গোপালগঞ্জ মানেই কি শুধু টুঙ্গিপাড়া? এর বাইরেও লুকিয়ে আছে প্রাচীন জমিদার বাড়ি, মতুয়াদের তীর্থভূমি আর দিগন্তবিস্তৃত বাঁওড়ের অসাধারণ সৌন্দর্য। চলুন, আবিষ্কার করি এক অন্য গোপালগঞ্জকে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকা একটি নাম গোপালগঞ্জ। মধুমতী নদীর তীরে অবস্থিত এই সবুজ-শ্যামল জেলাটি অনেকের কাছে শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান হিসেবে পরিচিত। কিন্তু গোপালগঞ্জের পরিচয় এর চেয়েও অনেক ব্যাপক। এর পরতে পরতে লুকিয়ে আছে ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় সম্প্রীতি এবং প্রকৃতির অসাধারণ রূপ, যা ভ্রমণপিপাসু যেকোনো মানুষের মনকে আকৃষ্ট করতে বাধ্য।
ঐতিহাসিক জমিদার বাড়ি ও প্রাচীন দুর্গ, মতুয়া সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থভূমি থেকে শুরু করে দিগন্তবিস্তৃত বাঁওড়ের শান্ত জলরাশি সব মিলিয়ে গোপালগঞ্জ যেন ইতিহাস ও প্রকৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। যারা শহুরে কোলাহল থেকে বেরিয়ে একটি শান্ত ও স্নিগ্ধ পরিবেশে কয়েকটা দিন কাটাতে চান, তাদের জন্য এই জেলা হতে পারে এক আদর্শ গন্তব্য।
টুঙ্গিপাড়া: একটি জাতীয় স্মৃতির কেন্দ্র
গোপালগঞ্জ ভ্রমণের কথা উঠলে টুঙ্গিপাড়ার নামটি স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। এখানে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিসৌধ অবস্থিত। গোপালগঞ্জ শহর থেকে প্রায় ১৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থানটি জাতীয়ভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা হিসেবে পরিচিত। এখানে আছে –
সমাধিসৌধ কমপ্লেক্স
পুরো কমপ্লেক্সটি একটি পরিকল্পিত এবং গোছানো এলাকা। এর শান্ত ও ভাবগম্ভীর পরিবেশ দর্শনার্থীদের জন্য এক বিশেষ অনুভূতি তৈরি করে। মূল সমাধিসৌধটি সাদা মার্বেল পাথরে নির্মিত, যার স্থাপত্যশৈলী বেশ দৃষ্টিনন্দন। এখানে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার বাবা-মায়ের কবর পাশাপাশি অবস্থিত। দর্শনার্থীরা এখানে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
জাদুঘর, গ্রন্থাগার ও অন্যান্য সুবিধা
কমপ্লেক্সের ভেতরে একটি জাদুঘর রয়েছে, যেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিসপত্র এবং তার জীবনের নানা মুহূর্তের ছবি সংরক্ষিত আছে। পাশেই একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগারও রয়েছে, যেখানে ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে। দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য এখানে একটি ক্যাফেটেরিয়া এবং স্যুভেনিয়ারের দোকানও নির্মাণ করা হয়েছে।
পৈতৃক বাড়ি
কমপ্লেক্সের ভেতরেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পৈতৃক বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়, যা দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত। এই সাধারণ বাড়িটি দেখলে তার জীবনের শুরুর দিককার পরিবেশ সম্পর্কে একটি ধারণা পাওয়া যায়।
উলপুর জমিদার বাড়ি: কালের সাক্ষী এক রাজকীয় ধ্বংসাবশেষ
যারা ইতিহাস এবং পুরনো দিনের স্থাপত্যের ধ্বংসাবশেষ দেখতে ভালোবাসেন, তাদের জন্য উলপুর জমিদার বাড়ি একটি অসাধারণ গন্তব্য। গোপালগঞ্জ জেলা সদর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে উলপুর গ্রামে এই জমিদার বাড়িটি অবস্থিত। প্রায় এক শতাব্দী আগে এই অঞ্চলের প্রতাপশালী হিন্দু জমিদাররা এই বিশাল স্থাপনাগুলো নির্মাণ করেছিলেন।
