Image default
ইতিহাস ১০১

গরম থেকে স্বস্তি: এয়ার কন্ডিশনার কিভাবে বদলে দিলো মানবজীবন

গরমের দিনে ঘরের শীতল আরাম আজ আমাদের কাছে স্বাভাবিক। কিন্তু জানেন কি, এই প্রযুক্তিটি মানুষের আরামের জন্য নয়, বরং একটি ছাপাখানার কালি শুকানোর সমস্যা সমাধানের জন্য আবিষ্কার হয়েছিল? 

একবার গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের কথা ভাবুন। বাইরে যখন সূর্য আগুন ঝরাচ্ছে, তখন আপনি আপনার বাড়ি, অফিস বা শপিং মলের শীতল, আরামদায়ক পরিবেশে বসে আছেন। বোতাম চাপার সাথে সাথেই গরম হাওয়া উধাও হয়ে যায় এবং এক শীতল, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ মেলে। 

এয়ার কন্ডিশনার বা এসি আজকের দিনে এটি আমাদের কাছে এতটাই সাধারণ এবং অপরিহার্য একটি যন্ত্র যে, আমরা হয়তো এর পেছনের অবিশ্বাস্য ইতিহাস বা মানব সভ্যতার উপর এর সুদূরপ্রসারী প্রভাব নিয়ে খুব বেশি ভাবি না।

কিন্তু এয়ার কন্ডিশনার শুধু গরম থেকে আরাম দেওয়ার একটি যন্ত্র নয়; এটি এক নীরব বিপ্লব, যা আমাদের বসবাসের স্থান, কাজের ধরন, অর্থনীতির গতিপথ এবং এমনকি আমাদের বিনোদনের অভ্যাসকেও আমূল বদলে দিয়েছে। 

যে আবিষ্কারটি মানুষের আরামের জন্য নয়, বরং শিল্পের প্রয়োজনে জন্ম নিয়েছিল, সেটিই কীভাবে হয়ে উঠল আধুনিক সভ্যতার অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি?

এসি-পূর্ববর্তী যুগ: গরমের সাথে মানুষের লড়াই

এয়ার কন্ডিশনার আবিষ্কারের আগে, গরমের সাথে খাপ খাইয়ে চলা ছিল মানুষের জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ গরম থেকে বাঁচার জন্য নানা ধরনের প্রাকৃতিক এবং স্থাপত্য কৌশল অবলম্বন করে এসেছে। প্রাচীন মিশরীয়রা রাতে ভেজা কাপড় দরজায় ঝুলিয়ে রাখত, যা বাষ্পীভবনের মাধ্যমে ঘরকে ঠাণ্ডা করত। রোমানরা তাদের বাড়ি ঠাণ্ডা রাখার জন্য দেয়ালের ভেতর দিয়ে ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত করার ব্যবস্থা তৈরি করেছিল।

স্থাপত্যের দিক থেকেও, গরম আবহাওয়ার অঞ্চলের বাড়িগুলোর ডিজাইন ছিল ভিন্ন। উঁচু ছাদ, প্রশস্ত বারান্দা, বড় বড় জানালা এবং বাড়ির চারপাশে গাছপালা এই সবকিছুই ছিল বাতাস চলাচল বাড়িয়ে ঘরকে স্বাভাবিকভাবে ঠাণ্ডা রাখার প্রচেষ্টা। মানুষের দিনের কার্যক্রমও নির্ধারিত হতো সূর্যের গতিপথ অনুযায়ী। দুপুরে সবচেয়ে গরমের সময়টিতে সিয়েস্তা বা দিবানিদ্রা ছিল অনেক সংস্কৃতিরই অংশ। কিন্তু এই সব প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, প্রচণ্ড গরম উৎপাদনশীলতা এবং জীবনযাত্রার মানকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করত।

আবিষ্কারের সেই মুহূর্ত: এক ছাপাখানার সমস্যা ও উইলিস ক্যারিয়ার

এয়ার কন্ডিশনারের গল্পটি শুরু হয়েছিল মানুষের আরামের কথা ভেবে নয়, বরং একটি বাণিজ্যিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে। সময়টা ১৯০২ সাল, নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে অবস্থিত ‘স্যাকেট-উইলহেমস লিথোগ্রাফিং অ্যান্ড পাবলিশিং’ নামক একটি ছাপাখানা এক অদ্ভুত সমস্যায় ভুগছিল।

সমস্যাটা কী ছিল?

