নেতৃত্ব মানেই কি রাজপথের গর্জন? পর্দার আড়ালে থেকেও আন্দোলন গতিশীল হতে পারে একজন চিন্তাশীল মানুষের নীরব পরিকল্পনা থেকে। জুলাই আন্দোলনে বাংলাদেশকে নতুন পথে চালিত করা সেই নেপথ্যের শক্তি ছিলেন মাস্টারমাইন্ড মাহফুজ আলম।
২০২৪ সালের জুলাই মাস। বাংলাদেশে তখন দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা চলছিল। ঠিক সেই সময়েই ছাত্র-জনতাকে সাথে নিয়ে এক বিশাল গণ-আন্দোলন শুরু হয়, যা স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন ঘটায়। ইতিহাসে এই ঘটনা ‘জুলাই আন্দোলন’ নামে পরিচিতি পায়।
এই বিরাট পরিবর্তনের পেছনের কারিগর হিসেবে একজনের নাম সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে, তিনি হলেন মাহফুজ আলম। তিনি কোনো বড় রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য বা রাজপথের পরিচিত কোনো নেতা ছিলেন না। তবুও আন্দোলন চলাকালীন সময়ে পর্দার সামনে না থেকেও এই বিশাল গণজাগরণের পেছনে মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে তাকেই ভাবা হয়, আর একারণেই তাকে আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ বলা হয়। তার মেধা, নীরবে কাজ করার কৌশল এবং আদর্শের প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস তরুণ প্রজন্মের মনে এক নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছে।
তাহলে, কে এই মাহফুজ আলম? কীভাবে তিনি পর্দার আড়ালে থেকে প্রায় শূন্য হাতে এত বড় একটি আন্দোলন সফলভাবে গড়ে তুললেন?
শিক্ষাজীবন
মাহফুজ আলমের জীবনযাত্রা গতানুগতিক রাজনৈতিক নেতাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার জন্ম লক্ষ্মীপুর জেলার রামগঞ্জ উপজেলার এক সাধারণ পরিবারে। শিক্ষাজীবনের ভিত্তি স্থাপিত হয় ধর্মীয় আবহে, চাঁদপুর থেকে দাখিল এবং ঢাকার স্বনামধন্য তা’মীরুল মিল্লাত কামিল মাদ্রাসা থেকে আলিম পাসের মাধ্যমে। মাদ্রাসার এই প্রেক্ষাপট তাকে যেমন ইসলামের ইতিহাস, দর্শন ও সামাজিক ন্যায়বিচারের ধারণার সাথে পরিচিত করেছে, ঠিক তেমনই পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হওয়া তার জীবনদর্শনে এক নতুন মাত্রা যোগ করে। এই দ্বৈত শিক্ষাগত পটভূমি, একদিকে ধর্মীয় নীতিশাস্ত্র এবং অন্যদিকে আধুনিক রাষ্ট্রীয় আইন ও সেকুলার জ্ঞান তাকে এক স্বতন্ত্র ও সমন্বিত মানসিক শক্তি গঠনে সহায়তা করেছে, যা তার রাজনৈতিক কৌশলে পরবর্তীতে প্রতিফলিত হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তিনি প্রথাগত ছাত্র রাজনীতির ক্ষমতা ও পদের লড়াই থেকে নিজেকে সযত্নে দূরে রাখেন। এর পরিবর্তে তিনি সমমনা তরুণদের নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিনি ‘গণতান্ত্রিক ছাত্রশক্তি’ নামক একটি অ-ঐতিহ্যবাহী ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন, যা প্রচলিত ছাত্র রাজনীতির পেশিশক্তি-নির্ভর সংস্কৃতির বিরুদ্ধে একটি আদর্শিক বিকল্প তৈরির চেষ্টা করছিল।
এর পাশাপাশি, তার উদ্যোগে পরিচালিত ‘গুরবার আড্ডা’ নামক আলোচনাচক্রটি হয়ে ওঠে তার চিন্তার পরীক্ষাগার। এখানে প্লেটো-অ্যারিস্টটল থেকে শুরু করে ইবনে খালদুন, শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভি, এবং আধুনিক রাজনৈতিক দার্শনিকদের তত্ত্ব নিয়ে গভীর আলোচনা হতো। এই আড্ডাগুলোই ছিল ভবিষ্যৎ বিপ্লবের আঁতুড়ঘর, যেখানে একটি আদর্শিক প্রজন্ম নীরবে নিজেদের তৈরি করছিল।
