Image default
ইতিহাসইতিহাস ১০১

হিপ্পি আন্দোলন

“ফ্লাওয়ার চাইল্ড” তথা হিপ্পিদের আন্দোলন কেবলই প্রথা ভাঙার লড়াই ছিলো না। এটি ছিলো একটা গোটা সভ্যতার জীবনধারা।

প্রসঙ্গ যখন আমেরিকান আন্দোলনের, তখন অত্যন্ত কৌতুহলোদ্দীপক একটি বিষয় হলো হিপ্পি আন্দোলন। বলে হয়ে থাকে, এটি ছিল পুরো বিশ্বের মাঝে অন্যতম সাড়া জাগানো একটি আন্দোলন, যা পরবর্তীতে বেশ সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে। ষাটের দশকের প্রথম দিকে আমেরিকাজুড়ে শুরু হওয়া এই ব্যতিক্রমধর্মী আন্দোলনটি ছিল মূলত একটি যুব আন্দোলন। তবে প্রশ্ন হলো, কারা ছিল এই আন্দোলনকারীরা? তাদের উদ্দেশ্য-ই বা কী ছিল?

হিপ্পি আন্দোলন কী

ষাট ও সত্তরের দশকের মার্কিন তরুণ প্রজন্মকেই সাধারণত হিপ্পি বলা হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী গ্রেট ডিপ্রেশন চলাকালীন সময়ে কর্মসংস্থানের অভাবে আমেরিকান যুবক যুবতীরা হতাশার আঁধারে নিমজ্জিত ছিল। সেসময় তাদের মাঝে একটি নতুন উন্মাদনা দেখা দেয়, যা ছিল আক্ষরিক অর্থে পুরো বিশ্বের আনাচে কানাচে থাকা অসংখ্য জায়গা ঘুরে দেখার বাসনা। পাহাড়-পর্বত, মরুভূমিসহ সেসকল জায়গা তারা ভ্রমণ করা শুরু করে, যেসকল জায়গায় ইউরোপিয়ানদের পদচিহ্ন খুব একটা পড়েনি। 

এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে ভারতের দর্শন-শাস্ত্র, মন্ত্র সাধনা, তন্ত্রবিদ্যা, জাদুবিদ্যা ইত্যাদি তাদের মুগ্ধ করে। তারা গ্রামীণ পরিবেশে বসবাস করে এসবের চর্চা শুরু করে এবং আধ্যাত্মিকতার চরম পর্যায়ে যাবার জন্যে এল এস ডি সহ বিভিন্ন মাদক সেবন করে। স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ পাওয়া এই তরুণেরা সিদ্ধান্ত নেয়, পৃথিবীর যাবতীয় মারামারি-কাটাকাটির ইতিহাস মুছে তারা এই স্বাধীনতাকে বিস্তৃত করবে। প্রেম, শান্তি ও ভালোবাসা নিয়ে তারা কাজ শুরু করে।

ষাট ও সত্তরের দশকে মার্কিন তরুণ প্রজন্ম মূলত স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে এ আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটায়। তারা চেয়েছিল প্রাকৃতিক জগতের সাথে ঐক্যের সম্পর্ক গড়ার মধ্য দিয়ে একই মতাদর্শের মানুষদের সাথে বসবাস করতে (কম্যুনাল লিভিং) । বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে তারা বিভিন্ন রক ও ফোক গান এবং মাদকজাতীয় দ্রব্যকে বেছে নিয়েছিল । পারসিয়ান “মাজদাকীয়” সংস্কারের রূপকার ও সংস্কারক মাজদাক কম্যুনাল লিভিং এর ধারণাটি প্রচার করেন। মূলত সেখান থেকেই হিপ্পি আন্দোলনের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়। 

হিপ্পিদের এরূপ শান্তি সম্প্রীতির বাণীকে শিশুসুলভ হিসেবে বিবেচনা করা হতো বলে তাদেরকে “ফ্লাওয়ার চাইল্ড” নাম দেয় সেসময়ের মার্কিন বয়োজ্যেষ্ঠ নাগরিকেরা। এটি ছিল প্রধানত প্রাচ্যদেশীয় ধর্ম বিশ্বাস ও আধ্যাত্মিকতার সামঞ্জস্যে গড়ে ওঠা একটি সামাজিক আন্দোলন, যার মুখ্য বিষয়বস্তু ছিল ভোগবাদী জীবনধারা, যুদ্ধ এবং কর্তৃত্ববাদী নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাবতীয় তথাকথিত প্রথা ভেঙে দেয়া। 

হিপ্পিদের উত্থানঃ কেন এবং কীভাবে?

