Image default
এশিয়াদেশ পরিচিতি

দক্ষিণ কোরিয়ার জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের আড়ালে লুকিয়ে থাকা অন্ধকার জগৎ!

দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রতি ৩৯ মিনিটে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।

দক্ষিণ কোরিয়ার কথা উঠলেই, সাধারণত কে-পপ, কে-ড্রামা, স্যামসাং-এর মতো হাই-টেক কোম্পানি, আর দেশটির সুশীল ও ভদ্র মানুষের কথা মাথায় আসে। সবকিছু যেন নিখুঁত এবং গোছানো একটি দেশ! 

কিন্তু… আসলেই কি সবকিছু এতটা নিখুঁত? নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোন এক অস্বস্তিকর সত্য?

হতাশাজনক বাস্তবতা- সৌন্দর্য ও সফলতা

 জাঁকজমকপূর্ণ জীবনের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক হতাশাজনক বাস্তবতা। কারণ, এটি বিশ্বের এমন একটি দেশ, যেখানে মানুষকে বিচার করা হয় অর্থ, পরিশ্রম, সফলতা এবং সৌন্দর্য দিয়ে। তবে ভয়াবহ বিষয় হলো সফলতা এবং সৌন্দর্য্য এখানে একে অপরের সাথে এমনভাবে জড়িয়ে রয়েছে যে, একটি ছাড়া অন্যটি সম্ভব নয়। আবার সৌন্দর্য্যের সংজ্ঞা নিয়েও আছে বিতর্ক! 

জেনে অবাক হবেন, স্কুল-কলেজ এমনকি চাকরির ক্ষেত্রেও সৌন্দর্যকেই সবচেয়ে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হয় দক্ষিণ কোরিয়াতে। ফলে আজকের দিনে, দেশটি হয়ে উঠেছে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি প্লাস্টিক সার্জারির দেশ। বিশেষ করে দেশটির নারীদের, কোরিয়ান সৌন্দর্যের মানদণ্ডে পৌঁছাতে গিয়ে নানান কসমেটিক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। নাক, চোখ, মুখ এ সব কিছু বদলে ফেলাই যেন এখানে ‘সুখী জীবনের টিকিট!

এর শুরু কোথায় 

তবে দক্ষিণ কোরিয়ানদের সৌন্দর্য্য ও সফলতা নিয়ে এমন ভাবনার শুরুটা আসলে কোথায় থেকে? এটা জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে একটু অতীতে। সময়টা ১৯৫০-এর দশক…সেসময় কোরিয়ান যুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞে পুরো দক্ষিণ কোরিয়া যেন মাটিতে মিশে গিয়েছিল। প্রতি ১০ জনে ৭ জন কোরিয়ানই অতিশয় দারিদ্র্যে দিন কাটাচ্ছিলেন। এক কথায় একটা ভেঙে পড়া, বিধ্বস্ত, অসহায় দেশ।

১৯৫০-এর দশকে যুদ্ধ বিধ্বস্ত দক্ষিণ কোরিয়া

তারপরেই ঘটে গেল এক অলৌকিক পরিবর্তন। এক সময়ের দারিদ্রপীড়িত দেশ দক্ষিণ কোরিয়া আজ হয়ে উঠেছে বিশ্বের ১৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। এমনটি সম্ভব হলো মূলত তাদের সন্তানদের শিক্ষার পিছনে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ, নিজেদের অবিশ্বাস্য পরিশ্রম, আর কর্পোরেট জগতের উপর বাজি ধরার সাহসের কারণেই। আর এভাবেই তারা এক ধ্বংসস্তূপ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি করেছে এক অর্থনৈতিক বিস্ময়। কিন্তু… এত কিছু অর্জনের পেছনে যে চাপ, সেই চাপটাই এখন ধীরে ধীরে কোরিয়ানদের ভেঙে ফেলছে। 

