“দক্ষিণ আফ্রিকার পাহাড়ে লুকিয়ে আছে ‘আদম ক্যালেন্ডার’। দেখতে শুধু পাথরের ধ্বংসাবশেষ মনে হলেও, কেউ বলে এটি মানব ইতিহাসের এক অজানা সূচনার প্রমাণ। এই রহস্যময় সময়ঘড়ি হয়তো আমাদের জানা ইতিহাসই পাল্টে দিতে পারে।”
দক্ষিণ আফ্রিকার এমপুমালাঙ্গা প্রদেশের মাচাডোডর্প শহরের কাছে পাহাড়ি এলাকায় ছড়িয়ে আছে অনেক বৃত্তাকার পাথরের দেয়াল আর সোজা লাইনে সাজানো পথ। একে বলা হয় ‘ব্লাউবসক্রাল পাথরের ধ্বংসাবশেষ’। জায়গাটি এতটাই রহস্যে ঘেরা যে, এ সম্পর্কে নিশ্চিত তথ্য খুব কমই পাওয়া যায়। কেউ জানে না ঠিক কে এগুলো বানিয়েছিল আর কখন। কেউ বলে কয়েক হাজার বছর আগে, আবার কেউ দাবি করে এগুলো কয়েক লক্ষ বছর পুরোনো!
এই পাথরের ভেতর সবচেয়ে আলোচিত জায়গা হলো ‘অ্যাডামস ক্যালেন্ডার’ বা আদম ক্যালেন্ডার। এটি আসলে কী? কারও মতে, এটি ১৬শ শতকে গরু রাখার খোঁয়াড় ছিল। আবার কারও দাবি, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম ক্যালেন্ডারের একটি। আবার অনেকেই বলেন এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম সময়ঘড়ি।
আদম ক্যালেন্ডার কী?
আদমের ক্যালেন্ডার একটি ঐতিহাসিক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। যা বিশ্বের প্রাচীনতম মানব-নির্মিত কাঠামোগুলোর একটি বলে বিবেচিত। এটি একটি বৃত্তাকারে সাজানো খাড়া পাথরের সমন্বয়ে গঠিত এবং দক্ষিণ আফ্রিকার হেরিটেজ ট্রেইলের একটি প্রাদেশিক ঐতিহ্য স্থান। ১৯৭৫ সালে এটিকে জাতীয় স্মৃতিস্তম্ভ ঘোষণা করা হয়। এই স্থানটিকে কখনো কখনো ‘আফ্রিকার স্টোনহেঞ্জ’ বলা হয়। এখানকার ধ্বংসাবশেষগুলো ৭৫,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো বলে মনে করা হয়।
ধারণা করা হয়, এই রহস্যময় প্রাচীন স্থাপনাটি ইউরোপের স্টোনহেঞ্জ বা মিশরের গিজার গ্রেট পিরামিডের তুলনায় কয়েক দশ হাজার বছর পুরোনো, যা এটিকে পৃথিবীর প্রাচীনতম মানবনির্মিত স্থাপনাগুলোর একটি করে তুলেছে।
আদম ক্যালেন্ডার কোথায় অবস্থিত?