১৯৫৫ সালের ভিয়েতনাম যুদ্ধের অনৈতিকতা নিয়ে তরুণ প্রজন্ম প্রশ্ন তোলে এবং যুদ্ধের ভয়ংকর ক্ষয়ক্ষতির বিরুদ্ধে শান্তি প্রতিষ্ঠা করার আহ্বান জানায়। ভালোবাসা ও অহিংসা দ্বারা সুন্দর জীবন গড়ে তোলার লক্ষে তারা ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকান লেখকদের দ্বারা গড়ে ওঠা সংঘ “বিট প্রজন্ম”, হিপ্পি আন্দোলনের শৈল্পিক ও আদর্শিক ভিত্তি স্থাপন করে। প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো দুঃসাহসিক কাজ করে তারা তরুণ প্রজন্মের প্রতিবাদী সত্তাকে উদ্বুদ্ধ করে।

শিল্পোন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে রিয়েলিজম বা বাস্তববাদ ও ভোগবাদের প্রসার দেখা যায়, যার ফলস্বরূপ উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বিপাকে পড়তে হয় বারংবার। স্বার্থান্বেষী এই চিন্তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মাধ্যমে তরুণেরা সর্বসাকুল্যে নাগরিক অধিকার জোরদার করতে উৎসাহী হয়।

সবমিলিয়ে তরুণ সমাজের মধ্যে তৎকালীন সমাজব্যবস্থা ও রক্ষণশীল মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয়। এছাড়াও রক ও সাইকেডেলিক সঙ্গীত এবং মাদকদ্রব্যের প্রভাব এই আন্দোলনের গতিকে তরান্বিত করে।

হিপ্পিদের দর্শন ও জীবনধারা

হিপ্পি সংস্কৃতির মূলবাণীই হলো অহিংসা, শান্তি, ভালোবাসা, সাম্য। পরিবেশের সাথে একাত্মতা পোষণ করে কমিউনাল লিভিং এর মাধ্যমে তারা বিকল্প জীবনধারা কে প্রচার ও প্রসার করে। হিপ্পিরা সঙ্গীত ও শিল্পের চর্চার মাধ্যমে তাদের নিজস্ব পরিচিতি তৈরি করে এবং এল এস ডি সহ অন্যান্য মাদকদ্রব্যকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে। তাদের দর্শন হলো মূলত ব্যক্তিগত স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেয়া যা বর্তমানকালের লিবারেলিজম ধারার পূর্বসূরী। জীবনদর্শন হিসেবে তারা সরলতা ও প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিয়ে ভোগবাদের বিরুদ্ধশক্তি হিসেবে নিজেদের আবির্ভাব ঘটিয়েছিল। গ্রামীণ-পরিবেশবান্ধব জীবন ধারা ও ধ্যান-ধারণা, আধ্যাত্মিকতার প্রসার ঘটিয়ে তারা জীবন যাপন করতে পছন্দ করতো। তাদের সকল কাজের মূলবাণী ছিল শান্তি ও প্রেম।

শান্তি সম্প্রীতিতে মিলেমিশে বেঁচে থাকা একদল তরুণ হিপ্পিসমাজ

মাদক ও সাইকেডেলিক রক মিউজিক 

মজার ব্যাপার হলো, হিপ্পিরা মনে করতো আধ্যাত্মিকতার চরম পর্যায়ে পৌঁছুতে হলে তাদের এল এস ডি সহ অন্যান্য মাদক সেবন করতে হবে। এতে করে তারা পুরোপুরি ভাবে আধ্যাত্মিকতার স্বাদ আস্বাদন করতে পারবে বলে বিশ্বাস করতো। তারা মূলত ভারতীয় হিন্দু ও বৌদ্ধ শাস্ত্র থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে আধ্যাত্মিক জীবন বেছে নিতে চেয়েছিল। 

ঠিক এখানে এসেই হলো সাইকেডেলিক রক মিউজিকের প্রবেশ। সাইকেডেলিক রক মিউজিক হলো এমন একটি সঙ্গীত ধারা যা সাইকেডেলিক অভিজ্ঞতার প্রতিফলন ঘটানোর জন্য তৈরি হয়েছিল। এল এস ডি ও অন্যান্য হ্যালুসিনোজেনিক মাদক সেবনে সাইকেডেলিক অভিজ্ঞতা হয় বলে জানা যায়। 

