একটা পাতলা করে কাটা আলু, এক চিমটি লবণ আর কামরেই কুড়মুড়ে শব্দ! এই ভাবতেই কি চিপসের কথা মনে পড়ে গেলো? কিন্তু জানেন কি, আপনার হাতে ধরা সেই কুড়কুড়ে চিপসের পেছনে লুকিয়ে আছে রাজনীতি, কিংবদন্তি, আর বিশ্বজয়ের গল্প? চলুন, ডুব দিই আলুর চিপসের মজাদার ইতিহাসে!”
নিয়মিত বেশি করে আলু খান, এতে ভাতের উপর নির্ভরতা কমবে। আলু বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি কখনও মাছের বিকল্প, কখনও বা মাংসের, আবার নিরামিষ রান্নাতেও এর উপস্থিতি চোখে পড়ে। ঝাল, ঝোল, ভাজি—প্রতিটি রেসিপিতেই আলুর ব্যবহার অনিবার্য। পৃথিবীতে চালের পর আলুই হলো দ্বিতীয় সর্বাধিক খাওয়া খাদ্যশস্য। আলু থেকেই তৈরি হয় সুস্বাদু পটেটো চিপস। কেউ বলতে পারেন, “এটা আবার নতুন কী কথা! পটেটো চিপস তো অবশ্যই আলু থেকেই হবে, ধানের খড় থেকে তো আর না!”
বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতের আলু পাওয়া যায়, যেমন গোল আলু, মিষ্টি আলু, শাক আলু ও মেটে আলু। এর মধ্যে সাদা গোল আলু থেকে পটেটো চিপস তৈরি করা হয়।
আলু চিপস এর নামকরণ
বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে আলুর চিপস বিভিন্ন নামে পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডায় এই খাবারকে সাধারণত ‘চিপস’ বলা হয়। অধিকাংশ দেশে একে ‘পটেটো চিপস’ নামেই ডাকা হয়। তবে যুক্তরাজ্য ও আয়ারল্যান্ডে এই শুকনো ও মচমচে আলু ভাজার নাম ‘ক্রিস্প’। সেখানে ‘চিপস’ শব্দটি ব্যবহার করা হয় গরম গরম ফ্রেঞ্চ ফ্রাই জাতীয় খাবারের জন্য।
উত্তর নিউজিল্যান্ডে বাসাবাড়িতে এটি ‘চিপিস’ নামে পরিচিত হলেও, বাণিজ্যিকভাবে পুরো দেশে একে ‘চিপস’ বলেই ডাকা হয়। বাংলাদেশেও এই খাবার সাধারণত ‘চিপ’ বা ‘চিপস’ নামে পরিচিত। তবে বিভিন্ন অঞ্চলে একে স্থানীয়ভাবে ‘আলু ভাজা’ বলেও উল্লেখ করা হয়।
আলুর চিপস কিভাবে আবিষ্কৃত হলো
১৭০০ সালের দিকে ফ্রান্সে মোটা করে কাটা আলু ভাজা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। সে সময় ফ্রান্সে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ছিলেন থমাস জেফারসন। তিনি এই ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের স্বাদে এতটাই মুগ্ধ হন যে, দেশ ফিরে যাওয়ার সময় এর রেসিপি সঙ্গে করে নিয়ে যান। পরে নিজের বাসস্থান মন্টিসেল্লোতে অতিথিদের ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পরিবেশন করে তিনি সবাইকে অভিভূত করেন। এভাবেই ধীরে ধীরে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই পুরো আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
