গোপন বিয়ে, সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক, আমেরিকার গ্রিন কার্ড আর নতুন সিনেমার বিশ্বজয়ী পরিকল্পনা। পর্দার আড়ালে শাকিব খানের জীবন সিনেমার চেয়েও বেশি নাটকীয়। মাসুদ রানা থেকে মেগাস্টার হয়ে ওঠার এই যাত্রায় শাকিব খানের কতটুকু আপনারা জানেন?
ঢালিউড বা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্পের কথা উঠলে গত দুই দশকে একটি নামই বারবার ঘুরেফিরে এসেছে, শাকিব খান। কারো কাছে তিনি ‘কিং খান’, কারো কাছে ‘নাম্বার ওয়ান শাকিব খান’, আবার কারো কাছে শুধুই ‘মেগাস্টার’। তিনি শুধু একজন নায়ক নন, তিনি নিজেই একটি ইন্ডাস্ট্রি। তার নামের ওপর ভর করে আজও কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ হয়, তার সিনেমার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে থাকে লক্ষ লক্ষ ভক্ত। এক কথায়, তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপন।
২০২৫ সালে এসে, ক্যারিয়ারের প্রায় আড়াই দশক পার করে, শাকিব খান যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেছেন। আমেরিকার দীর্ঘ বসবাস, শারীরিক রূপান্তর এবং চলচ্চিত্রের প্রতি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তাকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক ব্লকবাস্টার ‘তান্ডব’, তুফান, বরবাদ, প্রিয়তমা’-এর সাফল্য যেন তার এই নতুন যাত্রারই ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু পর্দার এই চাকচিক্য আর সাফল্যের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক অন্য শাকিব খানের গল্প। এক সাধারণ তরুণের অসাধারণ হয়ে ওঠার সংগ্রাম, ব্যক্তিগত জীবনের নানা ঝড়, বিতর্ক এবং ভবিষ্যতের জন্য এক বিশাল পরিকল্পনার কাহিনি।
মাসুদ রানা থেকে শাকিব খান
আজকের মেগাস্টার শাকিব খানের শুরুটা কিন্তু এতটা মসৃণ ছিল না। ১৯৭৯ সালে গোপালগঞ্জের একটি সাধারণ পরিবারে তার জন্ম। পরিবারের দেওয়া নাম ছিল মাসুদ রানা। ছোটবেলা থেকেই সিনেমার প্রতি ছিল তার তীব্র আকর্ষণ, বিশেষ করে সালমান শাহের স্টাইল তাকে দারুণভাবে প্রভাবিত করেছিল। সেই আকর্ষণ থেকেই নব্বইয়ের দশকের শেষে এক বুক স্বপ্ন নিয়ে তিনি পা রাখেন ঢাকার চলচ্চিত্র জগতে।
১৯৯৯ সালে পরিচালক সোহানুর রহমান সোহানের ‘অনন্ত ভালোবাসা’ সিনেমার মাধ্যমে রুপালি পর্দায় তার অভিষেক ঘটে। তবে তার নাম মাসুদ রানা থেকে বদলে রাখা হয় শাকিব খান। প্রথম সিনেমাই তাকে পরিচিতি এনে দিলেও, তারকা হয়ে ওঠার পথটি ছিল বেশ দীর্ঘ এবং বন্ধুর। ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়টা ছিল তার জন্য এক কঠিন সংগ্রামের অধ্যায়। সেই সময়ে ঢালিউড ছিল রিয়াজ, ফেরদৌস, মান্নার মতো প্রতিষ্ঠিত নায়কদের দখলে। কোনো চলচ্চিত্র পরিবার থেকে না আসায়, শাকিব খানকে নিজের জায়গা তৈরি করতে হয়েছিল শুধুমাত্র পরিশ্রম এবং অধ্যাবসায়ের মাধ্যমে।
এই সময়ে তিনি অসংখ্য সিনেমায় অভিনয় করেছেন, যার বেশিরভাগই ছিল মাঝারি মানের। তিনি কখনও দ্বিতীয় নায়ক, কখনও মাল্টি-স্টারার সিনেমার অংশ হয়েছেন। কিন্তু তিনি হাল ছাড়েননি। প্রতিটি সিনেমার মাধ্যমে তিনি নিজেকে ভেঙেছেন, গড়েছেন, শিখেছেন অভিনয়ের নানা কৌশল এবং ইন্ডাস্ট্রির বাণিজ্যিক দিকগুলো। এই সময়ের পরিশ্রমই তার ভবিষ্যতের শক্ত ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল এবং পরিচালক-প্রযোজকদের মধ্যে একটি নির্ভরযোগ্য নাম হিসেবে তাকে প্রতিষ্ঠা করেছিল।
