মনে পড়ে স্কুলের সেই “যেমন খুশি তেমন সাজো” প্রতিযোগিতার কথা? কেউ হতো রাজা, কেউ আবার পুলিশ, কেউবা মাদার তেরেসা! ছোটবেলায় আমরা সবাই হয়তো একবার না একবার এমন কোনো চরিত্রে সাজার আনন্দ নিয়েছি। আজ সেই শখটাই অনেক বড় এক শিল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে; নাম তার কসপ্লে।
“কসপ্লে” শব্দটি এসেছে “কস্টিউম প্লে” থেকে, যার মানে হলো পোশাক পরে কোনো চরিত্রে অভিনয় করা। তবে কসপ্লে শুধু পোশাক পরার মধ্যে সীমাবদ্ধ না। একজন কসপ্লেয়ার সেই চরিত্রের মতো হাঁটেন, কথা বলেন, এমনকি আচরণও করেন!
কোনো কসপ্লেয়ার সেজে উঠতে পারেন অ্যানিমে চরিত্র “নারুটো”, কোনো সুপারহিরো “স্পাইডার-ম্যান”, বা এমনকি ভিডিও গেমের চরিত্র “মারিও”! এসব চরিত্রের উৎস হতে পারে অ্যানিমে, কমিক, সিনেমা, টিভি সিরিজ কিংবা পুরনো লোককথা।
এই শিল্পে মডেলিং, মেকআপ, ফ্যাশন ডিজাইন আর অভিনয় সব একসাথে মিশে যায়। কসপ্লে মানে শুধুই সাজসজ্জা নয়, বরং প্রিয় কোনো চরিত্রের জীবনকে একদিনের জন্য হলেও নিজের ভেতরে ধারণ করা।
বাংলাদেশে কসপ্লে ইভেন্টের ইতিহাস
বাংলাদেশে কসপ্লের যাত্রা খুব বেশি পুরোনো নয়। প্রায় ২০১০–২০১১ সালের দিকে কয়েকজন অ্যানিমে, কমিক বা সুপারহিরো কালচার প্রেমী তরুণ-তরুণী বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিজেদের পছন্দের চরিত্রের মতো সাজতে শুরু করেন। এটিই ছিল দেশের কসপ্লে সংস্কৃতির শুরুর দিন।
এই ধারাবাহিকতায় ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত হয় “MazeCon”, যা বাংলাদেশের প্রথম অ্যানিমে কনভেনশন। এই ইভেন্টটিকে ধরা হয় বাংলাদেশের কসপ্লে ইতিহাসের প্রথম উল্লেখযোগ্য আয়োজন হিসেবে। কিন্তু তখনও কসপ্লে ব্যাপারটা অনেকের কাছেই অজানা ছিল।
পরের বছর, ২০১২ সালে, কসপ্লে জগতে একটি বড় ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশের তরুণ কসপ্লেয়ার শাদাব শায়েরী আহমেদ আন্তর্জাতিক অনলাইন কসপ্লে প্রতিযোগিতা Otaku House Cosplay Idol-এর এশিয়া প্যাসিফিক বিভাগে তৃতীয় স্থান অর্জন করেন। তিনি “নারুতো শিপ্পুডেন” অ্যানিমের ‘আকাতসুকি’ গ্রুপের চরিত্র হিদান হিসেবে কসপ্লে করেন। তার এই অর্জন বাংলাদেশের কসপ্লে কমিউনিটিকে প্রচুর আলোচনায় নিয়ে আসে এবং অনেক তরুণ-তরুণী এতে অনুপ্রাণিত হন।
এরপর ২০১২ সালেই শুরু হয় “ঢাকা কমিকন”। এটি ছিল ঢাকায় কসপ্লে চর্চার জন্য এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।পাশাপাশি এটি কসপ্লের জন্য একটি বড় মঞ্চ হিসেবে পরিচিত হতে থাকে। যেখানে আরও অনেক মানুষ নিজেদের প্রিয় চরিত্রে সাজার সুযোগ পান।
এর পরের বছর, ২০১৩ সালে, গড়ে ওঠে দেশের প্রথম সংগঠিত কসপ্লে গোষ্ঠী BD Cosplayers। এই সংগঠনটি কসপ্লেকে কেবল শখের জায়গায় আটকে না রেখে একটি সৃজনশীল ও সাংগঠনিক রূপ দিতে সাহায্য করে।
