Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

কিডনি ভ্যালি- যে গ্রামে মানুষের একটি কিডনি

তাদের বোঝানো হয়েছিল, একটি কিডনি দিয়ে দিলে সেখানে আরেকটি কিডনি জন্মাবে। যেমনটা গাছের ফল জন্মায়।

ভ্রমণপিপাসুদের কাছে নেপাল মানেই হিমালয়ের অপার সৌন্দর্য, ট্রেকিংয়ের রোমাঞ্চ আর মনোরম প্রকৃতির হাতছানি। যেখানে পাহাড়ের কোলঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে গেছে নদীর মতো সড়ক। আবার কোথায় কোথায়ো সেই পাহাড়ের চূড়াতেই গড়ে উঠেছে জনবসতি। কিন্তু এই অপার সৌন্দর্য্যের কোলেই লুকিয়ে আছে এক বিষণ্ণ উপত্যকা,  যার নাম শুনলেই গা শিউরে উঠে। 

কিডনি ভ্যালি…এই উপত্যকার গল্প কেবল দুঃসহ নয়, চরম অমানবিকতার এক করুণ আখ্যান। 

কোথায় অবস্থিত কিডনি গ্রাম

নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডুর খুব কাছেই কাভরেপলাঞ্চক জেলায় অবস্থিত একটি ছবির মতো সুন্দর পাহাড়ি গ্রাম। এর আসল নাম হোকসি হলেও, স্থানীয়রা এটিকে ‘কিডনি ভ্যালি’ নামেই চেনে। আপাতদৃষ্টিতে দেখতে শান্ত ও সবুজ হলেও এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই লুকিয়ে আছে এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।

অবাক করা বিষয় হলো, এখানকার প্রায় প্রতিটি পরিবারেই এমন কেউ না কেউ আছেন, যার শরীরে মাত্র একটি কিডনি রয়েছে। আরও অবাক করা বিষয় হলো, তারা একটি কিডনি নিয়েই জন্ম গরহণ করেছেন বিষয়টি এমন নয়। একটা সময় তাদের দু’টি কিডনিই ছিল, কিন্তু এখন তারা একটি কিডনি নিয়েই বেঁচে আছেন। 

আরেকটি কিডনি কোথায়?

সবার কাছেই এখন প্রশ্ন, অন্য কিডনিটি কোথায়? এর উত্তর হলো, তিনি সেই কিডনিটি বিক্রি করে দিয়েছেন। আর এমন ব্যক্তির সংখ্যা মাত্র একজন বা দুইজন নয়। এই গ্রামের প্রায়  ৯০ শতাংশ মানুষই তার একটি কিডনি বিক্রি করে দিয়েছে। শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও, এটাই এই গ্রামের বাস্তব চিত্র। আর সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো এই বিক্রি কোনো স্বাভাবিক লেনদেন নয়; এটি এই গ্রামের  সাধারণ মানুষের দরিদ্রতা এবং প্রতারণার এক ভয়ংকর চক্রের ফল।

এই গ্রামে দারিদ্র্য এতটাই প্রকট যে একজন মানুষ মাত্র ২,০০০ নেপালি টাকার বিনিময়ে তার কিডনি বিক্রি করতে রাজি থাকে। এমনকি এখানে কিডনি বিক্রি করা এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা যে কোনো পরিবারে টাকার সমস্যা দেখা দিলেই পরিবারের কোনো না কোনো সদস্য তার কিডনি বিক্রি করার জন্য চলে যায়। কিন্তু সব সময় যে দারিদ্রতার কারণে তারা কিডনি বিক্রি করে এমন নয়।  অনেক সময় কিডনি পাচারের জালে তারা আটকে যায়।

কিডনি ভ্যালির কয়েকজন মানুষের অপারেশনের দাগ

কিডনি পাচারের জাল

এই কিডনি পাচারের জাল বিছায় এক শ্রেণির অসাধু মানব পাচারকারী চক্র। এরা মূলত গ্রামের সহজ-সরল, দরিদ্র মানুষদের টার্গেট করে। আসলে নেপালের এই গ্রামে দারিদ্র্য এমন এক অভিশাপ, যা মানুষকে যেকোনো কিছু করতে বাধ্য করে। আর এই পাচারকারীরা সেই দুর্বলতার সুযোগ নেয়। তারা প্রথমে গ্রামবাসীদের কাছে বন্ধু সেজে আসে, তাদের অভাব-অনটনের গল্প শোনে এবং বিভিন্ন লোভনীয় প্রস্তাব দেয়।

