Image default
আফ্রিকাদেশ পরিচিতি

ইরিত্রিয়া- যেখানে সময় থেমে আছে!

একটা দেশ যেখানে গণমাধ্যম প্রায় নেই, কথার স্বাধীনতাও নিয়ন্ত্রিত। যেখানে একজন নাগরিক আজীবন সামরিক “সেবা” দিয়ে যান, আর যেখানে এখনো পুরনো ইউরোপিয়ান গাড়ি চলে রাস্তায়। 

এই দেশটির গল্প শুনলে মনে হবে সময় যেন আটকে আছে কয়েক দশক পেছনে! এমন একটি দেশ হল আফ্রিকার ইরিত্রিয়া। আসলে আমরা হর্ন অব আফ্রিকা অঞ্চল নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। এই অঞ্চল আমাদের কাছে এখনও যেন একটু বেশি দূরের, আর রহস্যময়। কিন্তু ঠিক এখানেই, লোহিত সাগরের কোলে পাহাড়, মরুভূমি আর সমুদ্রকে ঘিরে এক অবিশ্বাস্য দেশ দাঁড়িয়ে আছে ইরিত্রিয়া।

ইরিত্রিয়ার নামকরণ

ইরিত্রিয়া” শব্দটি গ্রিক শব্দ ‘Erythra Thalassa’( ইরিথ্রা থালাসসা) থেকে এসেছে, যার অর্থ হলো, “লোহিত সাগর”। মূলত, দেশটির উপকূল ঘেঁষে থাকা বিস্তৃত সমুদ্রের রক্তিম রূপ-রহস্যের কারণেই দেশটির এই নামকরণ হয়েছে। 

ইরিত্রিয়ার অবস্থান ও আয়তন 

আফ্রিকার মানচিত্রে খুব মনযোগ দিয়ে চোখ বুলিয়ে দেখলে এক কোণে চোখে পড়বে ছোট্ট এই দেশটিকে। আফ্রিকার উত্তর-পূর্ব কোণে, লোহিত সাগরের কোল ঘেঁষে এর অবস্থান। দেশটির উত্তরে সুদান, পশ্চিমে ইথিওপিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্বে রয়েছে জিবুতি। এই তিনটি দেশের মাঝে একরকম চেপে থাকা ইরিত্রিয়া আয়তনে খুব একটা বড় নয়। প্রায় ১,১৭,০০০ বর্গকিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত এই দেশটি আয়তনে বাংলাদেশের কাছাকাছি, তবে ভৌগোলিক বৈচিত্র্যে এটি বেশ বৈচিত্র্যময়।

কারণ, ইরিত্রিয়ার এই ছোট্ট আয়তনের মধ্যেই রয়েছে রুক্ষ মরুভূমি, উঁচু-নিচু পাহাড়, লোহিত সাগরের তীরবর্তী উপকূলীয় সমভূমি, আর প্রায় ৩৫০টিরও বেশি দ্বীপ। এই বৈচিত্র্যময় ভূপ্রকৃতির অন্যতম রত্ন হলো, দাহলাক দ্বীপপুঞ্জ। প্রায় তিন শতাধিক দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দ্বীপরাজ্য ইরিত্রিয়ার লোহিত সাগর উপকূল জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। এখানকার স্বচ্ছ নীল জল, প্রবালপ্রাচীর আর রঙ-বেরঙের সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য এতটাই মনকাড়া যে, মালদ্বীপ, বাহামা বা হাওয়াইয়ের মতো বিশ্বখ্যাত দ্বীপগুলোও সৌন্দর্য্যে একে টেক্কা দিতে পারে না। এই দ্বীপ এখলে মনে হবে প্রকৃতি যেন নিজের হাতে এক নিখুঁত শিল্পকর্ম গড়ে তুলেছে । তবুও বিস্ময়করভাবে এই স্বর্গসম দ্বীপগুলো পর্যটকদের কাছে আজও অজানা থেকে গেছে। এর প্রধান কারণ হলো, সরকারি অনুমতি ছাড়া সাধারণ কেউ এখানে প্রবেশ করতে পারে না। 

