নো ম্যাকডোনাল্ডস বা স্টারবাকস! নো ট্রাফিক লাইট ! এমন একটি শহর কি আদৌ আছে??
অনেক সময় নিশ্চয়ই আপনারও ইচ্ছে করে শহরে যান্ত্রিকতা থেকে দুরে কোথাও হারিয়ে যেতে!! কোলাহলহীন, শান্ত পরিবেশে ভ্রমণ করতে হলে , আপনার জন্য পারফেক্ট জায়গা হতে পারে ভুটান রাজধানী থিম্পু। যা অনেকের কাছে সুখের শহর হিসেবেও পরিচিত। থিম্পু নামটি পালি শব্দ “থিম্পু” থেকে এসেছে, যার অর্থ “ঈশ্বরের প্রিয়” বা “ঈশ্বরের বরপুত্র”। এখানকার বাসিন্দারা বিশ্বাস করে ঈশ্বরের আশীর্বাদের কারণে দেশটিতে এত শান্তি ও সুখ বিরাজমান রয়েছে।
দেশ | ভুটান |
অঞ্চল/ রাজ্য | পশ্চিম ভুটান |
আয়তন | ২৬.১ বর্গকিলোমিটার |
জনসংখ্যা | ১১৪,৫৫১ জন (২০১৭ সালের আদমশুমারি) |
সরকারি ভাষা | জোংখা |
প্রধান মুদ্রা | নগুলত্রুম (BTN) |
সময় অঞ্চল | বিটিটি (ইউটিসি+০৬:০০) |
আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর | পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর |
ম্যাপ
থিম্পু এর অবস্থান ও জলবায়ু
থিম্পু ভুটানের রাজধানী এবং দেশটির বৃহত্তম শহর। এটি ভুটানের পশ্চিম অংশে হিমালয়ের উঁচু উপত্যকায়, থিম্পু নদী (ওয়াং চু) এর তীরে অবস্থিত। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ২,৩৩৪ মিটার (৭,৬৫৭ ফুট) উঁচুতে হওয়ায় এর আবহাওয়া অনেকটাই শীতল থাকে ।
থিম্পুর আবহাওয়া বেশ আরামদায়ক। গ্রীষ্মে (মে-সেপ্টেম্বর) এখানে হালকা গরম। আর শীতকাল (নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি) আবহাওয়া বেশ শুষ্ক ও শীতল হয়। গ্রীষ্মকালে সাধারণত তাপমাত্রা ১৫°C থেকে ২৫°C থাকে। তবে শীতকালে তাপমাত্রা কখনও কখনও শূন্য ডিগ্রির নিচে নেমে যায়।
মজার বিষয় হলো, পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ার কারণে দিন এবং রাতের তাপমাত্রার মধ্যে পার্থক্য অনেকটাই বেশি। যদি আপনি ভুটান যাবার কথা ভেবে থাকেন তার জন্য সবচেয়ে ভালো সময় হলো অক্টোবর এবং নভেম্বর মাস। কারণ, এই সময় আকাশ পরিষ্কার থাকে যার ফলে দূরের পাহাড়, নদী, বনাঞ্চল পরিষ্কারভাবে দেখা যাবে।
থিম্পুর ইতিহাস
থিম্পুর ইতিহাস প্রাচীন হলেও, এটি ১৯৬১ সালে ভুটানের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর আগে, ভুটান এর রাজধানী ছিল পুনাখা, যা মূলত ১৬০০ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয়। এবং এই শহরটি অনেক বছর ধরে ভুটানের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র ছিল।
থিম্পু তখন ছিল একটা ছোট্ট গ্রাম। তখনকার তুলনায় এখন এটা পুরোপুরি বদলে আধুনিক একটা শহরে পরিণত হয়েছে। এই বদলের শুরুটা হয়েছিল রাজা জিগমে দর্জি ওয়াংচুকের সময়ে। তিনিই ১৯৬১ সালে ভুটানে প্রথমবারের মতো উন্নয়ন পরিকল্পনা শুরু করেন।
ধীরে ধীরে শহরে রাস্তা বানানো হয়, সরকারি দপ্তর তৈরি হয়, আর শিক্ষা আর স্বাস্থ্যসেবার ব্যাপারেও বেশ উন্নতি হয়। ১৯৭৪ সালে আন্তর্জাতিক পর্যটন শুরু হয়। এর ফলে থিম্পুর অর্থনীতিকে অনেকটা এগিয়ে দেয়। ৮০-এর দশকের দিকে শহরে বিদ্যুৎ, পানির ব্যবস্থা আর টেলিফোন সংযোগও চালু হয়।