ছাপাখানার বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ খুব বেশি বেড়ে যাওয়ায়, কাগজের আকার সামান্য সংকুচিত বা প্রসারিত হচ্ছিল। এর ফলে, রঙিন ছবি ছাপার সময় বিভিন্ন রঙের কালিগুলো ঠিক জায়গায় পড়ছিল না এবং ছবির মান নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল। এই সমস্যার কারণে ছাপাখানার বিপুল আর্থিক ক্ষতি হচ্ছিল।

কাগজে ছড়িয়ে যাওয়া কালি

এই সমস্যা সমাধানের দায়িত্ব পড়ে বাফেলো ফোর্জ কোম্পানি-র একজন তরুণ এবং মেধাবী ইঞ্জিনিয়ারের উপর। তার নাম উইলিস হ্যাভিল্যান্ড ক্যারিয়ার (Willis Haviland Carrier)। ক্যারিয়ার তখন সবেমাত্র কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে চাকরিতে যোগ দিয়েছেন।

ক্যারিয়ারের যুগান্তকারী সমাধান:

ক্যারিয়ার বুঝতে পারছিলেন যে, শুধু তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করলেই হবে না, বাতাসের আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করাই হলো আসল চ্যালেঞ্জ। তিনি এমন একটি যন্ত্রের নকশা তৈরি করলেন, যা পাইপের কয়েলের মধ্যে দিয়ে ঠাণ্ডা পানি প্রবাহিত করে বাতাসকে শীতল করতে পারত। ঠাণ্ডা পাইপের সংস্পর্শে এসে বাতাসের জলীয় বাষ্প ঘনীভূত হয়ে পানিতে পরিণত হতো, ফলে বাতাস একই সাথে ঠাণ্ডা এবং শুষ্ক হয়ে যেত।

১৯০২ সালের ১৭ই জুলাই, ক্যারিয়ার তার এই “অ্যাপারেটাস ফর ট্রিটিং এয়ার” বা “বায়ু পরিশোধন যন্ত্র”-এর নকশাটি সম্পন্ন করেন। এটিই ছিল বিশ্বের প্রথম আধুনিক, মেকানিক্যাল এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম। মাত্র ২৬ বছর বয়সী এই তরুণ ইঞ্জিনিয়ার হয়তো সেদিন কল্পনাও করতে পারেননি যে, তার এই আবিষ্কারটি একদিন পুরো বিশ্বকে বদলে দেবে।

শিল্প বিপ্লবের নতুন চালিকাশক্তি

ক্যারিয়ারের এই আবিষ্কার প্রথমদিকে শিল্প কারখানায় ব্যবহৃত হতে শুরু করে এবং দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবকে এক নতুন গতি দেয়।

  • টেক্সটাইল শিল্প: তুলার সুতা তৈরির জন্য একটি নির্দিষ্ট আর্দ্রতার প্রয়োজন হয়। এসি ব্যবহারের ফলে, টেক্সটাইল মিলগুলো সারা বছর ধরে উচ্চ মানের সুতা উৎপাদন করতে সক্ষম হয়।
  • অন্যান্য শিল্প: ময়দার মিল, রেজর ব্লেড তৈরির কারখানা, এবং বিশেষ করে অস্ত্র তৈরির কারখানায় এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার উৎপাদনশীলতা এবং পণ্যের গুণমান বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। সঠিক তাপমাত্রা এবং আর্দ্রতা ছাড়া অনেক ধরনের যন্ত্র তৈরি করা সম্ভব ছিল না।

অর্থাৎ, প্রথম দিকে এসি ছিল একটা টুল, যা মানুষের জন্য নয়, বরং মেশিনের জন্য আরামদায়ক পরিবেশ তৈরি করত।

