আপনি কি জানেন, পৃথিবীতে এমন একটি দেশ আছে যার অবস্থান ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে হলেও, দেশটির প্রায় ৩৫% মানুষ ভারতীয় বংশোদ্ভূত?
এই দেশটির কোন এক রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাবেন তখন আপনার কানে ভেসে আসবে হিন্দি গানের সুর, পাশের বাড়ি থেকে শুনবেন ভজনের ধ্বনি, আর রাত হলে পাড়া-মহল্লায় চলবে ‘বলিউড নাইট’ এর আয়োজন। এছাড়াও দেশটিতে রয়েছে মন মাতানো সমুদ্র সৈকত, এবং মনোরম প্রকৃতি।
সেই দেশটির নাম ত্রিনিদাদ ও টোবাগো।
চলুন জেনে নেওয়া যাক এই দেশের জন্মকথা, ইতিহাস, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, আর এমন কিছু তথ্য যা হয়তো আপনাকে অবাক করবে।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগো’র আয়তন ও জনসংখ্যা
ত্রিনিদাদ ও টোবাগো নামক দুইটি দ্বীপকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ছোট এই দেশ। এটি দক্ষিণ ক্যারিবিয়ান সাগরে ভেনেজুয়েলার উপকূল থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। দুটি দ্বীপ নিয়ে গঠিত এই দেশটি আয়তনে ছোট হলেও প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। প্রায় ১৩,০০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই দেশটিতে বসবাস করে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ। বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর, ভাষার ও ধর্মের মানুষ এখানে একসাথে বসবাস করে এক অপূর্ব সামাজিক ঐক্যের নিদর্শন তৈরি করেছে। আর সেই কারণেই ত্রিনিদাদ ও টোবাগোকে অনেকে বলেন—”একটি দেশ, অনেক পৃথিবী!”
এই দুই দ্বীপের মধ্যে ত্রিনিদাদ দ্বীপটি তুলনামূলকভাবে বড় এবং দেশটির অর্থনীতি, শিল্প ও নগরায়নের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়। অন্যদিকে টোবাগো দ্বীপটি অপেক্ষাকৃত ছোট হলেও এই অঞ্চলটি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর জন্য প্রকৃতির এক অপূর্ব আশীর্বাদ। সবুজ পাহাড়, স্বচ্ছ জলরাশি, নীল সমুদ্র আর সাদা বালির সৈকত যেন এখানে প্রতিটি শ্বাসে প্রশান্তি নিয়ে আসে। এখানে নেই শহরের কোলাহল, নেই কর্পোরেট দৌড়ঝাঁপ। দেশটির রাজধানী শহর পোর্ট অব স্পেন।
ম্যাপ
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর পর্যটনস্থান
মারাকাস বে
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিকগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এখানকার সৈকতগুলো। তার মধ্যে ত্রিনিদাদের সবচেয়ে বিখ্যাত সৈকত হলো মারাকাস বে। নীলচে সবুজ রঙের ঢেউ, সোনালি বালুর চাদর, আর চারপাশে ছায়াময় পাহাড়,সব মিলে এই জায়গাটা মনে হবে যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা কোনো নিখুঁত চিত্রকর্ম। এই সৈকতে স্থানীয় জনগণ থেকে শুরু করে পর্যটকেরা স্নান করতে, কেউ রোদ পোহাতে, আবার কেউ শুধু সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ শুনে কিছুটা প্রশান্তি খুঁজতে আসেন।
পিজন পয়েন্ট বিচ
