Image default
কী ও কেন

দুই চাকার রহস্য: সাইকেল ও মোটরসাইকেল আসলে কিভাবে ব্যালেন্স করে?

দাঁড় করিয়ে রাখলে যে সাইকেল পড়ে যায়, চলার সময় সেটাই কীভাবে সোজা থাকে? দুই চাকার এই জাদুর পেছনে লুকিয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানের কিছু দারুণ রহস্য। জানুন সাইকেল ও মোটরসাইকেলের ভারসাম্য রক্ষার সেই বৈজ্ঞানিক কৌশল, যা জানলে অবাক হবেন আপনিও। 

ভূমিকা: দুই চাকার যান, এক চলমান বিস্ময়

আমাদের দৈনন্দিন জীবনের এক অতি সাধারণ দৃশ্য—একজন মানুষ সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু এই সাধারণ দৃশ্যটির পেছনে লুকিয়ে আছে এক অসাধারণ বৈজ্ঞানিক রহস্য, যা নিয়ে বড় বড় বিজ্ঞানীরাও শত শত বছর ধরে গবেষণা করেছেন। একবার ভেবে দেখুন, দুটি পাতলা চাকার উপর ভর করে একটি বিশাল মোটরবাইক বা একটি সাইকেল কীভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সোজা হয়ে চলতে পারে? অথচ, এটিকে থামিয়ে দিলেই তা এক নিমিষে পড়ে যায়।

শিশুরা যখন প্রথমবার সাইকেল চালানো শেখে, তখন তাদের পড়ে যাওয়াটাই যেন নিয়ম। কিন্তু একবার শিখে গেলে, আমাদের মস্তিষ্ক আর শরীর স্বয়ংক্রিয়ভাবেই এই অসম্ভব কাজটি করতে থাকে। আমরা তখন বন্ধুদের সাথে গল্প করতে করতে বা গান শুনতে শুনতেও অনায়াসে সাইকেল চালাই। কীভাবে এই ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব হয়?

অনেকেই হয়তো ভাবেন, এর পেছনে চালকের দক্ষতাই একমাত্র কারণ। অথবা হয়তো ছোটবেলায় শুনেছেন যে, চাকার ঘূর্ণনই একে সোজা রাখে। এই ধারণাগুলো আংশিকভাবে সত্য, কিন্তু পুরো রহস্য এর চেয়েও অনেক বেশি চমকপ্রদ। সাইকেলের এই ভেলকিবাজির সাথে জড়িয়ে আছে পদার্থবিজ্ঞানের কয়েকটি মৌলিক নীতি, যেমন- জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট, ট্রেইল বা কাস্টার এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের অবচেতন মনের এক অবিশ্বাস্য কৌশল কাউন্টারস্টিয়ারিং।

আজকের লেখায় আমরা দুই চাকার এই রহস্যময় জগতের গভীরে প্রবেশ করব এবং সহজ ভাষায় জানার চেষ্টা করব, সাইকেল ও মোটরসাইকেল আসলে কীভাবে তাদের ভারসাম্য রক্ষা করে।

সাধারণ ভুল ধারণা: শুধু কি চালকের কেরামতি?

সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানোর সময় চালকের ভূমিকা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। চালক তার শরীরের ওজন ডানে-বামে সরিয়ে এবং হ্যান্ডেল ঘুরিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করেন। কিন্তু এটিই একমাত্র কারণ নয়। যদি তাই হতো, তবে একজন দক্ষ সার্কাস শিল্পীও একটি স্থির সাইকেল বা মোটরসাইকেলের উপর বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারতেন না। আসল রহস্যটি লুকিয়ে আছে যানটির গতি এবং তার গঠনের মধ্যে। যখন একটি দুই চাকার যান চলতে শুরু করে, তখনই পদার্থবিজ্ঞানের কিছু নীতি সক্রিয় হয়ে ওঠে, যা তাকে সোজা থাকতে সাহায্য করে। এগুলো হলো-

জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট

দুই চাকার ভারসাম্য রক্ষার পেছনের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং বহুল প্রচলিত তত্ত্বটি হলো জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট (Gyroscopic Effect)। 

পদার্থবিজ্ঞানের নিয়ম অনুযায়ী, যখন কোনো বস্তু, যেমন- একটি চাকা যখন খুব দ্রুত ঘুরতে থাকে, তখন এটি তার ঘূর্ণন অক্ষের (axis of rotation) পরিবর্তনকে বাধা দেয়। অর্থাৎ, এটি যে অক্ষে ঘুরছে, সেই অক্ষেই ঘুরতে চায়। একটি লাটিম যখন খুব জোরে ঘোরে, তখন যেমন সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, ঠিক একই নীতি এখানেও কাজ করে।

