যে কোনো ঋতুতে ত্বকের যত্নে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ঘর থেকে বেরোনোর ৩০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন লাগানো এবং প্রতি দুই-তিন ঘণ্টায় পুনরায় প্রয়োগ করুন ।
আমাদের মধ্যে অনেকেই জানেনা, দীর্ঘ সময় রোদে থাকার ফলে ত্বকে পোড়া ভাব, র্যাশ, বার্ধক্যের ছাপ এবং এমনকি স্কিন ক্যান্সারের মতো গুরুতর সমস্যা দেখা দিতে পারে। মূলত রোদের আলো সরাসরি ত্বকে প্রবেশের ফলে এসব সমস্যার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
এ থেকে রক্ষা পেতে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি। তবে সানস্ক্রিন ব্যবহারের নিয়ম নিয়ে অনেকের মনে দোটানা রয়েছে। তাই সানস্ক্রিন ব্যবহারের সঠিক নিয়ম সম্পর্কে জানা প্রয়োজন।
সানস্ক্রিন কি?
ত্বকের সুরক্ষায় ও স্কিন কেয়ার রুটিনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধাপ হলো সানস্ক্রিন ব্যবহার। এটি একটি বিশেষ ধরনের সুরক্ষা ক্রিম বা লোশন, যা সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি (UVA ও UVB) রশ্মি থেকে ত্বককে রক্ষা করে। সানস্ক্রিন ত্বকের সানবার্ন, অকালবার্ধক্য (যেমন, বলিরেখা ও দাগ) এবং স্কিন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।
সানস্ক্রিনের কার্যকারিতা SPF (Sun Protection Factor) দ্বারা নির্ধারিত হয়। এসপিএফ ৩০ বা তার বেশি মানের সানস্ক্রিন সবচেয়ে বেশি কার্যকরী । এটি ইউভিবি রশ্মি থেকে ৯৭ শতাংশ সুরক্ষা দেয়।
সানস্ক্রিন মূলত দুটি ধরনের হয়:
১. কেমিক্যাল সানস্ক্রিন – এটি ত্বকে শোষিত হয়ে কার্যকর হতে সাধারণত ২০-৩০ মিনিট সময় লাগে। তাই বাইরে যাওয়ার অন্তত ৩০ মিনিট আগে এটি ব্যবহার করা উচিত। যাতে UV রশ্মিকে নিষ্ক্রিয় করতে যথেষ্ট সময় পায়।
২. ফিজিক্যাল (মিনারেল) সানস্ক্রিন – এটি ত্বকের ওপর একটি প্রতিরক্ষামূলক স্তর তৈরি করে, যা সূর্যের রশ্মি প্রতিফলিত করে। ফলে এটি লাগানোর পরপরই বাইরে যাওয়া যায়।
কীভাবে ত্বকের ধরন অনুযায়ী সানস্ক্রিন কিনবেন?
বাজারে বিভিন্ন ধরনের এবং ব্রান্ডের সানস্ক্রিন আছে। ভুল সানস্ক্রিন বেছে নিলে আপনার ত্বক উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে, তেলতেলে অনুভূতি দিতে পারে। এ জন্য ত্বকের ধরন অনুযায়ী সানস্ক্রিন বেছে নেওয়া অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
তৈলাক্ত বা ব্রণ-প্রবণ ত্বকের জন্য সানস্ক্রিন
আপনার ত্বক যদি তৈলাক্ত হয় তাহলে তেল-মুক্ত এবং নন-কমেডোজেনিক সানস্ক্রিন কিনুন। বাজারে আজকাল বিভিন্ন ব্র্যান্ডের লাইট ওয়েট সানস্ক্রিন পাওয়া যায়। এগুলোও তৈলাক্ত ত্বকের জন্য উপযোগী।
এছাড়া যাদের ত্বকে ব্রণের প্রবণতা রয়েছে তাদের সবসময় সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। কারণ, সূর্যের ক্ষতিকারক ইউভি রশ্মি ত্বকে জ্বালা -পোড়া সৃষ্টি করতে পারে, যা ব্রণকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
শুষ্ক বা সংবেদনশীল ত্বকের জন্য সানস্ক্রিন