আধুনিক যুগে এসে থিম্পু আরও অনেক কিছু পেয়েছে। ব্যাংকিং, প্রযুক্তি আর টেকসই উন্নয়নে অনেক এগিয়ে গেছে। ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য ধরে রেখেও শহরে এখন উঁচু বিল্ডিং, শপিং মল আর চমৎকার ক্যাফেগুলো রয়েছে।
থিম্পু শহরের দর্শনীয় স্থান
সুন্দর পাহাড় ও পরিপাটি জীবনধারার শহর থিম্পু, অনেক ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে একটি স্বপ্নের দেশ। এখানে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা আপনার ভুটানে যাওয়ার অভিজ্ঞতাকে আরও মজাদার করে তুলবে।
তাশিচো জং (Tashichho Dzong)
তাশিচো জং থিম্পু শহরের উত্তরে অবস্থিত একটি বিখ্যাত বৌদ্ধ দুর্গ ও মঠ। গ্রীষ্মে এটি রাজকীয় সরকারের অফিস এবং ভুটানের ধর্মীয় নেতার আসন হিসেবে ব্যবহৃত হয়। স্থাপনাটি সুসজ্জিত টাওয়ার ও ছাদের অসাধারণ নকশা দিয়ে এমনভাবে তৈরি যে, এটি দেখতে একটি নাট্যমঞ্চের সেটের মতো মনে হয়। তবে এর সৌন্দর্যের পাশাপাশি এর বাস্তব অস্তিত্ব একে আরও অনন্য করে তুলেছে।
চেরি গোএম্বা (The cheri goemba)
এটি ভুটানের প্রথম মঠ, যা থিম্পুর কাছাকাছি অবস্থিত। অনেকে মনে করে, এটি ভুটানের সবচেয়ে পুরানো মঠ। স্থানীয় ক্যাব ব্যবহার করে সহজেই এই ঐতিহাসিক স্থাপনায় যাওয়া যায়। তবে, সেখান থেকে উপরে ওঠার জন্য একটি খাড়া পথ রয়েছে। এই পথ শারীরিকভাবে দুর্বল বা উচ্চতাভীতি সম্পন্ন মানুষের জন্য উপযুক্ত নয়।
ভুটানিদের কাছে এই মঠটির বিশেষ গুরুত্ব ও শ্রদ্ধার স্থান। এর ঐতিহাসিক এবং ধর্মীয় গুরুত্ব একে ভুটানের অন্যতম পবিত্র স্থান হিসেবে স্বীকৃতি করে দিয়েছে।
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর জুরিগ চুসুম(The National Institute for Zorig Chusum)
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর জুরিগ চুসুম হলো চিত্রকলার বিদ্যালয়। ভুটানের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলার ১৩টি শৈলীর উপর একাধিক শিক্ষামূলক প্রোগ্রাম পরিচালনা করে। এখানে উৎসাহী শিক্ষার্থীরা চিত্রকলা, কাঁথা সেলাই, কাঠের খোদাই এবং মূর্তি নির্মাণের মতো জটিল শিল্পকলায় দক্ষতা অর্জনের সুযোগ পান। এসব শিল্পকর্ম তৈরিতে সাধারণত মাটির ব্যবহার হয়। এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের তৈরি শিল্পকর্মগুলো দেখতে প্রতিনিয়ত হাজারো দর্শক ভিড় করে ।
বুদ্ধ ডোরডেনমা (Buddha dordenma)
এটি বিশ্বের বৃহত্তম বুদ্ধ মূর্তিগুলোর একটি, যা তার আকার ও সৌন্দর্যে সবাইকে মুগ্ধ করে। এই মূর্তিটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো, এর ভেতরে ১ লক্ষেরও বেশি ছোট বুদ্ধ মূর্তি সংরক্ষিত রয়েছে। এগুলো ব্রোঞ্জ ও সোনার তৈরি।
ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্টেন
ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্টেন একটি তিব্বতীয়-মোটিফ ধর্মীয় স্থাপনা। এটি ভূটানের মানুষের পুজোর কেন্দ্রস্থল। ১৯৭৪ সালে দেশটির তৃতীয় রাজার স্মরণে এই স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। সাধারণ এই স্থানে মানুষ ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের জন্য বা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
তবে পর্যটনের জন্যও এটি অত্যন্ত জনপ্রিয় স্থান। চোর্টেনে রয়েছে অসাধারণ এশিয়ান স্থাপত্য, বিস্তৃতভাবে আঁকা আনেক্স( আঁকার ধরন) , মনোমুগ্ধকর মান্ডালা এবং রাজার প্রতি নিবেদিত পূজার স্থান।
চাংগাংখা মন্দির (Changangkha Temple)
থিম্পুর সবচেয়ে প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্দির হলো চাংগাংখা মন্দির। এটি ধর্মীয় ও ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের অনন্য নিদর্শন। মন্দিরটি বিশাল আকারের প্রার্থনা চাকা, ধর্মগ্রন্থ এবং হাজার-হাত বিশিষ্ট অবলোকিতেশ্বর (Avalokitesvara) মূর্তির জন্য বিখ্যাত। বৌদ্ধ ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, এই দেবতা জীবনের দুঃখ ও কষ্ট দূরীকরণে নজর রাখেন। মন্দিরটি ভুটানি সংস্কৃতি ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক হিসেবে যুগ যুগ ধরে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে আছে।
জাতীয় গ্রন্থাগার (National Library)
১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠিত এই জাতীয় গ্রন্থাগার দেশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে সাহায্য করে। এখানে প্রাচীন সাহিত্য, শিল্পকর্ম এবং ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি সযত্নে রক্ষিত রয়েছে, যা ভুটানের ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাক্ষ্য বহন করে। এই গ্রন্থাগার গবেষক এবং ঐতিহ্যপ্রেমী একদম পারফেক্ট।
এইখানে দেশের অতীত এবং আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কে গভীরভাবে জানার সুযোগ রয়েছে। ভুটানে পবিত্র ধর্মীয় পাণ্ডুলিপি ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত।
থিম্পু মার্কেট
থিম্পু মার্কেট শহরটির জমজমাট একটি জায়গা, যেখানে স্থানীয় মানুষের ভিড় এবং পর্যটকদের ব্যস্ততা একসঙ্গে মিশে থাকে। এখানে আপনি ভুটানি ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্পের জিনিসপত্র যেমন- থাঙ্কা পেইন্টিং, কাঠের নকশা করা পাত্র, বোনা কাপড় এবং গহনা পাবেন। এছাড়া ভুটানের বিখ্যাত ঐতিহ্যবাহী পোশাক যেমন “ঘো” এবং “কিরা” ও পাবেন।
মার্কেটে মিষ্টি ও শুকনো খাবার, ভুটানি চা, জৈব মধু এবং পাহাড়ি অঞ্চলের সুগন্ধি মশলারও ভালো সংগ্রহ পাওয়া যায়। যারা খাবার পছন্দ করেন, তারা স্থানীয় খাবারের স্টলগুলোতে “এমা দাতসি” বা ভুটানি চিজ চিলি খেয়ে দেখতে পারেন।
থিম্পু এর অর্থনীতি ও শিল্প
থিম্পু ভুটানের রাজধানীর হওয়ার পাশাপাশি, এটি দেশটির অর্থনৈতিক প্রধান কেন্দ্র। এটি দেশের প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখে।
পর্যটন শিল্প