অন্যদিকে, টোবাগো দ্বীপের পিজন পয়েন্ট বিচ হলো এমন এক সৈকত, যা দেখলেই মনে হয় কোনো শিল্পীর আঁকানো প্রাকৃতিক দৃশ্য। এখানকার কাঠের ঘাট, নীল-স্বচ্ছ শান্ত জলরাশি, আর সারি সারি নারকেল গাছের ছায়া মিলেমিশে তৈরি করে এক কোন মুগ্ধকর পরিবেশ। এই সৈকতের আরেকটি বিশেষ আকর্ষণ হলো পানির নিচের জগৎ। এখান থেকেই শুরু করা যায় স্নরকেলিং বা স্কুবা ডাইভিং, যা পর্যটকদের নিয়ে যায় এক রহস্যময় জলজ জগতে। প্রবাল প্রাচীর, বাহারি মাছ, আর স্বচ্ছ জলের নিচে সূর্যের আলোর খেলা,সব মিলিয়ে এই অভিজ্ঞতা যেন এক জীবনে একবার না করলেই নয়।
রাইট নেচার সেন্টার ও ক্যারোনি বার্ড স্যাংচুয়ারি
সৈকতের পরে এবার চলুন ত্রিনিদাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের দিকে। ত্রিনিদাদের উত্তরাঞ্চলের এক ঘন সবুজ অরণ্যের মধ্যে অবস্থিত আসা রাইট নেচার সেন্টার হলো পাখিপ্রেমীদের জন্য এটি স্বর্গভূমি। এখানে প্রায় ১৬০ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে, যার মধ্যে রয়েছে বিখ্যাত টুকান ও হামিংবার্ড। যারা প্রকৃতির নীরবতা ও সৌন্দর্যের মাঝে হারিয়ে যেতে ভালোবাসে, তাদের জন্য এটি হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য।
এছাড়াও রয়েছে ক্যারোনি বার্ড স্যাংচুয়ারিও অন্যতম একটি প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্র। এই অঞ্চলটি মূলত একটি বিস্তৃত জলাভূমি অঞ্চল। এখানে নৌকায় ভেসে ঘুরতে ঘুরতে দেখতে পাওয়া যায় স্কারলেট আইবিস নামে উজ্জ্বল লাল রঙের এক অসাধারণ পাখি। এটি ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর জাতীয় পাখি হিসেবেও পরিচিত। সূর্য ডোবার সময় যখন হাজার হাজার স্কারলেট আইবিস একসঙ্গে গাছে ফেরে, সেই দৃশ্য সত্যি অভাবনীয়।
পিচ লেক
আরেকটু ভিন্ন স্বাদের অভিজ্ঞতা নিতে পর্যটকেরা ঘুরে আসেন পিচ লেক থেকে। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক পিচ বা অ্যাসফল্টের হ্রদ। এই লেকটিকে দূর থেকে দেখলে মনে হবে বিশাল এক কালো পিচের মাঠ। কিন্তু এই হ্রদের গভীরে লুকিয়ে আছে হাজার হাজার বছরের পুরনো গাছের অংশ, জীবাশ্ম ও ভূতাত্ত্বিক ইতিহাস। কথিত আছে, ক্রিস্টোফার কলম্বাসের জাহাজ একবার এই হ্রদের পিচে আটকে পড়েছিল। আর এ কারণেই এই জায়গাটিকে ঘিরে তৈরি করেছে ইতিহাসের এক রহস্যময় আবরণ।
সান ফার্নান্দো হিল
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় পর্যটন স্থানের মধ্যে আরেকটি উল্লেখযোগ্য হলো শহরের ঠিক উপরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা ত্রিনিদাদের সান ফার্নান্দো হিল। এই পাহাড়ের চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচের শহরকে দেখলে মনে হয় যেন পাখির চোখ দিয়ে দেখছি গোটা দৃশ্যপট। এর সাগরের নীল জল, ছায়াময় গাছপালা আর দূরের কুয়াশায় ঢাকা ঘরবাড়ি যেন এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা।
দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই দেশটিতে আছে অনেক আকর্ষণীয় ঐতিহাসিক স্থান। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ত্রিনিদাদের দ্য ম্যাগনিফিসেন্ট সেভেন ভবন। পোর্ট অব স্পেন শহরে অবস্থিত এই সাতটি প্রাসাদ-সদৃশ ভবন নির্মিত হয়েছিল ঔপনিবেশিক আমলে। ফরাসি, স্কটিশ ও ব্রিটিশ স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এই ভবনগুলো দেখতে যেন মনে হয় ইউরোপের কোনো রাজপ্রাসাদের পথে হেঁটে চলেছেন। এই ভবনগুলোর প্রতিটিতেই রয়েছে কারুকার্যময় জানালা, মিনার, আর ঐতিহাসিক অলঙ্করণ, যা স্থানীয় সংস্কৃতির সাথে এক অপূর্ব সংমিশ্রণ গড়ে তোলে।
