Image default
জীবনযাপনযাপন

হতাশা, একাকীত্ব আর ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল: কীভাবে সামলাবেন?

চারপাশে সবাই আছে, তবুও আপনি একা। কোনো কিছুতেই আনন্দ বা দুঃখ পাচ্ছেন না, এটিই ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল’, যা এক গভীর মানসিক শূন্যতার অনুভূতি। রোমান্টিক সম্পর্ক, পুরনো বন্ধুত্ব কিংবা এই জীবন, সবকিছুকেই তখন অর্থহীন মনে হয়। জানুন, কেন এই অবস্থা তৈরি হয় এবং এই অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসার কার্যকরী উপায়গুলো কী কী।

‘স্বপ্ন নয় – শান্তি নয় -ভালোবাসা নয়,

হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;

আমি তারে পারি না এড়াতে,

সে আমার হাত রাখে হাতে,

সব কাজ তুচ্ছ হয় – পণ্ড মনে হয়,

সব চিন্তা – প্রার্থনার সকল সময়

শূন্য মনে হয়,

শূন্য মনে হয়।’

বিখ্যাত কবি জীবনানন্দ দাশের বোধ কবিতার মধ্যেই ইমশনাল ব্ল্যাকহোলের এক গভীর সংজ্ঞা পাওয়া যায়। মহাবিশ্বের ব্ল্যাকহোলের কথা আমরা সবাই জানি, এটি এমন এক মহাকর্ষীয় শক্তি, যা তার কাছাকাছি আসা সবকিছুকে নিজের গভীরে টেনে নেয়। আমাদের মনের জগতও কিন্তু মহাবিশ্বের চেয়ে কম রহস্যময় নয়। এই মনের গহীনেও আছে এমন এক ব্ল্যাকহোল যা আমাদের অনুভূতিকে শুষে নিয়ে এক গভীর শূন্যতার মধ্যে নিক্ষেপ করে? তা হোক পরম আনন্দের কোন অনুভূতি কিংবা চরম কষ্টের কোন উপলব্ধি। 

মানুষের মনের এই অবস্থাকে মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন ‘ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল’ (Emotional Black Hole) বা মানসিক শূন্যতা। এটি সাধারণ মন খারাপ বা দুঃখের চেয়েও অনেক বেশি গভীর এবং ভয়ঙ্কর একটি অবস্থা। যখন আপনি কোনো কিছুতেই কিছু অনুভব করেন না; না আনন্দ, না কষ্ট, না রাগ; তখনই আপনি এই মানসিক ব্ল্যাকহোলের গভীরে তলিয়ে যেতে শুরু করেন। 

আজকের লেখায় আমরা এই জটিল মানসিক অবস্থার বিষয়টি বিশ্লেষণ করব এবং এর থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কিছু কার্যকরী ও মনস্তাত্ত্বিক উপায় নিয়ে আলোচনা করব।

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল কী এবং কেন এটি তৈরি হয়?

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল মনোবিজ্ঞানের কোন প্রাতিষ্ঠানিক টার্ম না হলেও, এটি একটি শক্তিশালী রূপক হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা একজন ব্যক্তির মানসিক অসাড়তা বা অনুভূতিহীনতাকে (Emotional Numbness) প্রকাশ করে। এটি এমন এক অবস্থা, যেখানে একজন মানুষ তার নিজস্ব আবেগ-অনুভূতি এবং চারপাশের জগৎ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বোধ করে।

মনবিজ্ঞানীরা বলছেন, মানুষের মনের এই চরম অবস্থার পেছনে থাকতে পারে এক বা একাধিক কারণ। যেমন-

দীর্ঘমেয়াদী হতাশা (Depression): হতাশা শুধু মন খারাপ থাকা নয়। এর একটি প্রধান লক্ষণ হলো ‘অ্যানহেডোনিয়া’ (Anhedonia), যার মানে হলো, যে কাজগুলো আগে আনন্দ দিত, সেগুলোতে আর কোনো আনন্দ খুঁজে না পাওয়া। দীর্ঘ সময় ধরে হতাশায় ভুগতে থাকলে, তা ধীরে ধীরে সব অনুভূতিকে ভোঁতা করে দিয়ে এক মানসিক শূন্যতা তৈরি করতে পারে।

গভীর মানসিক আঘাত (Trauma): কোনো বড় দুর্ঘটনা, প্রিয়জনের মৃত্যু, শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন; এই ধরনের আকস্মিক এবং তীব্র আঘাত আমাদের মনকে এতটাই বিপর্যস্ত করে দেয় যে, মস্তিষ্ক নিজেকে রক্ষা করার জন্য সব ধরনের অনুভূতিকে ব্লক করে দেয়। এটি একটি ডিফেন্স মেকানিজম, যা সাময়িকভাবে কষ্ট থেকে মুক্তি দিলেও, দীর্ঘমেয়াদে ব্যক্তিকে এক অনুভূতিহীন জগতে ঠেলে দেয়।