জুলাই বিপ্লবের প্রেক্ষাপট এবং মাহফুজের আবির্ভাব
জুলাই আন্দোলনের আকস্মিক বিস্ফোরণ ঘটলেও এর পটভূমি তৈরি হচ্ছিল দীর্ঘদিন ধরে। বাংলাদেশে গণতন্ত্রের ক্রমবর্ধমান সংকোচন, বিরোধী মতের ওপর দমন-পীড়ন, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতি এক ধরনের সামাজিক চাপা ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ছাত্রদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেললেও রাষ্ট্রীয় দমন-নীতির মুখে তা স্তিমিত হয়ে পড়ে এবং আদালতের রায়ে কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হলে সেই ক্ষোভের আগুন আবার জ্বলে ওঠার অপেক্ষায় ছিল।
এই পরিস্থিতিতেই মাহফুজ আলম ও তার সহযোদ্ধারা মঞ্চে প্রবেশ করেন। তারা বুঝতে পেরেছিলেন, বিক্ষিপ্ত ছাত্র বিক্ষোভকে যদি একটি সুসংগঠিত ও আদর্শিক কাঠামোর মধ্যে আনা না যায়, তবে তা আবারও ব্যর্থ হতে বাধ্য। এই উপলব্ধি থেকেই জন্ম নেয় ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’। এই প্ল্যাটফর্মের অন্যতম প্রধান সমন্বয়ক হিসেবে মাহফুজ আলম দ্রুতই নিজেকে একজন ব্যতিক্রমী সংগঠক হিসেবে প্রমাণ করেন। তার নেতৃত্বের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আত্মপ্রচারবিমুখতা। তিনি মিডিয়ার সামনে বা মঞ্চের আলোয় আসার পরিবর্তে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ কাঠামো শক্তিশালী করা, দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক তৈরি করা এবং আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণে নিজেকে নিয়োজিত করেন। আন্দোলনকালীন সময়ে প্রধান সমন্বয়কদের ডিবি হেফাজতে আটকে রাখা হলেও থেমে থাকেনি আন্দোলন বা কোন কর্মসূচি। এসেছে একের পর এক নতুন কর্মসূচি। আর এখানেই মাহফুজ এবং তার সহযোদ্ধাদের সাফল্য। পর্দার আড়ালে থেকেই আন্দোলনকে গতিশীল রাখা এই নিভৃতচারীর কার্যকর ভূমিকা তাকে দ্রুতই আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে, যদিও সাধারণ মানুষ তখনো তার নামটির সাথে পরিচিত ছিল না।
‘মেটিকুলাস ডিজাইন’ এক অভিনব মাস্টারপ্ল্যান
কীভাবে কোনো প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছাড়া, রাষ্ট্রের সব প্রতিকূলতাকে অগ্রাহ্য করে এই আন্দোলন সফল হলো? এর উত্তরে মাহফুজ আলম নিজেই তার এক ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেছেন যে, আন্দোলনের প্রথম পর্বটি ছিল ‘মেটিকুলাসলি ডিজাইনড’ বা অত্যন্ত যত্ন ও বিচক্ষণতার সাথে পরিকল্পিত। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসও প্রকাশ্যে মাহফুজ আলমকে এই আন্দোলনের ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। এই মাস্টারপ্ল্যানের কয়েকটি মূল স্তম্ভ ছিল:
বিকেন্দ্রীভূত অথচ সমন্বিত নেতৃত্ব
মাহফুজ আলম ও তার সহকর্মীরা জানতেন, বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনীতিতে আন্দোলন দমনের প্রধান কৌশল হলো শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার করে আন্দোলনকে নেতৃত্বহীন করে দেওয়া। এই ফাঁদ এড়াতে তারা একটি বিকেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব কাঠামো তৈরি করেন। ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’-এর একটি কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক কমিটি থাকলেও, প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়। ফলে সরকার যখন ঢাকার নেতাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করেছে, তখন চট্টগ্রাম, রাজশাহী বা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের মশাল জ্বালিয়ে রেখেছে। এই মডেলটি আন্দোলনকে একাধারে গতিশীল এবং অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।
