Image default
প্রযুক্তি

যুদ্ধক্ষেত্র দাপিয়ে বেড়াচ্ছে এআই(AI)

যুদ্ধের ময়দানে ঢুকে পড়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। যুদ্ধ এখন আর শুধু ট্যাঙ্ক-গোলার লড়াই নয়, গোলাবারুদ আর গ্রেনেডের পাশেই আছে আরেক মরণঘাতী অস্ত্র। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স! এআই চালাচ্ছে ড্রোন, নিচ্ছে সিদ্ধান্ত, আর বদলে দিয়েছে যুদ্ধের রীতিনীতি আর ফলাফল। 

২০২১ সালের মে মাসে গাজায় ১১ দিন যুদ্ধ শেষে ইসরায়েলের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, এটি তাদের প্রথম ‘এআই যুদ্ধ’। গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধের মাধ্যমেই প্রথমবারের মত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI এর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম ব্যবহার প্রত্যক্ষ করে পৃথিবী।

গাজায় তীব্র বোমাবর্ষণের বিষয়ে কোনো গোপনীয়তা রাখেনি ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। আক্রমণের শুরুর দিকে দেশটির বিমান বাহিনী প্রধান নিরবচ্ছিন্ন বিমান হামলার কথা জানিয়েছিলেন। তবে বলেছিলেন, তারা কেবল হামাসের সামরিক টার্গেটগুলোতে আঘাত করছেন এবং যোগ করেন যে, তারা ‘সার্জিক্যাল’ নন। তাহলে সেগুলো কী? 

 বলাই বাহুল্য, এই বুদ্ধিমান সত্ত্বা এখন যুদ্ধক্ষেত্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে! যুদ্ধ মানে এখন শুধু সৈন্য আর অস্ত্রের লড়াই নয়, বরং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খেলাও। এতে যুদ্ধ যেমন হয়ে উঠছে আরও দ্রুত আর কৌশলনির্ভর, তেমনই তৈরি হচ্ছে নানা নতুন প্রশ্ন আর আশঙ্কা। 

এই লেখায় আমরা সহজ ভাষায় জানব, কীভাবে AI যুদ্ধের ময়দানে কাজ করছে, যুদ্ধের রীতি-নীতি কীভাবে ওলটপালট করে দিচ্ছে, আর এর কারণে কী কী নতুন সম্ভাবনা বা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। 

সৈন্যের এআই রোবট

যুদ্ধক্ষেত্রে এআই: প্রেক্ষাপট ও প্রযুক্তিগত ধারণা

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা AI শুনতে ভারি শব্দ মনে হলেও, ব্যাপারটা হলো কম্পিউটার বা যন্ত্রকে মানুষের মতো ‘বুদ্ধিমান’ করে তোলা। যেমন ধরুন, নিজে নিজে তথ্য ঘেঁটে শেখা, অনেকটা আমরা যেমন বই পড়ে বা অভিজ্ঞতা থেকে শিখি অথবা ছবি বা শব্দ চিনে ফেলা যেমন কে বন্ধু, কে শত্রু বা কোনো নির্দিষ্ট আওয়াজ। এমনকি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সবচেয়ে ভালো সিদ্ধান্তটা নেওয়া। 

বিজ্ঞানীরা অনেকদিন ধরেই চেষ্টা করছিলেন যন্ত্রকে এমনি বুদ্ধিমান বানানোর। এর আগে শুধু কল্পনাতেই এমন সম্ভব ছিল। যেমন- আমরা টার্মিনেটর মুভিতে দেখেছি যেখানে এআই রোবট বিশেষ মিশন নিয়ে টাইম ট্রাভেল করেছিল। কিন্তু কম্পিউটার যখন দিনে দিনে আরও শক্তিশালী হলো আর ইন্টারনেটের মাধ্যমে বিশাল তথ্যভান্ডার সহজলভ্য হলো, এআই যেন ডানা মেলে উড়ল! 

আর এই উড়ন্ত প্রযুক্তি দেখে সামরিক বাহিনী বা মিলিটারি কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। তারা বুঝলেন, এই প্রযুক্তি তাদের জন্য দারুণ কাজের হতে পারে। শত্রুর অবস্থান দ্রুত খুঁজে বের করা, দুর্গম জায়গায় নজরদারি চালানো, বিশাল পরিমাণ তথ্য চোখের পলকে বিশ্লেষণ করা, নিজেদের সৈন্যদের নিরাপত্তা বাড়ানো, এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে নির্ভুলভাবে অস্ত্র চালাতেও এআই হতে পারে এক মোক্ষম হাতিয়ার। 