২০০৭-০৮ সাল থেকে শাকিব খানের ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরতে শুরু করে। ‘আমার প্রাণের স্বামী’, ‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’-র মতো সিনেমাগুলো তাকে বাণিজ্যিক সফলতা এনে দেয়। বিশেষ করে ২০০৮ সালে মুক্তি পাওয়া ‘প্রিয়া আমার প্রিয়া’ সিনেমার আকাশছোঁয়া সাফল্য তাকে ঢালিউডের শীর্ষ নায়কের আসনে বসিয়ে দেয়। এই সিনেমাটি তৎকালীন সময়ে আয়ের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে এবং শাকিব খানকে ‘নাম্বার ওয়ান’ নায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। এই সিনেমার পর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তিনি হয়ে ওঠেন পরিচালকদের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য এবং দর্শকদের সবচেয়ে প্রিয় নায়ক।
পরবর্তী এক দশক, অর্থাৎ ২০০৯ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত সময়টা ছিল শাকিব খানের একচ্ছত্র আধিপত্যের সময়। তিনি একাই ঢালিউডকে টেনে নিয়ে গেছেন। এই সময়ে তিনি যাতেই হাত দিয়েছেন, তাই যেন সোনা হয়ে গেছে। ঈদ মানেই ছিল শাকিব খানের সিনেমা, আর শাকিব খানের সিনেমা মানেই ছিল উৎসব।
এই সময়ে তার সাফল্যের সবচেয়ে বড় অংশীদার ছিলেন চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস। শাকিব-অপু জুটি বাংলা সিনেমার ইতিহাসে অন্যতম সফল এবং জনপ্রিয় জুটিতে পরিণত হয়। তারা একসাথে ৭০টিরও বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছেন এবং প্রায় প্রতিটি সিনেমাই ব্যবসায়িকভাবে সফল হয়েছে। তাদের অন-স্ক্রিন রসায়ন দর্শকদের এতটাই মুগ্ধ করেছিল যে, পর্দার বাইরেও তাদের সম্পর্ক নিয়ে গুঞ্জন শুরু হয়, যা পরবর্তীকালে সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছিল। ‘কোটি টাকার কাবিন’, ‘চাচ্চু’, ‘দাদীমা’-র মতো সিনেমাগুলো তাদের জুটিকে কিংবদন্তির পর্যায়ে নিয়ে যায়।
শাকিব খান খুব দ্রুতই বাণিজ্যিক সিনেমার ফর্মুলাটি আয়ত্ত করে ফেলেন। অ্যাকশন, রোমান্স, ড্রামা এবং নাচ-গানের এক নিখুঁত মিশ্রণ থাকতো তার সিনেমায়। গ্রামের সহজ-সরল যুবক থেকে শহরের ডন সব চরিত্রেই তিনি ছিলেন সাবলীল। তার সংলাপ বলার ভঙ্গি এবং ম্যানারিজম সাধারণ দর্শকদের মধ্যে দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়। তিনিই হয়ে ওঠেন ঢালিউডের একমাত্র ‘ওয়ান ম্যান শো’, যার কাঁধে ভর করে পুরো ইন্ডাস্ট্রি চলত।
সাফল্যের সাথে সাথেই তিনি হয়ে ওঠেন ঢালিউডের সবচেয়ে দামী তারকা। তার পারিশ্রমিক ৬০ লক্ষ থেকে শুরু করে এক কোটি টাকা পর্যন্ত পৌঁছে যায় বলে শোনা যায়, যা ইন্ডাস্ট্রির অন্য যেকোনো নায়কের চেয়ে অনেক গুণ বেশি। এই উচ্চ পারিশ্রমিক একদিকে যেমন তার তারকাখ্যাতির প্রমাণ, তেমনই এটি নিয়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে। তবে প্রযোজকরা জানতেন, শাকিব খানের নামের ওপর বিনিয়োগ করলে টাকা ফেরত আসার নিশ্চয়তা প্রায় শতভাগ। তার এই তারকাখ্যাতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছায় যে, সিনেমা হিট করানোর জন্য তার উপস্থিতিই যথেষ্ট ছিল, গল্পের প্রয়োজন হতো না।
