হিমালয়ের বুকে ১৬,০০০ ফুট উঁচুতে অবস্থিত এক হিমবাহ হ্রদ, যার তীরে ছড়িয়ে আছে শত শত মানুষের কঙ্কাল। কারা ছিল এই হতভাগ্যরা? কীভাবে তাদের মৃত্যু হলো? এটি রূপকুন্ড, হিমালয়ের সবচেয়ে রহস্যময় এবং ভুতুড়ে স্থানগুলোর একটি।
হিমালয় শুধু বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতমালাই নয়, এটি রহস্য, আধ্যাত্মিকতা এবং কিংবদন্তির এক বিশাল ভান্ডার। এর দুর্গম চূড়া আর শান্ত উপত্যকার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে আছে এমন সব গল্প, যা মানুষকে যুগ যুগ ধরে বিস্মিত ও আতঙ্কিত করে চলেছে। এমনই এক হাড়হিম করা রহস্যের নাম রূপকুন্ড লেক, যা সারা বিশ্বে ‘স্কেলেটন লেক’ বা ‘কঙ্কাল হ্রদ’ নামে বেশি পরিচিত।
ভারতের উত্তরাখণ্ড রাজ্যের চামোলি জেলায়, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৬,৫০০ ফুট (প্রায় ৫,০২৯ মিটার) উঁচুতে অবস্থিত এই ছোট্ট হিমবাহ হ্রদটি বছরের বেশিরভাগ সময় বরফে ঢাকা থাকে। কিন্তু গ্রীষ্মকালে, যখন বরফ গলতে শুরু করে, তখন এক ভয়ংকর এবং অবিশ্বাস্য দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে ওঠে। হ্রদের অগভীর, স্বচ্ছ জলের নিচে এবং এর তীরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায় শত শত মানুষের হাড়গোড়, খুলি এবং কঙ্কাল।
কারা ছিল এই মানুষগুলো? কীভাবে এক জায়গায় এতগুলো মানুষের এমন করুণ পরিণতি হলো? তারা কি কোনো হারানো সেনাবাহিনীর অংশ ছিল? কোনো ভয়ংকর মহামারীর শিকার? নাকি কোনো অভিশপ্ত স্থানের বলি? কয়েক দশক ধরে, রূপকুন্ডের এই কঙ্কালগুলো প্রত্নতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী এবং রোমাঞ্চ সন্ধানীদের জন্য এক বিশাল রহস্যের জন্ম দিয়েছে।
আবিষ্কারের ইতিহাস
১৯৪২ সাল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন তুঙ্গে। ব্রিটিশ ভারতের একজন বনরক্ষক, এইচ. কে. মাধওয়াল, এই দুর্গম অঞ্চলে টহল দেওয়ার সময় হঠাৎ করেই রূপকুন্ড হ্রদের তীরে এই ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পান। বরফগলা জলের মধ্যে ভাসমান শত শত কঙ্কাল দেখে তিনি প্রাথমিকভাবে ধারণা করেন যে, এরা হয়তো জাপানি সৈন্য, যারা গোপনে এই পথ দিয়ে ভারতে অনুপ্রবেশ করার চেষ্টা করেছিল এবং প্রতিকূল আবহাওয়ায় মারা গেছে।
ব্রিটিশ সরকার এই সম্ভাবনাটি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং একটি তদন্তকারী দল পাঠায়। কিন্তু তদন্তের পর দেখা যায়, এই কঙ্কালগুলো জাপানি সৈন্যদের নয়, বরং এগুলো আরও অনেক বেশি প্রাচীন। এই আবিষ্কারই রূপকুন্ডকে প্রথমবারের মতো বিশ্বের নজরে নিয়ে আসে এবং জন্ম দেয় এক দীর্ঘস্থায়ী রহস্যের।
কারা ছিল এই হতভাগ্যরা? প্রাথমিক তত্ত্ব ও লোককথার জাল
কঙ্কালগুলোর পরিচয় নিয়ে কয়েক দশক ধরে নানা ধরনের তত্ত্ব এবং স্থানীয় লোককথা প্রচলিত ছিল।
- জেনারেল জোরাওয়ার সিং-এর হারানো সেনাবাহিনী: একটি জনপ্রিয় তত্ত্ব ছিল যে, এই কঙ্কালগুলো কাশ্মীরি জেনারেল জোরাওয়ার সিং-এর সৈন্যদের, যারা ১৮৪১ সালে তিব্বত আক্রমণ করে ফেরার পথে এই দুর্গম অঞ্চলে পথ হারিয়ে ভয়াবহ তুষারঝড়ে পড়ে মারা যায়।
- মুহাম্মদ তুঘলকের ব্যর্থ অভিযান: আরেকটি ধারণা ছিল, এরা হয়তো দিল্লি সালতানাতের সুলতান মুহাম্মদ বিন তুঘলকের সৈন্য, যিনি তিব্বত জয়ের এক ব্যর্থ অভিযান পরিচালনা করেছিলেন।
- মহামারীর শিকার তীর্থযাত্রী: অনেকেই মনে করতেন, এরা হয়তো কোনো তীর্থযাত্রীর দল, যারা কোনো ভয়ংকর সংক্রামক ব্যাধি বা মহামারীর শিকার হয়ে এখানে মারা গেছেন এবং তাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার মতো কেউ ছিল না।
