ফিরে যেতে চাই… কিন্তু কোথায়?
একটা ঘোর লাগা অনুভূতি, বুকের গভীরে অদ্ভুত এক টান—নস্টালজিয়া! হারানো দিনের স্মৃতিতে ম্লান হাসি, নিঃশব্দ কথোপকথন আর নীরব কান্নার এক ঝিলিক। কফি হউসের সেই আড্ডা, কখনও বেলা বোশ, আমাদের সবাইকে নস্টালজিক করেছে আর ভবিষ্যতেও করবে ।
আজ আমরা নস্টালজিয়াকে মনে করি এক ধরনের ইতিবাচক অনুভূতি। এই অনুভূতি আমাদের মানসিকভাবে উজ্জীবিত করে, একাকিত্ব কমায়। কিন্তু জানেন কি, মাত্র ২০০ বছর আগেও এই নস্টালজিয়া ছিল এক ভয়ংকর রোগ। এই রোগ মানুষকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিত?
নস্টালজিয়া কি?
হঠাৎ কোনো কিছুর মাধ্যমে পুরনো সময়ের কথা মনে পড়ে যাওয়াকেই নস্টালজিয়া বলে। এটি হতে পারে শৈশবের কোনো নির্দিষ্ট গন্ধ, পুরনো গানের সুর, কিংবা বন্ধুর সঙ্গে কাটানো দিনগুলোর স্মৃতি। এই অনুভূতিটি হঠাৎ করেই জাগতে পারে। যেমন, কোনো পুরনো গান শুনে মনে পড়ে যেতে পারে স্কুলের কোন ঘটনা, কিংবা খাবারের গন্ধে মনে পড়ে যেতে পারে কোন প্রিয় মানুষকে।
নস্টালজিয়া আবিষ্কার
একটা সময় ছিল যখন এই নস্টালজিয়াকে মানুষিক রোগ হিসেবে দেখা হত। ১৬৮৮ সালে, সুইস চিকিৎসক, জোহানেস হোফারের কাছে অদ্ভুত কিছু রোগী আসে। তারা সবাই সুস্থ-সবল। তাদের মাঝে শারীরিক অসুস্থতার কোনো লক্ষণ নেই। কিন্তু তাদের খাবারে রুচি নেই, কাজে মন বসে না আবার শরীরে শক্তি নেই।আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা সবাই ছিল সুইস সৈন্য। হোফার এই অদ্ভুত রোগের নাম দিলেন “নস্টালজিয়া”। নস্টালজিয়া শব্দটি প্রাচীন গ্রীক শব্দ νόστος (nostos) অর্থাৎ ‘বাড়ি ফেরার আকুলতা’ এবং ἄλγος (algos) অর্থাৎ ‘যন্ত্রণা’ নিয়ে গঠিত। নস্টালজিয়া শব্দের মানে হলো “বাড়ি ফেরার আকুলতা থেকে জন্ম নেওয়া একধরনের যন্ত্রণা।”
তাদের পরীক্ষা করতে গিয়ে হোফার বুঝতে পারলেন, দীর্ঘ সময় নিজের বাড়ি, পরিবার থেকে দূরে থাকার কষ্ট এই মানসিক অবস্থার জন্য দায়ী।এই সব রোগীর মধ্যে দেখা যেত প্রবল মানসিক যন্ত্রণা, ক্ষুধাহীনতা, অনিদ্রা। অনেকে নস্টালজিয়াতে পড়ে মারাও গেছে। যুদ্ধক্ষেত্রে দূর দেশে অবস্থান করত, তারা এই রোগ বেশি দেখা যেত সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মধ্যে।
নস্টালজিয়ার অদ্ভুত চিকিৎসা!
মাত্র কয়েকশো বছর আগে চিকিৎসকরা নস্টালজিয়াকে প্রাণঘাতী রোগ মনে করতেন। তাদের বিশ্বাস ছিল, এটি শরীর ও মস্তিষ্কের ওপর খারাপ প্রভাব ফেলে। আর তাই এই রোগ সারানোর জন্য তারা অদ্ভুত কিছু পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। এগুলো আজকের দৃষ্টিতে হাস্যকর সাথে ভয়ংকর!
- রক্ত বের করা!