সিনেমা হল এবং ‘সামার ব্লকবাস্টার’-এর জন্ম

শিল্পের জগৎ থেকে সাধারণ মানুষের জীবনে এয়ার কন্ডিশনারের প্রবেশের গল্পটি শুরু হয় সিনেমা হলের মাধ্যমে। ১৯২০-এর দশকে, সিনেমার মালিকরা বুঝতে পারছিলেন যে, গ্রীষ্মকালে গরমের কারণে দর্শক সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যায়।

এই সমস্যার সমাধান হিসেবে, ১৯২৫ সালে নিউ ইয়র্কের রিভোলি থিয়েটারে প্রথমবারের মতো বাণিজ্যিকভাবে ‘কমফোর্ট কুলিং’ বা আরামদায়ক শীতলীকরণ ব্যবস্থা হিসেবে এয়ার কন্ডিশনার বসানো হয়। এটি ছিল এক অভাবনীয় সাফল্য। মানুষ গরম থেকে বাঁচতে এবং ঠাণ্ডা, আরামদায়ক পরিবেশে সিনেমা দেখার জন্য দলে দলে হলে আসতে শুরু করে।

সামার ব্লকবাস্টার

খুব দ্রুতই, “Refrigerated Air” বা “শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত” কথাটি সিনেমা হলগুলোর জন্য সবচেয়ে বড় বিজ্ঞাপনে পরিণত হয়। এয়ার কন্ডিশনার এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, এটিই ‘সামার ব্লকবাস্টার’ বা গ্রীষ্মকালীন সুপারহিট সিনেমার ধারণার জন্ম দেয়। স্টুডিওগুলো তাদের সবচেয়ে বড় এবং ব্যয়বহুল সিনেমাগুলো গ্রীষ্মকালে মুক্তি দিতে শুরু করে, কারণ তারা জানত যে, মানুষ গরম থেকে বাঁচতে হলেও সিনেমা হলে আসবে। ‘গন উইথ দ্য উইন্ড’ থেকে শুরু করে ‘স্টার ওয়ার্স’ অনেক ক্লাসিক সিনেমার সাফল্যের পেছনে এয়ার কন্ডিশনারের এই নীরব ভূমিকা রয়েছে।

অফিস, বাড়ি এবং এক নতুন জীবনযাত্রা

সিনেমা হলের সাফল্যের পর, ডিপার্টমেন্টাল স্টোর, অফিস এবং সরকারি ভবনগুলোতেও এয়ার কন্ডিশনারের ব্যবহার শুরু হয়। অফিসের শীতল পরিবেশ কর্মীদের উৎপাদনশীলতা বাড়িয়ে দেয় এবং গরম আবহাওয়ায় কাজ করাকে সহনীয় করে তোলে।

বিশ্বের প্রথম এসি

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ১৯৫০-এর দশকে আমেরিকায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসে এবং এয়ার কন্ডিশনার আকারে ছোট ও দামে সস্তা হতে শুরু করে। এই সময়েই প্রথমবারের মতো ঘরে ঘরে এসি ব্যবহারের চল শুরু হয়। এটি আমেরিকানদের, এবং পরবর্তীতে বিশ্বজুড়ে মানুষের জীবনযাত্রাকে আমূল পরিবর্তন করে দেয়।