এক্সিস রোটেশন

ঠিক একইভাবে যখন সাইকেল বা মোটরসাইকেলের চাকাগুলো দ্রুত ঘুরতে থাকে, তখন তারা একটি জাইরোস্কোপের মতো আচরণ করে। এই ঘূর্ণায়মান চাকাগুলো যানটিকে ডানে বা বামে পড়ে যেতে বাধা দেয় এবং সাইকেলকে সোজা রাখতে সাহায্য করে। গাড়ির গতি যত বেশি হয়, চাকার ঘূর্ণন তত দ্রুত হয় এবং জাইরোস্কোপিক ইফেক্টও তত শক্তিশালী হয়। একারণেই, খুব কম গতির চেয়ে বেশি গতিতে সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালানো এবং ব্যালেন্স করা অনেক বেশি সহজ।

তবে, আধুনিক গবেষণা বলছে, জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট ভারসাম্যের একটি অংশ মাত্র, কিন্তু এটিই মূল কারণ নয়। বিজ্ঞানীরা এমন সাইকেল তৈরি করেছেন, যেগুলোর চাকার জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট প্রায় শূন্য, কিন্তু এই সাইকেলগুলোও চালানো সম্ভব। 

তার মানে, এর পেছনে নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে আরও বড় কোনো রহস্য। 

কাস্টার বা ট্রেইল (Caster or Trail)

এটি দুই চাকার ভারসাম্যের পেছনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও এই পদ্ধতি নিয়ে খুব কমই আলোচনা হয়৷ এটি মূলত সাইকেল বা মোটরসাইকেলের সামনের চাকার জ্যামিতিক গঠনের সাথে সম্পর্কিত।

আপনি যদি সাইকেলের সামনের চাকাটি লক্ষ্য করেন, তাহলে দেখবেন যে, স্টিয়ারিং অক্ষটি (যে অক্ষ বরাবর হ্যান্ডেলটি ঘোরে) চাকার কেন্দ্রবিন্দুর ঠিক উপর দিয়ে যায় না, বরং কিছুটা সামনে দিয়ে যায়। স্টিয়ারিং অক্ষটিকে যে বিন্দুতে স্পর্শ করে এবং চাকাটিকে যে বিন্দুতে স্পর্শ করে, এই দুই বিন্দুর মধ্যবর্তী দূরত্বকেই বলা হয় ‘ট্রেইল’ (Trail)।

এই ট্রেইলের কারণেই সামনের চাকাটি সবসময় সোজা থাকতে চায়, অনেকটা শপিং কার্টের চাকার মতো। আপনি যদি একটি শপিং কার্টকে ঠেলে দেন, দেখবেন তার চাকাগুলো সবসময় পেছনের দিকে মুখ করে সোজা হয়ে যায়। ঠিক একইভাবে, সাইকেলের সামনের চাকার এই ‘ট্রেইল’, যানটিকে স্বাভাবিকভাবেই সোজা পথে চলতে সাহায্য করে। যখন সাইকেলটি কোনো একদিকে সামান্য হেলে পড়ে, তখন ট্রেইলের কারণেই সামনের চাকাটি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেই দিকে সামান্য ঘুরে যায় এবং সাইকেলটিকে আবার সোজা অবস্থায় ফিরিয়ে আনে। একে বলা হয় সেলফ-স্টেবিলিটি’ (Self-stability)। 

জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট এবং ট্রেইল, এই দুটি মিলে একটি নির্দিষ্ট গতির পর সাইকেল বা মোটরসাইকেলকে প্রায় নিজে থেকেই স্থিতিশীল রাখে।

কাউন্টারস্টিয়ারিং (Countersteering)

এতক্ষণ আমরা জানলাম, একটি চলমান সাইকেল কীভাবে নিজে থেকেই সোজা থাকতে চায়। কিন্তু আমরা যখন এটিকে ডানে বা বামে ঘোরাতে চাই, তখন কী হয়? এখানেই লুকিয়ে আছে দুই চাকার ভারসাম্যের সবচেয়ে বিস্ময়কর কৌশলটি, যার নাম কাউন্টারস্টিয়ারিং।

কাউন্টার স্টিয়ারিং

সহজ কথায়, একটি নির্দিষ্ট গতির উপরে (সাধারণত ঘণ্টায় ৮-১০ কিলোমিটারের বেশি) কোনো দুই চাকার যানকে ডানে ঘোরানোর জন্য, আপনাকে হ্যান্ডেলটি সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে খুব সামান্য সময়ের জন্য বামে ঘোরাতে হয়। আর বামে ঘোরানোর জন্য, হ্যান্ডেলটি সামান্য ডানে ঘোরাতে হয়।

শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও এটাই সত্যি। আপনি যদি সাইকেল বা মোটরসাইকেল চালাতে জানেন, তবে আপনি প্রতিবার বাঁক নেওয়ার সময় অবচেতনভাবেই এই কাজটি করে থাকেন।

এখন প্রশ্ন আসবে, এটা কিভাবে কাজ করে?

