Image default
যাপন

আধুনিক ডেটিং সাইটের সমস্যা কোথায়?

আধুনিক ডেটিং-এর গোলকধাঁধায় হারিয়ে গেছেন? চারপাশে এত মানুষ কিন্তু মনের মত সঙ্গী মিলছে না? কিন্তু কেন? 

এর পেছনে থাকা অন্ধকার জগৎ সম্পর্কে জানতে পারলে, অনেক প্রশ্নের উত্তর পাওয়া সম্ভব হবে। জানুন সেই ৫টি চ্যালেঞ্জ, যা আপনার সম্পূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিতে পারে। 

এক দশক আগেও মনের মতো সঙ্গী খুঁজে বের করা ছিল এক সম্পূর্ণ ভিন্ন অভিজ্ঞতা। মানুষের পরিচয় হতো বন্ধুদের মাধ্যমে, কোনো অনুষ্ঠানে বা কর্মক্ষেত্রে। সম্পর্কগুলো গড়ে উঠত ধীরে ধীরে, সামনাসামনি কথোপকথন, একে অপরের হাবভাব বোঝা এবং একসাথে সময় কাটানোর মাধ্যমে। কিন্তু আজ, স্মার্টফোনের এক ক্লিকেই আমাদের সামনে খুলে যায় হাজার হাজার সম্ভাব্য সঙ্গীর প্রোফাইল। প্রযুক্তির এই আশীর্বাদে ভালোবাসা খোঁজা আগের চেয়ে অনেক সহজ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল, তাই না?

কিন্তু বাস্তবতা যেন ঠিক তার উল্টো। অসংখ্য তরুণ-তরুণীর কাছে আধুনিক ডেটিং, বিশেষ করে ডেটিং অ্যাপ-নির্ভর জগৎ, এক হতাশাজনক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অর্থহীন কথোপকথন, হঠাৎ করে উধাও হয়ে যাওয়া (গোস্টিং), অবাস্তব প্রত্যাশা এবং নিরন্তর সোয়াপিং-এর এই চক্রে অনেকেই আজ ক্লান্ত। 

ভালোবাসা খোঁজার এই নতুন পদ্ধতি কেন প্রায়শই এত তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্ম দেয়? কেন আজকাল প্রেম সহজে টিকছে না?

এর উত্তর লুকিয়ে আছে আধুনিক প্রযুক্তির তৈরি করা কিছু মনস্তাত্ত্বিক ফাঁদের মধ্যে। চলুন, সেই মূল ৫টি কারণ বিশ্লেষণ করা যাক, যা জানলে আপনি আধুনিক ডেটিং-এর এই জটিল গোলকধাঁধা  আরও ভালোভাবে বুঝতে পারবেন।

কারণ ১: প্রচুর বিকল্প জন্ম দেয় সিদ্ধান্তহীনতার (The Paradox of Choice)

ডেটিং অ্যাপগুলোর সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন হলো আপনার সামনে রয়েছে পছন্দের অফুরন্ত সুযোগ। হাজার হাজার প্রোফাইলের মধ্যে থেকে আপনি আপনার মনের মতো সঙ্গী বেছে নিতে পারেন। শুনতে দারুণ লাগলেও, মনোবিজ্ঞানী ব্যারি শোয়ার্টজ তার বিখ্যাত “The Paradox of Choice” তত্ত্বে দেখিয়েছেন যে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অপশন বা বিকল্প আমাদের সুখী করার পরিবর্তে আরও বেশি উদ্বিগ্ন, দ্বিধান্বিত করে তোলে। প্রচুর সুযোগ থাকার কারণে আমাদের ভেতর আরও বেশি কিছু পাওয়ার ক্ষুধা তৈরি হয়৷ 

মনোবিজ্ঞানী ব্যারি শোয়ার্টজ এবং তার বিখ্যাত -The Paradox of Choice- তত্ত্ব

কীভাবে এটি ডেটিং-এর ক্ষেত্রে কাজ করে?

