রাত ঘনিয়ে আসে, চারপাশ নিস্তব্ধ হয়ে যায়, কিন্তু আপনার চোখে ঘুম নেই। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ করেন, মোবাইল ঘাঁটেন, ঘড়ির কাঁটা গুনে যান, তারপরও চোখে ঘুম আসে না। ‘হোয়াই উই স্লিপ’ বইয়ের লেখক অধ্যাপক ওয়াকার লিখেছেন, ‘বিশ্বের একটা বিশাল অংশ অন্ধকারে জেগে থাকে। যে ঘুম তাদের নষ্ট হচ্ছে, সেটা যে পূরণ করা দরকার, সেটা তারা ভাবে না। তারা মনে করে, ‘যা গেছে তা গেছে।’
রাতে ঘুম না আসা বা অনিদ্রা খুবই পরিচিত একটি সমস্যা, যাকে আমরা বেশিরভাগ সময়ই গুরুত্বের সাথে নিই না। সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির কারণে অনিদ্রার সমস্যা দিনে দিনে ভয়ংকর আকার ধারণ করছে। নিজেদের অজান্তেই দেরি করে ঘুমানোর অভ্যাসকে নিজের জীবনে স্থায়ী করে ফেলছি আমরা। অথচ এটি যে এক পর্যায়ে জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে মাথাব্যথাও খুব একটা দেখা যায় না।
অনিদ্রার সমস্যা কেন হয়?
ঘুম না হওয়ার কারণ ও সমাধান খুঁজতে হলে প্রথমে বুঝতে হবে ঘুমের সমস্যা কাদের হয় এবং কেন হয়।
সাধারণত পূর্ণবয়স্ক মানুষদের ৭-৮ ঘণ্টা, শিশুদের ৯-১৩ ঘণ্টা, নবজাতক বাচ্চাদের ১২-১৭ ঘণ্টা ঘুম প্রয়োজন। ঘুমানোর মাধ্যমে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, টক্সিন নামক পদার্থ শরীর থেকে বের করে দিয়ে কর্মক্ষমতাও বাড়ে। সুতরাং পরবর্তী দিনের শক্তি ও দক্ষতার অনেকটাই নির্ভর করে ব্যক্তির পর্যাপ্ত ঘুমের ওপর।
রাতে ঘুম না আসা বা আসলেও বারবার ভেঙ্গে যাওয়াকে বলা হয় ইনসমনিয়া বা অনিদ্রা রোগ। যার ফলে দিনের বেলা ঘুমোনো, সারাদিন ঝিমুনি ভাব, কাজে মনোযোগ না দিতে পারা, সারাদিন মেজাজ খিটখিটে ও বিষণ্ণ হয়ে থাকার মত ঘটনা ঘটতে পারে। শিশু থেকে বৃদ্ধ সবারই ইনসমনিয়া হতে পারে। তবে বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঘুমের হার কমে যাওয়া বা ঘুম পাতলা হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দেয়।
অনিদ্রা বা ঘুমের সমস্যা হওয়ার পেছনে বিভিন্ন কারণ প্রভাবক হিসেবে কাজ করে।
যেমন-
-অতিরিক্ত মানসিক চাপ বা দুশ্চিন্তা
-মোবাইল, ল্যাপটপ বা টিভি স্ক্রিনে বেশি সময় কাটানো
-অসামঞ্জস্যপূর্ণ ঘুমের রুটিন
-ক্যাফেইন বা চা-কফি অতিরিক্ত গ্রহণ করা
-নানাবিধ শারীরিক অসুস্থতা যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদযন্ত্রের দূর্বলতা
-অতিরিক্ত শব্দ বা আলো
-অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাস
দ্রুত ঘুমানোর উপায় কী?