এই অভিজ্ঞতার মিশ্রণে জটিল, অপ্রচলিত ও নতুন সুর দ্বারা তৈরি সঙ্গীতই হলো সাইকেডেলিক রক মিউজিক। হিপ্পিরা এই সঙ্গীতের ধারার সাথে পুরোপুরি একাত্মতা পোষণ করে আধ্যাত্মিকতার শীর্ষে পৌঁছানোর প্রয়াস করেছিল। একারণেই সাইকেডেলিক রক মিউজিক এর সাথে তাদের এতো সম্পৃক্ততা পরিলক্ষিত হয়।

সঙ্গীত ও মাদকে মত্ত স্বাধীনচেতা হিপ্পি তরুণী

হিপ্পি আন্দোনলনের প্রভাবঃ সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অন্যান্য 

যুগোপযোগী আন্দোলন হিসেবে হিপ্পি আন্দোলনের বেশ সুনাম রয়েছে। আর একারণেই এ আন্দোলনের বেশ সুদূরপ্রসারী প্রভাব লক্ষ করা যায়। সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রাঙ্গনে এর প্রভাব লক্ষণীয়। 

সামাজিক প্রভাব

 সমাজের তথাকথিত প্রথা ও নীতিনৈতিকতার ঊর্ধ্বে গিয়ে স্বাধীনতা, শান্তি ও ভালোবাসার মধ্য দিয়ে জীবন যাপনের মূলনীতি নির্ধারিত হয়৷ নারীদের যৌনজীবন নিয়ে প্রকাশ্য আলোচনা, সামাজিক ট্যাবুর অবসান, জন্মনিয়ন্ত্রক পিলের ব্যবহার, যৌন মেলামেশার খোলামেলা দৃষ্টিভঙ্গি, বহুসাংস্কৃতিকতা ইত্যাদি হয়ে ওঠে নতুন সমাজের শিরদাঁড়া। 

সঙ্গীত 

এসময়ে বিটলস, জিমি হেন্ড্রিক্স, পিংক ফ্লয়েড, দ্য ডোরস, জনি মিচেল ইত্যাদি শিল্পীদের গান ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং আন্দোলনকে বেগবান করে। রক মিউজিক, বিশেষ করে সাইকেডেলিক রক বেশ সাড়া পায়। ঊনসত্তরের উডস্টক ফেস্টিভ্যাল আন্দোলনের প্রভাবকে চূড়ান্ত রূপ দেয়। 

ফ্যাশন 

সেসময় স্বতন্ত্র ফ্যাশন স্টাইল হিসেবে ফ্লোরাল প্রিন্ট, বড় ঝোলা পোশাক, বেল-বটম প্যান্ট -এর প্রসার ঘটে। চলচ্চিত্র জগতে হিপ্পি আন্দোলনের যথার্থ উপস্থাপনের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো “ইজি রাইডার” (Easy Rider) সিনেমাটি। এছাড়াও হান্টার এস. থম্পসনের মতো লেখকরা এসময় বেশ সাড়া পায়। 

ভিয়েতনাম যুদ্ধ ও রাজনীতি

“মেক লাভ, নট ওয়ার” স্লোগানে মুখরিত ছিল সেসময়ের আকাশ-বাতাস, যা রাজনীতিতে শান্তির বাণী হিসেবে উচ্চারিত হয়। ১৯৫৫ সাল থেকে মোটামুটি ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ভিয়েতনাম ও আমেরিকার মধ্যে যুদ্ধ লেগে ছিল। এ যুদ্ধের ভয়াবহতা তরুণ প্রজন্মের কোমল মন কে আঘাতে দেয় ও তাদের চিন্তিত করে তোলে। তাই তারা এই যুদ্ধের বিরোধিতা করে শান্তি প্রতিষ্ঠার কথা বলে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধী আন্দোলনের উপর হিপ্পি আন্দোলনের প্রভাব ছিল বেশ বলিষ্ঠ। যার ফলে সাম্য, সহনশীলতা, নারী ও নাগরিক অধিকার তথা সামাজিক উন্নতির ধারণা খুব জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। শান্তির বাণী নিয়ে ঘটিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম “সামার অফ লাভ” এ হিপ্পিরা একত্রিত হয়ে সম্প্রীতির বাণী প্রচার করে। তাদের এই অংশগ্রহণ ছিল বেশ নজরকাড়া। এতে তারা ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে এবং শান্তি প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়।

