যোগেন মণ্ডল, এক বিস্মৃত ইতিহাস, এক বিতর্কিত রাজনৈতিক যাত্রা। দলিতদের অধিকার থেকে শুরু করে দেশভাগ পর্যন্ত, তাঁর সিদ্ধান্তগুলো উপমহাদেশের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। কিন্তু কেন তিনি ইতিহাসের পাতা থেকে হারিয়ে গেলেন?
যোগেন মন্ডল, ইতিহাসের অতল গহবরে হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্র। এই প্রজন্মের অনেকেই হয়ত তার নাম পর্যন্ত শোনেনি। অথচ উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তিনি হতে পারতেন এক উল্লেখযোগ্য চরিত্র। কিন্তু অনেক সময় যাঁরা ইতিহাস নির্মাণ করেন তাঁদেরই সেই ইতিহাসে জায়গা হয় না। যোগেন মন্ডল তেমনই এক হতভাগা চরিত্র।
কে এই যোগেন মন্ডল, তার রাজনৈতিক ইতিহাস, কেনই বা তিনি হারিয়ে গেলেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে এখনো তিনি কিভাবে প্রাসঙ্গিক সবই জানবো আজকের লেখায়।
বরিশালের যোগেন মণ্ডল
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে অনেকে চেনেন বরিশালের যোগেন মণ্ডল হিসেবে। ২৯ জানুয়ারি ১৯০৪ সালে তৎকালীন বাকেরগঞ্জ অর্থাৎ বরিশালের এক নমঃশূদ্র, দলিত পরিবারে যোগেন মণ্ডলের জন্ম হয়েছিল। সেই সময় নমঃশূদ্রদের আর্থসামাজিক অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়।
মহাত্মা গান্ধীর ‘হরিজন’
নমঃ শূদ্রদের অচ্ছুত হিসেবে বিবেচনা করা হতো। এমনকি তাদেরকে হিন্দু ধর্মের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য করা হতো না। যদিও এখনো ভারতের অনেক জায়গায় দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের অবস্থার খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। মহাত্মা গান্ধী সেইসব গোত্রভুক্ত মানুষদের নাম দিয়েছিলেন ‘হরিজন’, যার অর্থ ভগবান হরির সন্তান। তবে, ব্রিটিশরা তাদের তালিকাভুক্ত করেছিল নিম্নবর্গের মানুষ হিসেবে।
পেশায় তারা ছিলেন কৃষক, নাপিত, মুচি, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, ডোম কিংবা মাছ বিক্রেতা। অনেক নৃতত্ত্ববিদের তথ্যমতে, এই দলিতরাই ছিলেন আদি ভারতবাসী। আর্যরা ভারত আক্রমণের পর তারা নিম্নবর্গের মানুষ হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। তাই অত্যন্ত প্রাচীনকাল থেকেই এই দলিতরা নিপীড়িত, নিগৃহীত হয়ে আসছে।
তৎকালীন সময়ে তাদের সামাজিক অবস্থা কতটা শোচনীয় ছিল তার কিছু উদাহরণ হলো- দলিত সম্প্রদায়ের শিশুদের স্কুলে বা মন্দিরে যাওয়ার অধিকার ছিল না। এক কাপ চায়ের জন্য নিজেদের টিনের কাপ নিয়ে দোকানের সামনে বসে থাকতে হতো। কারণ তারা অচ্ছুত; তাদের সংস্পর্শে বাকীদের জাত যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।
সাধারণ মানুষের জন্য নির্মিত কুয়া থেকে জলপান পর্যন্ত তাঁদের জন্য নিষিদ্ধ ছিল। বলিউডের বিভিন্ন সিনেমায় এখনো তাদের দুরবস্থার চিত্র বিভিন্ন সময় আমরা দেখতে পাই। তবে দু:খের বিষয় হলো, পৃথিবী অনেকদূর এগিয়ে গেলেও ভারতের অনেক স্থানে এই রকম অমানবিক প্রথা এখনো চালু আছে।
যোগেন মন্ডলের শিক্ষাজীবন
এই করুণ অমানবিক সামাজিক পরিস্থিতির মধ্যে থেকেও যোগেন মন্ডল উচ্চশিক্ষিত হোন, জায়গা পান রাজনীতির উচ্চপদে। তিন ভাই ও দুই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবচেয়ে ছোট।
