৩৬ জুলাই, অর্থাৎ ৫ই আগস্ট ২০২৪; এই দিনটিকে ভুলবে না বাংলাদেশের কোনো নাগরিক। কারণ, এই দিনে শত শত প্রাণের বিনিময়ে রচিত হয়েছে নতুন এক ইতিহাস। এই দিনেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে পতন হয় ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন আমলের। আর ঠিক সে সময় থেকেই, নতুন প্রজন্মের, নতুন নীতির এবং নতুন দল গড়ে ওঠা নিয়ে জনগণের মনে জন্ম নিয়েছে নানান আশা! ঠিক এমন সময়, চলতি মাসেই নতুন দল এর ঘোষণা দিয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
নতুন রাজনৈতিক দলের প্রেক্ষাপট
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার পর, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এমনকি বাংলাদেশ এক সাংবিধানিক সংকট এর মধ্যেও পতিত হয়েছে, কারণ, সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর পলায়ন কিংবা পদত্যাগ করলে নতুন সরকার গঠন নিয়ে কোন বিধান নেই। এ সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য গত ৮ ই আগস্ট নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। সেই সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নেয় বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের দুই সমন্বয়কারী ছাত্র নেতা মো. নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
এখন, এই রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাব্য তারিখ ঘোষণা করে হয়েছে ২০২৫ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর। এদিকে, আওয়ামিলীগের অবর্তমানে, বড় দল হিসেবে বিএনপির পুনরায় আবির্ভাব ঘটেছে। নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে, ছাত্ররাও নতুন একটি দল গঠন করতে চাইছে। সেই প্রচেষ্টায় জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের ঘোষণা আসতে পারে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি।
অবাক করা বিষয় হলো—বিশ্ব ইতিহাসে বিভন্ন সময়ে ছাত্রদের বিভন্ন বিপ্লব ঘটলেও, ছাত্র-বিপ্লবের পর রাজনৈতিক দল গঠনের মতো ঘটনা বাংলাদেশেই প্রথম, এবং, এর মাধ্যমে ছাত্ররা পুরো বিশ্বে এক অনন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে চলেছে। এই লক্ষ্যে গত ১৬ই ডিসেম্বর ২০২৪, ঢাকায় বিজয় দিবস উপলক্ষ্যে জাতীয় নাগরিক কমিটির ব্যানারে বিজয় র্যালির আয়োজন করা হয়। বিজয় র্যালিতে ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলা-উপজেলা থেকে ,সংগঠনের ব্যানার নিয়ে সদস্যরা উপস্থিত হয়।
জাতীয় নাগরিক কমিটির এই কর্মসূচি রাজনীতির মঞ্চে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, অভ্যুত্থানের পর থেকে নতুন যে রাজনৈতিক দলের কথা বলা হচ্ছে, তার প্রস্তুতি চলছে নাগরিক কমিটির অধীনে। এবং সেখানে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনেরো ভূমিকা রয়েছে। গেলো তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে সারাদেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় কমিটি গঠন করে সংগঠনের বিস্তৃতিও ঘটিয়েছে তারা। তাদের মতে, তৃণমূলে সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি হলে দলও দাঁড়িয়ে যাবে।
যেমন হবে ছাত্রদের নতুন দল
বাংলাদেশের বাস্তবতায় গত প্রায় চার দশকে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো সারা দেশে বিস্তৃত বড় কোনও রাজনৈতিক দল তৈরি হয়নি। বিভিন্ন সময় বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল গঠিত হলেও, সেগুলো আওয়ামী লীগ-বিএনপির মতো বড় দলে রূপান্তরিত হতে পারেনি। এছাড়া বাম-ডান, জাতীয়তাবাদী থেকে শুরু করে, ইসলামপন্থি আদর্শের রাজনীতিও, আগে থেকেই রয়েছে দেশটিতে। ফলে, ছাত্রদের নতুন দল কোন আদর্শকে সামনে রেখে এগোবে সেটা একটা বড় প্রশ্ন।
সংগঠনটির মুখপাত্র সামান্তা শারমিন এর মতে, বাংলাদেশে একক শীর্ষ নেতাদের যে ধারণা সেখান থেকেই বেরিয়ে আসতে চান তারা। এক নেতার এক দল– সেরকম কোনো কাঠামোতে যেতে চান না, আর এ কারণেই তারা যৌথ নেতৃত্বের ধারণা নিয়ে কাজ করছে। জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক সারজিস আলম এর মতে, ফ্যাসিস্টদের বিরোধী ছাত্রদের যে নতুন রাজনৈতিক দল হবে, সেই দল সব শ্রেণি-পেশার মানুষের জন্য উন্মুক্ত থাকবে এবং এটি হবে জনগণের দল।