১৯৬৭ এর “সামার অফ লাভ”এ অংশগ্রহণকারী হিপ্পি তরুণ-তরুণীরা

নীতি আদর্শিক প্রভাব

ভোগবাদের বিরোধিতা দ্বারা হিপ্পি আন্দোলনের মূলনীতি তথা সাম্যবাদী চিন্তাচেতনার প্রসার ঘটে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন রিয়েলিজমে উদ্বুদ্ধ শিল্পোন্নত দেশগুলো অন্য দেশগুলোকে বঞ্চিত করে কেবল তাদের স্বার্থান্বেষণে মনোযোগী হলো, তখন এই কর্পোরেট সংস্কৃতি ও ভোগবাদের বিরুদ্ধে তারা অবস্থান নেয়। এর ফলে বিকল্প অর্থনৈতিক পদ্ধতি হিসেবে সমবায়ভিত্তিক জীবন ধারা এবং বিনিময় পদ্ধতি প্রসার পেতে শুরু করে।

আধ্যাত্মিকতা ও দর্শনচর্চা

হিপ্পিদের মাধ্যমে সমাজের বিভিন্ন স্তরে আধ্যাত্মিক ও হিন্দু-বৌদ্ধ দর্শনের চর্চা দেখা দেয়। এছাড়াও পরিবেশ রক্ষায় হিপ্পিদের কার্যক্রম পরবর্তীতে পরিবেশ আন্দোলনগুলোর জন্য আদর্শ হয়ে দাঁড়ায়।

আধ্যাত্মিকতার চর্চায় প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর হিপ্পি তরুণ-তরুণীরা

আধুনিক যুগে হিপ্পি আন্দোলন

হিপ্পিরা পরিবেশ বিষয়ে বেশ সচেতন ছিল – তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কাজেই পরবর্তীতে যে তাদের এই মহা উদ্যোগ কোনো ভূমিকা রাখবেনা – সেটা হতেই পারেনা। হিপ্পিদের এই পরিবেশ সচেতনতাই পরবর্তীতে পরিবেশ আন্দোলনগুলোর মুখপাত্র হয়ে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আধুনিক পরিবেশবাদীরা হিপ্পিদের দেখানো পথ অনুসরণ করে আন্দোলনকে বেগবান করেছে। 

যেহেতু হিপ্পিরা প্রাকৃতিক জীবনের উপর নির্ভরশীল ছিল, সেহেতু তাদের সেই জৈব খাদ্যের অভ্যাস আধুনিক যুগে মানুষদের স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনে অনুপ্রাণিত করেছে। আবার, হিপ্পিরা বেশকিছু মজার যোগব্যায়াম করে নিজেদের যৌবন ও সুস্থতা প্রাকৃতিকভাবে ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়েছিল। সেই যোগব্যায়ামের চল আজও আমাদের যুগে রয়েছে, এমনকি আধুনিক ডাক্তাররাও প্রায়ই যোগব্যায়াম করতে উৎসাহিত করেন। 

সেসময়ের সাইকেডেলিক রক ও ফোক মিউজিক একালের রক এবং ফোক জনরাকে সমৃদ্ধ করে চলেছে প্রতিনিয়তই। 

আজকের যুগের বিশ্ব রাজনীতিতে প্রশংসিত “লিবারেলিজম” মূলত হিপ্পিদের যুগের ব্যক্তিস্বাধীনতার কথাই বলে। “ফ্রিডম অফ স্পিচ”, “ফ্রিডম অফ রাইট”, “ফ্রিডম অফ প্রেস”, “ফ্রিডম অফ মুভমেন্ট” এবং “ফ্রিডম অফ এসেম্বলি” নামক আধুনিক যুগের টার্মগুলো আর কিছুই নয় বরং হিপ্পিদের প্রচারকৃত সেই জামানার স্বাধীনতার ধারণার বিস্তৃত রূপ। 

সাম্প্রতিক সময়ে আমরা বিভিন্ন সামাজিক ট্যাবু ভাঙার মুভমেন্ট দেখতে পাই। যেমন- মেয়েদের যৌন সমস্যা, যৌন জীবন, ঋতুস্রাব, সন্তান প্রসব, গর্ভধারণের জটিলতা, জন্মনিয়ন্ত্রক পিল, জননাঙ্গের রোগ, সেক্স এডুকেশন ইত্যাদি সহ নানান বিষয় নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা উদ্বুদ্ধ করতে বিভিন্ন কর্মসূচী দৃশ্যমান। প্রকৃতপক্ষে ঠিক এই বিষয়গুলো নিয়েই হিপ্পিরা সেই সময়ে পদক্ষেপ নিয়েছিল। অর্থাৎ তাদের সেই আন্দোলনের সুদূরপ্রসারী ফলাফলই হলো আজকের এসব কর্মসূচী। 