ম্যাপ

ইরিত্রিয়ার পর্যটন স্থান 

দানাকিল ডিপ্রেশন

দেশটির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত দানাকিল ডিপ্রেশন। এই অঞ্চলটিকে ইরিত্রিয়ার রহস্যময় ভূখণ্ড বলা হয়। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে এটি পৃথিবীর অংশ নয়, বরং কোনো ভিনগ্রহের ভূদৃশ্য। যদিও এই বিস্ময়কর উপত্যকার বড় অংশ ইথিওপিয়ার মধ্যে পড়ে, তবুও ইরিত্রিয়ার অংশেও এর বিস্তার রয়েছে। পৃথিবীর অন্যতম উষ্ণতম ও শুষ্কতম স্থান হিসেবে পরিচিত এই দানাকিল অঞ্চলে উজ্জ্বল রঙিন খনিজের স্তর, সাদা লবণের মাঠ, ফুটন্ত পানির ঝরনা, এবং ধোঁয়া ওঠা মাটির ফাটল দেখা যায়। এই বিস্ময়কর ঘটনাগুলো একদিকে যেমন ভয়ংকর, অন্যদিকে তেমন অপূর্ব সৌন্দর্যের এক অনন্য উদাহরণ। 

দানাকিল ডিপ্রেশন

সাহাবা মসজিদ

প্রকৃতির অপার বিস্ময়ের পাশাপাশি ইরিত্রিয়ার মাটিতে লুকিয়ে আছে ধর্মীয় ইতিহাসেরও গৌরবময় স্মৃতি। ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের জন্য এক পবিত্র স্থান হলো মাসাওয়া শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত সাহাবা মসজিদ। ইতিহাস বলছে, ইসলামের প্রাথমিক যুগে যখন মক্কার কুরাইশদের হাতে মুসলমানরা নিপীড়নের শিকার হচ্ছিলেন, তখন নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর নির্দেশে তাঁর কিছু সাহাবি হিজরত করে ইথিওপিয়ার সম্রাট নাজ্জাশির অধীন এই অঞ্চলে আশ্রয় নেন। সেই সাহাবিদের পদচিহ্ন বহন করে আজো দাঁড়িয়ে আছে সাহাবা মসজিদ। এমনকি মসজিদ আশপাশে সাহাবীদের কিছু কবরও রয়েছে।

সাহাবা মসজিদ

দেব্রা বিসা

অন্যদিকে ইরিত্রিয়ায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য রয়েছে আরেকটি অনন্য ধর্মীয় নিদর্শন, দেব্রা বিসাই  গির্জা। এটি ইরিত্রিয়ার অন্যতম প্রাচীন ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স গির্জা, যার অবস্থান একটি উঁচু পর্বতের চূড়ায়। সেখানে পৌঁছাতে হলে প্রায় ৩ ঘণ্টার খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে উঠতে হয়, যা নিঃসন্দেহে এক কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গির্জায় পৌঁছানোর পর চারপাশে ছড়িয়ে থাকা নীরবতা, আধ্যাত্মিক পবিত্রতা এবং পাহাড়ের উপর থেকে দেখা প্রকৃতির অসাধারণ দৃশ্য সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়।

এছাড়াও, এই উপকূলের সবচেয়ে জনপ্রিয় শহর হলো মাসাওয়া। একসময় এটি অটোমান ও ইতালীয় ঔপনিবেশিকদের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর ছিল। লোহিত সাগরের কোলঘেঁষে অবস্থিত এই মাসাওয়া শহর শুধু তার সমুদ্রবন্দরের জন্য বিখ্যাত নয়, বরং তার অতীত ঐতিহ্য ও স্থাপত্যশৈলীর জন্যও বিখ্যাত। এই শহরের কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে শাহী মসজিদ, যেটি মার্বেল পাথরে তৈরি এবং ইসলামি-অটোমান স্থাপত্যের অপূর্ব এক নিদর্শন। আর মসজিদের পাশেই রয়েছে ইতালীয় উপনিবেশিক আমলে নির্মিত ইম্পেরিয়াল প্যালেস। যদিও আজ তা পরিত্যক্ত, তবুও এর দেয়াল যেন ইতিহাসের নীরব সাক্ষ্য বহন করে চলে। 