এই সময়ে Comic Con, Pop Culture Expo–এর মতো আরও নানা ইভেন্ট নিয়মিত হতে শুরু করে। এসব আয়োজনের মাধ্যমে কসপ্লে দেশের তরুণদের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ধীরে ধীরে কসপ্লে শুধু সাজগোজ নয়, বরং একটা শিল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশের একটি মাধ্যম হয়ে দাঁড়ায়।
কসপ্লে করতে কী কী জিনিস লাগে
কসপ্লে করতে গেলে শুধু পোশাক পরে বসে থাকা চলবে না, এতে লাগে একেবারে শিল্পীর মতো সৃষ্টিশীল মন আর অভিনয় দক্ষতা। যেমন পেশাদার কসপ্লেয়ার ইভ বোরেগার্ড বলেন, “একটা আধা-ভালো সেলাই মেশিন আর প্রচুর নার্ডি উৎসাহই হলো কসপ্লে করার মূল চাবিকাঠি।”
একজন কসপ্লেয়ারের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার হলো তাঁর কল্পনা ও আত্মনিবেদন। অনেকেই নিজে হাতে সেলাই করেন নিজের পোশাক, ঘষে-মেজে তৈরি করেন প্রপস। যেমন, কোনো চরিত্রের তরবারি, জাদু কাঠি, বন্দুক, ঢাল, বই, বা এমনকি কোনো খেলনা প্রাণী; সবই কসপ্লে প্রপসের উদাহরণ হতে পারে। এসব প্রপস কসপ্লের অভিব্যক্তিকে আরও জীবন্ত করে তোলে।
শুধু তাই নয়, চরিত্রটির হাঁটা, কথা বলার ভঙ্গি, হাসি, রাগ, এমনকি প্রয়োজন হলে নাচ বা অ্যাকশনও আয়ত্তে আনতে হয়। এগুলো সাধারণত মূল পোশাকের অংশ না হলেও, সেই চরিত্রেকে বিশ্বাসযোগ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলতে সাহায্য করে।
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে কসপ্লে ট্রেন্ড
বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে কসপ্লে ধীরে ধীরে একটা বড় ট্রেন্ডে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে অ্যানিমে ও জাপানি পপ কালচারের কারণে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো ২০১১ সালে মেজসিটি আয়োজিত মেজকন, যা দেশের প্রথম বড় অ্যানিমে কনভেনশন হিসেবে কসপ্লে সংস্কৃতির জোরদার ভূমিকা রেখেছে। যদিও কসপ্লে আসলে যেকোনো পপ কালচারের চরিত্র নিয়েই করা যায়, বাংলাদেশে ‘গোকু’, ‘ইচিগো’ কিংবা অন্যান্য জনপ্রিয় জাপানি অ্যানিমে চরিত্রের কসপ্লে বেশ বেশি দেখা যায়, আর সুপারম্যান বা গ্রিন ল্যান্টার্নের মত সুপারহিরোদের থেকে এগুলো বেশি জনপ্রিয়।
শাদাব শায়েরী আহমেদের মতো কসপ্লেয়ারদের সাফল্যের পর কসপ্লের চর্চা আরও বিস্তার পেয়েছে। শাদাব ২-ইন-১ অনলাইন কসপ্লে কমিউনিটি ও দোকান ‘অ্যানিফিনিটি’ চালু করে পোশাক ও প্রপসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করেছেন। এতে নতুন তরুণরা কসপ্লেতে অনেক সহজেই যুক্ত হচ্ছে। যদিও তিনি স্বীকার করেন পুরো বাংলাদেশে সবকিছু সরবরাহ করা এখনও চ্যালেঞ্জিং, তবুও এই উদ্যোগ বাংলাদেশের কসপ্লে সম্প্রদায়কে বেশ শক্তিশালী করেছে। ফলে এখন মেজকন, কমিক কন ও পপ কালচার এক্সপোতে প্রতিবারই কসপ্লে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, আর তরুণদের মধ্যে এটি একটা জনপ্রিয় ও সৃজনশীল শখ হিসেবে পরিচিতি পাচ্ছে।