আদম ক্যালেন্ডার দক্ষিণ আফ্রিকার পূর্বাঞ্চলের এমপুমালাঙ্গা প্রদেশে অবস্থিত। ইসিজুলু ভাষায় এ নামের অর্থ “যেখানে সূর্য ওঠে।” এই অঞ্চলের উত্তর দিকে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় বিস্তৃত রয়েছে অসংখ্য পাথরের বৃত্তাকার কাঠামো, যেগুলো একে অপরের সঙ্গে লম্বা পথে যুক্ত। এগুলো তৈরি হয়েছে গাঢ় রঙের সূক্ষ্ম দানাযুক্ত আগ্নেয় শিলা, ডায়াবেজ বা ডোলেরাইট দিয়ে।
পুরো এলাকা প্রায় ৪,০০০ বর্গমাইল জুড়ে বিস্তৃত, এবং এই অসংখ্য কাঠামো একসঙ্গে পরিচিত ব্লাউবসক্রাল পাথরের ধ্বংসাবশেষ নামে। এসব পাথরের বৃত্তের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত স্থান হলো আদমের ক্যালেন্ডার, যা ওয়াটারভাল বোভেন শহর থেকে প্রায় তিন মাইল উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত।
এই বৃত্তটির ব্যাস প্রায় ১০০ ফুট (প্রায় ৩০ মিটার), এবং যদিও এটি এমপুমালাঙ্গার হাজারো পাথরের বৃত্তের একটি মাত্র, তবুও এর বিশেষ গঠন ও অবস্থানের কারণে এটি বেশি পরিচিত। অন্য কাঠামোগুলোকে কেউ কেউ ১৭শ শতকের স্থানীয় সভ্যতার প্রাচীরঘেরা শহর বা প্রাচীন মন্দির মনে করেন, কিন্তু অনেক গবেষক আদমের ক্যালেন্ডারকে প্রাচীন সূর্য ক্যালেন্ডার হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
কেন্দ্রে রয়েছে দুটি বড় পাথর, যেগুলো ডোলোমাইট দিয়ে তৈরি এবং প্রতিটির ওজন প্রায় পাঁচ টন। ধারণা করা হয়, এই পাথরগুলো দূর থেকে এনে এখানে রাখা হয়েছে। এই কাঠামো এখনো বেশিরভাগ অংশে অক্ষত রয়েছে এবং স্যাটেলাইট থেকেও এর গঠন স্পষ্ট দেখা যায়। তাই এটি শুধু ঐতিহাসিক দিক থেকে নয়, বরং প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত।
আবিষ্কারের ইতিহাস
১৮০০ সালের শেষের দিকে দক্ষিণ আফ্রিকায় পাথরের এই ধ্বংসাবশেষগুলোর কথা ধীরে ধীরে জানা শুরু হয়। ১৮৯১ সালে ইংরেজ ভ্রমণকারী থিওডোর বেন্ট প্রথম অনুমান করেন, এই এলাকায় হাজার হাজার প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ থাকতে পারে। পরে আরও অনুসন্ধানের মাধ্যমে ১৯৭৪ সালে জানা যায়, এই অঞ্চলে প্রায় ২০,০০০টির মতো পাথরের গঠন রয়েছে।
এই স্থান প্রথম আলোচনায় আসে ২০০৩ সালে, যখন দক্ষিণ আফ্রিকান পাইলট ইয়োহান হেইন এমপুমালাঙ্গার পাহাড়ে প্লেন দুর্ঘটনায় পড়েন। দুর্ঘটনার পর তিনি আশেপাশে ছড়িয়ে থাকা অদ্ভুত পাথরের বৃত্ত লক্ষ্য করেন এবং সেগুলোর ছবি তোলেন। কাছ থেকে দেখার পর তিনি লক্ষ্য করেন, পাথরগুলো উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিম দিক বরাবর সঠিকভাবে সাজানো, এবং এর পেছনে রয়েছে বিশাল পাথরের বৃত্ত। এতে তিনি ধারণা করেন, এটি এক হারিয়ে যাওয়া প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন।
পরে তিনি গবেষক ও লেখক মাইকেল টেলিঞ্জারের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং তাঁরা একসঙ্গে গবেষণা শুরু করেন। তাঁরা আবিষ্কার করেন, পাথরগুলো বিষুব (ইকুইনক্স), অয়ন (সোলস্টিস) ও সূর্যোদয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সাজানো। পশ্চিম দিকে একটি গর্তও ছিল। ইয়োহান বুঝতে পারেন, এটি এক প্রাচীন ক্যালেন্ডার সম্ভবত পৃথিবীর প্রাচীন সময়ঘড়ি।
তাঁদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, এলাকার মূল শিলা ব্ল্যাক রিফ কোয়ার্টজাইট হলেও, এই মনোলিথগুলো ডোলোমাইট দিয়ে তৈরি এবং দূরবর্তী স্থান থেকে আনা হয়েছে। এগুলো নিখুঁত জ্যামিতিক বিন্যাসে দাঁড়ানো এবং দিক-নির্দেশনার সঙ্গে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