আফ্রিকার রোম- আসমারা

এই ইতিহাসের রেশ ধরেই চলে আসা যায় ইরিত্রিয়ার রাজধানী আসমারায়। যাকে অনেকেই “আফ্রিকার রোম” বলেন। প্রথম দেখাতেই যেকোনো ভ্রমণপিপাসুর মন কেড়ে নেবে এই শহর। ১৯৩০-এর দশকে ইতালির ফ্যাসিস্ট শাসনের সময়ে এই শহরে নির্মিত হয়েছিল আসমারার বিখ্যাত সব স্থাপনা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ফিয়াট ট্যাগ্লিয়ার ভবন, কিন্দু সিনেমা হল, ক্যাথেড্রাল অব আসমারা ইত্যাদি। 

আসমারা শহর

এই স্থাপনাগুলো শুধুই বিল্ডিং নয়, বরং ইউরোপীয় শৈলীর নিখুঁত প্রতিবিম্ব, যা আফ্রিকার বুকে দাঁড়িয়ে এক ভিন্ন আবহ তৈরি করেছে। আসমারার প্রতিটি রাস্তাঘাট, ক্যাফে, এমনকি পুরনো ল্যাম্পপোস্টগুলোতেও যেন ইউরোপীয় ছোঁয়া লেগে আছে। আর তাই তো ঐতিহাসিক ও স্থাপত্যিক গুরুত্বের জন্যই ইউনেস্কো একে “বিশ্ব ঐতিহ্য শহর” হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। 

আসাব ও কেরেন শহর

এই অদ্ভুত ভূপ্রাকৃতিক পরিবেশের মাঝেই রয়েছে ইরিত্রিয়ার আসাব শহর। লোহিত সাগরের তীরে অবস্থিত এই শহর শুধু একটি সমুদ্রবন্দরই নয়, বরং আশপাশের প্রাকৃতিক গরম পানির ঝর্ণাগুলোর জন্যও বেশ পরিচিত। স্থানীয়দের কাছে এই জায়গাগুলো একেকটি স্বস্তির আশ্রয়। অনেকে বিশ্বাস করেন, এসব গরম পানিতে স্নান করলে নাকি নানা রকম শারীরিক ব্যথা-বেদনা ঠিক হয়। আর যখন সূর্য ধীরে ধীরে দিগন্তের ওপারে হারিয়ে যায়, তখন চারপাশের লবণাক্ত হ্রদগুলোর দৃশ্য হয়ে ওঠে অসাধারণ সুন্দর। 

ইরিত্রিয়ায় হয়তো সুন্দরবনের মতো ঘন জঙ্গল নেই, কিংবা সিলেটের মতো চা-বাগানও না। কিন্তু যারাই প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য খোঁজেন, তাদের মন জয়ের জন্য রয়েছে পাহাড়ি শহর কেরেন। রাজধানী আসমারা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই শহরটি যেন ইরিত্রিয়ার এক শান্ত, ছায়া-ঢাকা গ্রামীণ প্রতিচ্ছবি। চারপাশে সবুজ পাহাড়, ছায়াঘেরা গাছ, আর তার মাঝখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঘরবাড়ি, সবকিছু এক নিস্তব্ধ অথচ প্রাণবন্ত পরিবেশের ছোঁয়া দেয়। কেরেন শহরের আরেকটি দিক হলো তার ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য। এখানে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে পুরনো ক্যাথলিক গির্জা, মুসলিম মসজিদ আর গ্রীকদের অর্কিড বাগান। 