যখন আপনার সামনে শত শত প্রোফাইল থাকে, তখন আপনি কাকে বেছে নেবেন, তা নিয়ে এক ধরনের দ্বিধাদ্বন্দে ভুগতে শুরু করেন। আপনি হয়তো কারো সাথে কথা বলা শুরু করলেন, কিন্তু আপনার মনের গভীরে সবসময় একটি চিন্তা কাজ করে—”এর চেয়েও ভালো কেউ কি পরের প্রোফাইলে অপেক্ষা করছে?” এই ‘আরও ভালো কিছু পাওয়ার’ (Fear of Missing Out বা FOMO) আশঙ্কা থেকে আমরা কোনো একজন মানুষের প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ দিতে পারি না।

এর ফলে, আমরা হয় কাউকেই বেছে নিতে পারি না, অথবা একাধিক মানুষের সাথে ভাসা ভাসা সম্পর্ক বজায় রাখি। ডেটিং এপের মাধ্যমে কোনো সম্পর্ক গড়ে উঠলেও তা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ক্ষণস্থায়ী হয় কারণ আমাদের মনে হয়, আরও ভালো অপশন হয়তো হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। পছন্দের এই প্রাচুর্যই আমাদের কোনো একজন পছন্দসই মানুষের প্রতি বিশ্বস্ত থাকতে বাধা দেয়, যা আধুনিক ডেটিং-এর অন্যতম বড় একটি সমস্যা।

কারণ ২: নিখুঁত মানুষের খোঁজ এবং অবাস্তব প্রত্যাশা (The Illusion of Perfection)

সোশ্যাল মিডিয়া এবং ডেটিং অ্যাপের প্রোফাইলগুলো হলো আমাদের জীবনের এক একটি ‘হাইলাইট রিল’। এখানে আমরা আমাদের সবচেয়ে ভালো ছবি, আকর্ষণীয় সব কর্মকাণ্ড এবং সবচেয়ে সফল মুহূর্তগুলোই তুলে ধরি। কেউ তার খারাপ দিনের ছবি, তার দুর্বলতা কিংবা তার সাধারণ, সাদামাটা জীবনের মুহূর্তগুলো প্রোফাইলে দেয় না।

এই ডিজিটাল পারফেকশনের জগতে বাস করতে করতে আমাদের মনে অবচেতনভাবে এক নিখুঁত সঙ্গীর কাল্পনিক ছবি তৈরি হয়ে যায়। আমরা এমন একজন মানুষকে খুঁজতে শুরু করি, যার প্রোফাইলের মতোই জীবনটা হবে নিখুঁত, যার আছে আকর্ষণীয় চেহারা, ভালো চাকরি, দারুণ ব্যক্তিত্ব কিন্তু কোনো ধরনের মানসিক বা চারিত্রিক খুঁত তার মধ্যে থাকবে না।

বাস্তবতার সাথে সংঘাত কোথায়?

সমস্যাটা তখনই শুরু হয়, যখন আমরা এই ডিজিটাল ফ্যান্টাসি থেকে বেরিয়ে বাস্তব জীবনে কারো সাথে দেখা করি। বাস্তব মানুষটি হয়তো দেখতে তার সবচেয়ে সুন্দর ছবিটির মতো নয়, তার হয়তো কিছু মুদ্রাদোষ আছে, বা সে হয়তো সবসময় সুন্দর করে কথা বলতে পারে না। 

আমাদের আকাশচুম্বী প্রত্যাশার সাথে এই বাস্তবতার সংঘাত ঘটলে, আমরা খুব সহজেই হতাশ হয়ে পড়ি। আমরা তার ছোটখাটো খুঁতগুলোকেই বড় করে দেখি এবং তাকে পছন্দের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিই, কারণ সে আমাদের সেই ‘নিখুঁত’ তালিকার সাথে বাস্তবের এই দোষত্রুটি যুক্ত মানুষটির চরিত্র মিলছে না। 

এই অবাস্তব প্রত্যাশার কারণেই আধুনিক ডেটিং-এ অনেক সম্পর্ক শুরু হওয়ার আগেই শেষ হয়ে যায়।

কারণ ৩: তাড়াহুড়োর কারণে সম্পর্কে গভীরতার অভাব (Lack of Depth and Instant Gratification)

আধুনিক ডেটিং-এর জগৎটি চলে ‘ফাস্ট ফুড’ সংস্কৃতির মতো। সবকিছু চাই দ্রুত এবং তাৎক্ষণিকভাবে। ডেটিং অ্যাপে আমরা মাত্র কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি প্রোফাইল দেখে সিদ্ধান্ত নিই, ডানে সোয়াইপ (লাইক) নাকি বামে সোয়াইপ (ডিসলাইক)। এই সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয় মূলত কয়েকটি ছবি এবং একটি ছোট বায়োর ওপর ভিত্তি করে, যা একজন মানুষকে ভালোভাবে জানতে বা চিনতে কোনভাবেই যথেষ্ট নয়। তাছাড়া কেউ চাইলে এখানে ভুল তথ্যও দিতে পারে৷ 