শুরুটা হয় সামান্য কিছু টাকার লোভ দেখিয়ে। ধীরে ধীরে পাচারকারীরা তাদের বলে, শহরে নিয়ে যাব, ভালো কাজ দেব, অনেক টাকা রোজগার করতে পারবে। গ্রামের যেসব মানুষ অভাবের তাড়নায় হাঁসফাঁস করছে, তারা সহজেই এই ফাঁদে পা দেয়। পাচারকারীরা তাদের শহরে তো নিয়ে যায় কিন্তু সেগুলো নেপালের কোন শহর নয়, বরং তারা ভারতের দিল্লি, মুম্বাই, তামিলনারুর মতো শহরগুলোতে তাদের নিয়ে যায়। সেখানে তাদের জানানো হয়, এখানে লক্ষ লক্ষ টাকা পাওয়া যাবে। কিন্তু এই টাকা পাওয়ার পেছনে শর্ত থাকে একটাই, কিডনি দান করতে হবে।

বেশিরভাগ সময় গ্রামবাসীরা প্রথমে রাজি হতে চায় না। তারা কিডনি দানের ঝুঁকির কথা শুনে ভয় পায়। কিন্তু পাচারকারীরা অত্যন্ত কৌশলী। তারা নানা রকম মিথ্যা গল্প ফেঁদে বোঝায় যে, একটি কিডনি দিয়েও সুস্থ জীবন কাটানো যায়, এতে কোনো সমস্যা হয় না। অনেক ক্ষেত্রে তারা গ্রামবাসীকে বোঝায় যে, শহরে কেউ একজন গুরুতর অসুস্থ, তার জীবন বাঁচাতে একটি কিডনি দরকার। আর এই ‘মানবতার খাতিরে’ কাজটি করলে অনেক পুণ্য হবে এবং সাথে আবার মোটা অঙ্কের টাকাও পাওয়া যাবে।

এই গ্রামের মানুষ যে আসলেই সরল তার প্রমাণ পাওয়া যায় একটি প্রশ্ন করলে। তাদের যদি জিজ্ঞাসা করা হয় যে তারা কেন একটি কিডনি দান করেছেন; তখন তারা সরলভাবে উত্তর দেন যে, তাদের বোঝানো হয়েছিল, একটি কিডনি দিয়ে দিলে সেখানে আরেকটি কিডনি জন্মাবে। যেমনটা গাছের ফল জন্মায়।

এছাড়াও, এই প্রতারকচক্র গ্রামবাসীকে শারীরিক পরীক্ষা করার নাম করে কিংবা অথবা পেটে ব্যথা হচ্ছে তাই ছোট একটি অপারেশন করার কথা বোঝায়। এই অপারেশনের পর যখন তারা জ্ঞান ফিরে পায়, তখন জানতে পারে তাদের একটি কিডনি শরীর থেকে বের করে নেওয়া হয়েছে।

কিডনি ভ্যালি গ্রামের দরিদ্র জীবনের চিত্র

সবশেষে পাচারকারীরা তাদের হাতে কিছু সামান্য টাকা ধরিয়ে দেয় এবং বাকি টাকা পরে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গ্রামে ফেরত পাঠিয়ে দেয়। কিন্তু সেই ‘বাকি টাকা’ আর তাদের হাতে পৌঁছায় না। তারা বুঝতে পারে, তাদের ঠকানো হয়েছে। 

তাছাড়া, একটি কিডনি হারানোর পর তাদের স্বাস্থ্য দ্রুত অবনতি হতে শুরু করে। এর প্রধান কারণ হলো, দ্বিতীয় কিডনির ওপর অতিরিক্ত চাপ। এর ফলে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, এবং দীর্ঘমেয়াদী কিডনি রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সামান্য পরিশ্রমেই তারা হাঁপিয়ে ওঠে, যা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে বাধা দেয়। ফলে, তারা আর ভারী কাজ করতে পারে না এবং পরিবারের আয়ের উৎস কমে যায়। তারা কেবল শারীরিক ক্ষতিই নয়, আর্থিক ক্ষতির শিকারও হয়।