পরিশ্রমের ফলে মানসিক চাপ

কিন্তু যদি আপনার সাফল্যের জন্য অতিরিক্ত পরিশ্রম করাই আপনাকে ভেঙে দেয় তবে কী হবে? দক্ষিণ কোরিয়ার অনেক তরুণ শিক্ষার্থীর বাস্তবতা এমনই। দেশটিতে তাদের বাবা-মায়ের অতিরিক্ত চাপের কারণে ১৪ ঘণ্টা করে পড়াশোনা করতে হয়। 

দক্ষিণ কোরিয়ান শিশুরা স্কুলে যাচ্ছে

অন্যরা যখন সাপ্তাহিক বন্ধের সময় বিশ্রাম নেয়। তখন কোরিয়ার কিশোর-কিশোরীরা ঘুম থেকে উঠেই আরও কঠোর পরিশ্রম করার জন্য।  এটা কেবল একদিনের কথা না এই পুনরাবৃত্ত ক্লান্তি চলে প্রতিদিন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, দক্ষিণ  কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা এতটাই প্রতিযোগিতামূলক যে, অনেক বাবা-মা তাদের সন্তানদের সাফল্য নিশ্চিত করার জন্য হাজার হাজার ডলার খরচ করেন। 

এদিকে দক্ষিণ কোরিয়ায়, স্কুলের চাপও অন্য যেকোনো দেশে শিক্ষা ব্যবস্থার চেয়ে অস্বাভাবিক। প্রতি বছর এদেশে প্রায় ৩০% শিক্ষার্থী স্কুলে সহিংসতার শিকার হয়, এবং তাদের মধ্যে একাংশ আত্মহত্যা করে। এই পরিসংখ্যান অস্বস্তিকর হলেও ,এটাই কোরিয়ার তরুণদের জীবন বাস্তবতা।

K ও সৌন্দর্যের চাপ

দক্ষীণ কোরিয়ার জীবন-যাপনে হতাশা ও চাপ এর সবথেকে উৎকৃষ্ট উদাহরণ হলো দক্ষিণ কোরিয়ার কে-পপ কালচার! আমরা সবাই জানি কোরিয়া তার কে-পপ কালচারের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত এবং কে-পপ আর্টিস্টরা সফল মানুষ। আর তাই সফল মানুষ হিসেবে গড়তে  অনেক পরিবার তাদের মাত্র পাঁচ বছর বয়সের সন্তানকে পাঠিয়ে দিচ্ছে কে-পপ প্রশিক্ষণে। তবে দুঃখের বিষয়, প্রতি ৫ জন সফল তারকার বিপরীতে আরও ৫,০০০ জন ঝরে পড়ে যায়!

কে-পপ গ্রুপ বিটিএস ও ব্ল্যাক পিংক

সফলতার চাবিকাঠি প্লাস্টিক সার্জারি

আরও অবাক করা বিষয় হলো দক্ষিণ কোরিয়ায় ‘চেহারা’ শুধু একটা মুখ নয়, বরং সেটাই আপনার জীবনের সাফল্য নির্ধারণ করতে পারে। কারণ, এখানে সৌন্দর্য সমাজ চাকরি পাওয়ার যোগ্যতা ঠিক করে দেয়। এখানে  “প্রথম ইমপ্রেশনই শেষ ইমপ্রেশন”—এই ধারণাটা এতটাই গাঢ়ভাবে বসে আছে যে, চাকরির জন্য অ্যাপ্লাই করতে গেলেও আপনাকে বাধ্যতামূলকভাবে নিজের একটা ছবি জমা দিতে হয়! মানে, যোগ্যতা নয়—চেহারাই আগে যাচাই হবে! 