মানডে ক্যামেল মার্কেট

আপনার মনে হতেই পারে কেরেন মানেই শুধু প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। কিন্তু তা নয়, এখানকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় আয়োজন হলো সাপ্তাহিক Monday Camel Market(মানডে ক্যামেল মার্কেট)। দূরদূরান্ত থেকে কৃষকরা উট, গরু, ছাগল নিয়ে আসেন এই হাটে। কিন্তু এটা শুধু কেনাবেচার জায়গা না। এ এক আস্ত লোকজ উৎসব। যেখানে গান বাজে, লোকনৃত্য হয়, আর জায়গায় জায়গায় সাজানো থাকে স্থানীয় খাবারের দোকান। বিদেশি পর্যটকদের কাছে এই হাট যেন ইরিত্রিয়ার সংস্কৃতির সরাসরি এক জানালা। এখানে আসলে পর্যটকেরা নিজ চোখে দেখতে পারেন এই দেশের মানুষদের সহজ জীবন, পরিশ্রম আর আনন্দের রঙ। 

মানডে ক্যামেল মার্কেট

ইরিত্রিয়ার সংস্কৃতি

তবে ইরিত্রিয়ায় যেকোনো পর্যটন ভ্রমণ পূর্ণতা পায় এখানকার সংস্কৃতি ও জীবনধারার ছোঁয়ায়।। এখানে ধর্ম যেন ভাগ করে না, বরং জুড়ে দেয়। দেশের প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মুসলমান, আর বাকি ৫০ শতাংশ খ্রিস্টান। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এই দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে রয়েছে এক অসাধারণ ধর্মীয় সহাবস্থানের পরিবেশ।

রমজান মাসে মুসলমানদের রোজা পালনকে ঘিরে দেখা যায় খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের শ্রদ্ধাশীল আচরণ। রাস্তাঘাটে প্রকাশ্যে খাওয়াদাওয়া কমে যায়, প্রতিবেশীরা সহযোগিতা করেন। আবার বড়দিন এলে খ্রিস্টানদের ঘরে উৎসবের আলো জ্বলে ওঠে, আর মুসলমান প্রতিবেশীরাও অংশ নেন সেই আনন্দে। 

ইরিত্রিয়ান খ্রিস্টানদের বড় একটি অংশ ইরিত্রিয়ান অর্থোডক্স চার্চ অনুসরণ করেন। এই ধর্মীয় ধারা অনেকটা প্রাচীন, রীতিনীতিতে জটিলও বটে। কিন্তু তাতে রয়েছে এক গভীর ইতিহাস, ঐতিহ্য, আর আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়া। 

ইরিত্রিয়ানরা কফি খাওয়ায় দারুণ পটু। আসমারা বা কেরেন শহরে গেলে দেখা যাবে স্থানীয় “কফি সেরেমনি”। এই রীতিতে কফি বানানো হয় তিনটি ধাপে। প্রথম ধাপে সবচেয়ে গাঢ়, এরপর একটু হালকা, আর শেষে প্রায় জলঘোলা। কিন্তু প্রতিটি ধাপে থাকে আলাদা স্বাদ, আলাদা অনুভব। এই আয়োজন শুধু কফির স্বাদ নেওয়ার জন্য নয়, বরং, সময় নিয়ে বসে গল্প করার ও পারস্পরিক সম্পর্ককে আরও গভীর করার এক উপলক্ষ। পরিবারের সদস্য, পাড়া-প্রতিবেশী কিংবা অতিথি সবাই একসাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে এই কফি আড্ডা উপভোগ করেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইরিত্রিয়াতে কাউকে বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়ে যদি তাঁকে কফি না দেওয়া হয় তা এক ধরনের অবমাননা হিসেবে দেখা হয়।

ইরিত্রিয়ান কফি সেরেমনি

ইরিত্রিয়ার সংস্কৃতি যেমন বৈচিত্র্যময়, তাদের খাবার আর পোশাক তেমনই রঙিন ও ঐতিহাসিকভাবে সমৃদ্ধ। এখানকার প্রধান খাবারের মধ্যে অন্যতম হলো ইঞ্জেরা। এটি এক ধরনের টক স্বাদের পাতলা রুটি, যা সবজির ঝোল বা মাংসের তরকারির সঙ্গে খাওয়া হয়। এছাড়া রয়েছে জিগিনি, যেটা মূলত মসলা দেওয়া মুরগি বা গরুর মাংসের ঝোল। এই খাবার কেবল জিভেই নয়, মনেও দাগ কাটে।