টেম্পল ইন দ্য সি
আর ধর্মীয় ঐতিহ্যের কথা বলতে গেলে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে টেম্পল ইন দ্য সি বা “সমুদ্রে মন্দির”। এটি একটি অসাধারণ ও ব্যতিক্রমী মন্দির, যা সমুদ্রের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে। এই মন্দিরটি গড়ে তুলেছিলেন এক ভারতীয় চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, সেওদাস সাধু, যিনি সব বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে নিজের বিশ্বাস আর আস্থাকে অটুট রেখে নিজ হাতে এই মন্দির তৈরি করেছিলেন। তার এই সাহসিকতা ও আত্মত্যাগ কেবল এক উপাসনালয়ের সীমাবদ্ধ নয়, বরং এটি মানুষের অদম্য ইচ্ছাশক্তি ও আত্মত্যাগের এক জীবন্ত প্রমাণ।
এছাড়াও যদি কেউ প্রচলিত পর্যটনের বাইরে গ্রামীণ সংস্কৃতির নিভৃত আনন্দ ও সরল জীবনযাত্রার ছোঁয়া পেতে চান, তাহলে ঘুরে আসতে পারেন লা ব্রেয়া বা ব্লাঞ্চিসিউস গ্রামের দিকে। এখানে দেখতে পাবেন সাদাসিধে মানুষের দৈনন্দিন জীবন, ঐতিহ্যবাহী মাছ ধরা পদ্ধতি এবং ছিমছাম, কাঠের নির্মিত গ্রামীণ ঘরগুলোর নিখুঁত সৌন্দর্য।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর ইতিহাস
কিন্তু এই দেশটির শুধু সৌন্দর্যেই নয়, ইতিহাসেও রয়েছে গভীরতা। এই দ্বীপে মানুষের বসতি গড়ে ওঠে হাজার বছর আগে। আদিবাসী আরাওয়াক ও ক্যারিব মানুষদের হাত ধরে এই দ্বীপটিতে শুরু হয় মানুষের জীবনযাত্রা। তারা মাছ ধরে, কৃষিকাজ করে,এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে বাঁচতো।
ইউরোপীয় উপনিবেশ ও দাসপ্রথা
কিন্তু ইতিহাসের মোড় ঘুরে যায় ১৪৯৮ সালে, যখন খ্যাতনামা অভিযাত্রী ক্রিস্টোফার কলম্বাস ত্রিনিদাদে এসে পৌঁছান। কলম্বাস এই দ্বীপে পা রাখার সময় তিনটি পাহাড় দেখে নাম রাখেন “লা ট্রিনিদাদ” অর্থাৎ “ত্রিত্ব”। তখনকার দিনে ইউরোপীয়রা যেখানেই যাচ্ছিল, সেখানেই নতুন করে নাম দিচ্ছিল, দখল নিচ্ছিল, আর তাদের ইউরোপীয় সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছিল স্থানীয়দের উপর। ত্রিনিদাদও তার ব্যতিক্রম নয়।
প্রথমে স্প্যানিশরা এই দ্বীপ দখল করে, এরপর দীর্ঘ দুই শতাব্দীর বেশি সময় ধরে তারা এখানে রাজত্ব চালায়। ততদিনে টোবাগোও হয়ে ওঠে ইউরোপীয়দের চোখের মণি। টোবাগো ছিল যেন এক রাজকুমারী, যাকে নিয়ে লড়াই করছিল একে একে ডাচ, ব্রিটিশ, ফরাসি ও কুরেশিয়ানরা। যার ফলে বারবার মালিকানা বদল হয়েছে টোবাগোর। কেউ এক বছর রাজত্ব করেছে, কেউ দশ বছর, আবার কেউ এক দশকও টিকতে পারেনি।
১৭৯৭ সালে ব্রিটিশ বাহিনী ত্রিনিদাদ দখল করে নেয় এবং ১৮০২ সালে চূড়ান্তভাবে স্পেন থেকে এই দ্বীপটি নিয়ে নেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে টোবাগোও ধীরে ধীরে চলে আসে ব্রিটিশদের হাতে। পরবর্তীতে ১৮৮৯ সালে ব্রিটিশ সরকার ত্রিনিদাদ ও টোবাগোকে একত্র করে একটি উপনিবেশ বানিয়ে ফেলে। যার কারনে এই সময়ে ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সমাজে ঘটে বড় ধরনের পরিবর্তন।