থিম্পুর পর্যটন শিল্প ভুটানের অন্যতম বড় আয়ের উৎস। প্রতিবছর ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা যেমন- তাশিচো জং আর মেমোরিয়াল চর্তেন দেখতে প্রচুর মানুষ আসে। হিমালয়ের সৌন্দর্য আর ভুটানের শান্ত পরিবেশ সবাইকে মুগ্ধ করে। বিদেশি পর্যটকদের আগমন শহরের রেস্তোরাঁ, হোটেল এবং স্থানীয় দোকানগুলোর আয় বাড়ায়। বিশেষ করে, পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে নিকটবর্তী হওয়ার কারণে এখানে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি।
হস্তশিল্প এবং কারুশিল্প
থিম্পুর হস্তশিল্প ভুটানের ঐতিহ্যের সুন্দর এক প্রতিচ্ছবি। এখানকার হাতে তৈরি টেক্সটাইল যেমন- থাগকা আর কিরা দারুণ জনপ্রিয়, বিশেষ করে স্থানীয়দের পাশাপাশি পর্যটকদের মধ্যেও। কাঠ, ধাতু আর পাথরের কাজেরও আলাদা একটা কদর আছে। মৃৎশিল্প আর পেইন্টিং তো এমনিতেই বিদেশি পর্যটকদের নজর কাড়ে। এখানকার স্থানীয় কারিগরেরা এইসব শিল্পকর্ম তৈরি করে বেশ ভালো আয় করেন। তাছাড়া, হস্তশিল্পের রপ্তানির সুযোগ বেড়ে যাওয়ায় এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে। ঐতিহ্য ধরে রেখে এসব শিল্প থিম্পুর অর্থনীতিতে একটা আলাদা রং যোগ করেছে।
কৃষি ও খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ
থিম্পুর আশেপাশে কৃষিকাজ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। থিম্পুর অধিবাসীরা তাজা শাক-সবজি খেতে পছন্দ করে, যার ফলে শাক-সবজির চাষাবাদ এখানে খুবই জনপ্রিয়। চাল, গম, আর আলু ,ধান এখানে প্রধান ফসল। এইখানে জৈব খাদ্যের চাহিদা ক্রমাগত বাড়ছে। থিম্পুর বাজারে কৃষকরা সরাসরি তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করেন, যা গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরো শক্তিশালী করে তুলেছে। ধান ও আলুর উৎপাদন এখানকার অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে।
সরকারি সেবা এবং প্রশাসনিক কেন্দ্র
থিম্পু দেশটির সব বড় সরকারি দপ্তরের ঠিকানা। প্রশাসনিক কাজের জন্য প্রতিদিনই প্রচুর মানুষ এখানে আসে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অফিসগুলোও থিম্পুতেই অবস্থিত। প্রশাসনিক কাজকর্মের কারণে শহরে অনেক ব্যবসার চাহিদা তৈরি হয়। হোটেল, রেস্তোরাঁ, পরিবহন থেকে শুরু করে ছোটখাটো দোকান—সবখানেই এর প্রভাব পড়ে। এক কথায়, থিম্পুর প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পুরো শহরের অর্থনৈতিক চাকা ঘুরিয়ে রাখে।
তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ
একটি অদ্ভুত বিষয় হল, এখন থিম্পুতে মোবাইল টেলিভিশন দেখা গেলেও ৩-৪ বছর আগেও এটি অসম্ভব ছিল। পুরো বিশ্ব যেখানে আধুনিকতার ছোঁয়ায় ভাসছে সেখানে ভুটান এখনো এইসব প্রযুক্তি থেকে বেশ দূরে। তবে থিম্পুতে তথ্যপ্রযুক্তি খাত ধীরে ধীরে উন্নত হচ্ছে। ইন্টারনেট, সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট, আর টেলিকম খাতেও উন্নয়ন হচ্ছে। স্থানীয়রা এই খাত থেকে নতুন দক্ষতা শিখছে। তথ্যপ্রযুক্তির কারণে অনেক ব্যবসা সহজ হয়ে গেছে।
জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র
এখানকার অর্থনীতিতে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ভুটানের প্রাকৃতিক নদী ও ঝরনাগুলো জলবিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উৎস। থিম্পুর আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে বেশ কিছু ছোট-বড় জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র রয়েছে, যা শুধু স্থানীয় বিদ্যুতের চাহিদা পূরণ করেই থেমে নেই, বরং ভারত সহ অন্যান্য প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বিদ্যুৎ রপ্তানি করে থাকে।
থিম্পুর সংস্কৃতি ও জীবনধারা
হিমালয় পর্বতমালার কোলে অবস্থিত, এই শহরটি ভুটানের বৌদ্ধ সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য পরিপূর্ণ। থিম্পুর সংস্কৃতি ভুটানের ইতিহাস, ধর্ম, এবং সামাজিক রীতিনীতির গভীর প্রভাব বহন করে।
বৌদ্ধধর্মের প্রভাব
থিম্পুর সংস্কৃতিতে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব যেন শহরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। এখানে প্রচুর গোম্ফা (বৌদ্ধ মঠ) আর স্তূপ দেখতে পাওয়া যায়, যা শুধু ধর্মীয় কেন্দ্র নয়, সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডেরও প্রাণকেন্দ্র। মঠ, স্তূপ, এবং ধর্মীয় চিহ্নগুলো শহরের সর্বত্র দেখা যায়।
থিম্পুর ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্য- দজং
থিম্পুর ঘরবাড়ি এবং দজং (মঠ-দুর্গ) ভুটানের ঐতিহ্যবাহী স্থাপত্যশৈলীর উজ্জ্বল উদাহরণ। এই ভবনগুলো কাঠের সূক্ষ্ম খোদাই, উজ্জ্বল রঙের চিত্রকলা এবং ধর্মীয় প্রতীক দিয়ে সজ্জিত। প্রতিটি স্থাপত্যে প্রাকৃতিক উপাদান, যেমন কাঠ এবং পাথরের ব্যবহার, পরিবেশের প্রতি ভুটানের গভীর শ্রদ্ধা প্রকাশ করে। দজংগুলো সাধারণত প্রশাসনিক ও ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা মঠ এবং দুর্গের সমন্বয়ে গঠিত। এগুলোর নকশা বৌদ্ধ ধর্মীয় নীতিমালা অনুসরণ করে তৈরি করা হয়োয়।
থিম্পুর ঐতিহ্যবাহী পোশাক- ঘো ও কিরা
ভুটানের লোকেরা তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করতে পছন্দ করেন। পুরুষরা ঘো নামে পরিচিত পোশাক পরেন, যা একটি লম্বা রোবের মতো এবং কোমরের কাছ থেকে একটি বিশেষ কাপড় দিয়ে বেঁধে রাখা হয়। নারীরা পরেন কিরা, যা একটি দীর্ঘ স্কার্টের মতো পোশাক, যা একটি উঁচু ব্লাউজ বা চোশো (শার্ট) এর সাথে পরা হয়।
তেশু উৎসব
প্রতিবছর থিম্পুতে “তেশু” নামে এক জমজমাট উৎসব হয়, যেখানে ঐতিহ্যবাহী মুখোশ নাচ, মন্ত্রপাঠ আর সঙ্গীতের ধারা মানুষকে মুগ্ধ করে।
দ্রুক পুজা
দ্রুক পুজা ভুটানের আরেকটি জনপ্রিয় ধর্মীয় উৎসব। “দ্রুক” মানে ড্রাগন, যা ভুটানের জাতীয় প্রতীক। এই উৎসবের সময়, ভুটানিরা ধর্মীয় উপাসনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করে, বিভিন্ন মন্দির এবং উপাসনালয়ে বিশেষ পূজা, নৃত্য এবং সঙ্গীত অনুষ্ঠিত হয়। উৎসবের পরিবেশ পাহাড়ি এলাকায় রঙিন হয়ে ওঠে, যা স্থানীয়দের ধর্মীয় আবেগকে আরও শক্তিশালী করে তোলে।