২০০৩ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার পাইলট ইয়োহান হেইন দীর্ঘদিন ধরে এই এলাকার ওপর দিয়ে উড়ে যাওয়ার সময় এসব স্থাপনার ছবি তোলেন এবং এই বিষয়টি নিয়ে আগ্রহী হন। প্রথম দিকে স্থানীয় বিশেষজ্ঞরা জানান যে, এগুলো ১৪শ শতকে অভিবাসী বান্টু জনগোষ্ঠীর গবাদিপশুর খোঁয়াড় ছিল। কিন্তু পরে দেখা যায়, এসব পাথরের গঠন বান্টুদের খোঁয়াড়ের সাথে মিল নেই, কারণ সাধারণত বান্টুদের খোঁয়াড় কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড় দিয়ে তৈরি হত, যা গবাদিপশুকে আটকে রাখতো এবং অনেক গঠনে প্রবেশদ্বারও ছিল না।
এরপর, ইয়োহানের একজন সহকর্মীর প্লেন দুর্ঘটনার শিকার হওয়ার ঘটনা এই রহস্য উন্মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দুর্ঘটনার পরে ক্রু সদস্যকে উদ্ধার করার পর, ইয়োহান আশেপাশের পাথরের মনোলিথগুলো ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করেন এবং দেখতে পান যে, এগুলো উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক বরাবর নিখুঁতভাবে সারিবদ্ধ।
এছাড়া, তিনি লক্ষ্য করেন যে কিছু পাথর বিষুব (Equinox) এবং অয়ন (Solstice)-এর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণভাবে সাজানো। সূর্যোদয়ের দিকে তিনটি পাথরের সারি ছিল এবং পশ্চিম দিকে মাটিতে একটি গর্ত দেখা যায়। তখনই ইয়োহান বুঝতে পারেন, এটি সম্ভবত পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন ক্যালেন্ডার।
আডামস ক্যালেন্ডারের রহস্য
প্রথমে ধারণা করা হয়েছিল যে, দক্ষিণ আফ্রিকায় পাওয়া এই পাথরের গঠনগুলো ১৩শ শতকে দক্ষিণে আসা আফ্রিকান উপজাতিদের গবাদিপশুর খোঁয়াড় (ক্রাল)-এর ধ্বংসাবশেষ। কিন্তু পরে দীর্ঘ গবেষণার পর বিশেষজ্ঞরা বুঝতে পারেন যে, এগুলো শুধু খোঁয়াড় নয়, বরং এক প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যাগত মানমন্দির এবং সম্ভবত ধর্মীয় উপাসনালয়ও ছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো, এই এলাকায় প্রায় ২০ হাজার এমন পাথরের বৃত্তাকার গঠন আবিষ্কৃত হয়েছে। আরও অবাক করা ব্যাপার হলো, ক্যালেন্ডারটি আজও কাজ করে। সূর্যাস্তের সময় পাথরের ছায়া পরিবর্তনের মাধ্যমে ঋতু ও সময়ের সংকেত পাওয়া যায়।
ইসিজুলু জনগোষ্ঠীর প্রবীণরা বলেন যে, এই স্থানকে তারা “সূর্যের জন্মভূমি” বলে ডাকেন। কারণ, বহু প্রাচীনকালে এখানেই তাদের বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান হতো। তাদের বিশ্বাস, এই ক্যালেন্ডারের পাথরগুলো পৃথিবীর অন্যান্য প্রাচীন পাথরের স্থাপনার শক্তি ধারণ করে এবং সেগুলোর সঙ্গে একধরনের সংযোগ তৈরি করে।
এছাড়া, অন্যান্য প্রাচীন পাথরের স্থাপনার মতো, আদমের ক্যালেন্ডারও নক্ষত্রপুঞ্জ ও আকাশের গতিবিধির সঙ্গে নিখুঁতভাবে মিল রেখে তৈরি। তাই এটি আমাদের প্রাচীন পূর্বপুরুষদের অসাধারণ জ্ঞান ও সৃজনশীলতার প্রমাণ বহন করে।
গবেষকরা ক্যালেন্ডারের তিনটি বিশেষ পাথরের অবস্থান বিশ্লেষণ করেন এবং ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের বেল্ট যখন দিগন্তে সমান্তরাল ছিল, তখনকার তারাভিত্তিক হিসাব মেলান। সেই বিশ্লেষণ থেকে জ্যোতির্বিজ্ঞানী বিল হোলেনবাখ অনুমান করেন যে, এই ক্যালেন্ডারের বয়স অন্তত ৭৫ হাজার বছর।
পরে, ২০০৯ সালের জুন মাসে ক্ষয়প্রাপ্ত ডোলোরাইট পাথরের ক্ষয়মাত্রা পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন যে, এই স্থাপনাটির প্রকৃত বয়স অন্তত ১ লাখ ৬০ হাজার বছর হতে পারে।
আদম ক্যালেন্ডার কিভাবে কাজ করে?