ঢাকার কমিক কন ইভেন্টে কসপ্লে কেমন হয়
ঢাকার কমিক কন ইভেন্টে কসপ্লে যেন এক অন্যরকম জাদুর মেলা। এখানে দেখা মেলে কমিক বইয়ের প্রিয় চরিত্রগুলোর জীবন্ত রুপ।
ঢাকায় এই ইভেন্টে কসপ্লেয়াররা নিজেদের পছন্দের চরিত্রের পোশাক পরে হাজির হন। কেউ হয়ে ওঠেন গোয়েন্দা শার্লক হোমস, কেউ হ্যারি পটারকে পরামর্শ দেন। ব্যাটম্যান থেকে শুরু করে ‘ম্যাট্রিক্স’ সিনেমার নিও পর্যন্ত দেখা যায় এক ছাতার তলায়। দেখা যায়, ডিজনির প্রিন্সেস এলসা কিংবা অ্যানিমে চরিত্র নারুতো সেলফি তুলছেন উৎসবের মাঝামাঝি।
কমিক কন ইভেন্টে কসপ্লের সঙ্গে থাকে নানা আকর্ষণীয় কার্যক্রম। যেমন- কস্টিউম প্লে ফটোগ্রাফি, মিম প্রতিযোগিতা, বাংলা কমিকের কস্টিউম প্লে, আর্ট ও ফেস আর্ট প্রদর্শনী। ব্যান্ড পারফরম্যান্স, বিটবক্সিং, ডিজে সঙ্গীত এবং হিপহপ ও কে-পপ নাচের মাধ্যমে পুরো মঞ্চ যেন এক উৎসবে পরিণত হয়। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR) গেমস ও পণ্যের স্টলগুলোতে জমে ওঠে মানুষের ভিড়।
বিশেষ করে ব্যান্ড সুইসাইডাল পাম্পকিন ও ইমপ্লিসিটের পারফরম্যান্স, নাচিয়ে দল নৃত্যছায়ার নাচ, কোক স্টুডিওর জাদ্রো, গ্লিজমো ও ইনভ্যালিডের বিটবক্সিং এবং ডিজে রিজওয়ানের সঙ্গীতের সঙ্গে উৎসবের আনন্দ দগ্ধ হয়।
টিকিট মূল্য মাত্র ৪০০ টাকা, যা কিশোর ও তরুণদের মধ্যে কসপ্লে ও পপ কালচারের প্রতি আগ্রহ আরো বাড়িয়ে তোলে। ঢাকার কমিক কন ইভেন্টে কসপ্লে তাই শুধু একটি শখ নয়, এটি হয়ে উঠেছে তরুণদের স্বপ্ন ও সৃজনশীলতার মঞ্চ।
বাংলাদেশে কসপ্লে করা নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
বাংলাদেশে কসপ্লে করাকে নিয়ে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি এখনো পুরোপুরি স্বীকৃত নয়। অনেক অভিভাবক এবং বড়দের জন্য এটা নতুন এবং অচেনা একটি বিষয়, তাই তারা কসপ্লে ইভেন্টের গুরুত্ব বা আকর্ষণ বুঝতে পারেন না। বিশেষ করে যারা এ ধরনের পপ কালচার বা কনভেনশনে বড় হননি, তাদের কাছে মনে হয় এটা শুধুই সময় নষ্ট বা অপ্রয়োজনীয় শখ। এই কারণে অনেক সময় পরিবারের সমর্থনও কম থাকে, যা নতুন কসপ্লেয়ারদের জন্য এক বড় বাধা।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো, কসপ্লে বেশ ব্যয়বহুল হতে পারে। যদিও কিছু কসপ্লেয়ার কম বাজেটে নিজে পোশাক বানানোর চেষ্টা করেন, উচ্চমানের উপকরণ ও ডিটেইলড ডিজাইন প্রায়ই হাজার হাজার টাকা খরচ করে। বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এটা অনেকের জন্য সাধ্যের বাইরে। এর ফলে অনেকেই তাদের পছন্দের চরিত্রে সেজে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকেন।