এই প্রক্রিয়াটি আমাদের বিচারবুদ্ধিকে অত্যন্ত সুপারফিশিয়াল করে তোলে। আমরা এইটুকু তথ্য দেখেই আরেকজন ব্যক্তি সম্পর্কে ভাবতে শুরু করি বা বিচার করতে শুরু করি।

একজন ব্যক্তির মনমানসিকতা সম্পর্কে পুরোপুরি  জানার আগেই, শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ বা পেশার ওপর ভিত্তি করে তাকে বিচার করি এবং সিদ্ধান্ত নিই। 

রেস্টুরেন্টে ডেট

‘স্পার্ক’-এর খোঁজ

তাৎক্ষণিকতার এই সংস্কৃতি আমাদের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। আমরা প্রথম দেখাতেই বা প্রথম কয়েকবার মেসেজিংয়েই এক ধরনের ‘ম্যাজিক্যাল স্পার্ক’ বা বৈদ্যুতিক আকর্ষণ আশা করি। যদি সেই তীব্র আকর্ষণটি শুরুতেই অনুভব না করি, তাহলে আমরা ধরে নিই যে এই সম্পর্কটি কাজ করবে না এবং আমরা পরের অপশনের দিকে চলে যাই।

অথচ, সত্যিকারের গভীর সম্পর্ক বা ভালোবাসা প্রায়শই কোনো ‘ম্যাজিক্যাল স্পার্ক’ দয়ে শুরু হয় না। এটি ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে পারস্পরিক সম্মান, বিশ্বাস, একসাথে সময় কাটানো এবং একে অপরকে বুঝতে চেষ্টার মাধ্যমে। 

আধুনিক ডেটিং-এর এই তাড়াহুড়োর সংস্কৃতি সেই ধৈর্য, একে অন্যকে বোঝা এবং সময় দেওয়ার সুযোগটিকেই নষ্ট করে দিচ্ছে।

কারণ ৪: ডিজিটাল যোগাযোগ এবং ভুল বোঝাবুঝির গোলকধাঁধা (Communication Breakdown)

প্রযুক্তির কল্যাণে আমরা এখন যেকোনো সময় যেকোনো মানুষের সাথে যোগাযোগ করতে পারি। কিন্তু এই ডিজিটাল যোগাযোগই আধুনিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তৈরি করছে এক বিশাল দেয়াল।

  • ভুল বোঝাবুঝি: টেক্সটিং বা চ্যাটিং-এর সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এখানে কোনো নন-ভার্বাল কিউ বা শারীরিক অভিব্যক্তির সুযোগ নেই। আমরা একে অপরের গলার স্বর, চোখের চাহনি বা শারীরিক ভাষা দেখতে পাই না। এর ফলে, একটি সাধারণ শব্দ বা বাক্যও ভিন্ন ভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হতে পারে। একটি “Ok” বা একটি “K” যে কত সম্পর্কের ইতি টেনেছে, তার কোনো শেষ নেই। সারকাজম, রসিকতা বা আবেগের গভীরতা —কোনোটাই টেক্সটে ঠিকভাবে প্রকাশ করা যায় না, যা থেকে জন্ম নেয় ভুল বোঝাবুঝি এবং যার পরিণতি হয় সম্পর্কের ভাঙ্গন।
  • ‘টেক্সটিং-শিপ’: অনেক আধুনিক সম্পর্ক আজ ‘টেক্সটিং-শিপ’-এ পরিণত হয়েছে। অর্থাৎ, সম্পর্কটি শুধুমাত্র টেক্সট চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ চ্যাটিং চললেও, সামনাসামনি দেখা করার কোনো উদ্যোগ থাকে না। এই ভার্চুয়াল সম্পর্কগুলো বাস্তবতার ছোঁয়া পায় না, যার ফলে  সামান্য ভুল বোঝাবুঝিতেই সম্পর্ক ভেঙে যায়।
  • গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা এড়িয়ে যাওয়া: ডিজিটাল যোগাযোগ আমাদের প্রয়োজনীয় কথোপকথনগুলো এড়িয়ে যাওয়ার অনেক সুযোগ করে দেয়। মতের অমিল হলে বা কোনো সমস্যা দেখা দিলে, সরাসরি কথা বলার পরিবর্তে আমরা হয় টেক্সট করা বন্ধ করে দিই বা উত্তর দেওয়া এড়িয়ে যাই। কিন্তু একটি সুস্থ সম্পর্কের জন্য এই আলোচনাগুলোই সবচেয়ে বেশি জরুরি।