একজন কোরিয়ান তরুণী প্লাস্টিক সার্জারির আগে ও পরে

দেশটিতে সুন্দর দেখতে হওয়ার চাপ এতটাই বেশি যে, অনেক তরুণ-তরুণী তাদের বাবা-মায়ের কাছ থেকে গ্র্যাজুয়েশন গিফট হিসেবে প্লাস্টিক সার্জারি চায়। এমনকি প্লাস্টিক সার্জারি সেখানে একদমই স্বাভাবিক ব্যাপার! শুনতে অবাক লাগলেও, সেখানে নাক ঠিক করা বা চোখ বড় করার মতো সার্জারি অনেকটা চুল কাটার মতোই সাধারণ ব্যপার।

আরও ভয়াবহ ব্যপার হলো এই সৌন্দর্যের প্রতিযোগিতা শুধু তাদের নিজেদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর প্রভাব ছড়িয়ে গেছে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও। একজন ভারতীয়, ফিলিপিনো, থাই বা ভিয়েতনামী যদি দক্ষিণ কোরিয়ায় যায়,তাহলে তাকে অনেক সময়ই শুধু চেহারা আর গায়ের রঙ দেখে কম মর্যাদার মানুষ ধরে নেওয়া হয়। 

ফলাফল যখন আত্মহত্যা

আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, যেই দেশটা এক সময় দারিদ্র্যের মাঝে বসবাস করছিলো, তারা নিশ্চয়ই অন্যদের কষ্ট বুঝবে, সহানুভূতিশীল হবে। কিন্তু, বাস্তবতা তার উল্টো হয়েছে। তাদের অতীত দারিদ্র্য আর পরিশ্রম আজ এক জাতীয় গর্ব হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা বর্তমানে অহংকারে রূপ নিয়েছে।

তাছাড়া জেনে অবাক হবেন, দক্ষিণ  কোরিয়ায় প্রতি ৩৯ মিনিটে একজন ব্যক্তি আত্মহত্যা করে।  কেবলমাত্র গত কয়েক বছরে, এই দেশের তরুণদের জীবনে আত্মহত্যা নিয়ে এক অন্ধকার অধ্যায় যোগ হয়েছে। আর এর কারণ শুধু মাত্র এই সফল হওয়ার প্রতিযোগিতা।

দক্ষিণ কোরিয়ার আত্মহত্যার রেট এর ইনফোগ্রাফ

শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে যুদ্ধ, দখলদারি আর সংকটের ভেতর দিয়ে যাওয়ার ফলে কোরিয়ানদের ভেতর এক ধরণের গভীর ভয় গেঁথে গিয়েছে। আর সেই ভয়টা হলো নিজেদের অস্তিত্ব হারানোর ভয়। আর এই ভয় থেকেই জন্ম নিয়েছে এক ধরনের অন্যায্য বিশ্বাস, যে “দরিদ্র দেশ মানেই অলস মানুষ”। তাদের ধারণা, পরিশ্রমই সবকিছুর মূল চাবিকাঠি। তাই যখন তারা নিজেদের GDP, প্রযুক্তি, শিক্ষা বা অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকে তাকায়, তারা ভাবে, কোরিয়ানরা বাকি বিশ্বের চেয়ে বেশি পরিশ্রমী।

কিন্তু একটি ছোট্ট শিশুর পক্ষে সৌন্দর্য, প্রতিযোগীতা কিংবা ধনী হওয়ার মতো বিষয়গুলো বোঝা খুব কষ্টকর। বরং, এই ধরণের বিষয়গুলো একটি শিশুর মনে প্রয়োগ করা কতটা ভয়াবহ হতে পারে তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই অসুস্থ প্রতিযোগীতার মধ্যে দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিটি শিশুকে যেতে হচ্ছে। আর তাদের জন্য এই পৃথিবী একটা হতাশাপূর্ণ জগৎ এ রুপ নিয়েছে। 

তথ্যসূত্র-

Related posts

ইউরোপের রুটির ঝুড়ি ইউক্রেন

কালো মানুষের দেশ সুদান

শেখ আহাদ আহসান

সূর্যোদয়ের দেশ জাপান

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More