Image default
যাপন

মিনিমাল লিভিং: কম জিনিসে কেমন করে বাড়ে সুখ?

বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তা স্টিভ জবস সবসময় কালো টার্টলনেক, নীল জিন্স ও স্নিকার্স পরতেন। কেন? কারণ তিনি পোশাক বাছাইয়ের চিন্তাটাকেও সরিয়ে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দিকে মনোযোগ দিতে চেয়েছিলেন!

মিনিমালিজমের ধারণাটি বিগত কয়েক বছরে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এমনকি বাংলাদেশেও এই জীবনদর্শন এখন বহুল প্রচলিত। আমরা অনেকেই আধুনিক জীবনের চাকচিক্য ত্যাগ করে অতি সাধারণ জীবনযাপন করতে চাই। অপ্রয়োজনীয় জিনিসে ঘেরা জীবনে আমাদের চাপ, অস্থিরতা আর ক্লান্তি বেড়েই চলে। অথচ কম জিনিসে, সহজভাবে বাঁচলেই মিলতে পারে প্রকৃত শান্তি ও সুখ। মিনিমাল লিভিং বা সরল জীবনধারা ঠিক কীভাবে আমাদের মানসিক স্বস্তি এনে দেয় এই লেখায় তা জানবো।

মিনিমালিজম কী?

মিনিমালিজম হচ্ছে জীবনের গুরুত্বপূর্ণ এবং মূল্যবান জিনিসকে ধারণ করা এবং বাকি যা কিছু রয়েছে তাকে ইচ্ছাকৃত ভাবে দূরে সরিয়ে রাখা। আর যারা মিনিমালিজমকে জীবনে ধারণ করে তাদেরকে বলা হয় মিনিমালিস্ট। মিনিমালিস্ট হতে হলে নির্দিষ্ট কোনো মানদন্ড লাগে না। মিনিমালিস্টদের কাছে “Less is More” বা ‘কমই আসলে বেশি’ ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ।

ইতিহাসের ভিজুয়াল আর্ট, মিউজিক,ও অন্যান্য মিডিয়াতে মিনিমালিজম হলো একটি শিল্প আন্দোলন যা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পশ্চিমা বিশ্বে শুরু হয়েছিল। এই আন্দোলন সবচেয়ে জোরালোভাবে ১৯৬০ ও ৭০ এর দশকের প্রথম দিকে আমেরিকান ভিজুয়াল আর্ট গুলোকে সাথে নিয়ে। 

পুরনো হয়ে যাওয়া শিল্পজগতে তারা আনতে চেয়েছিলেন নতুনত্ব। শিল্পের এক বা একাধিক বিমূর্ত ধারণা প্রকাশ করার অনুশীলন তাদের কাছে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল। এরপরেই তরুণ শিল্পীরা কম উপাদান ব্যবহার করে সূক্ষ কাজের প্রতি মনোযোগ দেওয়া শুরু করলেন। শিল্প বিনির্মাণের এই চর্চা আলোড়ন সৃষ্টি করে ১৯৭০ এর শেষের দিকে।

ভিজুয়াল আর্ট

মিনিমালিজম কীভাবে মানসিক শান্তি আনে?

মিনিমাল লিভিং বা মিনিমাল একটি জীবনদর্শন, যা স্বচ্ছতা, সরলতা ও উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবনের প্রতি আমাদের আহ্বান জানায়। এই জীবনধারার মূল উদ্দেশ্য হলো অহেতুক জিনিসপত্রের জঞ্জাল সরিয়ে এমন এক মানসিক অবস্থা তৈরি করা, যেখানে শান্তি, স্থিতি এবং স্বাধীনতার স্থান থাকে।

‘মিনিমালিজম লাইফ’ লিখে যদি কেউ গুগলে সার্চ করেন, তাহলে দেখা যায় খুব সুন্দর গোছানো পরিপাটি ঘরের ছবি। একটা খাট, একটা টেবিল, পাশে একটা ফুলের টব। রান্নাঘরে মাত্র কয়েকটা ক্রোকারিজ। আলমারিতে কয়েকটা কাপড়। এই ছবিগুলো যেন চুপিচুপি বলে Simple Living ই শান্তি।’

আধুনিক জীবনের ব্যস্ততা, ভোগবাদী সংস্কৃতির চাপ এবং প্রতিনিয়ত বেশি চাওয়ার এই দৌড়ে আমরা নিজের অজান্তেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি। মানসিক চাপ, উদ্বেগ, অস্থিরতা জায়গা করে নেয় জীবনের প্রতিটি কোণে। এমন সময় মিনিমালিজম আমাদের সামনে একটি ভিন্ন পথ দেখায়—কম নিয়ে বেশি আনন্দে বাঁচার পথ।