অহিংস ও নৈতিক কৌশল
আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে মাহফুজ আলমের কৌশল ছিল যেকোনো মূল্যে সহিংসতা এড়িয়ে চলা। তারা জানতেন, রাষ্ট্রের সাজানো ফাঁদে পা দিয়ে সহিংসতায় জড়ালেই আন্দোলন দমনের নৈতিক বৈধতা পেয়ে যাবে সরকার। এর পরিবর্তে ‘বাংলা ব্লকেড’-এর মতো শান্তিপূর্ণ কিন্তু চরম কার্যকর কর্মসূচি দেওয়া হয়। শিক্ষার্থীরা রাস্তায় বসে গান গেয়ে, ছবি এঁকে, আলোচনার মাধ্যমে অবরোধ পালন করেছে। এই অহিংসা ও সৃজনশীলতা সাধারণ মানুষের ব্যাপক সহানুভূতি অর্জন করে এবং আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এর মাধ্যমে আন্দোলনকারীরা একটি নৈতিক শ্রেষ্ঠত্বের জায়গা তৈরি করে, যা সরকারের দমন-পীড়নকে জনগণের চোখে আরও অনৈতিক হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে।
প্রযুক্তি ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিপ্লবী ব্যবহার
জুলাই আন্দোলনকে প্রায়শই ‘জেনারেশন জেড’-এর বিপ্লব বলা হয়, যার প্রধান অস্ত্র ছিল স্মার্টফোন। মাহফুজ আলমের নেতৃত্বে আন্দোলনকারীরা সোশ্যাল মিডিয়াকে এক অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ব্যবহার করেছে। তারা শুধু কর্মসূচির প্রচার বা যোগাযোগের জন্যই ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করেনি, বরং একে রাষ্ট্রীয় প্রচারণার বিরুদ্ধে পাল্টা বয়ান তৈরির একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। লাইভ স্ট্রিমিংয়ের মাধ্যমে পুলিশি আক্রমণ সরাসরি সম্প্রচার করা, ইনফোগ্রাফিক্সের মাধ্যমে জটিল রাজনৈতিক বিষয়কে সহজ করে উপস্থাপন করা, এবং ভুয়া সংবাদের বিরুদ্ধে দ্রুত ফ্যাক্ট-চেক সেল তৈরি করা এই সবই ছিল তাদের ডিজিটাল রণকৌশলের অংশ। এর মাধ্যমে তারা প্রচলিত গণমাধ্যমের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সরাসরি জনগণের সাথে সংযোগ স্থাপন করতে সক্ষম হয়।
দাবির রূপান্তর – কোটা থেকে ‘ফ্যাসিবাদ’ বিরোধী আন্দোলন
মাহফুজ আলমের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলো আন্দোলনের দাবিকে সময়োপযোগীভাবে রূপান্তর করার ক্ষমতা। তিনি এবং তার সহযোদ্ধারা দ্রুতই উপলব্ধি করেন যে, কেবল কোটা সংস্কারের দাবিতে এই আন্দোলনকে সীমাবদ্ধ রাখলে তা একসময় গতি হারাবে এবং ছাত্র সমাজের বাইরের মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না। যখনই শিক্ষার্থীদের ওপর রাষ্ট্রীয় বাহিনীর আক্রমণ শুরু হলো, তারা নিপুণভাবে আন্দোলনের বয়ানকে কোটার দাবি থেকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যান। তারা এটিকে পরিচয় করান রাষ্ট্রের ‘ফ্যাসিবাদী’ চরিত্রের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ হিসেবে। ‘এক দফা এক দাবি’ এই স্লোগানটি তখন আর কোটার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, তা পরিণত হয় স্বৈরাচারী শাসনের অবসানের দাবিতে। এই রূপান্তরই আন্দোলনকে একটি গণ-অভ্যুত্থানের চরিত্র দান করে।