স্থানীয় বালাবাড়িতে গ্রাম্য পাঠশালার মাধ্যমে তার শিক্ষাজীবনের শুরু হয়। পরবর্তীতে চতুর্থ শ্রেণীতে ‘বার্থী তারা ইনস্টিটিউশনে’ ভর্তি হন। সেখান থেকেই ১৯২৪ সালে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। ওই বছরই বরিশাল বিএম কলেজে আইএ বা ইন্টারমেডিয়েটে ভর্তি হন। ১৯২৬ সালে আইএ এবং ১৯২৯ সালে বিএ পাশ করেন। ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে কলকাতা আইন কলেজ থেকে এলএলবি পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৩৬ সালে প্রথমে কলকাতায় এবং একই বছর বরিশালে আইনজীবী হিসেবে যোগদান করেন।
যোগেন মন্ডলের রাজনৈতিক জীবন
১৯৩৭ সালে অবিভক্ত ভারতের আইনসভার একটি মাত্র সাধারণ আসনে তফসিলী জাতির একমাত্র প্রার্থী হিসেবে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল এমএলএ অর্থাৎ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এমএলএ নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার সমবায় ও ঋণদান মন্ত্রীর দায়িত্ব পান। যেখানে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষেরা প্রাথমিক শিক্ষা অর্জনের সুযোগই পায় না, সেখান থেকে যোগেন মন্ডলের সংসদ সদস্য হওয়া এবং মন্ত্রীত্ব পাওয়ার বিষয়টি নিঃসন্দেহে অভূতপূর্ব সাফল্য ছিল তৎকালীন সময়।
তবে তার মন্ত্রীত্ব পাওয়ার বিষয়টি একবার নয়, কয়েকেবারই ঘটেছে। তার ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের দিকে তাকালেই আমরা তা জানতে পারবো।
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে আবারও এমএলএ নির্বাচিত হয়ে সোহরাওয়ার্দীর মন্ত্রীসভার বিচার ও পূর্তমন্ত্রীর গুরুদায়িত্ব পালন করেন। শেষের দিকে অবিভক্ত ভারতের অন্তর্বর্তী কেন্দ্রীয় সরকারের আইনমন্ত্রী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন।
যোগেন মন্ডলের উল্লেখযোগ্য কর্ম
এখন প্রশ্ন আসতে পারে, শুধু মন্ত্রীত্বই কি তাকে ইতিহাসে স্মরণীয় করে রাখতে যথেষ্ট?
১৯১১ সালের লোকশুমারি অনুযায়ী, বাকেরগঞ্জে হিন্দুসমাজের মধ্যে শতকরা ৪৫ ভাগই ছিল নমশূদ্র, তথা দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ। আজকের প্রশাসনের ভাষায় যারা ‘তফসিলি জাতি’ হিসেবে পরিচিত। এদেরই কণ্ঠস্বর ছিলেন যোগেন মন্ডল।
কংগ্রেস ও সুভাষ বসুকে ঘিরে যোগেন মন্ডল
রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে ছিলেন কংগ্রেসে। সুভাষ বসুকে ঘিরে নতুন এক রাজনীতির স্বপ্ন দেখতেন তিনি। যোগেনের পৃথক সেই অবস্থানের মূল দিক ছিল নিপীড়িত বর্গগুলোর ঐক্যের তাগিদ। সমগ্র ভারতবর্ষে তিনিই প্রথম তফসিলি জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন নিয়ে আওয়াজ তোলেন। কিন্তু সুভাষের বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে কংগ্রেসের প্রতি চূড়ান্ত মোহভঙ্গ ঘটেছিল তাঁর। পরবর্তীতে তিনি ভাবতে শুরু করেন, ভারতবর্ষে দলিত ও মুসলমানরা হলো প্রধান দুই নিপীড়িত বর্গ, এদের ঐক্য প্রয়োজন।
ভারত ভাগ হওয়ার সময় পূর্ববঙ্গের দলিত সম্প্রদায় দ্বিধায় পড়ে তারা কি দেশত্যাগ করে হিন্দুপ্রধান ভারতে চলে যাবে, না পাকিস্তানে থেকে যাবে। পাকিস্তান একটি মুসলমান প্রধান দেশ হবে ঠিকই তবে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে জাতিপ্রথা নিয়ে তেমন কোনো মাথাব্যথা নেই। তাই পূর্ববঙ্গের দলিতরা দেশত্যাগ না করাটাই শ্রেয় মনে করেন। তাঁদের নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসেন যোগেন মণ্ডল, যিনি আজীবন দলিতদের ন্যায্য অধিকার নিয়ে সোচ্চার ছিলেন।
মুসলিম লীগ ও যোগেন মন্ডল
১৯৪৬ সালের নির্বাচনে যোগেন মণ্ডল যেসব এলাকায় দলিত সম্প্রদায়ের ভোটার বেশি ছিল সেই সব এলাকায় মুসলিম লীগ প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করেন এবং তাঁদের জিতিয়ে আনতে সক্ষম হোন।