কথিত আছে, উলপুরের জমিদারেরা ছিলেন ‘একশত ঘর শরীক’, অর্থাৎ তাদের বংশের প্রায় একশটি পরিবার এখানে একটি বিশাল এলাকা জুড়ে বসবাস করত। প্রায় ২০০ একর জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই জমিদার বাড়িতে এখনো বেশ কয়েকটি বিশাল দালান কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এর মধ্যে ৭-৮টি দোতলা দালান রয়েছে, যেগুলোর স্থাপত্যশৈলীতে ইউরোপীয় এবং মুঘল রীতির এক দারুণ মিশ্রণ দেখা যায়। যদিও অযত্ন আর অবহেলায় দালানগুলোর এখন জীর্ণ দশা, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে, বট-পাকুড়ের শিকড় দেয়ালের গভীরে প্রবেশ করেছে, তবুও এর বিশালতা এবং খিলান ও স্তম্ভের কারুকার্যময় গঠন সহজেই দর্শনার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
ওড়াকান্দি ঠাকুরবাড়ি: মতুয়া সম্প্রদায়ের পবিত্র তীর্থভূমি
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলায় অবস্থিত ওড়াকান্দি গ্রামটি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মতুয়া সম্প্রদায়ের কাছে একটি অত্যন্ত পবিত্র তীর্থস্থান। এখানেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন মতুয়া ধর্মের প্রবর্তক এবং উনিশ শতকের অন্যতম সমাজ সংস্কারক শ্রী শ্রী হরিচাঁদ ঠাকুর। তার দর্শন ছিল মূলত নিপীড়িত ও নিম্নবর্ণের মানুষের মুক্তি এবং ভক্তির মাধ্যমে ঈশ্বর লাভ। এখানে আছে –
মন্দির ও আধ্যাত্মিক পরিবেশ
এখানে হরিচাঁদ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত একটি সুন্দর মন্দির রয়েছে, যেখানে ভক্তরা পূজা-অর্চনা করেন। পুরো ঠাকুরবাড়ি এলাকাটি একটি শান্ত ও আধ্যাত্মিক আবহে পরিপূর্ণ। মন্দিরের স্থাপত্য এবং চারপাশের নির্মল পরিবেশ দর্শনার্থীদের মনে এক অন্যরকম প্রশান্তি এনে দেয়।
বারুণী মেলা ও কামনা সাগর
প্রতি বছর চৈত্র মাসে বারুণী স্নান ও মেলা উপলক্ষে বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ মতুয়া ভক্ত এখানে সমবেত হন। মন্দিরের পাশে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, যাকে ‘কামনা সাগর’ বলা হয়। ভক্তরা বিশ্বাস করেন, এই পুকুরে স্নান করলে তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। মেলার সময় পুরো ওড়াকান্দি ঢোল, কীর্তন আর ভক্তদের পদচারণায় এক আনন্দময় মিলনমেলায় পরিণত হয়।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
ধর্মীয় গুরুত্বের পাশাপাশি, ওড়াকান্দির সামাজিক এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্যও অপরিসীম। এটি দুই বাংলার মানুষের মধ্যে একটি সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন হিসেবে কাজ করে। ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই ঠাকুরবাড়ি পরিদর্শন করলে স্থানটি আন্তর্জাতিকভাবে আরও বেশি পরিচিতি লাভ করে।
বর্ণির বাঁওড়: প্রকৃতির বুকে এক শান্ত জলাধার
যারা প্রকৃতির নির্মল সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তাদের জন্য গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বর্ণির বাঁওড় একটি আদর্শ স্থান। স্থানীয়ভাবে এটি ‘মধুমতি বাঁওড়’ নামেও পরিচিত। সত্তর দশকে প্রমত্তা মধুমতী নদীর গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এই বিশাল জলাশয় বা বাঁওড়ের সৃষ্টি হয়।