অনেকেই মনে করে মিনিমালজিম মানে হলো শূন্য ঘরে বাস করা অথবা শুধু সাদা কালো জিনিসপত্র ব্যবহার করা। 

কিন্তু মিনিমালিজম হল সেই জীবন দর্শন, যা আমাদের শেখায় কীভাবে কম জিনিস নিয়ে সুখে থাকা যায়। কম জিনিস মানেই কম দায়িত্ব, কম ঝামেলা। ফলে সময়, মনোযোগ এবং ভালোবাসা বরাদ্দ করা যায় সত্যিকারের প্রয়োজনীয় বিষয়গুলোর জন্য, নিজের জন্য, পরিবার ও প্রিয়জনের জন্য, নিজের স্বপ্নের জন্য। এভাবেই মিনিমালিজম আমাদের শেখায় কিভাবে কম নিয়ে গভীরভাবে বাঁচা যায়। কম জিনিসে সুখী থাকার উপায় এনে দেয় মেন্টাল ক্লারিটি ।

মিনিমালিজম লাইফ

মিনিমাল লিভিং গাইড ফর স্টার্টার

বর্তমান ভোগবাদী বিশ্বে আমাদের প্রায়শই শেখানো হয়—‘আরও চাই, আরও পেতে হবে।’ প্রতিনিয়ত নতুন কিছু কেনা, জমিয়ে রাখা, তুলনা করা… এই দৌড়ে আমরা হারিয়ে ফেলছি মানসিক শান্তি। ঠিক সেই জায়গা থেকেই অনেকেই আজ ফিরছেন ‘মিনিমালিজম’ বা মিতব্যয়ী ও অর্থবহ জীবনের পথে।

বিশ্বখ্যাত উদ্যোক্তা স্টিভ জবস সবসময় কালো টার্টলনেক, নীল জিন্স ও স্নিকার্স পরতেন। কেন? কারণ তিনি পোশাক বাছাইয়ের চিন্তাটাকেও সরিয়ে দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজের দিকে মনোযোগ দিতে চেয়েছিলেন!

কেউ যদি তার মত মিনিমাল জীবন বেছে নিতে চায় তাহলে কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে হবে—

পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলা:
একটি অগোছালো পরিবেশ আমাদের মনে অস্থিরতা, দুশ্চিন্তা এবং মানসিক চাপ তৈরি করে। যখন ঘরবাড়ি বা আশপাশের পরিবেশ অপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে ভর্তি থাকে, তখন আমাদের মনও সেভাবেই ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। মিনিমালিজম বা ন্যূনতম জিনিসপত্রে জীবনযাপন এই বিশৃঙ্খলা কমিয়ে আনে। গুছানো ও পরিচ্ছন্ন পরিবেশ মানসিক শান্তি বজায় রাখে এবং মনকে প্রশান্ত করে।

কনজিউমারিসম থেকে মুক্তি:

 বর্তমান সমাজে ভোগবাদ আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন জিনিস কেনার প্রলোভনে ফেলছে। মিনিমালিজম আমাদের শেখায় কিভাবে আমরা প্রয়োজনীয় এবং টেকসই জিনিসগুলো বেছে নিতে পারি এবং অপ্রয়োজনীয় কেনাকাটা এড়িয়ে চলতে পারি। এই জীবনদর্শন মানুষকে অহেতুক ভোগ থেকে বিরত রাখে এবং প্রকৃত প্রয়োজন মেটানোর দিকেই মনোযোগী করে তোলে।

সময় ও মানসিক শান্তি বৃদ্ধি:
অল্প জিনিস থাকা মানে হলো কম সিদ্ধান্ত নেওয়া, কম চিন্তা করা। কী পরবেন, কী ব্যবহার করবেন বা কোনটা রাখবেন—এ ধরনের ছোট ছোট সিদ্ধান্তের সংখ্যা কমে যাওয়ায় আমাদের মানসিক চাপও কমে যায়। এর ফলে দৈনন্দিন জীবন হয়ে ওঠে সহজ ও হালকা, এবং আমরা আরও বেশি মেন্টাল ক্ল্যারিটি অনুভব করি।

সচেতন ব্যয়ের অভ্যাস:
যখন আমরা কেবল প্রয়োজনীয় জিনিস কিনি, তখন আমাদের খরচ অনেক কমে আসে। অপ্রয়োজনীয় খরচ কমলে সঞ্চয়ের হার বাড়ে এবং আমরা আর্থিকভাবে আরও বেশি স্থিতিশীল হতে পারি। এই অভ্যাস আমাদের ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পিত হতে সাহায্য করে।

কম জিনিস, বেশি অর্থবহতা:
যখন আমরা শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় এবং প্রিয় জিনিসগুলো রাখি, তখন প্রতিটি জিনিস আমাদের জীবনে একটি নির্দিষ্ট অর্থ বহন করে। এই জিনিসগুলোর প্রতি যত্ন এবং কৃতজ্ঞতা তৈরি হয়। অপ্রয়োজনীয় জিনিস বাদ দিয়ে মিনিমাল জীবনধারা গ্রহণ করলে আমরা জীবনের প্রকৃত সৌন্দর্য ও অর্থ উপলব্ধি করতে পারি।

স্টিভ জবস

মিনিমালিজম কোথায় কোথায় প্রয়োগ করা যায়?