শুষ্ক ত্বকের প্রধান সমস্যা হলো আর্দ্রতার অভাব, যার ফলে ত্বক রুক্ষ ও খসখসে হয়ে যায়। তাই শুষ্ক ত্বকের জন্য এমন সানস্ক্রিন নির্বাচন করা প্রয়োজন, যা ত্বকের আর্দ্রতা ধরে রাখবে এবং পাশাপাশি হাইড্রেটও করবে। এ ক্ষেত্রে আপনি ময়েশ্চারাইজিং সানস্ক্রিন ব্যবহার করতে পারেন।
তবে ময়েশ্চারাইজিং সানস্ক্রিন বেছে নেওয়ার সময় নিশ্চিত করুন যেন এতে হায়ালুরোনিক অ্যাসিড, গ্লিসারিন বা সেরামাইডের মতো উপাদান থাকে। এ উপাদান গুলো ত্বককে গভীর থেকে আর্দ্র রাখে এবং শুষ্কতা রোধ করে, ফলে ত্বক দীর্ঘক্ষণ কোমল ও মসৃণ থাকে।
সংমিশ্রণ ত্বকের জন্য সানস্ক্রিন
সংমিশ্রিত ত্বকে কিছু অংশ তৈলাক্ত এবং কিছু অংশ শুষ্ক হওয়ায় এমন সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত যা ত্বকের ভারসাম্য বজায় রাখবে। এই সানস্ক্রিন যেমন টি-জোনের তৈলাক্তভাব নিয়ন্ত্রণ করবে, তেমনি গালের শুষ্কতাকে আর্দ্র রাখবে।
সংমিশ্রণ ত্বকের সানস্ক্রিন কেনার সময় ‘সব ধরনের ত্বকের জন্য’ বা ‘কম্বিনেশন স্কিনের জন্য’ লেবেলযুক্ত লাইটওয়েট ও নন-গ্রিজি ফর্মুলা নির্বাচন করুন। নিয়াসিনামাইড, অ্যালোভেরা ও গ্রিন টি এক্সট্র্যাক্ট উপাদান গুলো ত্বককে হাইড্রেট রাখার পাশাপাশি অতিরিক্ত তেল উৎপাদনও নিয়ন্ত্রণ করে।
সংবেদনশীল ত্বকের জন্য সানস্ক্রিন
সংবেদনশীল ত্বক খুব সহজেই জ্বালা বা লালচে হয়ে যেতে পারে। তাই সানস্ক্রিন বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। এ ধরনের ত্বকের জন্য ফিজিক্যাল সানস্ক্রিন উপযুক্ত, বিশেষ করে জিংক অক্সাইড বা টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড উপাদানযুক্ত সানস্ক্রিন সবচেয়ে ভালো কাজ করে। পাশাপাশি, অ্যালকোহল ও সুগন্ধিমুক্ত সানস্ক্রিন সংবেদনশীল ত্বকের জন্য নিরাপদ, কারণ এটি অতিরিক্ত জ্বালা বা চুলকানি সৃষ্টি করে না।
স্বাভাবিক ত্বকের জন্য সানস্ক্রিন
স্বাভাবিক ত্বকে যেকোনো ধরনেরই সানস্ক্রিন (সানজেল, সানস্টিক, সানপাউডার,সানস্প্রে) কেমিক্যাল ব্লকিং কিংবা মিনারেল ব্লকিং ব্যবহার করা যায়। তবে সেক্ষেত্রে পণ্যটি আসল নাকি নকল সেটি যাচাই করে নেওয়া খুব জরুরি।
সানস্ক্রিন কখন এবং কীভাবে ব্যবহার করবেন
সানস্ক্রিন প্রতিদিন ব্যবহার করা উচিত, এমনকি মেঘলা দিনে বা ঘরের ভেতর থাকলেও। যারা দীর্ঘ সময় ধরে সূর্যালোকে থাকেন বা চুলার কাজ করেন, তাদের অবশ্যই অন্তত ২০ মিনিট আগে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। পাশাপাশি, সানস্ক্রিনের কার্যকারিতা ধরে রাখতে প্রতি দুই ঘণ্টা পরপর এটি পুনরায় ব্যবহার করা উচিত।
সানস্ক্রিন ব্যবহারের সময় শুধু মুখেই নয়, ঘাড়সহ অন্যান্য উন্মুক্ত অংশেও যথাযথভাবে প্রয়োগ করা জরুরি। সাধারণত মুখ ও ঘাড়ের জন্য প্রায় এক টেবিল চামচ পরিমাণ সানস্ক্রিন ব্যবহার করা উচিত। তবে শরীরের অন্যান্য উন্মুক্ত অংশে প্রয়োজন অনুযায়ী প্রয়োগ করতে হবে।
সানস্ক্রিন এর সাথে অন্য কিছু ব্যবহার করা যাবে কিনা
সবার একটা কমন প্রশ্ন হল ,সানস্ক্রিনের পাশাপাশি ময়েশ্চারাইজার বা মেক-আপ প্রসাধনী ব্যবহার করা যাবে কিনা? অবশ্যই ব্যবহার করা যাবে। তবে সঠিকভাবে প্রয়োগের জন্য কিছু ধাপ অনুসরণ করাতে হবে।