চলুন দেখে নিই ঘুমের সমস্যা দূর করার কয়েকটি ঘরোয়া উপায়-
রাত জেগে কাজ না করা
যারা রাত জেগে কাজ করেন তারা অনেক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়েন। রাতে কাজ করে তারা দিনে ঘুমিয়ে রাতের ঘুমের অভাব পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। কারণ সাধারণত তারা দিনের বেলার ঘুম কখনোই তেমন গভীর হয় না, এবং তা রাতের ঘুমের সুফল দিতে পারে না শরীরকে। হার্ভাডের এক গবেষণা বলছে, রাতে কাজ করা লোকজনের অনেকেই নিশাচর হয়ে যান। তারা কিছুতেই দিনের আলোয় বের হতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন না।
প্রতিদিন একই সময় ঘুমোতে যাওয়া
প্রতিদিন রাতে নির্দিষ্ট সময়ে ঘুমাতে যেতে হবে এবং সকালে একটি নির্দিষ্ট সময়ে বিছানা জেগে উঠতে হবে। প্রতিদিন একই সময়ে ঘুম থেকে ওঠা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এটা ঘুমানোর সময়কালকে নিয়মিত রাখে এবং শরীরও সময়ের সঙ্গে অভ্যস্ত হতে পারে।
চা-কফি থেকে দূরে থাকা
চা-কফি খেলে অনেকেরই ঘুমের সমস্যা হয়৷ শুধু চা-কফি নয় যেকোনো কোমল পানীয়ও ঘুমের সমস্যার কারণ হতে পারে। প্রফেসর ওয়াকার বলছেন, ঘুমানোর সময়ে থেকে ১২ ঘণ্টা আগে এসব খাওয়া বন্ধ করা উচিত। কেননা এর প্রভাব শরীরে থেকে যায় দীর্ঘ সময়।
দূরে রাখুন ফোন ল্যাপটপ
আমরা অনেকেই বিশ্রাম নিতে কিংবা ঘুমের আগে ফেসবুক থেকে ঢু মেরে আসি। কিন্তু এতে ঘুম আসার পরিবর্তে মস্তিষ্ককে উত্তেজিত করে চোখ থেকে ঘুম তাড়িয়ে দেয়। তাই ঘুমের সমস্যা দূর করতে চাইলে দীর্ঘসময় ধরে মোবাইল, কম্পিউটার, ল্যাপটপ ইত্যাদি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন।
খাদ্যাভ্যাস
আমরা অনেকেই জানিনা, ঘুমের সমস্যার পেছনে খাদ্যাভাসের ভূমিকা অনেক। যারা ইনসমনিয়ায় ভুগছেন তাদের জন্য খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনা ঘুমের জন্য সহায়ক হতে পারে।
ম্যাগনেসিয়ামযুক্ত খাবার
ম্যাগনেসিয়াম হলো এমন একটি খনিজ পদার্থ যা পেশীকে শিথিল করতে এবং স্ট্রেস কম করতে সাহায্য করে। ডার্ক চকোলেট, বাদাম, অ্যাভোকাডো এগুলোতে ম্যাগনেসিয়াম আছে। রাতে এগুলো খেলে ভালো উপকার পাবেন।
মেলাটোনিনযুক্ত খাবার
মেলাটোনিন শুধু ঘুম আসতে নয়, ঘুম দীর্ঘস্থায়ী করতেও সাহায্য করে। আমরা সালাদ হিসেবে যা খাই যেমন টমেটো, শসা, ব্রোকোলি, সরিষা, আখরোট, বেদানা ইত্যাদিতে মেলাটোনিন থাকে। প্রতিদিনের খাবারে সবজিগুলো যোগ করলে ঘুমের সমস্যা কেটে যাবে৷
কলা
অনিদ্রা কমাতে কলা খুবই কার্যকর৷ কলাতে আছে ম্যাগনেশিয়াম ও পটাশিয়াম যা মাংসপেশি শিথিল করে দ্রুত ঘুম আনয়নে সাহায্য করে৷
গরম দুধ