এর পাশাপাশি, ঢাকা বা বড় শহরের কনভেনশনগুলোতে অংশগ্রহণের পরিবেশ অনেক সময় খুব ভিড়পূর্ণ হয়ে ওঠে। যেহেতু এই ইভেন্টগুলো সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, তাই ভিড় নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এতে অনেক সময় অগোছালো পরিস্থিতি, নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং চাপ সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে যারা সামাজিক উদ্বেগ বা লজ্জাবোধে ভোগেন, তাদের জন্য এই ভিড়পূর্ণ জায়গায় থাকা বেশ অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশের বেশিরভাগ কসপ্লেয়ারের তাদের প্রতিভা প্রদর্শনের পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। মেজসিটি বছরে একটি মেজকন এবং কয়েকটি অন্যান্য ইভেন্ট আয়োজন করে এবং সম্প্রতি কমিক কন এবং পপ কালচার এক্সপো শুরু হয়েছে। তবুও বছরে মাত্র তিনটি ইভেন্ট হয়। এই শিল্পের প্রেমীরা একমত যে বড় বা ছোট আকারের আরো ইভেন্ট সাধারণ না হলে, দেশে কসপ্লে শিল্প হিসেবে বিকশিত হওয়ার সম্ভাবনা কম।
কসপ্লে বাংলাদেশের তরুণ সমাজে সৃজনশীলতা, আত্মপ্রকাশ, এবং বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতিচর্চার একটি নতুন মাধ্যম হয়ে উঠছে। এটি শুধু একটি শখ নয়, বরং অভিনয়, ফ্যাশন ডিজাইন, প্রযুক্তি ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সম্মিলিত প্রকাশ। তবে এই শিল্প চর্চার পথ খুব সহজ ছিল না। কসপ্লের পোশাক ও সরঞ্জাম অনেক সময় বিদেশ থেকে আনতে হতো, যা ছিল ব্যয়বহুল। অনেকেই নিজের হাতে তৈরি করেছেন পোশাক, কেউ কেউ আবার বিদেশ থেকে আনিয়েছেন। নতুন কসপ্লেয়ারদের চরিত্র বাছাই থেকে শুরু করে উপকরণ জোগাড় পর্যন্ত অনেক সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। তবুও, সেই সব কষ্টকে ছাপিয়ে গেছে ভালোবাসা ও উৎসাহ।
আজও কসপ্লে ইভেন্ট বাংলাদেশে খুব বেশি হয় না। বছরে মাত্র কয়েকটি বড় ইভেন্ট থাকে। তবুও, দেশের কসপ্লে সংস্কৃতি ধীরে ধীরে এগিয়ে যাচ্ছে। তরুণদের আগ্রহ আর আন্তর্জাতিক যোগাযোগের ফলে এই শিল্প ভবিষ্যতে আরও বড় জায়গা পাবে, এমনটাই আশাবাদী কসপ্লে অনুরাগীরা
তথ্যসূত্র-
- https://www.thedailystar.net/cosplay-a-bangladeshi-perspective-31244
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%87-%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A7%9F%E0%A6%A4%E0%A6%BE-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%9A%E0%A7%8D%E0%A6%9B%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A6%B8%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B2%E0%A7%87
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/vzcto2111d