এভাবেই কম্পিউটার প্রোগ্রাম আর বুদ্ধিমান অ্যালগরিদম (যা মূলত কিছু নিয়ম বা নির্দেশ যা কম্পিউটারকে কাজ করতে শেখায়) ধীরে ধীরে সামরিক প্রযুক্তির এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠল, যাকে আমরা বলছি মিলিটারি এআই।

এআই চালিত ড্রোন

আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রে এআই-এর বহুমুখী ব্যবহার 

তাহলে, যুদ্ধের ময়দানে এই বুদ্ধিমান যন্ত্র বা এআই ঠিক কী কী কাজ করছে? এর ব্যবহার কিন্তু অনেক! আসুন, কয়েকটা দারুণ উদাহরণ দেখি:

নজরদারি: এমন এক প্রহরী যে কখনো ক্লান্ত হয় না, ঘুমায় না! AI ঠিক এই কাজটাই করে। এটি স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া হাজার হাজার ছবি বা শত্রুর রেডিও সিগন্যাল শুনে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে বের করতে পারে। কোথায় শত্রু লুকিয়ে আছে, বা তারা কী পরিকল্পনা করছে – এসব বোঝার জন্য AI যেন এক সুপার গোয়েন্দা!

স্মার্ট ড্রোন: আগে ড্রোন চালাতে মানুষের দরকার হতো, কিন্তু AI-চালিত ড্রোন নিজে নিজেই উড়তে পারে, শত্রুকে চিনতে পারে, এমনকি আক্রমণের সিদ্ধান্তও নিতে পারে (যদিও এটা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে)। 

যুদ্ধক্ষেত্রে রোবট: খুব বিপজ্জনক জায়গায়, যেমন বোমা নিষ্ক্রিয় করতে বা শত্রুর ঘাঁটির খুব কাছে নজরদারি চালাতে, এখন মানুষের বদলে পাঠানো হচ্ছে এআই রোবট। এরা মাটির নিচে লুকানো মাইন খুঁজে বের করতে বা আহত সৈন্যদের উদ্ধার করতেও সাহায্য করে।

লক্ষ্যভেদী অস্ত্র: এআই এখন মিসাইল বা বোমার ভেতরেও ঢুকে পড়েছে! এর সাহায্যে অস্ত্রগুলো আরও নিখুঁতভাবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারে, ফলে আশেপাশে ক্ষয়ক্ষতি কম হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এগুলোকে বলা হয় ‘স্মার্ট’ অস্ত্র।

ডাটা অ্যানালাইসিস এআই

বিশ্লেষক: যুদ্ধের সময় প্রতি মুহূর্তে হাজারো তথ্য আসে। এত তথ্য দ্রুত বিশ্লেষণ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া মানুষের পক্ষে কঠিন। এখানেই এআই হয়ে ওঠে সেনাপতির সেরা বন্ধু। এটি ডেটা বিশ্লেষণ করে যুদ্ধের সেরা কৌশল বাতলে দিতে পারে, বা শত্রু পরবর্তীতে কী করতে পারে, তা অনুমান করতে সাহায্য করে। যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তৈরি বিশেষ এআই সফটওয়্যার এখন রীতিমতো গেম চেঞ্জার!

লজিস্টিকস ও সাপোর্ট: যুদ্ধ মানে শুধু লড়াই নয়, সৈন্যদের জন্য খাবার, অস্ত্র, রসদ ঠিকঠাক পৌঁছানোও জরুরি। এআই এই সাপ্লাই চেইনকে অনেক সহজ করে দেয়। কখন কোন জিনিস লাগবে, কোন গাড়ি বা প্লেন কখন মেরামত করতে হবে এসবের নিখুঁত হিসাব রাখে এআই।

সাইবার জগতের লড়াই: আজকাল যুদ্ধ শুধু মাঠেই হয় না, ইন্টারনেটেও হয়। এআই একদিকে যেমন নিজেদের কম্পিউটার নেটওয়ার্ককে সাইবার আক্রমণ থেকে বাঁচায়, তেমনি শত্রুর সিস্টেমে দুর্বলতা খুঁজে বের করতেও সাহায্য করে।

এক কথায়, আকাশ থেকে পাতাল, সম্মুখ সমর থেকে সাইবার জগৎ, যুদ্ধের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই এআই তার ছাপ রাখতে শুরু করেছে।

এআই যেভাবে যুদ্ধের কৌশল ও প্রকৃতি বদলাচ্ছে 

এই যে এতসব ক্ষেত্রে AI ব্যবহার হচ্ছে, এর ফলে যুদ্ধের চেহারাটাই কিন্তু আমূল বদলে যাচ্ছে! কীভাবে?