তাঁর বক্তব্য ছিল ‘ছোটলোকদের এক হওয়া প্রয়োজন।’
এই অবস্থানের কারণেই তিনি দাঙ্গার দিনগুলোয় বাংলা ঘুরে ঘুরে নিম্নবর্ণের মানুষদের দাঙ্গা থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন এই বলে যে,
দাঙ্গা হলো শাসক এলিটদের শক্তি পরীক্ষার দুষ্ট ফল; এতে অংশ নিয়ে নিম্নবর্গের কোনো লাভ নেই।
যোগেন মণ্ডলের এই অবস্থানের মধ্য দিয়েই সাতচল্লিশে বাংলায় দলিত ও মুসলমানদের জোট রাজনীতির প্রধান বর্গ হয়ে ওঠে এবং তারই ফল ‘পূর্ব বাংলা’র পাকিস্তানের অংশ হওয়া। একই সঙ্গে যোগেনের এই ভূমিকা সেদিন নোয়াখালী ব্যতীত প্রায় পুরো পূর্ববঙ্গে দলিত-নমশূদ্রদের দাঙ্গার উত্তাপ থেকে অনেকাংশে রক্ষা করেছিল।
যোগেন মণ্ডল সব সময় দলিত-মুসলিম লীগ একতার জন্য কাজ করেছেন। তিনি জিন্নাহ ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অত্যন্ত আস্থাভাজন ছিলেন। দেশভাগের প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালে সিলেটে গণভোট হয়। সেসময় সিলেট ছিল আসামের অংশ। আসাম ও সিলেট মিলে হিন্দু-মুসলমানের জনসংখ্যার অনুপাত ছিল অনেকটা সমান সমান।এছাড়া সিলেটের চা বাগানগুলোতে আবার একটি উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার ছিল দলিত সম্প্রদায়ের। খুব স্বাভাবিকভাবেই তারা যেদিকে সমর্থন দেবে পাল্লা সেদিকে ভারী হবে।
জিন্নাহর অনুরোধে যোগেন মণ্ডল সিলেটে গিয়ে দলিত সম্প্রদায়ের মাঝে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেওয়ার জন্য জোর প্রচারণা চালান এবং শেষ পর্যন্ত সিলেট পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। সেক্ষেত্রে বলাই যায়, সিলেটের বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পেছনেও উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে এই মানুষটির। কিন্তু তারপরেও যোগেন মন্ডল উপমহাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে বিস্মৃত, অবহেলিত।
গণপরিষদে যোগেন মন্ডল
যোগেন মণ্ডল ও তাঁর দলিত অনুসারীরা দেশ ত্যাগ না করে পূর্ব পাকিস্তানেই রয়ে যান। তিনি ৬৯ সদস্যবিশিষ্ট পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। জিন্নাহ যোগেন মণ্ডলকে পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রী নিয়োগ করেন। তার আগে তিনি বরিশালের যোগেন মণ্ডলকে পাকিস্তানের গণপরিষদের অস্থায়ী স্পিকার নিযুক্ত করেন এবং ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণ করে যোগেন মণ্ডলের কাছে গভর্নর জেনারেলের শপথ গ্রহণ করেন।
কিন্তু পরিস্থিতি ক্রমেই পাল্টাতে শুরু করে, যখন জিন্নাহর মৃত্যুর পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় বসেন লিয়াকত আলি খান। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ও ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণা করলে সব হিসাব নিকাশ উল্টেপাল্টে যায়। যোগেন মণ্ডল কিছুটা অসহায় বোধ করেন।
মোহাম্মদ আলির আক্রোশে যোগেন মন্ডল
পাকিস্তান ইসলামি প্রজাতন্ত্র ঘোষণা পরপরই দিল্লি থেকে পাকিস্তানে চলে আসেন ষড়যন্ত্রে পটু ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের আমলা চৌধুরী মোহাম্মদ আলি, যিনি পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হোন। তিনি ব্রিটিশদের একজন অত্যন্ত আস্থাভাজন আমলা ছিলেন। এসেই তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রিপরিষদের সচিব হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন।