অনিদ্রা দূর করতে গরম দুধের কোনো বিকল্প নেই। গরম দুধে থাকে ট্রিপটোফ্যান নামে এক ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিড। যা সিরোটোনিন হিসেবে কাজ করে আর এই সিরোটোনিন ঘুম আনতে খুবই সহায়ক।
মধু
মধুকে বলা হয় সর্বরোগের মহৌষধ। এক চামচ মধু ভালো ঘুমের জন্য খুবই সহায়ক কেননা এটি শরীরে ইনসুলিনের মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে। তাছাড়া মানসিক চাপ সৃষ্টিকারী হরমোন কমাতেও মধুর জুড়ি নেই।
দ্রুত ঘুম আসার জন্য গড়ে তুলুন কিছু অভ্যাস
পৃথিবীজুড়ে ১৫৩টি গবেষণা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কম ঘুমের কারণে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ এবং মোটা হয়ে যাবার সম্পর্ক আছে। প্রায় ৫০লাখ মানুষের উপর এসব গবেষণা চালানো হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, একটানা কয়েক রাত যদি ঘুম কম হয় তাহলে সেটি একজন ব্যক্তিকে ডায়াবেটিসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে পারে। এ ধরনের নিদ্রাহীনতা রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে শরীরের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।
তবে এই সমস্যা দেখা দেওয়ার শুরুতেই যদি কিছু উপায় অবলম্বন করা যায় তবে, অনিদ্রা থেকে খুব সহজেই মুক্তি পাওয়া সম্ভব। কিছু ঘরোয়া চিকিৎসা আছে যেগুলো গ্রহণ করে আপনি এ সমস্যা থেকে মুক্তি পেতে পারেন-
১. ঘুমানোর আগে গরম পানিতে পা ভেজানো
ঘুমানোর আগে হালকা গরম পানিতে ১০-১৫ মিনিট পা ভিজিয়ে রাখলে রক্তসঞ্চালন ভালো হয়, শরীর শিথিল হয় এবং ঘুম দ্রুত আসে। এটা একটি পুরনো কিন্তু কার্যকর ঘুমের টিপস।
২. ধ্যান বা মেডিটেশন
প্রতিদিন রাতে ঘুমানোর আগে মাত্র ১০ মিনিট ধ্যান করুন। গভীর নিঃশ্বাস নিন, চোখ বন্ধ করুন, শরীর-মন শান্ত রাখুন। এতে মানসিক চাপ কমবে এবং ভালো ঘুম আসবে।
৩. চমৎকার এক কাপ হারবাল চা
ঘুম ভালো করার উপায় হিসেবে ক্যামোমাইল বা ল্যাভেন্ডার চা খুবই কার্যকর। এগুলো স্নায়ুকে প্রশান্ত করে ও ঘুমে সহায়তা করে। তবে চা-কফি বা ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় থেকে দূরে থাকুন।
৪. নির্দিষ্ট ঘুমানোর রুটিন
প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং সকালে একই সময়ে উঠুন, এমনকি ছুটির দিনেও। এটি শরীরের সার্কাডিয়ান রিদম ঠিক রাখে, যা ঘুমের প্রধান নিয়ন্ত্রক।
৫. ঘুমানোর ১ ঘণ্টা আগে স্ক্রিন বন্ধ করুন
মোবাইল, ট্যাবলেট বা ল্যাপটপের নীল আলো মেলাটোনিন হরমোন নিঃসরণে বাধা দেয়। এই হরমোনই মূলত ঘুমের জন্য দায়ী। তাই ঘুমানোর আগে অন্তত ১ ঘণ্টা স্ক্রিন থেকে বিরত থাকুন।
ঘুমানোর আগে কী করলে ভালো ঘুম হয়?
