Image default
যাপন

প্রতিবাদ ও মিছিলের সময় কিভাবে নিরাপদ থাকবেন? সহজ গাইডলাইন

শান্তিপূর্ণ মিছিলেও মুহূর্তের মধ্যে পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে। আবেগ নয়, প্রস্তুতিই আপনার সবচেয়ে বড় শক্তি। জানুন, কীভাবে সচেতন থেকে এবং সঠিক কৌশল অবলম্বন করে যে কোনো গণআন্দোলনে নিজেকে নিরাপদ রাখবেন।

বিশ্বজুড়ে চলছে আন্দোলনের মৌসুম। শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আন্দোলন ছড়িয়েছে নেপাল, ইন্দোনেশিয়া। গণতান্ত্রিক সমাজে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ হলো নাগরিকদের মত প্রকাশের অন্যতম শক্তিশালী এবং মৌলিক একটি অধিকার। যখন কোনো অন্যায়, অবিচার বা বৈষম্যের বিরুদ্ধে মানুষ রাস্তায় নেমে আসে, তখন তা কেবল একটি মিছিল নয়, তা একটি সমাজের জীবন্ত বিবেকের প্রতিচ্ছবি। ছাত্র আন্দোলন হোক বা সাধারণ মানুষের গণজমায়েত, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের মাধ্যমে নাগরিকরা তাদের দাবি-দাওয়া তুলে ধরেন এবং রাষ্ট্রকে পরিবর্তনের জন্য চাপ সৃষ্টি করেন।

কিন্তু এই অধিকার প্রয়োগের সাথে সাথে আসে নিজের এবং সহযোদ্ধাদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। শান্তিপূর্ণ সমাবেশও মুহূর্তের মধ্যে উত্তপ্ত এবং বিশৃঙ্খল হয়ে উঠতে পারে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পদক্ষেপ, তৃতীয় পক্ষের উসকানি বা নিছক দুর্ঘটনা যেকোনো কিছুই একটি শান্ত মিছিলকে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে ঠেলে দিতে পারে।

এই আর্টিকেলের উদ্দেশ্য কাউকে প্রতিবাদে যেতে উৎসাহিত বা নিরুৎসাহিত করা নয়। এর একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, যারা তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তাদের জন্য একটি বিস্তারিত নিরাপত্তা গাইডলাইন তৈরি করা। কারণ, প্রতিবাদের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো প্রস্তুতি। আপনি যত বেশি প্রস্তুত এবং সচেতন থাকবেন, ততটাই নিরাপদে আপনার কণ্ঠস্বরকে তুলে ধরতে পারবেন। 

এই গাইডটি তিনটি ধাপে বিভক্ত: প্রতিবাদের আগে, প্রতিবাদের সময় এবং প্রতিবাদের পরে আপনার করণীয়।

প্রথম ধাপ: প্রতিবাদের আগে – সেরা প্রস্তুতিই সেরা সুরক্ষা

যেকোনো প্রতিবাদে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর, আপনার নিরাপত্তার প্রস্তুতি শুরু হয় বাড়ি থেকেই। এই ধাপটিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

জানুন এবং পরিকল্পনা করুন

  • আয়োজন এবং উদ্দেশ্য: কারা এই প্রতিবাদ আয়োজন করছে? তাদের অতীত ইতিহাস কেমন? এটি কি একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হিসেবে পরিকল্পিত? প্রতিবাদের মূল উদ্দেশ্য এবং দাবিগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা রাখুন। আবেগতাড়িত হয়ে হুট করে কোনো অজানা সমাবেশে যোগ দেবেন না।
  • স্থান এবং সময়: প্রতিবাদের নির্দিষ্ট স্থান, সময় এবং সম্ভাব্য রুট সম্পর্কে ভালোভাবে জেনে নিন। ওই এলাকার একটি মানচিত্র দেখে নিন এবং একাধিক বের হওয়ার পথ (Exit Route) আগে থেকেই চিহ্নিত করে রাখুন।
আন্দোলনকারী তরুন
  • বাডি সিস্টেম (Buddy System): কখনো একা প্রতিবাদে যাবেন না। অন্তত একজন বিশ্বস্ত বন্ধু বা সঙ্গীর সাথে যান, যাকে আপনি ‘বাডি’ হিসেবে ঠিক করবেন। একে অপরের উপর নজর রাখা এবং প্রয়োজনে সাহায্য করা আপনাদের প্রধান দায়িত্ব হবে। আগে থেকেই ঠিক করে নিন, যদি ভিড়ে আলাদা হয়ে যান, তাহলে কোথায় এবং কখন আবার দেখা করবেন।