মাহফুজ আলমের রাজনৈতিক দর্শন: বিভাজনের ঊর্ধ্বে নতুন এক বাংলাদেশ
মাহফুজ আলমের রাজনৈতিক দর্শন বাংলাদেশের প্রচলিত রাজনৈতিক বিভাজনের (বাম-ডান, সেকুলার-ইসলামপন্থী) ঊর্ধ্বে এক নতুন পথের সন্ধান দেয়। তিনি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেন যা ‘মর্যাদা’, ‘দায়বদ্ধতা’ এবং ‘সহানুভূতি’ এই তিনটি মূলনীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত হবে। এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, রাষ্ট্রকে হতে হবে তার সকল নাগরিকের জন্য একটি নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নির্বিশেষে সকলের মানবিক মর্যাদা সুরক্ষিত থাকবে।
তার রাজনৈতিক চেতনায় উপমহাদেশের অসাম্প্রদায়িক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতির ধারার গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। তিনি প্রায়শই তার লেখায় ও বক্তব্যে অবিভক্ত বাংলার দূরদর্শী নেতা আবুল হাশেম, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শরৎচন্দ্র বসু এবং দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের কথা উল্লেখ করেন। এটি ইঙ্গিত দেয় যে, তিনি সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে একটি বহুত্ববাদী ও সমন্বিত সমাজ গঠনে আগ্রহী।
অনেকে তার আদর্শকে ‘ইসলামিক ডেমোক্রেসি’ বা ইসলামী গণতন্ত্রের এক নতুন সংস্করণ হিসেবে দেখতে চান। তবে মাহফুজ আলম প্রচলিত ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ বা ‘খিলাফত’ প্রতিষ্ঠার ধারণার পরিবর্তে একটি ন্যায়ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রের কথা বলেন, যার মূল ভিত্তি হবে সামাজিক ন্যায়বিচার (social justice), যা ইসলামের একটি মৌলিক শিক্ষা। তার দর্শন আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ। যেমন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের সাথে ইসলামী নীতিশাস্ত্রের একটি সৃজনশীল সমন্বয় ঘটানোর প্রয়াস।
‘মাস্টারমাইন্ড’ আখ্যার বিনম্র প্রত্যাখ্যান
ডক্টর ইউনূস থেকে শুরু করে দেশ-বিদেশের গণমাধ্যম সকলেই যখন মাহফুজ আলমকে ‘জুলাই আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে আখ্যায়িত করছে, তখন স্বয়ং মাহফুজ আলম নিজে এই উপাধি গ্রহণে বরাবরই দেখিয়েছেন কুণ্ঠা ও বিনয়। তার এই অবস্থানকে কেবল ব্যক্তিগত নম্রতা হিসেবে দেখলে বিষয়টি সরলীকরণ করা হবে; এর গভীরে লুকিয়ে আছে সুচিন্তিত রাজনৈতিক কৌশল এবং গভীর আদর্শিক দায়বদ্ধতা।
মাহফুজ আলম বারবার স্পষ্ট করেছেন যে, জুলাই আন্দোলন কোনো একক ব্যক্তির মস্তিষ্কপ্রসূত নয়, বরং এটি ছিল হাজার হাজার শিক্ষার্থীর সম্মিলিত ক্ষোভ, ত্যাগ এবং সাহসিকতার ফসল। নিজেকে ‘মাস্টারমাইন্ড’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হলো, আন্দোলনের বাকি সংগঠক এবং রাজপথে জীবন বাজি রাখা অগণিত ছাত্র-ছাত্রীর ভূমিকাকে খাটো করা। তিনি বিশ্বাস করেন, এই বিপ্লবের প্রকৃত নায়ক কোনো ব্যক্তি নন, বরং ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ নামক প্ল্যাটফর্ম এবং এর পতাকাতলে সমবেত হওয়া সাধারণ শিক্ষার্থীরাই এর মূল চালিকাশক্তি। এই কৃতিত্বকে এককেন্দ্রিক না করে, তিনি তা ছড়িয়ে দিতে চান প্রত্যেকের মাঝে, যা আন্দোলনের গণতান্ত্রিক চেতনাকে সমুন্নত রাখে।