  • স্থাপত্যের পরিবর্তন: এয়ার কন্ডিশনার আবিষ্কারের আগে, গরম আবহাওয়ার অঞ্চলের বাড়িগুলোর ডিজাইন হতো উঁচু ছাদ, প্রশস্ত বারান্দা এবং আরিয়েল ভেন্টিলেশনের উপর ভিত্তি করে। কিন্তু এসির আগমনের পর, স্থপতিরা এই প্রাকৃতিক বায়ুচলাচলের প্রয়োজনীয়তা থেকে মুক্তি পান। এর ফলেই জন্ম নেয় আজকের দিনের নিচু ছাদের, সিল করা কাঁচের দেয়ালের আধুনিক আকাশচুম্বী ভবন বা স্কাইস্ক্র্যাপার।
  • জনসংখ্যার ভৌগোলিক পরিবর্তন: এয়ার কন্ডিশনার আমেরিকার জনসংখ্যা এবং অর্থনীতির মানচিত্রকেই বদলে দিয়েছে। ফ্লোরিডা, অ্যারিজোনা, টেক্সাস এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মতো উষ্ণ এবং শুষ্ক অঞ্চলগুলো, যা আগে বসবাসের জন্য অত্যন্ত কষ্টকর ছিল, সেগুলো এসির কল্যাণে আমেরিকার সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অঞ্চলে পরিণত হয়। এই অঞ্চলটি ‘সান বেল্ট’ (Sun Belt) নামে পরিচিতি পায়। এসি ছাড়া লাস ভেগাস বা দুবাইয়ের মতো আধুনিক শহরের অস্তিত্ব হয়তো কল্পনাও করা যেত না।
  • স্বাস্থ্যগত প্রভাব: এসি শুধু আরামই দেয়নি, এটি স্বাস্থ্যখাতেও বড় পরিবর্তন এনেছে। এটি হিটস্ট্রোক বা গরমজনিত মৃত্যুর হার নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দিয়েছে। হাসপাতালগুলোতে শীতল এবং নিয়ন্ত্রিত পরিবেশ রোগীদের আরোগ্য লাভে এবং সংবেদনশীল চিকিৎসা সরঞ্জামগুলোকে সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।

গরম দেশে এয়ার কন্ডিশনারের জনপ্রিয়তা

সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং আমাদের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে, যেখানে বছরের বেশিরভাগ সময়ই গরম এবং আর্দ্র আবহাওয়া থাকে, সেখানে এয়ার কন্ডিশনার আধুনিক জীবনের এক অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। এটি শুধু আরামই নয়, এটি অর্থনৈতিক অগ্রগতিরও একটি সূচক। শপিং মল, অফিস, এবং উন্নত আবাসন সবকিছুই আজ এসি-কেন্দ্রিক।

আধুনিক এসি

উইলিস ক্যারিয়ারের সেই ছাপাখানার কালি শুকানোর সমস্যা সমাধানের একটি ছোট প্রচেষ্টা থেকে যে প্রযুক্তিটির জন্ম হয়েছিল, তা আজ এক বিশ্বব্যাপী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। এয়ার কন্ডিশনার শুধু একটি যন্ত্র নয়, এটি আধুনিক সভ্যতার এক নীরব স্থপতি। এটি নির্ধারণ করে দিয়েছে আমরা কোথায় বাস করব, কেমন বাড়িতে থাকব, কীভাবে কাজ করব এবং কীভাবে বিনোদন উপভোগ করব।

অবশ্যই, এর কিছু নেতিবাচক দিকও রয়েছে। এসি প্রচুর পরিমাণে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং এর থেকে নির্গত গ্যাস পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এর ইতিবাচক প্রভাব এতটাই সুদূরপ্রসারী যে, এসি ছাড়া আজকের বিশ্বকে কল্পনা করা প্রায় অসম্ভব।

তাই, পরেরবার যখন আপনি প্রচণ্ড গরমে একটি শীতল ঘরে প্রবেশ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবেন, তখন একবারের জন্য হলেও উইলিস ক্যারিয়ারের কথা স্মরণ করবেন সেই মানুষটি, যিনি হয়তো আমাদের আরাম দেওয়ার কথা ভাবেননি, কিন্তু তার একটি আবিষ্কারই আমাদের জন্য এক শীতল এবং সহনীয় পৃথিবী তৈরি করে দিয়েছে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

ঘুমের ইতিহাস: একটানা ঘুম নাকি আধুনিক বদভ্যাস!

বিশ্বের প্রথম ২৪ ঘণ্টার নিউজ চ্যানেল: সিএনএন-এর ইতিহাস

জাসদ ছাত্রলীগ: বিপ্লবের স্বপ্ন ও বিতর্কের বাস্তবতা

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More