আবার পোশাকের দিক থেকে ইরিত্রিয়ার মানুষরা ঐতিহ্য ও আধুনিকতার দারুণ মিশ্রণ রয়েছে। উৎসব বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে মহিলারা পরে শামা নামের একটি সাদা, হালকা কাপড়ের পোশাক। যেটি অনেকটা শাড়ির মতোই চারপাশে জড়ানো থাকে। আর পুরুষরাও পরে ঐতিহ্যবাহী ঢিলেঢালা পোশাক। বিশেষ করে মুসলিম ও খ্রিস্টান, এই দুই ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লোকদের পোশাকে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। শহরে আধুনিক পোশাকের চল থাকলেও, গ্রামের দিকে এখনো ঐতিহ্য ধরে রাখা হয় পুরো গর্বের সঙ্গে। 

ইরিত্রিয়া শুধু ইতিহাস, ধর্ম আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দেশ নয় ,এটি হলো আফ্রিকার সাইক্লিং রাজধানী! হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন। এখানে সাইক্লিং এতটাই জনপ্রিয় যে বহু আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয় দেশটির আসমারা শহরে। এমনকি বিশ্বের সেরা কিছু আফ্রিকান সাইক্লিস্টরাও এসেছেন এখান থেকেই। আসমারা শহরের রাস্তাগুলোতে প্রায়শই সাইকেল রেস দেখা যায়। এটা যেন এক ধরণের উৎসব, যেখানে পুরুষ, মহিলা, বৃদ্ধ সবাই একত্রে অংশ নেয়। অনেকে আবার এটিকে “সাইকেল শহর” বলেও ডেকে থাকেন।

ইরিত্রিয়ার ইতিহাস

ইরিত্রিয়ার গল্প যতটা রঙিন ,তার ভিতরে লুকিয়ে আছে কিছু গম্ভীর বাস্তবতাও। ইরিত্রিয়ার ইতিহাসের এক পটভূমি, যেখানে হাজার বছর ধরে বিচিত্র সভ্যতা, ধর্ম, শাসন ও সংগ্রামের গল্প জড়িত। এই দেশটি মানুষের জীবন ও সংস্কৃতির আদল তৈরি হয়েছে প্রাচীন নীলনদের সভ্যতার সঙ্গে শুরু করে আকসুম সাম্রাজ্যের গৌরবময় সময় পর্যন্ত।

আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে, যখন পৃথিবী ছিল অনেকটাই আদিম, তখন ইরিত্রিয়ার ভূমিতে গড়ে উঠেছিল মানুষের প্রথম বসতি। আর তারপর সময় এগোলো। খ্রিস্টপূর্ব প্রথম সহস্রাব্দে, এখানে গড়ে উঠল আকসুম সাম্রাজ্য। এই সাম্রাজ্য ছিল তৎকালীন বিশ্বের বড় বড় সাম্রাজ্যের অন্যতম। সেখানে আদুলিস নামের এক বন্দর , যেটা দিয়ে রপ্তানি হতো স্বর্ণ, হাতির দাঁত, এমনকি সুগন্ধি মসলা। এই সময়েই খ্রিস্টধর্ম এই অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চের প্রভাব শুরু হয়। পরবর্তীতে ইসলাম ধর্মও এই অঞ্চলে প্রসার লাভ করে। যার ঐতিহাসিক প্রমাণ সাহাবা মসজিদে পাওয়া যায়।