এছাড়াও, জুলাই আন্দোলনের অন্যতম একটি মূলনীতি ছিল পূর্ববর্তী সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা ‘ব্যক্তিপূজা’র সংস্কৃতির বিরোধিতা করা। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন নেতাকে কেন্দ্র করে নিঃশর্ত আনুগত্য এবং স্তুতিবাদের যে চর্চা চলে আসছিল, মাহফুজ আলম ও তার সহযোদ্ধারা ঠিক তার বিপক্ষেই দাঁড়িয়েছিলেন। এখন তিনি নিজেই যদি ‘মাস্টারমাইন্ড’ বা ‘মহানায়ক’-এর মতো কোনো উপাধি গ্রহণ করেন, তবে তা হবে তাদের ঘোষিত আদর্শের সাথে এক ধরনের বিশ্বাসঘাতকতা।
মাহফুজ আলম- বিতর্ক ও সমালোচনা
যেকোনো যুগান্তকারী রাজনৈতিক পরিবর্তনের মতোই, মাহফুজ আলমের বিস্ময়কর উত্থানও বিভিন্ন বিতর্ক, সমালোচনা এবং গভীর পর্যালোচনার জন্ম দিয়েছে। তার নেতৃত্ব প্রশংসিত হলেও, কিছু নির্দিষ্ট দিক নিয়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে প্রশ্ন ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, যা তার নতুন নেতৃত্বের জন্য এক বড় পরীক্ষা।
প্রথমত, ‘মাস্টারমাইন্ড’ বা ‘প্রধান রূপকার’ অভিধাটি নিজেই একটি বিতর্কের বিষয়। সমর্থকরা এই উপাধিকে তার কৌশলগত দক্ষতার স্বীকৃতি হিসেবে দেখলেও, সমালোচকদের একটি অংশ মনে করেন, এটি জুলাই আন্দোলনের সম্মিলিত এবং স্বতঃস্ফূর্ত চরিত্রকে খর্ব করে। তাদের মতে, লক্ষ লক্ষ ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও সাহসিকতাকে কোনো একক ব্যক্তির কৃতিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা একটি নতুন ধরনের ‘ব্যক্তিপূজা’ বা ‘কাল্ট অফ পার্সোনালিটি’ তৈরি করার ঝুঁকি বহন করে।
এই উদ্বেগটি আরও ঘনীভূত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে ঘটা একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেখানে এক শিক্ষার্থী মাহফুজ আলমের দিকে একটি পানির বোতল নিক্ষেপ করলে তার অনুসারীরা নিক্ষেপকারী ছাত্রের ওপর তাৎক্ষণিকভাবে চড়াও হয় এবং তাকে মারধর করে। মূল সমালোচনাটি ছিল বোতল নিক্ষেপের ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয়, বরং ভিন্নমত পোষণকারী ঐ ছাত্রের প্রতি মাহফুজ আলমের অনুসারীদের সহিংস ও অসহিষ্ণু প্রতিক্রিয়া নিয়ে।
এই ঘটনাটি সমালোচকদের এই প্রশ্ন তোলার সুযোগ করে দেয় যে, যে আন্দোলন মত প্রকাশের স্বাধীনতার জন্য সংঘটিত হয়েছে, সেই আন্দোলনের নেতার অনুসারীরাই যদি ভিন্নমত সহ্য করতে না পারেন, তবে কি একটি নতুন ধরনের অসহিষ্ণুতার সংস্কৃতি তৈরি হচ্ছে? এটি ‘ব্যক্তিপূজা’র ঝুঁকিকে একটি বাস্তব রূপ দেয়।
দ্বিতীয়ত, মাহফুজ আলমের আদর্শিক অবস্থান নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা ও উদ্বেগ রয়েছে, বিশেষ করে দেশের ধর্মনিরপেক্ষ বা উদারপন্থী মহলে। তার মাদ্রাসা-শিক্ষার প্রেক্ষাপট এবং তার বক্তব্যে ইসলামী নীতিশাস্ত্রের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের কারণে অনেকে তার বিরুদ্ধে একটি ‘গোপন ইসলামপন্থী এজেন্ডা’ বাস্তবায়নের আশঙ্কা প্রকাশ করেন। যদিও তিনি নিজে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবিক রাষ্ট্রের কথা বলেছেন, তার দর্শনের সুনির্দিষ্ট প্রায়োগিক রূপ কী হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