“অ্যাডামস ক্যালেন্ডার” নামটি ব্লাউবসক্রালের এক বিশেষ পাথরের বৃত্তকে বোঝায়, যা ওয়াটারভাল বোভেন ও কেপসেহুপ শহরের মাঝামাঝি অবস্থিত। ২০২০ সালে জোহান হেইন ও মাইকেল টেলিঙ্গারের লেখা Adam’s Calendar: Stonehenge of South Africa বইয়ের মাধ্যমে এই নামটি ব্যাপক পরিচিতি পায়। তারা দাবি করেন, এটি পৃথিবীর প্রাচীনতম মানবনির্মিত কাঠামোর অন্যতম।
তাদের মতে, অ্যাডামস ক্যালেন্ডার নির্মিত হয়েছিল একটি সূর্যঘড়ি হিসেবে। খানে পাথরগুলো নিখুঁতভাবে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব ও পশ্চিম দিক করে সাজানো রয়েছে। ক্যালেন্ডার কাজ করে যখন একটি উঁচু পাথর সূর্যের আলো প্রতিফলিত করে তার ছায়া পাশের ১২টি সমতল পাথরের ওপর পড়ে। এই ১২টি পাথর বছরের ১২ মাসের প্রতীক।
কিছু গবেষক বলেন, আদম ক্যালেন্ডার থেকে শব্দ তরঙ্গ এবং তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তিও নির্গত হতো। যা বিশাল এলাকার শক্তি সরবরাহে কাজে লাগানো হত। তারা আরও মনে করেন, এই ক্যালেন্ডার মিশরের পিরামিড এবং গ্রেট জিম্বাবুয়ের সঙ্গে জ্যামিতিকভাবে সংযুক্ত এবং এটি দক্ষিণ আফ্রিকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা পাথরের বৃত্ত নেটওয়ার্কের অংশ।
আদম ক্যালেন্ডার নিয়ে বিতর্ক
অ্যাডামস ক্যালেন্ডার নিয়ে বিতর্ক প্রধানত এর বয়স, উদ্দেশ্য এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য নিয়ে গবেষক ও বিজ্ঞানীদের মধ্যে ভিন্নমতের কারণে সৃষ্ট। নিচে এই বিতর্কের প্রধান দিকগুলো সংক্ষেপে তুলে ধরা হলো:
বয়স নির্ধারণ নিয়ে বিতর্ক
গবেষক মাইকেল টেলিঙ্গার এবং জোহান হেইন দাবি করেন যে অ্যাডামস ক্যালেন্ডারের বয়স ৭৫,০০০ থেকে ১৬০,০০০ বছর, যা ওরিয়ন নক্ষত্রপুঞ্জের অবস্থান এবং ডলোমাইট পাথরের ক্ষয়ের হিসাবের ওপর ভিত্তি করে। তবে, প্রত্নতাত্ত্বিক সম্প্রদায়ের অনেকে এই হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তারা বলেন, এই ধরনের প্রাচীনত্ব প্রমাণের জন্য আরও কঠিন প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ প্রয়োজন, যেমন কার্বন ডেটিং বা অন্যান্য বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি।
সমালোচকরা মনে করেন যে পাথরের ক্ষয়ের হিসাব সঠিক নাও হতে পারে, কারণ প্রাকৃতিক ক্ষয়ের হার পরিবেশের ওপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়।
কাঠামোর উদ্দেশ্য
টেলিঙ্গারের দাবি, এই স্থানটি একটি জ্যোতির্বিদ্যার ক্যালেন্ডার এবং সম্ভবত শব্দ নিরাময় বা ধর্মীয় আচারের জন্য ব্যবহৃত হতো। পাথরের শব্দ তরঙ্গ এবং তাদের জ্যামিতিক স্থাপনার ওপর ভিত্তি করে এই তত্ত্ব প্রচার করা হয়। কিন্তু অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক এই দাবিকে “ছদ্ম-বিজ্ঞান” হিসেবে বিবেচনা করেন, কারণ শব্দ নিরাময়ের তত্ত্ব প্রমাণের জন্য পর্যাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক বা ঐতিহাসিক তথ্য নেই।