কারণ ৫: সম্পর্কের ‘ডিসপোজেবল’ সংস্কৃতি এবং দায়বদ্ধতার অভাব (The “Disposable” Culture)

আধুনিক ডেটিং-এর সবচেয়ে নিষ্ঠুর এবং বেদনাদায়ক দিকটি হলো এর ‘ডিসপোজেবল’ বা ‘ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া’র সংস্কৃতি। যেহেতু আমাদের হাতে পছন্দের অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে, তাই আমরা অন্য আরেকজন মানুষকে আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না; আমরা তাদের প্রতিস্থাপনযোগ্য (replaceable) ভাবতে শুরু করি।

‘গোস্টিং’ (Ghosting)

এই সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় উদাহরণ হলো ‘গোস্টিং’। এর মানে হলো, কোনো ধরনের ব্যাখ্যা বা বিদায় না জানিয়েই হঠাৎ করে একজনের জীবন থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে যাওয়া। যেমন ধরুন, কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ ধরে একজনেরর সাথে আপনার কথাবার্তা চলছিল এবং দুজনের মধ্যে ভাবের বিনিময়ও হয়েছে কিন্তু সে হঠাৎ করেই আপনার কল, মেসেজের উত্তর দেওয়া বন্ধ করে দিলো, যেন তার কোনো অস্তিত্বই ছিল না। এটাকেই বলা হয় গোস্টিং।

এই ধরনের আচরণ মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এটি মানুষের মনে আত্মবিশ্বাসহীনতা,  প্রত্যাখ্যানের ভয় এবং আস্থার সংকট তৈরি করে। ডিজিটাল জগতের আড়ালে থাকার কারণে কোনো ধরনের দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহিতার প্রয়োজন হয় না বলেই মানুষ অন্য আরেক মানুষের প্রতি এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন নিষ্ঠুর আচরণ করতে পারে খুব সহজেই।

এই ডিসপোজেবল মানসিকতার কারণেই আজকাল সম্পর্কগুলো এত ভঙ্গুর এবং ক্ষণস্থায়ী।

প্রযুক্তি আমাদের অনেক সুযোগ করে দিয়েছে, কিন্তু সেই সুযোগকে কীভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেই বিচক্ষণতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে। আধুনিক ডেটিং-এর এই গোলকধাঁধা থেকে বেরোনোর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং মানবিকতার বোধসম্পন্ন সম্পূর্ণ ভিন্ন এক দৃষ্টিভঙ্গি।

পছন্দের প্রাচুর্যে ভেসে না গিয়ে, কয়েকটি নির্দিষ্ট প্রোফাইলের উপর মনোযোগ দিন। নিখুঁত মানুষের খোঁজ না করে, জীবনে দোষত্রুটি যুক্ত একজন বাস্তব মানুষকে নিজের জীবনে নিয়ে আসুন।

 তাৎক্ষণিক ‘স্পার্ক’-এর পেছনে না ছুটে, ধৈর্য ধরে একটি সম্পর্ককে সময় দিন। ডিজিটাল যোগাযোগের পাশাপাশি সামনাসামনি কথা বলাকে গুরুত্ব দিন এবং সর্বোপরি, অন্য মানুষটিকে সম্মান করুন। মনে রাখবেন, ভালোবাসা বা একটি সুন্দর সম্পর্ক চারাগাছের মতো, যাকে যত্ন, সময় এবং ধৈর্য দিয়ে ধীরে ধীরে বড় করে তুলতে হয়।

তথ্যসূত্র –

Related posts

সময় কম? দেখে নিন আপনার জন্য উপযুক্ত ব্যায়াম

ইনডোর প্ল্যান্ট নাকি জাদুর কাঠি?

admin

এই গরমে শরীর সুস্থ রাখতে কী খাবার খাবেন?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More