ব্যক্তিগত জীবনের ঝড়: প্রেম, গোপন বিয়ে ও বিতর্ক
পর্দার জীবনে শাকিব খান যতটা সফল, পর্দার বাইরের ব্যক্তিগত জীবন তার ঠিক ততটাই জটিল এবং বিতর্কে ভরা। তার প্রেম, বিয়ে এবং সম্পর্ক নিয়ে গণমাধ্যমে যে পরিমাণ আলোচনা হয়েছে, তা অন্য কোনো বাংলাদেশি তারকাকে নিয়ে হয়নি।
অধ্যায় এক: অপু বিশ্বাস ও আব্রাম খান জয়
শাকিব খানের জীবনের সবচেয়ে নাটকীয় অধ্যায়টি জড়িত অপু বিশ্বাসকে ঘিরে। দীর্ঘ সময় ধরে তাদের প্রেমের গুঞ্জন থাকলেও, দুজনেই তা অস্বীকার করে আসছিলেন। তারা গোপনে ২০০৮ সালে বিয়ে করেন। কিন্তু ক্যারিয়ারের স্বার্থে সেই খবরটি দীর্ঘ ৯ বছর ধরে গোপন রাখা হয়। ২০১৬ সালে তাদের কোল আলো করে আসে পুত্রসন্তান আব্রাম খান জয়। এই খবরটিও ছিল লোকচক্ষুর আড়ালে।
অবশেষে, ২০১৭ সালের ১০ই এপ্রিল, অপু বিশ্বাস একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের লাইভ অনুষ্ঠানে সন্তান আব্রামকে নিয়ে হাজির হন এবং তাদের গোপন বিয়ে ও সন্তানের কথা প্রকাশ করেন। এই ঘটনাটি পুরো দেশে এক বিস্ফোরণের মতো আলোড়ন তৈরি করে। এটি ছিল ঢালিউডের সবচেয়ে বড় ‘ওপেন সিক্রেট’-এর প্রকাশ। শাকিব খান প্রথমে বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখালেও, পরে চাপের মুখে বিয়ে এবং সন্তানের কথা স্বীকার করে নেন। কিন্তু এই ঘটনার পর তাদের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে এবং ২০১৮ সালে বহু নাটকীয়তার পর তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়। এই পুরো অধ্যায়টি শাকিব খানের ভাবমূর্তিতে একটি বড় ধাক্কা দেয় এবং তাকে একজন দায়িত্বহীন স্বামী ও পিতা হিসেবে সমালোচিত হতে হয়।
অধ্যায় দুই: শবনম বুবলী ও শেহজাদ খান বীর
অপু বিশ্বাসের সাথে বিচ্ছেদের পর, শাকিব খানের ক্যারিয়ারে এবং জীবনে শবনম বুবলীর আগমন ঘটে। বুবলীর অভিষেকই হয় শাকিব খানের বিপরীতে এবং খুব দ্রুতই তারা একটি নতুন জনপ্রিয় জুটি হিসেবে পরিচিতি পান। আবারও সেই পুরনো গুঞ্জন, তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক রয়েছে। কিন্তু এবারও তারা দুজনেই বিষয়টি এড়িয়ে যান।
২০২২ সালে এসে আবারও একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। বুবলী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জানান যে, তিনি এবং শাকিব খান বিবাহিত এবং তাদের শেহজাদ খান বীর নামে একটি পুত্রসন্তানও রয়েছে। জানা যায়, তাদের বিয়েও হয়েছিল গোপনে, ২০১৮ সালে। এই খবরটিও শাকিব খানের ব্যক্তিগত জীবনকে নতুন করে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে আসে। যদিও তারা এখনও আইনত বিবাহিত, কিন্তু তাদের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল এবং তারা আলাদা থাকছেন বলেই জানা যায়। এই দুই সম্পর্ক নিয়ে অপু বিশ্বাস এবং শবনম বুবলীর মধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রায়ই ঠান্ডা লড়াই চলতে দেখা যায়, যা শাকিব খানকে আরও বেশি বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলে।