মোহাম্মদ আলির অভ্যাস ছিল সরকার বা মন্ত্রিপরিষদে যত অমুসলিম বা সংখ্যালঘু নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর সদস্য বা কর্মকর্তা ছিলেন তাঁদের দেশপ্রেম নিয়ে সন্দেহ করা। তার প্রভাব ফলতে শুরু করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময়। যোগেন মণ্ডল একসময় লক্ষ করেন তাঁকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফাইল না দেখিয়ে মন্ত্রিপরিষদের সচিব সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন। এতে তাঁর মন ভেঙে যায়।
১৯৫০ সালের ৮ অক্টোবর তিনি প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে দেশত্যাগ করে কলকাতায় চলে আসেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে কলকাতার মানুষও তাঁকে ভালোভাবে গ্রহণ করেননি। ১৯৬৮ সালের ৫ অক্টোবর বাংলাদেশে ভারত সীমান্তের বনগাঁ জেলায় এই মহান ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের জন্য তিনি এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তাদের কজনই বা তাঁর কথা মনে রেখেছেন? আর ভারতে দলিতদের অবস্থা খুব বেশি উন্নত হয়েছে, তা কি বলা যাবে?
যোগেন মণ্ডল ও তাঁর অনুসারীদের ব্যর্থতা
যোগেন মণ্ডল ও তাঁর অনুসারীদের ব্যর্থতার ইতিহাস এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু হয়নি। পঞ্চাশের দশকে পূর্ববঙ্গে ব্যাপক খাদ্য ঘাটতি দেখা দেয়। খাদ্য ঘাটতিকে কেন্দ্র করে খুলনা-যশোর অঞ্চলের মানুষের, বিশেষ করে দলিতদের অবস্থা হয় শোচনীয়। তার পাশাপাশি এই অঞ্চলে সীমিত আকারে সাম্প্রদায়িত দাঙ্গাও দেখা দেয়।
১৯৫২ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে পাসপোর্ট ব্যবস্থা চালু হলে নিম্নবর্গের হিন্দুরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং দলে দলে দেশ ত্যাগ শুরু করে। এই সর্বহারা উদ্বাস্তুদের জন্য মধ্যপ্রদেশ, ওড়িশা, মহারাষ্ট্র ও অন্ধ্র প্রদেশের একটি বিরাট এলাকাজুড়ে দণ্ডকারণ্য নামক স্থানে শরণার্থী শিবির খোলা হয়। দণ্ডকারণ্য ছিল একটি পরিত্যক্ত এলাকা। কারণ, এখানে নিয়মিত কোনো বৃষ্টিপাত হয় না, মাটি চাষবাসের অযোগ্য, পানীয়জলের তীব্র অভাব, নেই কোনো চিকিৎসার সুব্যবস্থা। জনবিচ্ছিন্ন এই স্থানে ছিন্নমূল মানুষদের জীবনযাত্রা এতটাই অসহনীয় হয়ে পড়েছিল যে দণ্ডকারণ্যে কয়েক হাজার নিরীহ মানুষ না খেয়ে, বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুবরণ করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যোগেন মন্ডল কতটা প্রাসঙ্গিক
বরিশালের যোগেন মণ্ডল হচ্ছেন ইতিহাসের একজন ক্ষণজন্মা রাজনীতিবিদ, যিনি নিজেই ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন কিন্তু কালের বিবর্তনে তিনি নিজেই হারিয়ে গেছেন ইতিহাস থেকে। অথচ বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে দেশের রাজনীতিতে একজন যোগেন মন্ডলের উপস্থিতি খুবই জরুরি। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠিসহ এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সার্বিক উন্নতি ও অধিকার রক্ষায় একটি বলিষ্ঠ কন্ঠস্বর প্রয়োজন।
তাঁর সংগ্রাম, সিদ্ধান্ত ও পরিণতি থেকে বর্তমান রাজনীতিবিদ ও নাগরিকদের অনেক কিছু শেখার আছে। যেমন-
সংখ্যালঘুদের অধিকার ও বর্তমান বাংলাদেশ
বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলা হলেও বাস্তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এখনো নানাভাবে বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। যোগেন মণ্ডলের লড়াই আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সংখ্যালঘুদের শুধু সাংবিধানিক অধিকার দিলেই হবে না, বরং, তাদের নিরাপত্তা ও সমান সুযোগ নিশ্চিত করাও অত্যন্ত জরুরি।
দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার
একটি বিষয় ভুলে গেলে চলবে না, শুধু ভারতে নয়, বাংলাদেশেও দলিত ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অবস্থা এখনও বেশ দুর্বল। তাদের অনেকেই শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও চাকরির ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন।
যোগেন মণ্ডল যদি তাঁর রাজনৈতিক স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারতেন, তাহলে হয়তো দলিত ও নমঃশূদ্র সম্প্রদায়ের সামাজিক অবস্থান উন্নত হতে পারত। তাঁর লড়াই আমাদের শেখায় যে দলিত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অধিকার নিশ্চিত করতে হলে তাদের আরও বেশি অংশগ্রহণ জরুরি।
রাজনৈতিক প্রতারণা ও সুবিধাবাদী রাজনীতি
যোগেন মণ্ডলের কংগ্রেস থেকে মুসলিম লীগে যোগদান এবং পাকিস্তানকে সমর্থন, সবই ছিল একটি বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে। আর সেটি হলো, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের উন্নয়ন। তিনি বিশ্বাস করেছিলেন যে, মুসলিম লীগ সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেবে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত তিনি প্রতারণার শিকার হন।
আজকের বাংলাদেশেও রাজনৈতিক দলগুলো সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থের কথা বলে, কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর তাদের উন্নয়নে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয় না। যোগেন মণ্ডলের জীবন আমাদের শিক্ষা দেয় যে শুধুমাত্র রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির ওপর নির্ভর করা যথেষ্ট নয়; শুধু নেতার উপর নির্ভর করলেই চলবে না, নিজেদেরকেও সেই অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।
তথ্যসূত্র
- https://www.prothomalo.com/opinion/column/%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AF%E0%A7%87%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AE%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%B2%E0%A6%95%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%BF-%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%8B-%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A7%9C%E0%A7%87
- https://www.dailyjanakantha.com/different-news/news/477628
- https://www.kalerkantho.com/print-edition/muktadhara/2020/01/07/859702
- https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%AE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1%E0%A6%B2,_%E0%A6%AF%E0%A7%8B%E0%A6%97%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%A5
- https://www.banglatribune.com/foreign/608191/%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%B7%E0%A6%A3%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%A8-%E0%A6%AF%E0%A6%B6%E0%A7%8B%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B6%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%87-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%89%E0%A6%B2%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%96