প্রচণ্ড মানসিক চাপ এবং বার্নআউট (Burnout): একটানা কাজের চাপ, পড়াশোনার চাপ বা সম্পর্কের টানাপোড়েনে থাকতে থাকতে যখন একজন মানুষের মানসিক শক্তি পুরোপুরি শেষ হয়ে যায়, তখন সে এক ধরনের ‘শাটডাউন’ মোডে চলে যেতে পারে।

একাকী বসে আছে যুবক

দীর্ঘস্থায়ী একাকীত্ব: মানুষের সাথে সংযোগের অভাব, যোগাযোগ না করা কিংবা সবসময় একা থাকতে চাওয়া,  আমাদেরকে মানসিকভাবে নিঃস্ব করে দেয়। দীর্ঘ সময় ধরে একা থাকতে থাকতে এমন অবস্থা হতে পারে। তবে অনেক সময় সম্পর্কের মধ্যে থেকেও যথপযুক্ত সঙ্গীর অভাবে একজন মানুষ একাকীত্ব অনুভব করতে করতে একজন ব্যক্তি ধীরে ধীরে এই ইমোশনাল ব্ল্যাকহোলের শিকার হতে পারে।

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোলের লক্ষণ: আপনিও কি এর শিকার?

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোলের লক্ষণগুলো সবসময় স্পষ্টভাবে প্রকাশ পায় না। নিচে কিছু সাধারণ লক্ষণ দেওয়া হলো, যা আপনাকে এই অবস্থাটি অনুভব করতে সহায়ক হতে পারে:

অনুভূতিহীনতা: কোনো কিছুতেই ভালো বা খারাপ, কোন ধরণের তীব্র অনুভূতি কাজ না করা। সুখবর শুনেও আনন্দিত না হওয়া, বা দুঃসংবাদেও কষ্ট না পাওয়া।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা: বন্ধু, পরিবার বা প্রিয়জনের কাছ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া। সামাজিক অনুষ্ঠানে যেতে ইচ্ছা না করা।

বন্ধুদের আড্ডা

উদ্দেশ্যহীনতাঃ  জীবনকে অর্থহীন এবং উদ্দেশ্যহীন মনে হওয়া। সকালে ঘুম থেকে ওঠার কোনো কারণ খুঁজে না পাওয়া।

স্থবিরতা: কোনো কিছু করার শক্তি বা ইচ্ছা খুঁজে না পাওয়া। ঘণ্টার পর ঘণ্টা শুয়ে-বসে কাটিয়ে দেওয়া।

শারীরিক লক্ষণ: অবিরাম ক্লান্তি, ঘুমের সমস্যা (খুব বেশি বা খুব কম ঘুমানো), এবং খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন।

সম্পর্কে উদাসীনতা: বন্ধুবান্ধব, প্রিয়জনের প্রতি কোনো আবেগ অনুভব না করা। তাদের সাথে কথা বলতে বা সময় কাটাতে ইচ্ছা না করা।

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল থেকে বেরিয়ে আসার কার্যকরী উপায়

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল থেকে বেরিয়ে আসা কঠিন হলেও এটি অসম্ভব কোন বিষয় নয়। এর জন্য প্রয়োজন ধৈর্য, সহানুভূতি এবং কিছু নির্দিষ্ট কৌশল। 

নিচে এমনই কিছু সহায়ক উপায় নিয়ে আলোচনা করা হলো: 

১. অনুভূতিকে স্বীকার করে নেওয়া

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল ঠেকে বেরিয়ে আসার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো, নিজের অবস্থাকে স্বীকার করে নেওয়া। “আমি কিছুই অনুভব করছি না” বা “আমি অনুভূতিহীন হয়ে গেছি”, এই কথাটি নিজেকে বলা খুবই জরুরি। নিজের অবস্থাকে অস্বীকার করলে বা এর জন্য নিজেকে দোষারোপ করলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। বুঝুন যে, এটি আপনার কোনো দুর্বলতা নয়, এটি একটি মানসিক অবস্থা, যা থেকে বেরিয়ে আসা সম্ভব।

কান্নারত অবস্থায় বান্ধবীর সাথে কথা বলছে তরুনী

২. ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে রুটিনে ফেরা

মানসিক শূন্যতা আমাদের দৈনন্দিন রুটিনকে নষ্ট করে দেয়। তাই, খুব ছোট ছোট পদক্ষেপের মাধ্যমে একটি সাধারণ রুটিনে ফেরার চেষ্টা করুন। যেমন-

  • প্রতিদিন সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিছানা ছাড়ার চেষ্টা করুন, এমনকি যদি কোনো কাজ নাও থাকে।
  • বিছানা গোছানোর মতো একটি ছোট কাজ দিয়ে দিন শুরু করুন। এই ছোট কাজ আপনাকে দিনের বাকি কাজগুলো করার জন্য মানসিক শক্তি জোগাবে।
  • প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে খাবার খান, গোসল করুন, ঘুমাতে যান। এই ছোট ছোট রুটিনগুলো আপনার জীবনে আবার শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনবে।