এসময় আখ চাষ ও চিনিকলের জন্য আফ্রিকা থেকে জোরপূর্বক নিয়ে আসা হয় হাজার হাজার দাস। এই দাসপ্রথা ছিল নিষ্ঠুর ও অমানবিক। ক্রীতদাসেরা দিনের পর দিন কষ্ট করে কাজ করতো, আর ইউরোপীয়রা তাদের শ্রমে রাজকীয় জীবন যাপন করতো। ১৮৩৪ সালে দাসপ্রথা বিলুপ্ত হলেও তার রেশ থেকে যায় বহু বছর।
কিন্তু দাসপ্রথা শেষ হওয়ার পর শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। তখন ব্রিটিশ সরকার ভারতে, চীন থেকে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক এনে বসিয়ে দেয় এই দ্বীপে। জেনে অবাক হবেন, অনেক ভারতীয় কৃষক পরিবারও তখন ত্রিনিদাদে চলে আসে। এভাবেই সেখানে আজকের বিশাল ভারতীয় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর শিকড় গড়ে ওঠে।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর স্বাধীনতা
ব্রিটিশ শাসনাধীনের সময়ই এই দ্বীপদ্বয় ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে এগোয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশটিতে স্বাধীনতার দাবি জোরালো হতে থাকে। ১৯৫৮ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ফেডারেশনের সদস্য হয়, কিন্তু সে ফেডারেশন বেশিদিন টেকেনি। অবশেষে বহু সংগ্রামের পর ১৯৬২ সালের ৩১ আগস্ট, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো ব্রিটিশদের কাছ থেকে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করে।
স্বাধীনতার পর দেশটির প্রথম প্রধানমন্ত্রী হন ড. এরিক উইলিয়ামস। তাঁকে ‘ফাদার অফ দ্য নেশন’ বলা হয়। তাঁর নেতৃত্বেই দেশটি এগিয়ে যেতে শুরু করে নতুন পথ ধরে। ১৯৭৬ সালে ত্রিনিদাদ ও টোবাগো একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। সেই থেকে এখন পর্যন্ত দেশটি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পরিচালিত হচ্ছে।বর্তমানে এখানে নিয়মিত নির্বাচন হয় এবং নাগরিকরা স্বাধীনভাবে তাদের মত প্রকাশ ও অংশগ্রহণের অধিকার ভোগ করে।
অবশ্য, দেশটি সময় সময় বেকারত্ব, মাদকদ্রব্যের অপব্যবহার এবং শহুরে অপরাধের বৃদ্ধির মতো কিছু সামাজিক সমস্যার সম্মুখীন হয়। তবে সরকার বিভিন্ন উন্নয়নমূলক উদ্যোগ গ্রহণ ও শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করে দেশটিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মানুষও ধীরে ধীরে সচেতন হয়ে উঠছে, যা ভবিষ্যতে দেশকে আরও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করে তুলবে বলে আশা করা যায়।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সংস্কৃতি
এত গৌরবময় ইতিহাসের কারণেই হয়তো ,ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর মানুষের বৈচিত্র্য এতো বিস্ময়কর। এখানে আফ্রিকান, ভারতীয়, ইউরোপীয়, চীনা ও আরবি বংশোদ্ভূত মানুষ মিলেমিশে একসাথে বাস করে। হিন্দু, খ্রিস্টান, ইসলাম, আফ্রিকান ঐতিহ্যভিত্তিক ধর্ম,সবকিছুরই রয়েছে এখানে সম্মানজনক অবস্থান। এখানে দিওয়ালি যেমন ধুমধাম করে উদযাপন হয়, তেমনি ঈদ কিংবা ক্রিসমাসও একই উৎসাহে পালন করা হয়।