১৫শ শতকের পর লোহিত সাগরের কৌশলগত গুরুত্ব বেড়ে যায়। আর সেই সুযোগে অটোমান সাম্রাজ্য ইরিত্রিয়ার উপকূল দখল করে নেয়। মাসাওয়া শহর হয়ে ওঠে অটোমানদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সামুদ্রিক ঘাঁটি। এরপর ১৯ শতকে কিছু সময়ের জন্য মিশরীয় শাসকরা অঞ্চলটি দখল করে রাখে।

ইরিত্রিয়া দখল নিচ্ছে অটোমানরা

পরবর্তীতে ১৮৮০-এর দশকে ইউরোপে ‘Scramble for Africa’(স্ক্র্যাম্বল ফর আফ্রিকা) চলাকালে, ইতালি ইরিত্রিয়াকে তাদের উপনিবেশে পরিণত করে। এটি ছিল ইতালির প্রথম উপনিবেশ। ১৮৯০ সালে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে “ইরিত্রিয়া” নামটি দেয়। এরপর এক শতাব্দীরও বেশি সময় দেশটি শাসিত হয় বিদেশি শক্তির হাতে।

এই সময়েই নির্মিত হয় আসমারা শহরের ইউরোপীয় ধাঁচের স্থাপনাগুলো। কিন্তু একই সঙ্গে, এই সময় জুড়ে ইরিত্রিয়ানদের ওপর চলতে থাকে দমন-পীড়ন, যার বিরুদ্ধে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইতালি হেরে গেলে ইরিত্রিয়া ব্রিটিশ প্রশাসনের অধীনে যায়। পরে ১৯৫২ সালে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে ইথিওপিয়ার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় একটি ফেডারেশনের মাধ্যমে। কিন্তু ইথিওপিয়া একতরফাভাবে ১৯৬২ সালে ইরিত্রিয়াকে নিজের প্রদেশ হিসেবে ঘোষণা করে নেয়।

ইরিত্রিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধ

এর পরই শুরু হয় ইরিত্রিয়ার দীর্ঘতম ও রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। প্রায় ৩০ বছর ধরে চলে এই সংগ্রাম, যেটি ইতিহাসে Eritrean War of Independence নামে পরিচিত। ১৯৯১ সালে অবশেষে ইরিত্রিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা বিজয় অর্জন করে, আর ১৯৯৩ সালে একটি গণভোটের মাধ্যমে ইরিত্রিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

অতীতে আটকে থাকা ইরিত্রিয়া

জেনে অবাক হবেন, ২০০১ সাল থেকে দেশটিতে কার্যকর কোনো নির্বাচন হয়নি, আর রয়েছে কঠোর সেন্সর ও বাকস্বাধীনতার অভাব। এমনকি বিশ্বের সবচেয়ে কঠোর বাধ্যতামূলক সামরিক সেবা রয়েছে এই দেশেই।

হ্যাঁ, শুনতে অদ্ভুত লাগলেও সত্য। ইরিত্রিয়ায় প্রতিটি নাগরিকের জন্য ন্যাশনাল সার্ভিস বাধ্যতামূলক। এবং সার্ভিসে যোগ দেওয়ার পর কখন রিটায়ার্মেন্ট এ যাওয়া যাবে, তার কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমা নেই। অনেক মানুষ এখানে বছর নয়, বরং দশকের পর দশক ধরে “সামরিক সেবা” দিয়ে যাচ্ছেন। এই সেবার আওতায় সরকারের নির্দেশে শুধু সেনাবাহিনীই নয়, অনেক সময় কৃষিকাজ, নির্মাণ, এমনকি শিক্ষকতাও করতে হয়। তাই অনেকেই ইরিত্রিয়াকে “আফ্রিকার উত্তর কোরিয়া” বলে থাকেন।

দেশটিতে বিদেশ ভ্রমণের অনুমতি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত, ইন্টারনেট ব্যবহারে কড়াকড়ি, আর সাংবাদিকতার স্বাধীনতা প্রায় নেই বললেই চলে। এর ফলে বহু ইরিত্রিয়ান তরুণ-তরুণী পালিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি নিয়েও দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন প্রতিবছর। 