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ হতে পারে আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি। এদিন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে আহ্বায়ক ও ডাকসুর সাবেক সমাজসেবা বিষয়ক সম্পাদক আখতার হোসেনকে সদস্য সচিব করে, কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা হওয়ার কথা। এর আগে দলটির ছাত্র সংগঠন ঘোষণা করারও পরিকল্পনা রয়েছে। এদিকে নতুন রাজনৈতিক দলের দায়িত্ব নিতে চলতি সপ্তাহে সরকারের উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করতে পারেন নাহিদ ইসলাম।
নতুন রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যাপক সক্রিয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। সক্রিয়তার অংশ হিসেবে ‘আপনার চোখে নতুন বাংলাদেশ’ নামে জনমত জরিপ কর্মসূচি হাতে নিয়েছিলেন তারা। ৫ ফেব্রুয়ারি শুরু হওয়া এই কর্মসূচিতে দেশের ২ লাখ ৬০ হাজার মানুষ এখন পর্যন্ত নিজেদের মতামত দিয়েছেন। অনলাইনের এই জরিপের পাশাপাশি সব জেলায়-উপজেলায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মতামত সংগ্রহ করা হচ্ছে। ইতোমধ্যেই ৩৩৮টি উপজেলা-থানা কমিটি গঠন করার কাজ শেষ করছে জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং সারা দেশের প্রায় ৪ হাজারের অধিক নেতাকর্মী কমিটিগুলোতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
ছাত্রদের নতুন দলের নাম ও প্রতীক
তবে দলটির নাম ও প্রতীক কী হবে, তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে সমর্থনের বিচারে এগিয়ে আছে তিনটি প্রতীক। এই প্রতীক তিনটি হলো মুষ্টিবদ্ধ হাত, হাতি এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগার।
অন্যদিকে একটি সূত্রে জানা গেছে, নামের জন্য সম্ভাব্য আটটি বিকল্প রয়েছে ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের কাছে। সেই সূত্র বলছে, বিএনপির মতো ইংরেজি নাম খুঁজছেন তারা। সম্ভাব্য আটটি নামের মধ্য থেকে জুলাই আন্দোলনের নেতাদের মতামতের ভিত্তিতে একটি নাম চূড়ান্ত হবে।
এই সম্ভাব্য নামগুলো হলো—বিপ্লবী জনতা সংগ্রাম পার্টি, জাতীয় বিপ্লবী শক্তি, বৈষম্যবিরোধী নাগরিক আন্দোলন, বাংলাদেশ নাগরিক দল, জাতীয় নাগরিক কমিটি, ছাত্র-জনতা পার্টি, জাতীয় জনশক্তি পার্টি ও জাতীয় নাগরিক শক্তি।
ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের আদর্শ
এই দলের আদর্শ নিয়েও মানুষের মনে কৌতুহলের কমতি নেই। তবে, জাতীয় নাগরিক কমিটির মতে, তারা চান ছাত্রদের নতুন দল যেন, বাংলাদেশে বামপন্থী কিংবা ডানপন্থী রাজনীতির প্রচলিত কোন ধারার মধ্যেই না থাকে। আর এই অবস্থানকে তারা বলছেন মধ্যপন্থী অবস্থান।
আদর্শ যেটাই হোক, ছাত্রদের নতুন দল কতটা জনপ্রিয়তা অর্জন করতে পারবে সেটা আগে থেকে বোঝার উপায় নেই। তবে এটাও ঠিক দেশটিতে গত ৪০ বছরে নতুন কোনো দল ভোটের মাঠে সেভাবে সুবিধা করতে পারেনি। তবে, দেশে না হলেও গত কয়েক দশকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, নতুন নতুন রাজনৈতিক দলের, অল্প সময়ের মধ্যেই ক্ষমতায় আসার নজীর রয়েছে।
এসব দলের মধ্যে বিশ্বব্যাপী বিশেষভাবে নজর কেড়েছে তুরস্কের রিচেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের এ কে পার্টি, পাকিস্তানের ইমরান খানের তেহরিক-ই-ইনসাফ এবং ভারতের অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আম আদমি পার্টি। আর তাই, সফলতার মন্ত্র খুঁজতে ছাত্ররাও নতুন এই তিনটি দলের কর্মসূচি ও, সাংগঠনিক কাঠামো যাচাই-বাছাই করছে।
ছাত্রদের দল নিয়ে জনমনে যেমন আশা-আকাঙ্খা রয়েছে তেমনি রয়েছে উদ্বেগও। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, আবার যেন “মুখে এক, আর কাজে আরেক’ এই নীতির নতুন কোন দল তৈরি না হয়ে বসে। এদিকে কমিটি নিয়ে দলের মধ্যেও দ্বন্দ্ব-বিভাজনের সুর যে শোনা যায়নি এমন না। তবে, আশার বাণী শোনাচ্ছেন নতুন প্রজন্ম। প্রো ইসলামিক, ভারত বিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিরোধী দর্শন নিয়ে তারা এগিয়ে যেতে চায়ছেন। তবে, এখনও ভবিষ্যতের অনেক হিসাব নিকাশ বাকি আছে।