অনেক চিকিৎসক বিশ্বাস করতেন যে নস্টালজিয়ার জন্য ‘বিষাক্ত রস’ (humors) দায়ী। এই রস শরীরের ভেতরে জমে থাকে। এই রস বের করার জন্য রক্ত বের করা হতো, যেন সেই বিষাক্ত উপাদান রক্তের সাথে বেরিয়ে যায়। - শাস্তি দিয়ে ‘বাস্তবে ফেরানো’
সৈন্যদের মধ্যে নস্টালজিয়াকে দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখা হতো। সেনাবাহিনীতে নস্টালজিয়ার শিকার সৈন্যদের নির্মমভাবে শাস্তি দেওয়া হতো। যেন তারা ‘বাস্তব জগতে’ ফিরে আসে। নেপোলিয়নের সময় নস্টালজিয়াকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে ধরা হতো - রাশিয়ান ‘কবর চিকিৎসা’
রাশিয়ার নস্টালজিয়ায় আক্রান্ত সৈন্যদের বাধ্য করা হতো নিজেদের কবর খুঁড়তে! যেন মৃত্যুভয়ে তারা সুস্থ হয়ে যায়।
মৃত্যু পর্যন্ত পৌঁছানো হোমসিকনেস
ইউনিভার্সিটি অব টরোন্টোর ইতিহাসবিদ এডওয়ার্ড শর্টারের মতে, নস্টালজিয়া ছিল ১৮ শতকের ভয়াবহ রোগগুলোর একটি। সেসময় চাকরি বা যুদ্ধের কারণে বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হওয়া মানুষদের মধ্যে এই রোগ দেখা যেত। কিছু মানুষ হোমসিকনেসে পড়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিত। এর ফলে অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়তো এবং অনেক সময় মারা যেত। মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময় ইউনিয়ন আর্মির মধ্যে অন্তত ৫,২১৩টি ‘নস্টালজিয়া’ আক্রান্তের ঘটনা রেকর্ড করা হয়। এর মধ্যে ৫৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল।
কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ থমাস ডডম্যান মনে করেন, এই রোগের উপসর্গগুলো অনেকটাই আজকের পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এর মতো ছিল। এই রোগটাকে কেউ কেউ বলেছিল “Homesickness”, আবার কেউ বলত “Pathological longing”। ১৭শ শতক থেকে ১৯শ শতক পর্যন্ত ইউরোপ ও আমেরিকার চিকিৎসকরা নস্টালজিয়াকে মানসিক ব্যাধি হিসেবেই দেখতেন। ডাক্তারদের মতে, অতিরিক্ত স্মৃতিচারণ শরীরে বিষের মতো ছড়িয়ে পড়ে। একজন ফরাসি চিকিৎসক তো এতটাই ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন যে বলেছিলেন, “নস্টালজিয়ার একবার কামড় পড়লে, মৃত্যু অনিবার্য!”
নস্টালজিয়া: রোগ থেকে আবেগ
২০শ শতাব্দীর শুরুতে, নস্টালজিয়া ধীরে ধীরে তার ‘রোগ’ তকমা হারিয়ে ফেলে। এটি তখন ‘সিজোফ্রেনিয়া’র মতো বড় মানসিক রোগের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যায়। তবে, আজকের নস্টালজিয়া একেবারে আলাদা।
সাউদাম্পটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী টিম ওয়াইল্ডশ্যুট এবং তার দল বছরের পর বছর গবেষণা করে দেখেছেন, বর্তমানের নস্টালজিয়া আসলে আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। এমনকি এটাও দেখা গেছে যে, নস্টালজিয়া সিরিয়ার শরণার্থীদের মানসিকভাবে চাঙ্গা রাখতে সাহায্য করেছে।
বিশ্ববিদ্যালয় অফ সাউদাম্পটনের অধ্যাপক টিম উইল্ডশুটের মতে, নস্টালজিয়া মানুষকে মানসিকভাবে শক্তিশালী করে। তার গবেষণা বলছে, এই অনুভূতি আত্মপরিচয়ের ধারাবাহিকতা তৈরি করে। সিরিয়ান শরণার্থীদের উপর গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যেও নস্টালজিয়া একটি মানসিক শান্তির অনুভূতি সৃষ্টি করে। তবে, তারা ভবিষ্যৎ নিয়ে কম আশাবাদী।
বিজ্ঞান কী বলে?