কী পরবেন এবং কী পরবেন না

আপনার পোশাকই হতে পারে আপনার নিরাপত্তার প্রথম স্তর।

  • যা পরবেন:
    • আরামদায়ক জুতো: শক্ত এবং টেকসই বুট বা স্নিকার্স পরুন, যা দিয়ে আপনি দীর্ঘ সময় হাঁটতে বা প্রয়োজনে দৌড়াতে পারবেন।
    • সাধারণ পোশাক: এমন পোশাক পরুন, যা ভিড়ের সাথে মিশে যায়। কোনো নির্দিষ্ট দলের লোগো, স্লোগান বা উজ্জ্বল রঙের পোশাক এড়িয়ে চলুন, যা আপনাকে সহজে চিহ্নিত করতে সাহায্য করবে।
    • একাধিক স্তর: আবহাওয়া অনুযায়ী একাধিক স্তরে পোশাক পরুন, যাতে প্রয়োজন অনুযায়ী খোলা বা পরা যায়। লম্বা হাতা এবং ফুল প্যান্ট ত্বককে বিপজ্জনক এবং সম্ভাব্য রাসায়নিক থেকে রক্ষা করে।
  • যা পরবেন না:
    • কনট্যাক্ট লেন্স: টিয়ার গ্যাসের সংস্পর্শে এলে কনট্যাক্ট লেন্স চোখের ভেতরে আটকে গিয়ে মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে। এর পরিবর্তে চশমা ব্যবহার করুন।
    • গয়না ও অলংকার: লম্বা দুল, চেইন বা ব্রেসলেট ভিড়ের মধ্যে টানাটানিতে ছিঁড়ে গিয়ে বা আটকে গিয়ে আপনাকে আহত করতে পারে।
    • সহজে জ্বলে এমন কাপড়: পলিয়েস্টারের মতো সিন্থেটিক কাপড় সহজে জ্বলে যায়। এর পরিবর্তে সুতির পোশাক পরাই নিরাপদ।
    • মেকআপ ও তেল: তেল-ভিত্তিক লোশন, সানস্ক্রিন বা মেকআপ ব্যবহার করবেন না, কারণ টিয়ার গ্যাস বা পেপার স্প্রের রাসায়নিক এগুলোর সাথে মিশে ত্বকের ক্ষতি বাড়িয়ে দেয়।

ব্যাগে কী নেবেন (প্রোটেস্ট কিট)

একটি ছোট এবং হালকা কাঁধের ব্যাগে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো নিন।

  • পানি: ডিহাইড্রেশন এড়াতে এবং চোখ বা ত্বক ধোয়ার জন্য বোতলে পানি রাখুন।
  • প্রাথমিক চিকিৎসা কিট: ছোট ব্যান্ডেজ, অ্যান্টিসেপটিক, গজ এবং ব্যথানাশক ট্যাবলেট রাখুন।
  • স্ন্যাকস: দীর্ঘ সময় রাস্তায় থাকতে হতে পারে, তাই বাদাম বা এনার্জি বারের মতো শুকনো খাবার সাথে রাখুন।
  • মাস্ক ও রুমাল: ধুলো এবং গ্যাস থেকে বাঁচতে ভালো মানের মাস্ক এবং একটি রুমাল রাখুন। রুমালটি ভিনেগার বা লেবুর রসে ভিজিয়ে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগে রাখলে, টিয়ার গ্যাসের সময় নিঃশ্বাস নিতে সুবিধা হয়।
  • জরুরি তথ্য: একটি ছোট কাগজে আপনার নাম, রক্তের গ্রুপ এবং জরুরি যোগাযোগের নম্বর লিখে রাখুন। একই নম্বরটি পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে আপনার হাতেও লিখে রাখতে পারেন।
  • পরিচয়পত্র ও টাকা: পরিচয়পত্রের একটি ফটোকপি এবং কিছু খুচরা টাকা সাথে রাখুন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা

আধুনিক যুগে, শারীরিক নিরাপত্তার পাশাপাশি ডিজিটাল নিরাপত্তাও অত্যন্ত জরুরি।

  • ফোন প্রস্তুত করুন:
    • পাসওয়ার্ড, নট বায়োমেট্রিক: ফোনের ফেস আইডি বা ফিঙ্গারপ্রিন্ট লক বন্ধ করে একটি শক্তিশালী পাসকোড বা প্যাটার্ন ব্যবহার করুন। কারণ, আইনি পরিস্থিতিতে আপনাকে বায়োমেট্রিক লক খোলার জন্য বাধ্য করা হতে পারে, কিন্তু পাসওয়ার্ড দেওয়ার জন্য নয়।
    • ডেটা ব্যাকআপ ও ক্লিয়ার: ফোনে থাকা সংবেদনশীল তথ্য, ছবি বা মেসেজ আগে থেকেই ব্যাকআপ নিয়ে মুছে ফেলুন।
    • লোকেশন সার্ভিস বন্ধ রাখুন: অপ্রয়োজনীয় ট্র্যাকিং এড়াতে ফোনের জিপিএস বা লোকেশন সার্ভিস বন্ধ করে দিন।
  • যোগাযোগ: বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের জন্য সিগন্যাল বা টেলিগ্রামের মতো এন্ড-টু-এন্ড এনক্রিপটেড মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করুন।

দ্বিতীয় ধাপ: প্রতিবাদের সময় – শান্ত থাকুন, সচেতন থাকুন

আপনি যখন প্রতিবাদ স্থলে পৌঁছাবেন, তখন আপনার প্রধান কাজ হলো মাথা ঠাণ্ডা রাখা এবং চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন থাকা।

পারিপার্শ্বিক সচেতনতা

  • নিজের অবস্থান: ভিড়ের ঠিক মাঝখানে না থেকে, একপাশে বা পেছনের দিকে থাকার চেষ্টা করুন। এতে আপনি সহজেই পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করতে পারবেন এবং প্রয়োজনে দ্রুত সরে যেতে পারবেন।
  • বিপদ চিহ্ন শনাক্ত করুন: উসকানিমূলক আচরণকারী (যারা ইচ্ছাকৃতভাবে সহিংসতা তৈরি করতে চায়), পুলিশের অস্বাভাবিক গতিবিধি বা ভিড়ের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো খেয়াল রাখুন।
  • বের হওয়ার পথ: সবসময় আপনার নিকটবর্তী বের হওয়ার পথ কোনটি, তা মাথায় রাখুন।
নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে শান্ত আচরণ

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে আচরণ

  • শান্ত থাকুন: পুলিশের সাথে কোনো ধরনের তর্কে বা উত্তেজনায় জড়াবেন না। তাদের আচরণ যাই হোক না কেন, আপনি শান্ত এবং সংযত থাকুন।
  • হাত দৃশ্যমান রাখুন: এমনভাবে দাঁড়ান বা চলুন, যাতে আপনার হাত সবসময় দেখা যায়। পকেটে হাত রাখবেন না।
  • হঠাৎ দৌড়াবেন না: যদি কোনো শারীরিক বিপদ না থাকে, তবে হঠাৎ করে দৌড় দেবেন না। দৌড়ানো প্রায়শই তাড়া করার প্রবণতা তৈরি করে। শান্তভাবে এবং দ্রুতগতিতে স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করুন।

বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে করণীয়

  • টিয়ার গ্যাস: যদি টিয়ার গ্যাস ছোড়া হয়, আতঙ্কিত হবেন না। বাতাসের বিপরীতে দৌড়ে যান, যাতে গ্যাস আপনার থেকে দূরে চলে যায়। নিচু হয়ে যান, কারণ টিয়ার গ্যাস বাতাসের চেয়ে ভারী। চোখে-মুখে পানির ঝাপটা দিন এবং আপনার সাথে থাকা ভেজা রুমাল দিয়ে নাক-মুখ ঢাকুন। চোখ ঘষবেন না।
  • ভিড়ের চাপ (Crowd Surge): যদি ভিড় হঠাৎ করে কোনো একদিকে দৌড়াতে শুরু করে, তবে তার বিপরীতে যাওয়ার চেষ্টা করবেন না। স্রোতের সাথে, কিন্তু আড়াআড়িভাবে (diagonally) ভিড়ের কিনারের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আপনার হাত দুটি বুকের কাছে তুলে রাখুন, যাতে শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য জায়গা থাকে। পড়ে গেলে কাত হয়ে মাথা এবং ঘাড় হাত দিয়ে ঢেকে ফেলুন।
  • গ্রেপ্তার হলে: যদি আপনাকে গ্রেপ্তার করা হয়, তবে কোনো ধরনের প্রতিরোধ করবেন না। শান্তভাবে আপনার নাম জিজ্ঞাসা করুন এবং বলুন, “আমি চুপ থাকার অধিকার প্রয়োগ করছি এবং আমি আমার আইনজীবীর সাথে কথা বলতে চাই।”

তৃতীয় ধাপ: প্রতিবাদের পরে – নিরাপত্তা তখনও জরুরি

প্রতিবাদ শেষ হওয়ার পরেও আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য কিছু করণীয় থাকে।

  • নিরাপদে স্থান ত্যাগ: আপনার বাডি বা দলের সাথেই স্থান ত্যাগ করুন। একা একা ফিরবেন না। গণপরিবহন ব্যবহার করলে ভিড় এড়িয়ে চলুন। যদি মনে হয় কেউ আপনাকে অনুসরণ করছে, তবে সরাসরি বাড়ি না গিয়ে কোনো নিরাপদ পাবলিক প্লেসে যান এবং আপনার বন্ধুদের জানান।
  • ডিজিটাল হাইজিন: বাড়িতে ফিরে আপনার ফোন এবং সোশ্যাল মিডিয়া চেক করুন। এমন কোনো ছবি বা ভিডিও পোস্ট করবেন না, যা আপনাকে বা অন্য কোনো প্রতিবাদকারীকে বিপদে ফেলতে পারে। প্রয়োজনে ছবিতে থাকা মুখগুলো ব্লার বা ঝাপসা করে দিন।
  • মানসিক যত্ন: প্রতিবাদে অংশ নেওয়া একটি মানসিক চাপের অভিজ্ঞতা হতে পারে। ভয়, উত্তেজনা বা ক্রোধ অনুভব করা খুবই স্বাভাবিক। আপনার অভিজ্ঞতা নিয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু বা পরিবারের সাথে কথা বলুন। প্রয়োজনে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।

শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক হাতিয়ার। কিন্তু এর শক্তি তখনই প্রকাশ পায়, যখন অংশগ্রহণকারীরা নিরাপদ এবং সুরক্ষিত থাকে। আবেগতাড়িত হয়ে হুট করে রাস্তায় নেমে পড়া সাহসিকতা নয়; বরং ঠান্ডা মাথায়, সঠিক প্রস্তুতি নিয়ে এবং নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতন থেকে নিজের এবং সহযোদ্ধাদের রক্ষা করাই হলো সত্যিকারের দায়িত্বশীলতা। উপরের গাইডলাইনগুলো আপনাকে একজন সচেতন এবং সুরক্ষিত প্রতিবাদকারী হিসেবে আপনার ভূমিকা পালন করতে সাহায্য করবে। মনে রাখবেন, আপনার নিরাপত্তা আপনার অধিকার, এবং তা নিশ্চিত করা আপনারই দায়িত্ব।

তথ্যসূত্র –

Related posts

বিদেশে পড়তে চান? এই স্কলারশিপগুলোই আপনাকে পৌঁছে দেবে স্বপ্নের দেশে!

মাত্র ৭ দিনেই কালচে ভাব উধাও!! এই গরমেও ত্বক থাকবে ফ্রেশ আর উজ্জ্বল।

যে বিষয়গুলো একজন পুরুষকে অনাকর্ষণীয় করে তোলে: আচরণ, অভ্যাস ও ডেটিং ভুল

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More