  • বাসায়: অপ্রয়োজনীয় আসবাব বা জিনিস ফেলে দিয়ে প্রশান্তিময় ও খোলা পরিবেশ তৈরি করুন।
  • ডিজিটাল দুনিয়ায়: কমান অপ্রয়োজনীয় অ্যাপ, নোটিফিকেশন ও সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের সময়।
  • ক্যারিয়ারে: একসঙ্গে অনেক কাজ না করে গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ কাজে মন দিন।
  • ফ্যাশনে: অল্প কিন্তু মানসম্পন্ন, বহুমুখী পোশাক বেছে নিন।

মিনিমালিস্ট ঘর সাজানোর টিপস

১. “কম কিন্তু মানসম্পন্ন” আসবাব বেছে নিন

ঘরের প্রয়োজন অনুযায়ী নির্দিষ্ট কয়েকটি আসবাব রাখুন। অতিরিক্ত চেয়ার, টেবিল বা আলমারি শুধু জায়গা দখল করে। যেগুলো বহু কাজে ব্যবহার করা যায় (multi-functional furniture), সেগুলো বেছে নিন।

২. হালকা ও নিরপেক্ষ রঙ ব্যবহার করুন

সাদা, অফ-হোয়াইট, ধূসর, বেজ বা হালকা সবুজ/নীল রঙ ঘরকে প্রশান্তিময় ও খোলা মনে করায়। দেয়াল, পর্দা এবং বিছানার চাদরে এমন রঙ বেছে নিন।

৩. পরিষ্কার, খালি জায়গা তৈরি করুন

ঘরের প্রতিটি কোণ যেন হালকা ও নিঃশ্বাস নেওয়ার মতো ফাঁকা থাকে।

৪. অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে ফেলুন

যে জিনিসগুলো নিয়মিত ব্যবহার হয় না, সেগুলো দান করুন বা ফেলে দিন। মেঝে, টেবিল ও শেলফ সবসময় খালি রাখার চেষ্টা করুন।

৫. সংক্ষিপ্ত ও সিম্পল ডেকোরেশন ব্যবহার করুন

একটা ছোট গাছ, মোমবাতি, বা একখানা প্রিয় ছবিই ঘরের সৌন্দর্য বাড়াতে পারে। অতিরিক্ত শো-পিস বা বড় বড় পেইন্টিং পরিহার করুন।

সংক্ষিপ্ত ও সিম্পল ডেকোরেশন

৬. প্রাকৃতিক উপাদান যুক্ত করুন

ঘরে সামান্য কিছু ইনডোর গাছ রাখলে পরিবেশ প্রাণবন্ত ও সতেজ হয়। কাঠ, বাঁশ বা মাটির তৈরি জিনিসের ব্যবহার ঘরে একটি উষ্ণ, প্রাকৃতিক অনুভূতি আনে।

৭. আলো ও বাতাস চলাচলের সুবিধা রাখুন

প্রাকৃতিক আলো ও বাতাস প্রবেশ করে এমনভাবে জানালা খোলা রাখুন। ভারী পর্দার বদলে হালকা কাপড় ব্যবহার করুন।

৮. দেয়ালে খালি জায়গা রাখুন

সব দেয়ালে ছবি বা তাক না বসিয়ে কিছু জায়গা ফাঁকা রাখুন। এতে ঘর বড় ও পরিপাটি দেখায়।

৯. জিনিসের নির্দিষ্ট জায়গা নির্ধারণ করুন

প্রতিটি জিনিসের জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকলে ঘর থাকে পরিষ্কার ও গোছানো। 

১০. নিয়মিত ‘ডিক্লাটার’ করুন

মাসে অন্তত একবার ঘরের জিনিসপত্র ঝেড়ে দেখে অপ্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে ফেলুন। এটি ঘরকে হালকা ও প্রাণবন্ত রাখে।

তথ্যসূত্রঃ

Related posts

এই গরমে শরীর সুস্থ রাখতে কী খাবার খাবেন?

ত্বকের ধরণ অনুযায়ী কোন রঙের পোশাক সবচেয়ে ভালো ?

সময় কম? দেখে নিন আপনার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More