আমাদের মস্তিষ্ক অনেক রহস্যময় । বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রমাণ করেছে, আমাদের মস্তিষ্ক অতীত জীবনের কঠিন ও বাজে অভিজ্ঞতাগুলো ধীরে ধীরে ঝাপসা করে দেয়।এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় ‘রোজি রেট্রোস্পেকশন’ (Rosy Retrospection)। অর্থাৎ, আমরা অতীতকে বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর, মধুর করে মনে রাখি।
অনেক সময় একটি পুরনো গান, প্রিয় সুগন্ধ বা অজানা কোনো দৃশ্য আমাদের অতীতের মধুর মুহূর্তগুলিকে আবার জীবন্ত করে তোলে। আমাদের ব্রেনের মধ্যের অ্যামিগডালা ও হিপোক্যাম্পাস নামে দুইটি উপাদান একসঙ্গে কাজ করে স্মৃতি সংরক্ষণে। অ্যামিগডালা আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করে, আর হিপোক্যাম্পাস স্মৃতির বিশদ তথ্য সঞ্চয় করে।
এই যৌথ কার্যপ্রণালী আমাদের মনে, অতীতের ছবি ফুটিয়ে তোলে। যেমন, ছোটবেলার কোনো খেলা, বন্ধুর সঙ্গে কাটানো সোনালী মুহূর্ত অনেক বেশি রঙিন এবং প্রাণবন্ত মনে হয়। তবে, এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে আমরা জীবনের কঠিন অভিজ্ঞতা ও ব্যথা-দায়ক স্মৃতিকে ভুলে যেতে থাকি। আমাদের মস্তিষ্ক প্রকৃতপক্ষে আমাদের স্মৃতিকে এমনভাবে সাজিয়ে রাখে যাতে অতীতের ভাল দিকগুলো বেশি প্রাধান্য পায়। আর এভাবেই নস্টালজিয়া আমাদের অতীতে ফিরিয়ে নিয়ে যায়।
নস্টালজিয়া ও আধুনিক বিশ্ব
নস্টালজিয়া এখন আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। ফেসবুকের ‘On This Day’ ফিচার আমাদের পুরনো স্মৃতির প্রতি আসক্ত করে তুলছে। আমরা আর নিজেরা স্মৃতিচারণ করছি না, বরং অ্যালগরিদম আমাদের বলে দিচ্ছে কাকে মনে করতে হবে!
বছরের পর বছর ধরে, বিজ্ঞাপনদাতারা মিলেনিয়ালদের কাছে কীভাবে সফলভাবে বিজ্ঞাপন দেওয়া যায় তা নিয়ে লড়াই করে আসছেন। অবশেষে তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, স্মৃতিকাতরতা হল বিজ্ঞাপনের সবচেয়ে কার্যকর কৌশল। এই ভাবে বিভিন্ন কোম্পানির ‘রেট্রো মার্কেটিং’ আমাদের অতীতের আবেগকে কাজে লাগিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। যেমন, পুরনো ডিজাইনের পোশাক, ৯০ দশকের কার্টুন থিম, কিংবা ক্যাসেট প্লেয়ারের ডিজাইনে তৈরি মিউজিক অ্যাপ। আবার জেন-জি মার্কেটিং মিলেনিয়ালদের থেকে আলাদা।
এই বিষয়টা মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক টিম ওয়াইল্ডশুট ব্যাখ্যা করে বলেছেন, “আমরা যদি এটিকে গ্রুপ থেরাপি হিসেবে ব্যবহার করি তবে আমাদের সাবধানে চলতে হবে। গ্রুপের মধ্যে বন্ধন বৃদ্ধি করে এমন যেকোনো কিছু অন্যান্য গ্রুপের প্রতি নেতিবাচকতা বৃদ্ধি করার ক্ষমতা রাখে।”
নস্টালজিয়া এক অদ্ভুত জিনিস। কখনো এটা পুরনো দিনের উষ্ণতা এনে দেয়, কখনো বাস্তবতা থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। ছোটবেলার গলি, হারিয়ে যাওয়া মুখ, পুরনো গানের সুর—সব কিছু যেন মনে করিয়ে দেয়।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই স্মৃতির কারাগারে বন্দি, নাকি এগিয়ে যাওয়া পথের যাত্রী? অতীত আমাদের গড়ে তুলে, অনেক কিছু শেখায়। কিন্তু অতীতে আটকে থাকলে চলবে?
আপনি কী মনে করেন, নস্টালজিয়া আপনাকে এগিয়ে যেতে সাহায্য করে, নাকি মাঝে মাঝে পেছনে টেনে ধরে?