিস্তান পাকিস্তান সম্পর্ককে আরও জটিল করে তুলছে।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া আফগানিস্তান-পাকিস্তান সংঘর্ষে

আফগানিস্তান পাকিস্তান সংঘর্ষে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া মিশ্র এবং সতর্কতাপূর্ণ। পশ্চিমা শক্তি এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই ক্রমবর্ধমান সংঘাত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র উভয় পক্ষকে সংযম দেখানোর আহ্বান জানিয়েছে। তাদের প্রধান উদ্বেগ হলো, এই সামরিক উত্তেজনা যেন আঞ্চলিক সন্ত্রাসবাদকে আরও শক্তিশালী না করে তোলে এবং মানবিক পরিস্থিতিকে আরও খারাপ না করে।

আফগানিস্তানে পরাজয়ের পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন এই সংঘাতে সরাসরি সামরিক হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী নয়। তবে তারা পাকিস্তানের নিরাপত্তা উদ্বেগকে স্বীকৃতি দিয়েছে এবং তালেবানকে আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাস দমনের জন্য চাপ দিতে কূটনৈতিক চ্যানেল ব্যবহার করছে।

 অন্যদিকে, পাকিস্তান চীনের ঘনিষ্ঠ মিত্র। চীন আশা করে, এই অঞ্চলে শান্তি বজায় থাকলে CPEC প্রকল্প সুরক্ষিত থাকবে। বেইজিং উভয় পক্ষকে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য প্রকাশ্যে আহ্বান জানিয়েছে এবং পর্দার আড়ালে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করতে পারে।

তালেবান নেতা

আফগানিস্তান পাকিস্তান উত্তেজনা: সমঝোতা সম্ভাবনা

বর্তমানে দুই দেশের মধ্যে চরম সামরিক উত্তেজনা বিরাজ করলেও, কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকরা মনে করেন, সামরিক সমাধান এই সমস্যার স্থায়ী সমাধান নয়। আফগানিস্তান পাকিস্তান দ্বন্দ্বের ভবিষ্যৎ এবং শান্তি আলোচনা-ই একমাত্র পথ।

পাকিস্তানের পক্ষ থেকে প্রধান শর্ত হলো, টিটিপি-কে আফগান ভূখণ্ড থেকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করা বা পাকিস্তান সীমান্তে তাদের সমস্ত কার্যক্রম বন্ধ করা। অন্যদিকে, আফগানিস্তান চায় পাকিস্তান ডুরান্ড রেখাকে একটি স্বীকৃত আন্তর্জাতিক সীমান্ত হিসেবে ঘোষণা করুক এবং তাদের সার্বভৌমত্বকে সম্মান করুক।

কোনো তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতা ছাড়া এই আলোচনায় সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম। চীন বা তুরস্কের মতো দেশ, যাদের উভয় পক্ষের সাথে তুলনামূলকভাবে ভালো সম্পর্ক রয়েছে, তারা কার্যকর মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারে।

আফগানিস্তান পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সংঘাত: ভবিষ্যৎ

এই দ্বিপক্ষীয় সংঘর্ষ-এর ভবিষ্যৎ বহুলাংশে নির্ভর করে তিনটি প্রধান উপাদানের উপর:

১. আফগান তালেবান সরকার কি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি এবং অর্থনৈতিক সহায়তার বিনিময়ে টিটিপি-কে নিজেদের ভূখণ্ড থেকে সরিয়ে দেবে? 

২. পাকিস্তান কি সামরিক পদক্ষেপের পাশাপাশি কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক চাপ বজায় রেখে একটি দীর্ঘমেয়াদী কৌশল গ্রহণ করতে প্রস্তুত? নাকি তারা বৃহৎ পরিসরের সামরিক পাকিস্তান অভিযান চালিয়ে আঞ্চলিক সংঘাতকে আরও বাড়িয়ে তুলবে?

৩. ঐতিহাসিক এই সীমান্ত সমস্যার কোনো স্থায়ী এবং পারস্পরিক গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হবে কি না, সেটাই শান্তি আলোচনার মূল ভিত্তি হবে।

আফগানিস্তান পাকিস্তান সীমান্ত যুদ্ধের কারণ ও প্রভাব শুধুমাত্র দুই দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, এর ঢেউ মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত। কেবল সামরিক অভিযান বা সীমান্ত বন্ধ করে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার জন্য প্রয়োজন একটি সমন্বিত কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, যা আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে উভয় পক্ষকে বাধ্য করবে এবং ঐতিহাসিক ডুরান্ড রেখার প্রশ্নে একটি বাস্তবসম্মত সমঝোতায় পৌঁছতে সাহায্য করবে। এই মুহূর্তে যুদ্ধ ও শান্তি-র মধ্যে বেছে নেওয়ার চূড়ান্ত দায়ভার দুই দেশের নেতৃত্বকেই নিতে হবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

হুতি – অধিকারের লড়াই নাকি সন্ত্রাসবাদ?

আবু সালেহ পিয়ার

কুষ্টিয়ায় গাঁজা চাষ কি এখনো চলছে? সত্য-মিথ্যার রহস্যভেদ

ঢাকা : দূষণ আর দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার শহর

পুশরাম চন্দ্র

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More