থিম্পুর নাইট-লাইফ
থিম্পুর রাত্রিকালীন জীবন প্রাণবন্ত। শহরে বেশ কয়েকটি বার এবং ক্যাফে রয়েছে, যেখানে স্থানীয় বাসিন্দা এবং পর্যটকরা একত্রিত হয়ে আনন্দময় সময় কাটান।
এর মধ্যে মোজু (Mojo Park) বিশেষভাবে জনপ্রিয়। এটি একটি লাইভ মিউজিক ভেন্যু, যেখানে ভুটানের প্রতিভাবান স্থানীয় শিল্পীদের মনোমুগ্ধকর পারফরম্যান্স উপভোগ করতে পারবেন।
থিম্পুর খাবার
থিম্পুর খাবার স্বাদে ও বৈচিত্র্যে ভরপুর। থিম্পু অধিবাসীরা খাবারের ঝাল-মসলা বেশি ব্যবহার করে থাকে। এখানকার সবচেয়ে জনপ্রিয় খাবার এমা দাতশি, যা মরিচ ও পনির দিয়ে তৈরি হয়। ভাতের সঙ্গে এটি অত্যন্ত সুস্বাদু লাগে।
ফাকশা পা হলো শুকনো মাংসের একটি মশলাদার পদ, যা গরুর মাংস দিয়ে তৈরি। ডাম্পলিংস বা মোমোও ভুটানে খুব জনপ্রিয়, যা মাংস, পনির বা সবজি দিয়ে ভরা থাকে।
সুজা, ভুটানের ঐতিহ্যবাহী মাখন চা, ঠান্ডা আবহাওয়ায় বেশ আরামদায়ক। চিলি চিজ বা চেম মরিচ আর পনিরের মিশ্রণ, যা ঝালপ্রেমীদের জন্য উপযুক্ত।
থিম্পুর যোগাযোগ ব্যবস্থা
থিম্পুর যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল মাধ্যম হল সড়কপথ। শহরের ভিতরে চলাচলের জন্য ট্যাক্সি ও ব্যক্তিগত গাড়ি প্রচলন সবচেয়ে বেশি। এখানে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট থাকলেও তা অনেক সীমিত। আর বাসগুলো শুধু নির্দিষ্ট পয়েন্টেই চলে। তবে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে অ্যাপ-ভিত্তিক রাইড-শেয়ারিং পরিষেবা কিছুটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।
থিম্পুতে সরাসরি কোনো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নেই। তবে, নিকটবর্তী পারো আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, থিম্পু থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। থিম্পু থেকে পারোতে যাতায়াতের জন্য গাড়ি বা ট্যাক্সি সহজেই পাওয়া যায়, যা যাত্রীদের জন্য একটি সুবিধাজনক বিকল্প।
থিম্পুর বিনোদন ও ক্রিয়াকলাপ
থিম্পু ঐতিহ্য, প্রকৃতি এবং আধুনিক জীবনের একটি অনন্য সংমিশ্রণ পাওয়া যায়। ভুটানের সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অভিজ্ঞতা নিতে থিম্পু আপনাকে অনেক রকম বিনোদন ও ক্রিয়াকলাপের সুযোগ দেয়।
তাশিচো জং, থিম্পুর সবচেয়ে আইকনিক স্থানগুলোর একটি, যেখানে ভুটানের প্রশাসনিক এবং ধর্মীয় কার্যক্রম পরিচালিত হয়। ন্যাশনাল মেমোরিয়াল চোর্টেন একটি বিশেষ স্থান, যা রাজা জিগমে দরজি ওয়াংচুকের স্মৃতির উদ্দেশ্যে নির্মিত। এছাড়া, ভুটান টেক্সটাইল মিউজিয়াম এবং ন্যাশনাল মিউজিয়াম ঘুরে দেখলে ভুটানের শিল্পকলা এবং ঐতিহ্য সম্পর্কে গভীর ধারণা পাওয়া যায়।
থিম্পুর সাপ্তাহিক বাজার