ধরুন, আপনি আপনার মোটরসাইকেলটি ডানে ঘোরাতে চান।

১. আপনি হ্যান্ডেলটি খুব সামান্য সময়ের জন্য বাম দিকে ঘোরান।

২. এর ফলে, সামনের চাকাটি বাম দিকে যাওয়ায়, যানটির নিচের অংশ আপনার শরীরের বাইরের দিকে (ডান দিকে) হেলে পড়তে শুরু করে। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায়, এটি কেন্দ্রাতিগ বলের (Centrifugal Force) কারণে হয়।

৩. যানটি যখন ডান দিকে যথেষ্ট হেলে পড়ে, তখন আপনি হ্যান্ডেলটি আবার ডান দিকে ঘুরিয়ে বাঁকটি সম্পন্ন করেন। হেলে পড়ার কারণে তৈরি হওয়া অভিকর্ষ বল (Gravity) এবং বাঁকের কেন্দ্রবিমুখী বল (Centripetal Force) একে অপরকে ভারসাম্য প্রদান করে এবং আপনি নিরাপদে বাঁকটি নিতে পারেন।

কম গতিতে, আমরা শরীরের ওজন সরিয়ে এবং হ্যান্ডেল সরাসরি ঘুরিয়ে বাঁক নিই। কিন্তু গতি বাড়ার সাথে সাথে, কাউন্টারস্টিয়ারিং ছাড়া বাঁক নেওয়া প্রায় অসম্ভব এবং এটি অত্যন্ত বিপজ্জনক। মোটরসাইকেল রেসাররা এই কৌশলটি অত্যন্ত সচেতনভাবে ব্যবহার করেন।

মানুষের মস্তিষ্ক: চূড়ান্ত ব্যালেন্সিং মেশিন

তাহলে দেখা যাচ্ছে, সাইকেলের ভারসাম্য শুধু কোনো একটি নীতির উপর নির্ভরশীল নয়, এটি জাইরোস্কোপিক ইফেক্ট, ট্রেইল এবং কাউন্টারস্টিয়ারিং-এর এক জটিল সমন্বয়। কিন্তু এই সবগুলোকে একসাথে পরিচালনা করে কে?

এর উত্তর হলো, আমাদের মস্তিষ্ক। আমরা যখন সাইকেল চালানো শিখি, তখন আমাদের মস্তিষ্ক ensayo এবং ত্রুটির মাধ্যমে এই সব জটিল পদার্থবিজ্ঞানের নীতিগুলোকে অবচেতনভাবে শিখে নেয়। এটি একটি অবিশ্বাস্য নিউরাল নেটওয়ার্ক তৈরি করে, যা প্রতি মুহূর্তে শরীর এবং সাইকেলের অবস্থান, গতি এবং হেলে পড়া বিশ্লেষণ করে এবং ভারসাম্য রক্ষার জন্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে সবধরনের প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধন করে। একবার শিখে গেলে, এই প্রক্রিয়াটি এতটাই স্বয়ংক্রিয় হয়ে যায় যে, আমাদের আর এটি নিয়ে ভাবতেই হয় না।

নতুনদের জন্য ব্যালেন্স টিপস

শিশুদের জন্য: শিশুদের সাইকেল শেখানোর সময়, প্যাডেল খুলে দিয়ে প্রথমে তাদের পা দিয়ে ঠেলে ঠেলে ব্যালেন্স করতে শেখানো উচিত। এতে তারা প্রথমে ভারসাম্য এবং স্টিয়ারিংয়ের ধারণাটি আয়ত্ত করতে পারে।

মোটরসাইকেলের জন্য: নতুন বাইকারদের জন্য কম গতিতে কোন খোলা জায়গায় ব্যালেন্স অনুশীলন করা জরুরি। শরীরের ওজনের পরিবর্তে, হ্যান্ডেলের সূক্ষ্ম নড়াচড়া এবং থ্রটলের নিয়ন্ত্রণের উপর মনোযোগ দেওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা, কাউন্টারস্টিয়ারিং-এর ধারণাটি বুঝতে হবে এবং এটিকে ভয় না পেয়ে অনুশীলন করতে হবে।

একজন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী সাইকেল চালানো শিখছে

সাইকেল বা মোটরসাইকেলের ভারসাম্য রক্ষা করা কোনো জাদু নয়, এটি পদার্থবিজ্ঞান এবং মানব মস্তিষ্কের এক অসাধারণ সমন্বয়ের ফল। যার মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারি, আপাতদৃষ্টিতে সহজ একটি কাজের পেছনেও কতটা জটিল বিজ্ঞান লুকিয়ে থাকতে পারে। 

তাই, কখনো যদি আপনি কোনো সাইকেল বা মোটরসাইকেলকে অনায়াসে চলতে দেখেন, তখন শুধু তার চালকের দিকেই তাকাবেন না, ভেবে দেখবেন সেই পদার্থবিজ্ঞানের অদৃশ্য শক্তির কথা, যা এই দুই চাকার যানটিকে মাধ্যাকর্ষণের বিরুদ্ধে জয়ী হতে সাহায্য করছে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

গ্রহের গোলাকৃতি : মহাকর্ষ ও প্রকৃতির নিখুঁত গাণিতিক খেলা

আশা রহমান

ভুড়ি, ভাত আর বাঙালি: কেন আমাদের শরীরে এত সহজে চর্বি জমে?

পিঙ্ক ট্যাক্স- কেন নারীদের পণ্যের বেশি দাম দিতে হয়?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More