তৃতীয়ত, আন্দোলন সফল হওয়ার অব্যবহিত পরেই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে তার উপদেষ্টা হিসেবে যোগদান একটি উল্লেখযোগ্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। একদল মনে করেন, এটি আন্দোলনের যৌক্তিক পরিণতি এবং রাষ্ট্র পুনর্গঠনে তার মেধার সঠিক ব্যবহার। কিন্তু অন্য একটি প্রভাবশালী অংশ এটিকে ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ এবং আন্দোলনকারী থেকে দ্রুত রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার একটি উদাহরণ হিসেবে দেখে।
সবশেষে, ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সমর্থক এবং কিছু বিরোধী পক্ষ থেকে তার বিরুদ্ধে বিদেশি শক্তির মদদপুষ্ট ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয়েছে। যদিও এর স্বপক্ষে কোন প্রমাণ সামনে আসেনি, তবে এই ধরনের প্রচারণা তার ভাবমূর্তিকে বিতর্কিত করার একটি ধারাবাহিক প্রচেষ্টা হিসেবে বিদ্যমান।
মাহফুজ আলম এবং তার নেতৃত্বে সংঘটিত জুলাই আন্দোলন বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। একজন প্রচারবিমুখ, বুদ্ধিবৃত্তিক এবং কৌশলমনস্ক তরুণ হিসেবে তার উত্থান প্রমাণ করে যে, নেতৃত্ব কেবল ক্যারিশমা বা পারিবারিক উত্তরাধিকারের ওপর নির্ভর করে না। গভীর দর্শন, সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং নিভৃত সাংগঠনিক পরিশ্রমের মাধ্যমেও একটি গণজাগরণকে সফল পরিণতির দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব।
জুলাই বিপ্লবের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে তার অন্তর্ভুক্তি তাকে আন্দোলনকারী থেকে রাষ্ট্রপরিচালনার মঞ্চে নিয়ে এসেছে। এখন তার সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, যে আদর্শ ও স্বপ্নের ভিত্তিতে এই বিপ্লব সংঘটিত হয়েছিল, তাকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও টেকসই রূপ দেওয়া। বিভাজিত ও ক্ষতবিক্ষত বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি কি পারবেন তার প্রতিশ্রুত মর্যাদা, দায়বদ্ধতা ও সহানুভূতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে? সময়ই এই প্রশ্নের উত্তর দেবে।
তথ্যসূত্র –
- https://www.jugantor.com/index.php/country-news/929011
- https://www.ittefaq.com.bd/725510/%E0%A6%A4%E0%A6%A5%E0%A7%8D%E0%A6%AF-%E0%A6%89%E0%A6%AA%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B7%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE-%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%AB%E0%A7%81%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%93%E0%A6%AA%E0%A6%B0-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%B2%E0%A6%BE
- https://bhorernotunbarta.com/archives/1491
- https://www.bd-pratidin.com/national/2025/07/04/1133117
- https://www.prothomalo.com/opinion/column/ahea4ygv2a
- https://www.dhakapost.com/national/377867
- https://www.dainikamadershomoy.com/details/0197d86f7f90
- https://www.jugantor.com/national/921626
- https://bhorernotunbarta.com/archives/1491
- https://www.news24bd.tv/details/184745
- https://www.dhakatimes24.com/2025/05/14/385601