প্রায় ১৬২ হেক্টর জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই বাঁওড়টি ঋতুভেদে ভিন্ন ভিন্ন রূপে সেজে ওঠে। বর্ষাকালে যখন এর জল কানায় কানায় পূর্ণ থাকে, তখন এর রূপ হয় ভয়ংকর সুন্দর। চারদিকে যতদূর চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। বিকেলে ছোট ডিঙি নৌকায় করে বাঁওড়ের শান্ত জলে ভেসে বেড়ানোর অভিজ্ঞতা এককথায় অসাধারণ। নৌকার বৈঠার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ, মৃদু বাতাস আর মাঝির ভাটিয়ালি গান আপনাকে নিয়ে যাবে এক অন্য জগতে।
শীতকালে পানি কমে এলে বাঁওড়ের অন্য এক রূপ দেখা যায়। তখন এর কিছু অংশ শুকিয়ে বিস্তীর্ণ সবুজ মাঠে পরিণত হয়। এ সময় এখানে ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখির আনাগোনা দেখা যায়, যা পাখিপ্রেমীদের জন্য একটি বাড়তি আকর্ষণ। এছাড়া, এই বাঁওড়টি দেশীয় মাছের এক বিশাল অভয়ারণ্য। এখানকার নির্মল বাতাস, শান্ত পরিবেশ এবং দিগন্তবিস্তৃত জলরাশি যে কোনো প্রকৃতিপ্রেমীর মনকে মুহূর্তেই ভালো করে দেবে।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক ভিটা ও কোটাল দুর্গ
গণজাগরণের কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পৈতৃক বাড়িটি কোটালীপাড়া উপজেলায় অবস্থিত। এর পাশেই রয়েছে প্রাচীন কোটাল দুর্গ বা চন্দ্রবর্মণকোট। ধারণা করা হয়, এটি চতুর্থ শতকে নির্মিত। যদিও দুর্গটির বেশিরভাগ অংশই এখন বিস্মৃতির অতলে, তবুও এর বিধ্বস্ত চিহ্ন কবি সুকান্তের ভিটার সাথে মিলে এক ঐতিহাসিক আবহ তৈরি করেছে।
বর্তমানে বিধ্বস্ত প্রায় চন্দ্রবর্মণকোট শহরটিতে অতীতে দু’টি অংশ ছিল। প্রথমটি মূল দূর্গনগর ও দ্বিতীয়টি উপশহর। বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যাওয়া চন্দ্রবর্মণকোটে অতীতে যেসব ইমারতাদি ছিল সেসবের কোন চিহ্ন আর খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, বছরের বেশিরভাগ সময়ই এর অভ্যন্তরভাগ পানির নিচে ডুবে থাকে। ভেতর এবং বাইরের কোনো কোনো স্থানে নতুনভাবে মাটি ভরাট করে বসত ভিটা তৈরি করা হয়েছে। এর নতুন বসতি বর্তমানে সিকিরবাজার, রতলি, পঁচাপাড়া, পাড়কোনা, আমতলি, মনসাবাড়ি ইত্যাদি নামে পরিচিত। দূর্গ মধ্যস্থিত একটি ভিটি কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের পিতৃ-পুরুষদের বসতভিটার চিহ্ন ধারণ করে আছে।
একাত্তরের বধ্যভূমি (জয়বাংলা পুকুর)
গোপালগঞ্জ শহরের এই স্থানটি মহান মুক্তিযুদ্ধের এক করুণ সাক্ষী। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনী বহু মানুষকে এখানে হত্যা করেছিল। তাদের স্মৃতিরক্ষার্থে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভটি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। গোপালগঞ্জের বিভিন্ন উপজেলা থেকে মুক্তিযোদ্ধা ও জনসাধারণকে ধরে এনে হানাদারবাহিনী ক্যান্টনমেন্ট সংলগ্ন পুকুরের পাশে বিভিন্নভাবে পাশবিক ও শারীরিক নির্যাতন করার পর গুলি করে হত্যা করতো। এ পুকুরটি ‘জয়বাংলা পুকুর’ নামে পরিচিত। এ পুকুরের আশেপাশে মুক্তিযুদ্ধের অনেক জানা-অজানা শহীদের গণকবর রয়েছে। পরবর্তী সময়ে পুকুরটি ভরাট করে এখানে শহীদদের স্মৃতিরক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। এটিই একাত্তরের বধ্যভূমি/জয়বাংলা বধ্যভূমি নামে পরিচিত।
ধর্মীয় পর্যটন আকর্ষণ
গোপালগঞ্জ জেলা শুধু তার ঐতিহাসিক স্থানগুলোর জন্যই পরিচিত নয়, এর ধর্মীয় সম্প্রীতি, উৎসব এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও পর্যটকদের মুগ্ধ করে। জেলার বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা এই স্থানগুলো এখানকার সমৃদ্ধ সংস্কৃতির পরিচয় বহন করে।
কেন্দ্রীয় মসজিদ