ধর্মীয় উৎসবের বাহিরেও, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সবচেয়ে বিখ্যাত এবং বৈশ্বিক পরিচিতির উৎসব হলো “কার্নিভাল”। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারিতে আয়োজন করা হয় এই উৎসবের। পুরো দ্বীপজুড়ে তখন শুরু হয় এক উৎসবের আমেজ। এসময় মানুষজন নতুন নতুন রঙিন পোশাক তৈরি করে, মুখোশ পরে এবং মনোমুগ্ধকর সাজসজ্জায় নিজেদের সাজিয়ে তুলে।
দেশটির সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, ত্রিনিদাদ ও টোবাগোতে ভারতীয় সংস্কৃতির প্রভাব! সেটাকে যদি আপনি “গভীর” ভাবেন, তাহলে বলতে হয়, সেটা শুধু গভীর না,একেবারে মাটির তলায় গেঁথে আছে। ভারতে যারা গিয়েছেন, কিংবা ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যাদের পরিচয় আছে, তারা ত্রিনিদাদে গেলে রীতিমতো অবাক হয়ে যাবেন। ভারতীয় সিনেমা, গান, উৎসব যেন এই দ্বীপের নিত্যদিনের অংশ হয়ে গেছে।
শুধু তাদের সংস্কৃতিতেই নয়, তাদের খাবারের স্বাদের মধ্যেও ভারতীয়দের ছোঁয়া দেখা যায়। ত্রিনিদাদের রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কখনো ক্ষুধা জাগলে, সবচেয়ে সহজ এবং জনপ্রিয় যে খাবারটি পাওয়া যাবে তা হলো “ডাবলস”। ডাবলস হলো তাদের স্ট্রিট ফুডের এক রাণী। দুই মচমচে ভাজা রুটির মাঝখানে ঝাল ছোলা, টক তেঁতুল চাটনি আর ঝাল মসলা দিয়ে এটি পরিবেশন করা হয়। এর স্বাদ মনে হবে, যেন একবারে ভারতে বসে কোনো চাটনি দোকানে বসে খাচ্ছেন!
তাদের আরেকটা জনপ্রিয় খাবার হলো “রোস্ট মাংস”। মাংসকে নানা মশলা, আদা, রসুন দিয়ে মেরিনেট করে ধীরে ধীরে আগুনে ভাজা হয়। এই রোস্ট মাংসের গন্ধ পেয়ে যে কেউ ভীষণ ক্ষুধার্ত হয়ে পড়বে। আবার আপনি যদি চায়ের প্রেমিক হয়ে থাকেন, আপনার জন্য আছে “চাই”। আর কেউ চাইলে মিষ্টি টক “পাইনাপেল জুস” বা “কুমকুমা” খেতে পারে, যা এক ধরনের জনপ্রিয় ফলের শরবত।
অনেকেই হয়তো জানেন না, ত্রিনিদাদ ও টোবাগো এই দ্বীপের মাটি থেকে উঠে আসা একেকটি সুর, একেকটি ছন্দ, শুধু বিনোদন নয়, বরং ইতিহাস আর মানুষের অনুভূতির গল্প বলে। ত্রিনিদাদের ক্যালিপসো সংগীতের শুরুটা হয়েছিল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সময়েই। তখনকার শ্রমিকরা তাদের কষ্ট, যন্ত্রণা আর প্রতিবাদের কথাগুলো গানের ছন্দে ব্যক্ত করে। ক্যালিপসোর গানের কথায় রয়েছে সেখানকার মানুষের স্বপ্ন, হাসি-কান্না, আর তাদের সংগ্রাম।
অবশ্য সময়ের সঙ্গে বদলে যেতে শুরু করেছে সেই সুরের ছন্দ, আর সেই পরিবর্তনের ধারায় জন্ম নেয় ‘সোকা’। এ এক এমন ধারা—যা প্রাণবন্ত, তেজে ভরপুর, আর শুরু হতেই শরীরে ছন্দ এনে দেয়, যেন থেমে থাকা যায় না! প্রথমে এই সঙ্গীত ছিল ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর মাটির গান, কিন্তু ধীরে ধীরে তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্ব প্রান্তরে।
আরও একটা জিনিস আছে যা ত্রিনিদাদকে বিশ্ব মানচিত্রে আলাদা করে, সেটা হলো “স্টিলপ্যান”। ভাবুন তো, তেলের পুরনো ড্রাম কেটে বানানো ঢোল থেকে এমন এক বাদ্যযন্ত্রের জন্ম যে, তা বিশ্বজুড়ে সঙ্গীতপ্রেমীদের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে! স্টিলপ্যানের সুরগুলো যেমন প্রাণবন্ত, তেমনই এটি এই দেশের গর্বের প্রতীক। উৎসবে, অনুষ্ঠানে, আর হাস্যোজ্জ্বল মুহূর্তে স্টিলপ্যানের ছন্দ শুনলেই সবাই মন ভরে যায়।