ঘুমের আগে কিছু ছোট ছোট অভ্যাস আপনার ঘুমের মান উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়াতে পারে। কারণ বারবার ভেঙে যাওয়া ঘুম আপনাকে প্রশান্তি দিতে পারবে না।
ভালো ঘুমের জন্য প্রয়োজনীয় কিছু টিপস-
হালকা স্ট্রেচিং বা ইয়োগা
ঘুমানোর আগে হালকা ব্যায়াম বা স্ট্রেচ করলে পেশি শিথিল হয়, স্নায়ু শান্ত হয়। এ কাজে “চাইল্ড পোজ” বা “লেগস আপ দ্য ওয়াল” পোজ অত্যন্ত কার্যকর।
অন্ধকার ও ঠাণ্ডা পরিবেশ তৈরি করুন
ঘুমাতে যাওয়ার আগে আপনার ঘরটি অন্ধকার করে পর্দা টেনে দিন, সাথে ঘরের তাপমাত্রা হালকা ঠাণ্ডা রাখুন। এমন শান্ত পরিবেশ তৈরি হলে খুব সহজেই ঘুম চলে আসবে আপনার চোখে।
পছন্দের বই পড়ুন
ঘুমাতে যাওয়ার আগে ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রাম স্ক্রল না করে বরং একটি গল্প, উপন্যাস বা মোটিভেশনাল পড়ুন। এতে মন শান্ত হবে এবং ঘুম আসবে সহজে।
ঘুম আসার ঘরোয়া উপায়
ঘরোয়া চিকিৎসার কিছু সাধারণ উপায় আছে যেগুলো অনিদ্রার সমস্যা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবে বহুকাল ধরে ব্যবহৃত হয়ে আসছে।
যেমন-
-ঘুমানোর আগে এক গ্লাস হালকা গরম দুধ পান করুন।
-শোয়ার আগে অল্প পরিমাণে তুলসী পাতার রস মিশিয়ে পানি পান করুন
-নারকেল তেল বা অলিভ অয়েল দিয়ে মাথায় হালকা ম্যাসাজ করুন
-বিছানার ঠিক পাশে একটি সুগন্ধযুক্ত মোমবাতি জ্বালিয়ে রাখতে পারেন, যেমন- ল্যাভেন্ডার বা ভ্যানিলা। এতে ঘুম দ্রুত হবে।
কখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হবেন?
যদি আপনি সব ঘরোয়া উপায় চেষ্টা করেও এক মাসের বেশি সময় ধরে ঘুম না আসার সমস্যায় ভুগে থাকেন, তবে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। কারণ এই অনিদ্রা এখন আর কোন সাধারণ সমস্যার পর্যায়ে নেই বরং এটি রোগের পর্যায়ে চলে গেছে। তবে আশার কথা হলো, এই রোগ কিন্তু অপ্রতিকার্য নয়। অর্থাৎ চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললেই এই সমস্যা থেকে দ্রুত মুক্তি মিলবে।
বিশেষজ্ঞরা প্রয়োজন বুঝে অনিদ্রা চিকিৎসা দিয়ে থাকেন, যার মধ্যে রয়েছে সাইকোথেরাপি, লাইফস্টাইল পরিবর্তন অথবা স্লিপিং পিল সেবন।
দিনের ক্লান্তি দূর করে পরবর্তী দিনের জন্য শক্তি সঞ্চয় করতে একটি প্রশান্তির ঘুম অত্যন্ত জরুরি। তাই ঘুম না আসলে আতঙ্কিত না হয়ে, বরং ঘুমানোর আগে মাত্র ১৫ মিনিট সময় দিন নিজের যত্নে। আপনি দেখবেন, ঘুম আপনার দরজায় কড়া নাড়বে। এই সহজ অথচ কার্যকর উপায়গুলো মেনে চললে প্রথম রাত থেকেই আপনি গভীর ঘুমের স্বাদ পেতে পারেন। মনে রাখবেন, নিজেকে সুস্থ স্বাভাবিক রাখতে ঘুমের কোন বিকল্প নেই।
তথ্যসূত্র –
- https://bangla.thedailystar.net/life-living/food-health/news-380271
- https://www.apolloclinic.com/bn/health-tips/how-to-have-healthy-sleep
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/health/s4tbosy8zi
- https://www.prothomalo.com/lifestyle/health/77ncsxcr32
- https://continentalhospitals.com/bn/blog/tips-and-tricks-for-achieving-quality-sleep/
- https://bangla.thedailystar.net/life-living/news-482471