প্রথমত, যুদ্ধের গতি বেড়ে গেছে বহুগুণ। AI যেখানে সেকেন্ডের মধ্যে হাজারো তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে, সেখানে মানুষের সময় লাগে অনেক বেশি। ফলে যুদ্ধক্ষেত্রের পরিস্থিতি খুব দ্রুত বদলায় এবং চোখের পলকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

দ্বিতীয়ত, মানুষের ভূমিকাও পাল্টে যাচ্ছে। হয়তো সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ করার ঝুঁকি কমছে, কিন্তু ড্রোন বা রোবট অপারেটর হিসেবে বা সাইবার যুদ্ধের সৈনিক হিসেবে নতুন ধরনের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে দূরে বসেও অনেকে যুদ্ধের অংশ হয়ে উঠছেন।

তৃতীয়ত, তথ্যই হয়ে উঠছে সবচেয়ে বড় অস্ত্র। কার হাতে কত ডেটা আছে আর কে কত দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে সেই ডেটা ব্যবহার করে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে, তার উপরই নির্ভর করছে জয়-পরাজয়। এআই এই তথ্য বিশ্লেষণকে অন্য মাত্রায় নিয়ে গেছে।

চতুর্থত, AI-চালিত স্মার্ট অস্ত্রের কারণে যুদ্ধ আগের চেয়ে বেশি নিখুঁত হওয়ার কথা বলা হচ্ছে, যাতে সাধারণ মানুষের ক্ষয়ক্ষতি কমানো যায়। যদিও বাস্তবে এটা কতটা সম্ভব বা সবসময় হয় কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

সব মিলিয়ে, AI যুদ্ধের পুরনো নিয়মকানুন আর কৌশলকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। এর ফলে সামরিক কমান্ডারদের নতুন করে ভাবতে হচ্ছে, যুদ্ধের জন্য নতুন নীতি ও পরিকল্পনা তৈরি করতে হচ্ছে। যুদ্ধ এখন শুধু শক্তি বা সাহসের পরীক্ষা নয়, বরং বুদ্ধিমত্তা আর প্রযুক্তিরও লড়াই।

ভবিষ্যতের যুদ্ধক্ষেত্র ও এআই

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ভবিষ্যৎ যুদ্ধ হবে এআইনির্ভর ও দ্রুত। সেখানে তথ্যের সর্বোচ্চ ব্যবহার হবে। কারণ, যুদ্ধক্ষেত্রে এআই সক্ষম অস্ত্র (যেমন, ড্রোনের ঝাঁক) দ্রুত ও ব্যাপকভাবে মোতায়েন করা হলে স্বাধীনভাবে সেই তথ্য মূল্যায়ন করতে মানুষের সময় বা জ্ঞানের সক্ষমতা থাকবে না। উদাহরণস্বরূপ, গাজা যুদ্ধের সময় ইসরায়েল এআই ব্যবহারের কথা বলা যায়। 

যুদ্ধের সময় স্বায়ত্তশাসিত এসব অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা মানুষের থাকবে এই বিভ্রমকে প্রশ্রয় দেওয়ার পরিবর্তে সামরিক বাহিনীকে এখনই স্বায়ত্তশাসিত অস্ত্রের জন্য তাদের মডেলের প্রতি মনযোগী হতে হবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে নীতিনির্ধারক এবং সামরিক নেতাদের এ বিষয়ে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া সময়ের দাবি। 

যুক্তরাষ্ট্রের ঊর্ধ্বতন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা বলেন, এআইকে সরাসরি পদক্ষেপ নেওয়ার পরিবর্তে শুধু পরামর্শ দেওয়ার সক্ষমতা দেওয়া উচিত। কেউ কেউ বলেন, শুধু আত্মরক্ষার জন্য এসব অস্ত্রকে স্বয়ংক্রিয় হওয়ার অনুমতি দেওয়া উচিত। তবে অনেক বিশ্লেষক এর পালটা যুক্তি দিয়ে বলেন, সবচেয়ে পরিশীলিত এআই সিস্টেমও সব সময় সঠিক হবে না। তাই এর নৈতিক ব্যবহারের দিকটিতেই বেশি জোর দিতে হবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধ: আইফোনের দাম কি আকাশছোঁয়া হবে?

স্যাটেলাইটের আদ্যপ্রান্ত- ২০২৫ সালে মহাকাশে কত স্যাটেলাইট?

প্রতারকদের পছন্দ টেলিগ্রাম! কেন স্ক্যামাররা এই অ্যাপ ব্যবহার করে?

শেখ আহাদ আহসান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More