সংগীতের মঞ্চে ‘সোকা’ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর গর্ব, তেমনি খেলাধুলার জগতে এই দেশের সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম হলো ক্রিকেট। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড় যেমন ব্রায়ান লারা এসেছেন এই দেশ থেকেই। ব্রায়ান লারা শুধু ত্রিনিদাদ নয়, পুরো ক্রিকেটবিশ্বের এক জীবন্ত কিংবদন্তি। তিনি একমাত্র খেলোয়াড় যিনি টেস্ট ক্রিকেটে ৪০০ রানের ইনিংস খেলেছেন। ত্রিনিদাদের স্টেডিয়ামগুলোর গ্যালারিতে আজও তার নামে স্লোগান উঠে।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর অর্থনীতি
ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর অর্থনীতি মূলত প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের ওপর নির্ভরশীল। ত্রিনিদাদ দ্বীপে রয়েছে ক্যারিবিয়ানের সবচেয়ে বড় প্রাকৃতিক গ্যাস মজুদ, যা দেশটির অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। এই খাত থেকে পাওয়া রাজস্ব দেশের উন্নয়ন প্রকল্প, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পরিচালনায় ব্যয় হয়। পাশাপাশি, পেট্রোকেমিক্যাল শিল্পও দেশের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরিয়ে তোলে। কৃষি ক্ষেত্রেও ত্রিনিদাদ ও টোবাগো কিছুটা নির্ভরশীল। তারা সুগারকেইন, ফলমূল ও মৎস্য আহরণ মাধ্যমে দেশীয় চাহিদা মেটায়।
ত্রিনিদাদ ও টোবাগো সাধারণভাবে দুই দ্বীপ, কিন্তু এখানে প্রতিটি কোণে অনুভব করা যায় সংস্কৃতির, প্রকৃতির, খাদ্যের আনন্দের এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এই দেশ আমাদের শেখায়, ভাষা, ধর্ম, বর্ণ যতই ভিন্ন হোক না কেন, হৃদয়ের উষ্ণতায় সব পার্থক্যই মিলিয়ে যায়। ক্যারিবিয়ান সাগরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে, এই দেশ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় জীবনটা আসলে এক বিশাল কার্নিভাল, যেখানে হাসি, গান আর ভালোবাসা ছাড়া কিছুই স্থায়ী নয়। দেশটি সকল প্রতিবন্ধকতা ও চ্যালেঞ্জকে পেছনে ফেলে পৃথিবীর মানচিত্রে তার বৈচিত্র্যময়তা ছড়াতে থাক।
রেফারেন্স-
- https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A6_%E0%A6%93_%E0%A6%9F%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%8B
- https://constructive-voices.com/bn/%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A6-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%9F%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%8B-%E0%A6%AA%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%95-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%8F%E0%A6%AC%E0%A6%82-%E0%A6%9C%E0%A7%80%E0%A6%AC%E0%A6%AC%E0%A7%88%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AF/
- http://med.iiab.me/kiwix/wikipedia_bn_all_maxi_2020-01/A/%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A6%BE%E0%A6%A6_%E0%A6%93_%E0%A6%9F%E0%A7%8B%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%B0_%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%BE