আরও অবাক করার মতো বিষয় হলো, আধুনিক পৃথিবী যেখানে ধীরে ধীরে ডিজিটাল লেনদেনের দিকে ঝুঁকছে, সেখানে ইরিত্রিয়া একেবারেই বিপরীত ধারায় হাঁটছে। এখন পর্যন্ত ইরিত্রিয়ায় কোনো এটিএম (ATM) নেই! মানে আপনি চাইলেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে কার্ডে টাকা তুলতে পারবেন না। বিশ্বাস করতে কষ্ট হলেও এটি সত্য। এখানকার ব্যাংকিং ব্যবস্থা বেশ প্রাচীন। বেশিরভাগ লেনদেন নগদেই হয়। বিদেশি কারেন্সিও খুব সহজে পরিবর্তন করা যায় না। এ কারণে অনেক বিদেশি পর্যটক বা কর্মী আগে থেকেই পর্যাপ্ত নগদ সঙ্গে নিয়ে ঢোকেন দেশে।

আপনি যদি ইরিত্রিয়ায় টেলিভিশন চালু করেন, পাবেন মাত্র একটাই সরকারি চ্যানেল “Eri-TV”। সেখানেও যা দেখানো হয়, তার প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি দৃশ্য সরকারের নজরদারিতে। এমনকি আবহাওয়া বুলেটিনেও যেন কোনও স্বাধীনতা নেই। এখানে সাংবাদিকতা মানে শুধু খবর লেখা নয়, বরং জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। কেউ যদি সরকারের সমালোচনা করেন, সাধারণত তার পরিণাম হয় নিখোঁজ হয়ে যাওয়া, বিনা বিচারে কারাবন্দি হওয়া, কিংবা বিদেশে পালিয়ে যাওয়া।

ইরিত্রিয়ার সম্ভাবনা

তবুও, এই বাস্তবতার মাঝে ভবিষ্যতের সম্ভাবনাও রয়েছে। ইরিত্রিয়া একটি খনিজ-সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ। বিশেষ করে সোনা, তামা, এবং জিংকের মতো খনিজের বিরাট সম্ভার আছে এখানে। এছাড়া, লোহিত সাগরের তীরে অবস্থান করায়, বন্দর-ভিত্তিক বাণিজ্য ও পর্যটনের সুযোগও রয়েছে বিশাল।

তরুণ প্রজন্ম যদি সঠিক শিক্ষার সুযোগ পায়, যদি সরকার ভবিষ্যতমুখী সংস্কারে আগ্রহী হয়, তাহলে ইরিত্রিয়া একদিন হয়ে উঠতে পারে আফ্রিকার অন্যতম উদীয়মান শক্তি। আর তাঁদের সবচেয়ে বড় সম্পদ হলো, মানুষের মন থেকে হার না মানার সেই সহজাত জেদ, যা ৩০ বছরের স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা প্রমাণ করে দিয়েছে।

মোট কথা বিস্ময়কর দেশ ইরিত্রিয়ায় একদিকে সীমাবদ্ধতা আরোপ করা, আবার অন্যদিকে রয়ে গেছে অবাক করা ঐতিহ্য, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মানুষের জীবনযুদ্ধ। এই দেশটা এমন এক জায়গা, যেখানে গল্পের অভাব নেই। যারা স্বাধীনতা অর্জনের পরেও কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে, যারা হাসিমুখে মেনে নিয়েছে নিয়ন্ত্রণ, আবার রক্ষা করে যাচ্ছে তাদের সংস্কৃতি, ধর্ম, বন্ধন আর কফির সৌন্দর্য। এত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও থেকেও এত রঙিন জীবন ধারণ করা সত্যিই অনেক ঐশ্বরিক বিষয়।

Related posts

ইনকা সভ্যতার রহস্যময় দেশ পেরু

শেখ আহাদ আহসান

মালয়েশিয়া: এক দেশ দুই ভূখণ্ড

আশা রহমান

ইংল্যান্ড: Sorry, Please, ও Thank you এর দেশ!

আশা রহমান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More