শহরের ঠিক কেন্দ্রস্থলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে জেলার কেন্দ্রীয় জামে মসজিদ, যা শহরের অন্যতম প্রধান একটি স্থাপনা। এর উঁচু মিনারটি দূর থেকেই সবার নজর কাড়ে, আর বড় গম্বুজের সাথে ছোট ছোট গম্বুজের সমন্বয়ে তৈরি এর স্থাপত্যশৈলী বেশ দৃষ্টিনন্দন।
থানাপাড়া মসজিদ
এই জেলার ইসলামিক ঐতিহ্যের কথা বললে, প্রথমেই আসে থানাপাড়া মসজিদের নাম, যা শহরের প্রথম মসজিদ হিসেবে পরিচিত। খেলাফত আন্দোলনের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী এই মসজিদটি শুধু একটি উপাসনালয়ই নয়, এটি ইতিহাসেরও একটি অংশ।
শিকদার বাড়ী জামে মসজিদ
অন্যদিকে, আরও প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যের নিদর্শন দেখতে হলে যেতে হবে কোটালীপাড়ার পিঞ্জরী ইউনিয়নের শিকদার বাড়ী জামে মসজিদে। ধারণা করা হয়, এটি পঞ্চদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল এবং এর তিনটি গম্বুজ ও আকর্ষণীয় নির্মাণশৈলী প্রাচীন মুসলিম স্থাপত্যকলার এক অনন্য উদাহরণ।
সেন্ট মথুরানাথ এজি চার্চ
ধর্মীয় সম্প্রীতির আরেক চমৎকার উদাহরণ হলো সেন্ট মথুরানাথ এজি চার্চ। ১৮৭৫ সালে নির্মিত এই গির্জাটি শুধু একটি উপাসনালয়ই নয়, এর সাথে জড়িয়ে আছে মথুরানাথ বোস নামে একজন বরেণ্য ব্যক্তির স্মৃতি, যিনি ছিলেন উনিশ শতকের একজন সমাজসেবী। তার সমাধি ও তার স্ত্রীর সমাধি গির্জার পাশেই অবস্থিত। গির্জাটির পুরনো স্থাপত্য পর্যটকদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ।
শিব মন্দির
একইভাবে, সিদ্ধান্তবাড়ি নামক স্থানে গেলে দেখা মিলবে প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এক শিবমন্দিরের। স্থানীয় মানুষের কাছে এটি ‘পুড়া ঠাকুর’ মন্দির নামে বেশি পরিচিত। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শেষ দিনে এই মন্দিরকে কেন্দ্র করে এক বিশাল চৈত্র সংক্রান্তির মেলা বসে, যা এলাকার মানুষের জন্য এক বড় উৎসবে পরিণত হয়।
কোটালীপাড়ার বাঘিয়ার নৌকাবাইচ
গোপালগঞ্জের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য মিশে আছে তার উৎসবগুলোর মধ্যে। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো কোটালীপাড়ার বাঘিয়ার নৌকাবাইচ। প্রায় ২০০ বছরের পুরনো এই ঐতিহ্যটি কালিগঞ্জ বাজার সংলগ্ন বাবুর খালে অনুষ্ঠিত হয়। এটি শুধু একটি নৌকা দৌড় প্রতিযোগিতা নয়, এটি লাখো মানুষের আনন্দ আর উচ্ছ্বাসের এক মিলনমেলা। তিন দিন ধরে চলা এই উৎসব আবহমান গ্রাম বাংলার নিজস্ব সংস্কৃতিকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে।
মধুমতী নদী
সবশেষে, গোপালগঞ্জের আসল সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে এর নদী ও বিলের বিস্তীর্ণ জলরাশিতে। মধুমতী, কুমার, ঘাঘর নদীর মতো স্রোতস্বিনী নদীগুলো এই জেলার ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, যা এখানকার মাটিকে করেছে উর্বর। এছাড়াও, চান্দার বিল, কাজুলিয়ার বিল ও বর্ণির বাঁওড়ের মতো বিশাল বিশাল জলাশয়গুলো এখানকার প্রকৃতিকে এক ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে। এই বিল আর নদীগুলোই যেন গোপালগঞ্জের প্রাণ।
গোপালগঞ্জ ভ্রমণ গাইড: আপনার যা জানা প্রয়োজন
কীভাবে যাবেন?
পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর ঢাকা থেকে গোপালগঞ্জের সড়ক যোগাযোগ অত্যন্ত সহজ হয়ে গেছে। ঢাকার গাবতলী বা সায়েদাবাদ থেকে টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস, গোল্ডেন লাইন, ইমাদ পরিবহনের মতো বাসে করে মাত্র ৩-৪ ঘণ্টায় সরাসরি গোপালগঞ্জ শহরে পৌঁছানো যায়।
কোথায় থাকবেন?