তৎকালীন সময়ে পটেটো চিপসকে ‘ক্রিস্প’ নামে ডাকা হতো। ১৮১৭ সালে প্রকাশিত ব্রিটিশ চিকিৎসক উইলিয়াম কিচিনারের লেখা “দ্য কুক’স ওরাকল” ছিল সে সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় রান্নার বই। ১৮২২ সালে প্রকাশিত বইটির নতুন সংস্করণে পাতলা করে কাটা আলু ভাজার একটি রেসিপি যুক্ত হয়। সেই রেসিপি অনুযায়ী, আলুর খোসা ছাড়িয়ে কোয়ার্টার ইঞ্চি পুরু করে কেটে তা শুকরের কিংবা গরুর চর্বিতে ভাজতে হতো। ভাজার পর ঠান্ডা হলে আলুগুলোতে লবণ ছিটিয়ে পরিবেশন করা হতো।
১৮৫৩ সালের এক বসন্ত সন্ধ্যায় নিউ ইয়র্কের সারাতোগা স্প্রিংসে অবস্থিত অভিজাত রিসোর্টে পর্যটকদের ভিড় ছিল উপচে পড়া। সেই সময় “মুন লেক লজ” নামক একটি রেস্টুরেন্টে এক অতিথি তার অর্ডার করা ফ্রেঞ্চ ফ্রাই খেতে অস্বীকার করেন, কারণ তার মতে সেগুলো অনেক মোটা করে কাটা ছিল। সেদিন রান্নার দায়িত্বে ছিলেন এক নেটিভ আমেরিকান শেফ, জর্জ ক্রাম। তিনি ক্ষোভে আলুর টুকরো আরও পাতলা করে ভেজে নতুনভাবে পরিবেশন করেন। কিন্তু অতিথি সেটিও ফিরিয়ে দেন।
ক্রাম এবার চরম পদক্ষেপ নেন। তিনি আলুর স্লাইস এতটাই পাতলা করে কাটেন যাতে তা কাঁটাচামচে তোলা যায় না, তারপর ভেজে তার উপর লবণ ছিটিয়ে দেন। অবাক করার মতো, অতিথি এবার নতুন এই আলু ভাজা খেয়ে ভীষণ খুশি হন এবং পরদিন আবার সেটি অর্ডার দেন। এরপর থেকেই এই বিশেষ ধরনের আলু ভাজা জনপ্রিয় হতে থাকে। ক্রামের প্রতি আসতে থাকে একের পর এক অনুরোধ। পরবর্তীতে রেস্টুরেন্টের মেনুতে ‘সারাটোগা চিপস’ নামে এই নতুন আইটেমটি যুক্ত হয়।
১৮৬০ সালে জর্জ ক্রাম সারাটোগা লেকের পাশে মাল্টা অ্যাভিনিউতে নিজস্ব একটি রেস্টুরেন্ট চালু করেন। সে সময়ের ধনী ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের মধ্যে উইলিয়াম ভ্যান্ডারবিল্ট, কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট, জয় গোল্ড এবং হেনরি হিলটনের মতো মানুষ ছিলেন তার নিয়মিত অতিথি। তিন দশক ধরে রেস্টুরেন্ট পরিচালনার পর ১৮৯০ সালে তিনি সেটি বন্ধ করে দেন। অবশেষে ১৯১৪ সালে, ৯২ বছর বয়সে জর্জ ক্রাম মৃত্যুবরণ করেন।
আজ আমরা যে কুড়কুড়ে পটেটো চিপস খেয়ে আনন্দ পাই, তার পেছনে রয়েছে জর্জ ক্রামের অবদান। অথচ আমরা কজনই বা জানি তার নাম!