প্রথমে মুখ ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। তারপর ময়েশ্চারাইজার ব্যবহার করতে হবে। এরপর সানস্ক্রিন লাগাতে হবে। সানস্ক্রিনের পর যে প্রসাধনী বা মেকআপ ব্যবহার করতে চান, তা ব্যবহার করতে পারেন।
আজকাল বাজারে এমন কিছু মেক-আপ প্রসাধনী পাওয়া যায় যেগুলোতে সানস্ক্রিন দেওয়া থাকে। যেগুলো ত্বকের এক্সট্রা প্রটেকশন হিসেবে কাজ করে।তবে শুধুমাত্র মেকআপে থাকা সানস্ক্রিনের উপর নির্ভর করা যাবে না। কারণ, তাতে যে পরিমাণ সানস্ক্রিন থাকে, তা বাংলাদেশের আবহাওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। তাই মেকআপে সানস্ক্রিন থাকলেও, আলাদাভাবে সানস্ক্রিন ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।
গর্ভাবস্থায় কি সানস্ক্রিন ব্যবহার করা যাবে এবং করা গেলে কোন ধরনের সানস্ক্রিন নিরাপদ?
গর্ভাবস্থায় সানস্ক্রিন ব্যবহার করা নিরাপদ এবং প্রয়োজনীয়। এই সময় অনেক নারীর ত্বকে হরমোনজনিত কারণে মেছতার সমস্যা দেখা দেয়। তবে নিয়মিত সানস্ক্রিন ব্যবহারের মাধ্যমে এটি প্রতিরোধ ও কমানো সম্ভব।
গর্ভাবস্থায় মিনারেল-বেজড বা ফিজিক্যাল সানস্ক্রিন ব্যবহার করা সবচেয়ে ভালো। এই ধরনের সানস্ক্রিনে সাধারণত জিংক অক্সাইড বা টাইটানিয়াম ডাই-অক্সাইড থাকে। যা ত্বকের ওপর একটি সুরক্ষা স্তর তৈরি করে এবং ক্ষতিকর ইউভি রশ্মিকে প্রতিফলিত করে।
ত্বকের রং যা–ই হোক না কেন, সানস্ক্রিন এড়ানো উচিত নয়
অনেকে মনে করেন যে শ্যামবর্ণ ত্বকে মেলানিনের পরিমাণ বেশি থাকার কারণে এটি সূর্যের ক্ষতিকারক রশ্মি থেকে সুরক্ষা দেয়। যদিও মেলানিন কিছুটা সুরক্ষা দিতে পারে, তবে এটি সম্পূর্ণভাবে ত্বককে রক্ষা করতে সক্ষম নয়।
সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি (UV rays) ত্বকের ক্ষতি করে, রোদে পোড়ার কারণ হতে পারে এবং দীর্ঘমেয়াদে ত্বকের অকালবার্ধক্য ও অন্যান্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। তাই ফর্সা বা শ্যামলা—সব ধরনের ত্বকের জন্যই সানস্ক্রিন ব্যবহার করা অত্যন্ত জরুরি।
সানস্ক্রিন ব্যবহার করলেও সূর্যের আলো যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো। বাইরে গেলে ছাতা ব্যবহার করুন, স্কার্ফ পরুন বা টুপি পরিধান করুন। যাতে ত্বক সরাসরি সূর্যের সংস্পর্শে না আসে।
এ ছাড়া, গরমের সময় ত্বক ও শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করা জরুরি। শরীর আর্দ্র রাখার জন্য প্রচুর পানি পান করুন এবং পুষ্টিকর মৌসুমি ফল খান। যা ত্বককে ভেতর থেকে সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখতে সহায়তা করে।
তথ্যসূত্র
- https://www.skincancer.org/bn/press/the-skin-cancer-foundation-offers-tips-on-choosing-and-using-sunscreen-2/
- https://www.ntvbd.com/lifestyle/%E0%A6%95%E0%A7%80%E0%A6%AD%E0%A6%BE%E0%A6%AC%E0%A7%87-%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A6%A8-%E0%A6%85%E0%A6%A8%E0%A7%81%E0%A6%AF%E0%A6%BE%E0%A7%9F%E0%A7%80-%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%A8-%E0%A6%95%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%A8-1209037
- https://youtu.be/fNRmfPAvwUw?si=F_HXdSNicok45abR