গোপালগঞ্জ শহরে এবং টুঙ্গিপাড়ায় থাকার জন্য বিভিন্ন মানের হোটেল ও গেস্ট হাউস রয়েছে। বাংলাদেশ পর্যটন কর্পোরেশনের হোটেল মধুমতি (টুঙ্গিপাড়া), হোটেল রানা, হোটেল শিমুল এবং পলাশ গেস্ট হাউস উল্লেখযোগ্য। আপনার বাজেট অনুযায়ী যেকোনো একটি বেছে নিতে পারেন।
কী খাবেন?
গোপালগঞ্জ তার মিষ্টির জন্য বিখ্যাত। বিশেষ করে এখানকার ‘দত্তের মিষ্টির’ রসগোল্লা ও ছানার জিলাপির সুনাম দেশজুড়ে। এছাড়া, মধুমতী নদীর তাজা মাছের বিভিন্ন পদ, যেমন আইড়, বোয়াল, বা চিতল মাছের ঝোল চেখে দেখতে ভুলবেন না।
গোপালগঞ্জ-এ একদিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা
গোপালগঞ্জের দর্শনীয় স্থানগুলো ঘুরে দেখার জন্য একটি পরিকল্পিত ভ্রমণ তালিকা থাকা ভালো। আপনি যদি একদিনে ভ্রমণ করতে চান, তাহলে গোপালগঞ্জ শহর থেকে একটি অটোরিকশা বা প্রাইভেট কার সারাদিনের জন্য ভাড়া করে নিতে পারেন।
সকালের অংশ:
প্রথমে চলে যান টুঙ্গিপাড়া। সেখানে ২-৩ ঘণ্টা সময় কাটিয়ে সমাধিসৌধ, জাদুঘর এবং বঙ্গবন্ধুর পৈতৃক বাড়ি দেখে নিন।
দুপুরের অংশ:
টুঙ্গিপাড়া থেকে ফিরে আসার পথে উলপুর জমিদার বাড়ি ঘুরে আসুন। সেখানে ছবি তোলা এবং ঐতিহাসিক পরিবেশ উপভোগ করার জন্য ঘণ্টাখানেক সময়ই যথেষ্ট।
বিকেলের অংশ:
দুপুরের খাবার শেষে চলে যান বর্ণির বাঁওড়ে। বিকেলের নরম আলোয় নৌকায় করে বাঁওড়ের সৌন্দর্য উপভোগ করে দিনের ভ্রমণ শেষ করতে পারেন।
গোপালগঞ্জ শুধু একটি জেলা নয়, এটি বাংলাদেশের হৃদয়জুড়ে থাকা এক ভূখণ্ড, যেখানে মিশে আছে জাতির ইতিহাস, সংগ্রাম, আধ্যাত্মিকতা এবং প্রকৃতির স্নিগ্ধতা। এখানকার প্রতিটি স্থানই আপনাকে এক নতুন গল্প বলবে, নতুন অনুভূতি দেবে। তাই পরবর্তী অবসরে, ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ুন মধুমতীর তীরে, ইতিহাসের খোঁজে।
তথ্যসূত্র –
- https://www.ittefaq.com.bd/amp/232401/%E0%A6%93%E0%A7%9C%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%B0-%E0%A6%A0%E0%A6%BE%E0%A6%95%E0%A7%81%E0%A6%B0%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%B0%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0-%E0%A6%AE%E0%A7%8B%E0%A6%A6%E0%A6%BF
- https://bn.banglapedia.org/index.php?title=%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%97%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9C_%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE
- https://tourisminbangladesh.com/spectacular-place-dhaka-division-gopalganj-district/
- https://vromonprio.com/location/gopalganj
- https://adarbepari.com/location/gopalganj
- http://bangla.tourtoday.com.bd/category/tourist-spots-in-dhaka/gopalganj-tour/
- https://vromonguide.com/location/gopalganj
- https://info.gopalganj.gov.bd/bn/site/office_process_map/%E0%A6%97%E0%A7%8B%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%97%E0%A6%9E%E0%A7%8D%E0%A6%9C-%E0%A6%9C%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%B6%E0%A6%A8%E0%A7%80%E0%A7%9F-%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A7%82%E0%A6%B9%E0%A5%A4