১৮৯৫ সালে ক্লিভল্যান্ডের উইলিয়াম ট্যাপেনডেন নিজ বাড়িতে প্রথমবারের মতো পটেটো চিপস তৈরি করে আশপাশের মুদি দোকানগুলোতে সরবরাহ শুরু করেন। তার এই উদ্যোগ থেকেই গড়ে ওঠে বিশ্বের প্রথম পটেটো চিপস উৎপাদনকারী কারখানা। যদিও ১৮৫৩ সালে জর্জ ক্রাম প্রথম এই বিশেষ ধরনের আলু ভাজা তৈরি করেছিলেন, আজও তা আমেরিকানদের অন্যতম প্রিয় স্ন্যাকস হিসেবে জনপ্রিয়।
সময়ের প্রবাহে আটলান্টিক মহাসাগর পেরিয়ে পটেটো চিপস এখন বাঙালি শিশু-কিশোরদের মনেও জায়গা করে নিয়েছে।
লেইস চিপস এর ইতিহাস
হারমান লে নামের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ১৯২০ সালে সেলসম্যান হিসেবে আমেরিকার দক্ষিণাঞ্চলের নানা দোকানে ঘুরে ঘুরে নিজে তৈরি পটেটো চিপস বিক্রি করতেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর তৈরি চিপস মানুষের মাঝে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পরবর্তীতে এটি লে’জ (Lay’s) নামে পরিচিতি লাভ করে।
লে-র প্রতিষ্ঠিত কোম্পানিই ছিল প্রথম সফল দেশব্যাপী বাণিজ্যিক চিপস ব্র্যান্ড। ১৯৬১ সালে তিনি তার প্রতিষ্ঠানকে ড্যালাসভিত্তিক স্ন্যাকস প্রস্তুতকারী কোম্পানি ফ্রিটো-র সঙ্গে একত্রিত করেন। এর ফলে লে’জ চিপসের উৎপাদন ও বিপণন আরও বহুগুণে বৃদ্ধি পায়। আজও লে’জ বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় পটেটো চিপস ব্র্যান্ড হিসেবে সমাদৃত।
ফ্লেভারড চিপসের ইতিহাস
বর্তমানে আমরা যে পটেটো চিপস খাই, সেগুলো নানা রকমের বৈচিত্র্যময় স্বাদে ভরপুর। চিংড়ি, মুরগির মাংস, চকলেট, চিজসহ আরও বহু ধরনের ফ্লেভার আমাদের চেনা স্বাদে যুক্ত হয়েছে। এর পেছনে যার কৃতিত্ব রয়েছে, তিনি হলেন জো ‘স্পাড’ মারফি।
১৯৫০ সালের আগ পর্যন্ত পটেটো চিপস ছিল একেবারেই সাধারণ ও নির্লিপ্ত—এতে কোনো মসলা পর্যন্ত থাকত না। এমনকি অনেক সময় প্যাকেটের ভেতর লবণও দেওয়া হতো না। কিন্তু ১৯৫৪ সালে আয়ারল্যান্ডের বাসিন্দা মারফি তার নিজস্ব চিপস কোম্পানি টেটো প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি সেই সাদামাটা চিপসকে মোটেই পছন্দ করতেন না। তাই নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে চিপসে মসলা যোগ করে স্বাদে বৈচিত্র্য আনেন।
টেটো কোম্পানি প্রথম যে ফ্লেভারযুক্ত চিপস বাজারে আনে তা ছিল চিজ ও পেঁয়াজ স্বাদের। পরে লবণ ও ভিনেগার ফ্লেভারও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। আজও এই দুটি স্বাদকে বিশ্বজুড়ে আজও কদর করা হয়।
কিভাবে চিপস বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয় হলো
আলু বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় একটি সবজি, যা তার নানারকম স্বাদের জন্য সব বয়সী মানুষের নাস্তার তালিকায় বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। এই আলুর সবচেয়ে জনপ্রিয় ও পরিচিত রূপ হলো আলুর চিপস। এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর কেবলমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ১.৫ বিলিয়ন পাউন্ড আলুর চিপস খাওয়া হয়। বাংলাদেশেও এর জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে এবং এখন দেশের তৈরি আলুর চিপস আন্তর্জাতিক বাজারেও রপ্তানি করা হচ্ছে।
প্রচলিত মিথ