৩. শরীরকে সচল করুন (Activate Your Body):

মন এবং শরীরের মধ্যে একটি গভীর সংযোগ রয়েছে। মন যখন অসাড় হয়ে যায়, তখন শরীরকে সচল করার মাধ্যমে মনে আবার অনুভূতি ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যেমন- 

  • প্রতিদিন অন্তত ১৫-২০ মিনিট হাঁটুন, বিশেষ করে ভোরের আলোয়। হাঁটার সময় গান বা পডকাস্ট না শুনে, চারপাশের প্রকৃতির শব্দ এবং নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসের উপর মনোযোগ দিন।
  • হালকা ব্যায়াম, যোগব্যায়াম বা স্ট্রেচিং করুন। শারীরিক ক্রিয়াকলাপ মস্তিষ্কে এন্ডোরফিনের মতো ‘ভালো অনুভূতির’ হরমোন নিঃসরণ করে, যা মানসিক অবস্থার উন্নতিতে সাহায্য করে।

৪. পঞ্চ ইন্দ্রিয়কে জাগিয়ে তুলুন (Engage Your Senses):

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল আমাদের জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। এই বিচ্ছিন্নতা কাটানোর সেরা উপায় হলো, আমাদের পাঁচটি ইন্দ্রিয়কে (দেখা, শোনা, গন্ধ, স্বাদ, স্পর্শ) সচেতনভাবে ব্যবহার করা। একে গ্রাউন্ডিং টেকনিক (Grounding Technique) বলা হয়। যেমন- খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটুন, ঠাণ্ডা পানি দিয়ে মুখ ধোন, বা একটি নরম কম্বল গায়ে জড়ান। এর মাধ্যমে স্পর্শের অনুভূতি জাগ্রত হবে। মাঝে মাঝে আপনার প্রিয় কোনো খাবার বা ফলের স্বাদ গ্রহণ করুন। এতে আপনার স্বাদ ফিরতে শুরু করবে। মন না চাইলেও নিজেকে আগ্রহী করার চেষ্টা করুন। 

এভাবে ৫টি ইন্দ্রিয়কে যথাযথভাবে ব্যবহারের মাধ্যমে এই কৌশলগুলো আপনার ভোতা হয়ে যাওয়া অনুভূতিকে ধীরে ধীরে সংবেদনশীল করে তুলবে। 

৫. সাইকিয়াট্রিস্টের সাহায্য নিন (Seek Professional Help):

যদি আপনার মানসিক শূন্যতা দীর্ঘস্থায়ী হয় এবং আপনার দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করে, তবে আপনার উচিত হবে একজন মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বা থেরাপিস্টের সাহায্য নেওয়া। একজন সাইকিয়াট্রিস্ট আপনাকে এই অবস্থার পেছনে থাকা মূল কারণগুলো খুঁজে বের করতে এবং তা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সঠিক কৌশল শেখাতে সাহায্য করতে পারেন।

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল প্রায়শই হতাশা বা ট্রামার মতো গভীর মানসিক সমস্যার প্রাথমিক লক্ষণ হিসেবে দেখা দিতে পারে। তাই এই সমস্যাকে হেলাফেলা না করে প্রথমে নিজের চেষ্টা করা উচিত এমন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে। যদি নিজের প্রচেষ্টায় কন ফল না আসে, আপনার উচিত ডাক্তার বা সাইকিয়াট্রিস্টের পরামর্শ নেওয়া। তবে ভাববেন না, আপনি পাগল হয়ে গেছেন বা জটল কোন সমস্যার মুখে পড়েছেন। আমাদের শরীরেও যেমন অসুখ হয়, অসুখ হতে পারে আমাদের মনেও। এতে ঘাবড়ে যাবার কিছু নেই। 

ইমোশনাল ব্ল্যাকহোল এক অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো, যার মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলা খুব সহজ। কিন্তু মনে রাখতে হবে, প্রতিটি সুড়ঙ্গের শেষেই আলো থাকে। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার যাত্রাটি সময়সাপেক্ষ হলেও এর জন্য প্রয়োজন নিজের প্রতি সহানুভূতি এবং সঠিক পদক্ষেপ। ছোট ছোট রুটিন, শারীরিক ক্রিয়াকলাপ, পঞ্চইন্দ্রিয়ের ব্যবহার এবং প্রয়োজনে পেশাদার সাহায্য,; এই সবকিছু মিলেই আপনাকে ধীরে ধীরে সেই অন্ধকারের গহ্বর থেকে আলোর জগতে ফিরিয়ে আনবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

Time Management ভুলে যাও, আজ থেকে Energy নিয়ন্ত্রণ করো!

ইম্পোস্টার সিনড্রোম কীভাবে সফলতার পথে বাধা সৃষ্টি করে?

মাত্র ৫ মিনিটে স্ট্রেস কমাবেন কীভাবে? বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সহজ উপায়

রিজওয়ানা রহমান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More