সম্পর্কের জটিল সমীকরণ ও ‘সিঙ্গেল’ স্ট্যাটাসের রহস্য
শাকিব খান যখন জনসমক্ষে নিজেকে ‘সিঙ্গেল’ বলে দাবি করেন, তখন তা ঢালিউডের সবচেয়ে বড় আলোচনার জন্ম দেয়। দুটি আলোচিত বিয়ে, দুটি সন্তান এবং জনসমক্ষে আসা তিক্ত বিতর্ক এই সবকিছুর পর তার এই ‘সিঙ্গেল’ স্ট্যাটাসটি ভক্ত এবং সমালোচকদের কাছে এক জটিল ধাঁধার মতো। তবে এই ধাঁধাটি আরও ঘনীভূত হয়েছে সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায়, যা তার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে আবারও নতুন করে জল্পনা-কল্পনার ঝড় তুলেছে।
কিছুদিন আগেও তার ‘সিঙ্গেল’ থাকার কারণ হিসেবে কয়েকটি বিষয়কে চিহ্নিত করা হতো। প্রথমত, দুটি সম্পর্ক যেভাবে জনসমক্ষে এসেছে, তাতে তার ব্যক্তিগত জীবনে আস্থার সংকট তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। দ্বিতীয়ত, তিনি তার ক্যারিয়ারের এক নতুন এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপে রয়েছেন, যেখানে তিনি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চান। তাই ব্যক্তিগত জীবনের জটিলতা থেকে দূরে থেকে তিনি পুরোপুরি তার কাজে মনোযোগ দিতে চান। এবং তৃতীয়ত, দুই সন্তান আব্রাম এবং শেহজাদের প্রতি তিনি তার দায়িত্ব পালনে এখন অনেক বেশি মনোযোগী।
কিন্তু ২০২৫ সালের মাঝামাঝি সময়ে, এই সরল সমীকরণটি নতুন করে জটিল হয়ে ওঠে। আমেরিকা সফরে গিয়ে শাকিব খানকে তার দ্বিতীয় স্ত্রী শবনম বুবলী এবং তাদের পুত্র শেহজাদ খান বীরের সাথে বেশ অন্তরঙ্গভাবে সময় কাটাতে দেখা যায়। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, তারা একসাথে ঘুরছেন, শপিং করছেন এবং ছেলের সাথে খেলছেন। অনেকটা একটি সুখী পরিবারের মতো। বুবলীর সাথে তার কিছু ‘ক্লোজ’ ছবিও প্রকাশিত হয়, যা তাদের মধ্যে শুধু সৌজন্যমূলক সম্পর্ক নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছুর ইঙ্গিত দেয়।
এই ঘটনাটি শাকিব খানের ভক্তদের মধ্যে এক বিরাট বিভ্রান্তি তৈরি করে। কারণ, এর কিছুদিন আগেও বুবলীর সাথে তার সম্পর্ক অত্যন্ত শীতল ছিল এবং তারা যে শুধুমাত্র সন্তানের খাতিরে যোগাযোগ রাখেন, এমনটিই জানা গিয়েছিল। তাহলে আমেরিকার এই দৃশ্যগুলোর অর্থ কী? তারা কি আবার একসাথে সংসার করছেন? নাকি এটি ছিল শুধুমাত্র সন্তানের জন্য একটি লোকদেখানো সৌজন্য?
এই ঘটনার পর শাকিব খানের প্রথম স্ত্রী, চিত্রনায়িকা অপু বিশ্বাস, সরাসরি কোনো মন্তব্য না করলেও সামাজিক মাধ্যমে একটি ইঙ্গিতপূর্ণ পোস্ট দেন। তিনি লেখেন, “সত্যিকারের ভালোবাসা আর দায়িত্ববোধ কখনো লোকদেখানো হয় না, তা নীরবে পালন করতে হয়।” যদিও তিনি কারো নাম উল্লেখ করেননি, কিন্তু সবাই ধরে নেন যে, তার এই মন্তব্যটি শাকিব-বুবলীর আমেরিকা সফরকেই উদ্দেশ্য করে লেখা। অপুর এই এক লাইনের প্রতিক্রিয়াই যেন শাকিব খানের ব্যক্তিগত জীবনের ত্রিভুজ প্রেমের জটিলতাকে আবারও সবার সামনে নিয়ে আসে এবং ভক্তদের মধ্যে নতুন করে বিভাজন তৈরি করে।
এই নতুন প্রেক্ষাপটে, শাকিব খানের ‘সিঙ্গেল’ স্ট্যাটাসকে এখন কয়েকটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা যায়:
- শাকিব খান হয়তো কৌশলগত কারণেই নিজেকে ‘সিঙ্গেল’ হিসেবে উপস্থাপন করেন। একজন ‘অ্যাভেইলেবল’ সুপারস্টারের আবেদন তার ভক্তদের, বিশেষ করে নারী ভক্তদের কাছে, সবসময়ই বেশি থাকে। এটি তার তারকাখ্যাতি বজায় রাখার একটি পরীক্ষিত উপায় হতে পারে।
- আমেরিকা এবং পশ্চিমা বিশ্বে ‘কো-প্যারেন্টিং’-এর ধারণাটি খুব স্বাভাবিক, যেখানে ডিভোর্সড বা আলাদা থাকা বাবা-মা শুধুমাত্র সন্তানের সুস্থ বিকাশের জন্য একসাথে সময় কাটান। শাকিব খান হয়তো সেই আধুনিক মানসিকতা থেকেই বুবলী ও পুত্রের সাথে সময় কাটিয়েছেন, যার সাথে তার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কোনো যোগসূত্র নেই।
- এটাও সম্ভব যে, তাদের সম্পর্কটি একটি অন-অফ বা আসা-যাওয়ার মধ্যে রয়েছে। মিডিয়ার চাপ থেকে দূরে, বিদেশের মাটিতে তারা হয়তো তাদের সমস্যাগুলো মিটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
সম্ভবত, আসল সত্যটি এর কোনো একটি বা সবগুলোর মিশ্রণ। শাকিব খান এখন একজন পরিণত মানুষ এবং বিচক্ষণ তারকা, যিনি জানেন কীভাবে তার ব্যক্তিগত এবং পেশাগত জীবনকে আলাদা রাখতে হয়, আবার প্রয়োজনে একে অপরের পরিপূরক হিসেবে ব্যবহার করতে হয়। তিনি তার দুই সন্তানের প্রতি তার দায়িত্ববোধ এবং তার ক্যারিয়ারের প্রতি তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা দুটিকেই সমান গুরুত্ব দিচ্ছেন।
‘নতুন শাকিব’: আমেরিকা পর্ব ও ক্যারিয়ারের রূপান্তর
৩০২১ সালের শেষের দিকে শাকিব খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং সেখানে প্রায় ৯ মাস অবস্থান করেন। এই সময়টা ছিল তার ক্যারিয়ারের এক বিশাল টার্নিং পয়েন্ট। এটি ছিল শুধু একটি ভ্রমণ নয়, এটি ছিল এক আত্ম-আবিষ্কারের যাত্রা।
আমেরিকায় স্থায়ী হচ্ছেন কি?
তিনি আমেরিকার গ্রিন কার্ড বা স্থায়ী বসবাসের অনুমতি লাভ করেছেন। এরপর থেকেই গুঞ্জন শুরু হয় যে, শাকিব খান হয়তো দেশ ছেড়ে আমেরিকায় স্থায়ী হচ্ছেন। তবে তিনি বারবার সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, বাংলাদেশ তার শিকড় এবং ঢালিউডই তার আসল ঠিকানা। আমেরিকার নাগরিকত্ব তাকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করার এবং তার সিনেমাগুলোকে বিশ্বজুড়ে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে বাড়তি সুবিধা দেবে।
শারীরিক ও মানসিক রূপান্তর:
আমেরিকা থেকে ফিরে আসার পর এক নতুন শাকিব খানকে দেখতে পায় দর্শকরা। তিনি শরীরের ওজন কমিয়েছেন, নতুন হেয়ারস্টাইল এবং ফ্যাশন সেন্স দিয়ে নিজেকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলেছেন। শুধু বাইরে থেকেই নয়, তার মানসিক জগতেও বড় পরিবর্তন এসেছে। তিনি এখন গতানুগতিক, কম বাজেটের সিনেমা থেকে বেরিয়ে এসে আন্তর্জাতিক মানের, বড় ক্যানভাসের সিনেমার দিকে ঝুঁকছেন। তিনি এখন গল্পের মান, নির্মাণশৈলী এবং প্রযুক্তিগত দিকের উপর অনেক বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন।
এসকে ফিল্মস এবং বিশ্বজয়ের পরিকল্পনা:
শাকিব খান এখন শুধু একজন অভিনেতা নন, তিনি একজন বিচক্ষণ প্রযোজকও। তার প্রযোজনা সংস্থা ‘এসকে ফিল্মস’ থেকে তিনি এখন এমন সব সিনেমা নির্মাণ করছেন, যা বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে মুক্তি দেওয়ার পরিকল্পনা করা হচ্ছে। ‘প্রিয়তমা’ এবং বিশেষ করে ২০২৪ সালের ব্লকবাস্টার হিট ‘তুফান’-এর সাফল্য তার এই নতুন যাত্রাকে আরও গতি দিয়েছে। ‘তুফান’ সিনেমাটি বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, আমেরিকা, ইউরোপ এবং মধ্যপ্রাচ্যে দারুণ ব্যবসা করেছে, যা প্রমাণ করে যে, শাকিব খানের আবেদন এখন আর শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই।
ইন্ডাস্ট্রির প্রতিদ্বন্দ্বিতা: শাকিব খান বনাম অনন্ত জলিল
ঢালিউডে শাকিব খানের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও, প্রায়ই তার সাথে অনন্ত জলিলের তুলনা করা হয়। যদিও তাদের পথ এবং দর্শন সম্পূর্ণ ভিন্ন, তবুও এই তুলনাটি বেশ আকর্ষণীয়।
শাকিব খান: তিনি হলেন ইন্ডাস্ট্রির ‘ইনসাইডার’, যিনি সিস্টেমের ভেতর থেকে যুদ্ধ করে শীর্ষে উঠেছেন। তিনি দর্শকের নাড়ি বোঝেন এবং বাণিজ্যিক সিনেমার ব্যাকরণ তার নখদর্পণে। তিনি একজন জাত অভিনেতা, যিনি সময়ের সাথে সাথে নিজেকে ভেঙেছেন এবং গড়েছেন। তার শক্তি হলো তার বিশাল ফ্যানবেস এবং বাণিজ্যিক সফলতা। তিনি ইন্ডাস্ট্রির চালিকাশক্তি।
অনন্ত জলিল: তিনি হলেন ‘আউটসাইডার’, একজন সফল ব্যবসায়ী যিনি সিনেমায় এসেছেন নিজের স্বপ্ন এবং অর্থ নিয়ে। তিনি অভিনয়ের চেয়ে প্রযোজনার দিকেই বেশি মনযোগী। তার লক্ষ্য হলো, বাংলাদেশের সিনেমায় হলিউড-স্টাইলের VFX, বড় বাজেটের অ্যাকশন এবং নতুন প্রযুক্তি নিয়ে আসা। তিনি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, যিনি সবসময় প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে কিছু করতে চান। তার সিনেমাগুলো হয়তো সবসময় বাণিজ্যিকভাবে শাকিবের মতো সফল হয় না, কিন্তু তিনি ইন্ডাস্ট্রির প্রযুক্তিগত উন্নয়নে বড় ভূমিকা রাখেন।
সংক্ষেপে, শাকিব খান হলেন ঢালিউডের বর্তমান, আর অনন্ত জলিল হলেন ভবিষ্যতের এক সাহসী স্বপ্ন। ইন্ডাস্ট্রির উন্নতির জন্য দুজনের অবদানই ভিন্ন ভিন্ন দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ।
মাসুদ রানা থেকে শাকিব খান হয়ে ওঠার গল্পটি কোনো সাধারণ গল্প নয়। এটি এক ব্যক্তির অদম্য ইচ্ছাশক্তি, কঠোর পরিশ্রম, অবিশ্বাস্য সাফল্য এবং একই সাথে ব্যক্তিগত জীবনের নানা ভুলের এক জটিল আখ্যান। তিনি বহুবার সমালোচিত হয়েছেন, বিতর্কে জড়িয়েছেন, কিন্তু প্রতিবারই ফিনিক্স পাখির মতো ছাই থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন এবং বক্স অফিসে নিজেকে নতুন করে প্রমাণ করেছেন।
তথ্যসূত্র –
- https://www.swadeshpratidin.com/news/118460
- https://www.jagonews24.com/entertainment/news/560948
- https://www.kalerkantho.com/online/entertainment/2025/08/04/1557408q
- https://barta24.com/details/entertainment/288502
- https://www.somoynews.tv/news/2024-05-28/DLUR4FNP
- https://bbcfly.com/bn/shakib-khan-height-weight-age-wife-girlfriend-family-biography-92
- https://bmdb.com.bd/person/110/
- https://www.anandabazar.com/entertainment/shakib-khan-reunited-with-bubly-again-spending-time-with-eachother-in-usa-dgtl/cid/1623287