আলুর চিপসের জন্ম নিয়ে সবচেয়ে পরিচিত যে গল্পটি রয়েছে, সেটিকে অনেকেই কিংবদন্তি বা রূপকথার মতো মনে করেন। এই কাহিনিতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক অঙ্গরাজ্যের ছোট শহর সারাটোগার একটি রিসোর্টের বাবুর্চি জর্জ ক্রাম একদা হঠাৎ করেই আবিষ্কার করেন আলুর চিপস। সময়টি ছিল ১৮৫৩ সালের গ্রীষ্মকাল। সেই রিসোর্টে এসেছিলেন বিখ্যাত শিল্পপতি কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট। তিনি অর্ডার করেছিলেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কিন্তু পরিবেশিত খাবারটি তার পছন্দ হয়নি—তিনি মনে করেছিলেন ফ্রেঞ্চ ফ্রাইগুলো খুবই মোটা কাটা। ফলে তিনি খাবারটি ফিরিয়ে দেন।
এতে বাবুর্চি জর্জ ক্রাম কিছুটা বিরক্ত হন এবং প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি আলুগুলোকে খুব পাতলা করে কেটে, তেল দিয়ে ভেজে একটি নতুনভাবে পরিবেশন করেন। ভ্যান্ডারবিল্ট সেই ভিন্নধর্মী পাতলা ও মচমচে আলুর স্বাদে এতটাই মুগ্ধ হন যে, সেখান থেকেই শুরু হয় আলুর চিপসের পথচলা। তখন এটি ‘সারাটোগা চিপস’ নামে পরিচিতি লাভ করে।
মিথের উৎপত্তি
‘জেএসটিওআর ডেইলি’র এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জর্জ ক্রামের চিপস উদ্ভাবনের কাহিনীকে মিথ বা কাল্পনিক গল্প হিসেবে বিবেচনা করার প্রধান কারণ হচ্ছে—১৮৫৩ সালের সেই গ্রীষ্মকালে কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্ট যুক্তরাষ্ট্রেই ছিলেন না। শুধু তাই নয়, ঐ বছর সারাটোগায় এমন পাতলা করে ভাজা আলু নতুন কোনো আবিষ্কারও ছিল না। এর আগেই, ১৮৪৯ সালের জুলাইয়ে ‘নিউইয়র্ক হেরাল্ড’ পত্রিকায় সারাটোগার এলিজা নামের এক বাবুর্চির তৈরি ‘আলু ভাজা’ নামের একটি পদকে নিয়ে প্রশংসা প্রকাশিত হয়েছিল। অন্যদিকে, জর্জ ক্রামের সেই প্রচলিত গল্পটি জনপ্রিয়তা পায় ১৮৮৫ সালের পর থেকে, আর এক শতাব্দী পরে, একটি বিজ্ঞাপনচিত্রে কর্নেলিয়াস ভ্যান্ডারবিল্টের নাম জুড়ে দেওয়া হয় এই গল্পে।
তবে এই গল্পের ঐতিহাসিক সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও, আলুর চিপসকে জনপ্রিয় করে তুলতে জর্জ ক্রামের অবদান অস্বীকার করার উপায় নেই। ১৮৬০ সালে তিনি নিজেই একটি রেস্টুরেন্ট খুলেছিলেন, যার অন্যতম আকর্ষণ ছিল ‘সারাটোগা চিপস’ এর ঝুড়ি, যা ক্রেতাদের বেশ মন জয় করেছিল।
ফ্রান্সের রান্নাঘর থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্কের রিসোর্ট, কিংবা আয়ারল্যান্ডের ছোট্ট কারখানা থেকে আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ড—আলুর চিপস পেরিয়ে এসেছে এক বিশাল পথ। এ শুধু একটি খাবার নয়, বরং নানা সংস্কৃতির ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এক বিস্ময়কর যাত্রার গল্প।
আলুর মতো সাধারণ এক উপাদান কিভাবে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা, ব্যবসায়িক বুদ্ধিমত্তা এবং মানুষের স্বাদের খোঁজে পরিণত হলো বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় স্ন্যাকসে তা জানলে বিস্মিত না হয়ে পারা যায় না।
আজ বাঙালির ঘরের শিশুর হাতেও যেমন আছে এক প্যাকেট চিপস, তেমনি বিশ্বের প্রতিটি কোণে এটি ছড়িয়ে পড়েছে স্বাদ, গল্প আর ইতিহাস নিয়ে। ভবিষ্যতেও নতুন নতুন স্বাদে, নতুন রূপে এই পটেটো চিপস আমাদের নাস্তার তালিকায় জায়গা করে নেবে, আর আমরা মুগ্ধ হয়ে চিবিয়ে যাবো সেই পরিচিত কুড়কুড়ে শব্দ।
রেফারেন্স
- https://www.quora.com/What-s-your-top-5-most-favorite-British-meals
- https://blog.10minuteschool.com/foods-around-the-world/
- https://archive.roar.media/bangla/main/travel/scotland-is-a-multi-dimensional-country-of-history-and-heritage
- https://archive.roar.media/bangla/main/art-culture/buckingham-palace-the-emblem-of-royalty-of-british-monarch