বর্তমানে বৈশ্বিকভাবে শান্তি রক্ষা করতে জাতিসংঘ সহ অন্যান্য অনেক ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন কাজ করে যাচ্ছে। হিপ্পিদের আন্দোলনের লক্ষ্য ও ছিল বৈশ্বিকভাবে শান্তি, সম্প্রীতি,  সাম্য ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠা করা, যেটা অনেকাংশেই তখন সম্ভব না হলেও আধুনিক যুগের মানুষদের এ বিষয়ে ভাবাতে এবং কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করছে। 

সুতরাং ষাটের দশকের হিপ্পিদের আন্দোলন শুরু হয়ে ১৯৭৯ সালের দিকে গিয়ে সেটি স্তিমিত হলেও এই আন্দোলন আধুনিক যুগের মানুষদের সাবলীল জীবন যাপনের জন্য একটি সুষ্ঠু দৃষ্টান্ত। 

হিপ্পি আন্দোলনের পতন 

১৯৭৯ সালের দিকে এসে হিপ্পিদের এই আন্দোলনে ফাটল ধরে। তারা যেসব জায়গা থেকে অর্থ জোগাড় করছিল, সেসব জায়গা থেকে অর্থ লাভ কমে আসতে থাকায় আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে তারা কেবল নাচ, গান, আমোদ, ফূর্তি, মাদক সেবন ইত্যাদি করে দিন কাটাতে গিয়ে হিমশিম খায়। হিপ্পিদের ব্যতিক্রমী ফ্যাশনকে বাণিজ্যিকীকরণের মাধ্যমে মূল ধারার সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করা হয়, যা এই আন্দোলনের জনপ্রিয়তা ও চাহিদাকে হ্রাস করে। অন্যদিকে  বিপুল সংখ্যক মানুষ রোমহষর্ক ও রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শেষ ভেবে ফিরে যায়, আবার অনেকেই সেসময়কার সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কারণে আবির্ভূত নতুন স্টাইলে আকৃষ্ট হয়ে চলে যায়। ব্যাপক শিল্পায়নের কারণে কর্মসংস্থানগুলোতে বিপুল পরিমাণ জনবলের প্রয়োজন হচ্ছিল। যার ফলে দলে দলে মানুষ সেই জীবনমুখী হতে শুরু করে। আবার মাদক সেবনের বিরুদ্ধে সেসময় আইন কঠোর হতে শুরু করে, যা তাদের অনেককেই এসব ত্যাগে বাধ্য করে। মাদক শুরুতে বিনোদনের জন্য জনপ্রিয় হলেও এটি যে মূল্যবোধের বিচ্যুতি ঘটায়- সেটি বুঝতে পেরে অনেকেই এ পথ ত্যাগ করে। 

শুধু থেকে যায় অল্প কিছু মানুষ ও তাদের গল্প – স্মৃতিতে কিংবা বইয়ের পাতায়, ঠিক পাখির ফেলে যাওয়া পালকের মতো।

উপসংহার

একটি পুরো প্রজন্মের বিদ্রোহ হিসেবে পরিচিত এই হিপ্পি আন্দোলন। শান্তি-সম্প্রীতি ও ভালোবাসার সহিত যুদ্ধবিহীন পরিবেশে, ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় উজ্জীবিত হয়ে, একত্রিত হয়ে জীবনযাপন করার যেই আকাঙ্খা, সেটি আসলে সর্বকালের সর্বস্থানের সকল তরুণদেরই মনের কথা। সেদিক দিয়ে হিপ্পিরা তাই চিরকালই বরেণ্য, কেননা তাদের আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ না পেলেও ভবিষ্যতের তরুণদের জন্য নজির সৃষ্টি করে রেখে যেতে পেরেছে। 

প্রথা ভাঙার লড়াইয়ে অংশীদার হিপ্পিরা তাই কেবল একটি লড়াইয়ের অংশ নয়, বরং একটা গোটা সভ্যতার জীবনধারার সাক্ষী। 

রেফারেন্সঃ

Related posts

যৌন শিক্ষার পূর্বে যৌনতা কেমন ছিল?

আবু সালেহ পিয়ার

কীভাবে আপনার হাতে এলো ‘শপিং ব্যাগ’

অটোরিকশার ইতিহাস: স্বপ্নের চাকা নাকি নগরীর বোঝা?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More