সমস্যার সমাধানে কি ভূমিকা 

এখন প্রশ্ন আসতেই পারে যে,স্থানীয় সরকার ও বিভিন্ন এনজিও এই সমস্যার সমাধানে কি ভূমিকা পালন করছে!! সত্যি বলতে এখনও তাদের প্রচেষ্টা বেশ সীমিত। কিছু এনজিও, যেমন ‘নেপাল কিডনি ফাউন্ডেশন’, এই বিষয়ে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করছে। পাশাপাশি স্থানীয় সরকার পাচারকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্নীতির কারণে তা সম্ভব হয় না। 

যদিও নেপালে মানব অঙ্গ পাচার একটি গুরুতর অপরাধ, এবং এর বিরুদ্ধে কঠোর আইন রয়েছে। কিন্তু এই আইনের প্রয়োগে ব্যাপক দুর্বলতা দেখা যায়। পুলিশ ও বিচার ব্যবস্থা প্রায়শই পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রমাণ সংগ্রহে ব্যর্থ হয় অথবা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে মামলাগুলো দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে, অনেক পাচারকারী সহজে পার পেয়ে যায়।

সেই সাথে বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং ভুক্তভোগীদের আর্থিক দুর্বলতাও একটি বড় সমস্যা। দরিদ্র গ্রামবাসীরা কাঠমান্ডু বা অন্য বড় শহরে গিয়ে মামলার খরচ বহন করতে পারে না। ফলে, অধিকাংশ ভুক্তভোগীই বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দেয়। আইনের দুর্বল প্রয়োগ এবং শাস্তির অভাবের কারণে পাচারকারীরা আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে।

শেষ কথা

এই কিডনি ভ্যালির বাসিন্দাদের জীবন আজ এক নিরবচ্ছিন্ন দুর্ভোগের নাম। অনেকে একটি কিডনি নিয়ে কোনোমতে বেঁচে আছে, কিন্তু জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে গেছে। তাদের শরীর দুর্বল, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। অনেক সময় সামান্য পরিশ্রমেও তারা হাঁপিয়ে ওঠে। এই অমানবিক কর্মকাণ্ডের ফলে গ্রামের শিশুরা বাবা-মায়ের স্বাস্থ্যহানির কারণে দারিদ্র্যের চক্রে আরও গভীরভাবে জড়িয়ে পড়ে।

এই গ্রামের প্রতিটি পরিবারে কিডনি পাচারের করুণ গল্প আছে। কেউ নিজের ভাইকে হারিয়েছে, কেউ বাবাকে। পাচারকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার সাহসও তাদের নেই, কারণ তারা অত্যন্ত প্রভাবশালী এবং ভয়ংকর।

নেপালের কিডনি ভ্যালির গল্প কেবল একটি গ্রামের নয়, এটি পুরো মানব পাচার চক্রের এক ভয়াবহ উদাহরণ। এটি আমাদের মনে করিয়ে দেয়, দারিদ্র্য এবং অশিক্ষা কীভাবে মানুষের অসহায়ত্বের সুযোগ নেয়। এই গ্রামটি আজ আমাদের সামনে এক নীরব প্রশ্নচিহ্ন তুলে ধরেছে মানবতা কি তবে কেবলই একটি শব্দ? এই প্রশ্ন আজও বাতাস ভারী করে তোলে, হিমালয়ের কোলে লুকিয়ে থাকা বিষণ্ণ উপত্যকাটির দিকে তাকালে।

রেফারেন্সঃ

Related posts

হরমুজ প্রণালী: অশান্তির সরু দরজা, যেখানে বিশ্ব জ্বালানির ভাগ্য লেখা হয়

কেন ফেব্রুয়ারি মাস ২৮ দিনের? ইতিহাসে মজার কাহিনী

শেখ আহাদ আহসান

যুদ্ধই গড়েছে আধুনিক জীবনের অনুষঙ্গ আধুনিক প্রযুক্তি

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More