থিম্পুর সাপ্তাহিক বাজার (Centenary Farmers’ Market) একটি জনপ্রিয় স্থান, যেখানে স্থানীয় কৃষিপণ্য, হস্তশিল্প এবং ঐতিহ্যবাহী সামগ্রী পাওয়া যায়। এখানে ঘুরে আপনি ভুটানের স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে পারবেন। এছাড়া, নরজিন লাম (Norzin Lam) রোডের দোকানগুলোতে ভুটানের হস্তশিল্প, পোশাক এবং স্মারক সংগ্রহ করতে পারেন।
থিম্পুতে অ্যাডভেঞ্চার
থিম্পুতে অ্যাডভেঞ্চারের জন্য অনেক সুযোগ রয়েছে, যা ভ্রমণকে আরও রোমাঞ্চকর করে তোলবে। এখানে পাহাড়ি রাস্তায় ট্রেকিং এবং সাইক্লিং করার অভিজ্ঞতা দারুণ উপভোগ্য। এছাড়া, নদীর স্রোতের মধ্যে রিভার রাফটিং অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের জন্য একটি বিশেষ আকর্ষণ।শহরের আশপাশের গ্রামগুলোতে ভ্রমণ করে স্থানীয় গ্রামীণ জীবনের সৌন্দর্য এবং সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। গ্রামবাসীর আন্তরিক আতিথেয়তা এবং তাদের জীবনযাত্রার সরলতা পর্যটকদের জন্য অনুপ্রেরণাদায়ক হতে পারে।
থিম্পুর সিনেমা হল
থিম্পুতে মাত্র তিনটি সিনেমা হল রয়েছে। মজার বিষয় হল, সেখানে কোন বিদেশী ছবি দেখানো হয় না তাই যদি আপনি বলিউড কিংবা হলিউডের কোন সিনেমা দেখার কথা ওখানে চিন্তা করে থাকেন তাহলে বেশ আশাহত হতে হবে। কিন্তু, যদি সেখানে ভুটানের কোন সিনেমা দেখার কথা চিন্তা করে যে যেতে চান তাহলে যেতে পারেন।
সব মিলিয়ে এক অপার সৌন্দর্যের শহর থিম্পু। বেশ কয়েকটি দিক থেকে আধুনিক পৃথিবীর সাথে শহরটির অমিল রয়েছে ঠিকই। তবে, কিছুটা আধুনিকতার সাথে শহরবাসী তাদের ঐতিহ্যকেও আঁকড়ে রেখেছেন। শহরবাসী তাদের ঐতিহ্য দিয়ে যে কোন ভ্রমণার্থীর মন কেড়ে নিতে বাধ্য। এখানকার ঐতিহ্যবাহী নাচ ,বৈচিত্র্য সংস্কৃতির ,প্রাণবন্ত করে তুলতে পারে যে কাউকে। তাই এখানে কাটানো কিছু দিন হতে পরে আপনার জীবনে কাটনো শ্রেষ্ঠ মুহূর্তগুলোর একটি।
থিম্পুর সম্পর্কে কিছু মজার তথ্য
ট্রাফিক লাইট নেই!
থিম্পু পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী যেখানে কোন ট্রাফিক লাইট নেই।পুরো শহরটা ট্রাফিক পুলিশ দিয়ে পরিচালিত হয়। ভুটানিরা মনে করেন, ট্রাফিক লাইটের তুলনায় একজন মানুষ বেশি উষ্ণ এবং মানবিকভাবে জ্যাম সামলাতে পারে।
সুখের রাজধানী!
থিম্পু শুধু ভুটানের রাজধানী না, এটি “গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস”-এর কেন্দ্রও। মানে, এখানে সুখকে অর্থনৈতিক উন্নতির থেকেও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
সময়ের কাটা না দেখে, প্রকৃতি দেখা!
থিম্পুর মানুষরা সময় নিয়ে খুব বেশি চিন্তা করেন না। এখানে প্রকৃতি আর শান্তির মূল্য সময়ের চেয়েও বেশি।
প্রাণীদের জন্য নিরাপদ শহর!
থিম্পুর রাস্তায় যানবাহনের চেয়ে কুকুরদের সংখ্যা বেশি দেখা যায়। কিন্তু অধিবাসীরাও প্রতিটি কুকুরের যত্ন রাখে।
নো ম্যাকডোনাল্ডস বা স্টারবাকস!
বর্তমান সময়ে নিশ্চয়ই এমন কোন দেশ নেই যেখানে ম্যাকডোনাল্ডস বা স্টারবাকস মত আন্তর্জাতিক ফুডচেইন গুলো নেই কিন্তু মজার বিষয় হলো থিম্পু পৃথিবীর একমাত্র রাজধানী যেখানে এইসব আন্তর্জাতিক ফুডচেইন গুলো নেই।