কেউ কেউ মনে করেন এই পাথরগুলো সম্ভবত স্থানীয় উপজাতিদের দ্বারা পরবর্তী সময়ে (১৩শ শতাব্দীতে) গবাদি পশুর খোঁয়াড় (ক্রাল) হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল, যা টেলিঙ্গারের প্রাচীন সভ্যতার তত্ত্বের বিপরীতে যায়।
প্রাচীন সভ্যতার তত্ত্ব
টেলিঙ্গার এবং তার সমর্থকরা দাবি করেন যে অ্যাডামস ক্যালেন্ডার একটি উন্নত প্রাচীন সভ্যতার প্রমাণ, যারা জ্যোতির্বিদ্যা এবং জটিল প্রযুক্তির জ্ঞান রাখত। এই দাবি মূলধারার প্রত্নতত্ত্বের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, কারণ এত পুরনো সময়ে এমন জটিল সভ্যতার অস্তিত্বের প্রমাণ বিরল।
সমালোচকরা বলেন, এই তত্ত্বে প্রায়ই অতিরঞ্জিত বা অ-বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয়, যা প্রাচীন এলিয়েন সভ্যতার মতো ধারণার সঙ্গে মিলে যায়, যা বিজ্ঞানীদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
শব্দ তরঙ্গ ও নিরাময় তত্ত্ব
পাথরের শব্দ তরঙ্গ এবং তাদের তড়িৎ পরিবহন ক্ষমতা নিয়ে টেলিঙ্গারের দাবি বৈজ্ঞানিক সম্প্রদায়ের মধ্যে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। যদিও পাথর ঘষলে শব্দ হয়, তবে এর সঙ্গে নিরাময় বা আধ্যাত্মিক ব্যবহারের সরাসরি সম্পর্ক প্রমাণ করা কঠিন। সমালোচকরা বলেন, এই দাবিগুলোর পেছনে বৈজ্ঞানিক ভিত্তি কম এবং এটি বেশি অনুমাননির্ভর।
বাকোনি জনগোষ্ঠীর প্রাচীরঘেরা শহর
বেশিরভাগ প্রত্নতত্ত্ববিদ ও বিজ্ঞানীর মতে, এই ব্লাউবসক্রাল পাথরের ধ্বংসাবশেষ আসলে বাকোনি জনগোষ্ঠীর পাথরনির্মিত শহরের অবশিষ্টাংশ।
বাকোনিরা ১৬শ থেকে ১৯শ শতাব্দীর মধ্যে এমপুমালাঙ্গা এলাকায় বাস করত। তারা ছিল খনি শ্রমিক, ব্যবসায়ী, লৌহকার এবং বিশেষ করে দক্ষ কৃষক। গবেষকদের ধারণা, এই স্থানগুলো প্রমাণ দেয় এক উন্নত কৃষি পদ্ধতির, যেখানে পাথরের বৃত্তগুলো গৃহস্থালি এবং গবাদিপশুর খোঁয়াড় (“ক্রাল”) হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আশেপাশের পাহাড়ে তারা সোপান বা টেরেস তৈরি করেছিল, যা সে সময়ের উন্নত কৃষি প্রযুক্তির উদাহরণ।
অ্যাডামস ক্যালেন্ডার নিয়ে অন্যান্য তত্ত্ব
কেউ কেউ মনে করেন, বাকোনি ব্যাখ্যা এবং অ্যাডামস ক্যালেন্ডার তত্ত্ব দুটি আলাদা বিষয়। আবার কিছু তত্ত্বে বলা হয়, এই পাথরের বৃত্তগুলো ছিল জ্যোতির্বিদ্যাগত ঘড়ি, যা প্রাচীন ভারতের দ্রাবিড় বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর বংশধরেরা নির্মাণ করেছিল।
হাজার বছরের ধুলোয় ঢেকে থাকা ব্লাউবসক্রাল পাথরের ধ্বংসাবশেষ ও অ্যাডামস ক্যালেন্ডার আমাদের ইতিহাসের অজানা অধ্যায়ের নীরব সাক্ষী। বিজ্ঞান, প্রত্নতত্ত্ব ও কল্পনার সীমারেখা মুছে দিয়ে এগুলো মানুষকে ভাবায় – আমাদের অতীত আসলে কতটা রহস্যে ঘেরা? হয়তো এর সব প্রশ্নের উত্তর মিলবে না, তবুও এই প্রাচীন নিদর্শনগুলো মানবসভ্যতার অমীমাংসিত কাহিনী খুঁজে বের করার অদম্য কৌতূহলকে জাগিয়ে রাখবে চিরকাল।