স্থানীয় লোককথা: নন্দাদেবীর অভিশাপ
স্থানীয় গাড়োয়ালি মানুষদের মধ্যে একটি পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে, যা এই কঙ্কালগুলোর সাথে দেবী নন্দাকে যুক্ত করে। নন্দাদেবী এই অঞ্চলের সবচেয়ে পূজনীয় দেবী এবং ত্রিশূল পর্বতকে তার আবাসস্থল বলে মনে করা হয়।
কিংবদন্তি অনুযায়ী, বহু শতাব্দী আগে কনৌজের এক রাজা, তার গর্ভবতী রানী এবং বিশাল সৈন্যদল ও নর্তকীদের নিয়ে নন্দাদেবীর মন্দিরে তীর্থ করতে যাচ্ছিলেন। তাদের এই জাঁকজমকপূর্ণ এবং অশুদ্ধ আচরণে দেবী নন্দা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন। তিনি মনে করেন, এই রাজকীয় দল পবিত্র ভূমির শান্তি নষ্ট করছে। তার ক্রোধেই এক ভয়াবহ তুষারঝড় এবং শিলাবৃষ্টি নেমে আসে, যার আঘাতে পুরো দলটি মারা যায়। রূপকুন্ডের কঙ্কালগুলো নাকি সেই অভিশপ্ত তীর্থযাত্রী দলেরই অবশেষ।
বৈজ্ঞানিক গবেষণা: যখন কঙ্কাল কথা বলে ওঠে
লোককথা এবং অনুমানের জাল থেকে বেরিয়ে, বিজ্ঞানীরা এই রহস্যের সমাধানে এগিয়ে আসেন। বিভিন্ন সময়ে এই কঙ্কালগুলোর উপর কার্বন ডেটিং, ফরেনসিক এবং জেনেটিক গবেষণা চালানো হয়েছে, যা ধীরে ধীরে এক অবিশ্বাস্য এবং জটিল চিত্র তুলে ধরেছে।
প্রথম দিকের গবেষণা এবং শিলাবৃষ্টির তত্ত্ব:
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিওকার্বন অ্যাক্সিলারেটর ইউনিট দ্বারা পরিচালিত প্রথম দিকের গবেষণায় জানা যায়, এই কঙ্কালগুলো নবম শতাব্দীর (প্রায় ৮৫০ খ্রিস্টাব্দ) কাছাকাছি সময়ের। ফরেনসিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, অনেক খুলির উপরে এবং কাঁধের হাড়ে গভীর ফাটল রয়েছে, যা কোনো ধারালো অস্ত্র বা যুদ্ধের আঘাতের মতো নয়। এই আঘাতগুলো ছিল উপর থেকে আসা কোনো গোলাকার এবং ভারী বস্তুর।
এই প্রমাণ থেকে বিজ্ঞানীরা এক যুগান্তকারী তত্ত্বে পৌঁছান। তারা বলেন, এই মানুষগুলো কোনো যুদ্ধ বা মহামারীতে মারা যায়নি। তাদের মৃত্যুর কারণ ছিল এক আকস্মিক এবং ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি (Hailstorm)। তারা যখন এই খোলা, আশ্রয়হীন উপত্যকা দিয়ে যাচ্ছিল, তখন হঠাৎ করেই ক্রিকেট বলের আকারের বিশাল বিশাল বরফখণ্ড বা শিলা আকাশ থেকে পড়তে শুরু করে। পালানোর কোনো জায়গা না থাকায়, তাদের মাথায় এবং কাঁধে সরাসরি আঘাত লাগে এবং সেখানেই তাদের করুণ মৃত্যু হয়। এই তত্ত্বটি স্থানীয় লোককথার সাথেও মিলে যায়, যেখানে দেবী নন্দার ক্রোধে ভয়ংকর শিলাবৃষ্টির কথা বলা হয়েছে।
২০১৯ সালের ডিএনএ গবেষণা: রহস্য যখন আরও ঘনীভূত হয়
শিলাবৃষ্টির তত্ত্বটি প্রায় এক দশক ধরে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে বিবেচিত ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে ‘নেচার কমিউনিকেশনস’ জার্নালে প্রকাশিত একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা এই পুরো রহস্যকে এক নতুন এবং আরও জটিল দিকে মোড় দেয়।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞানীরা ৩৮টি কঙ্কালের উপর ডিএনএ এবং রেডিওকার্বন বিশ্লেষণ করেন, যা আগের সব ধারণাকে ওলট-পালট করে দেয়।
গবেষণার বিস্ময়কর ফলাফল:
১. একই সময়ে মৃত্যু হয়নি: সবচেয়ে বড় চমক ছিল এটা জানা যে, সব কঙ্কাল একই সময়ের নয়। তাদের মধ্যে সময়ের ব্যবধান প্রায় ১,০০০ বছর!
২. তিনটি ভিন্ন জেনেটিক গ্রুপ: ডিএনএ বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই কঙ্কালগুলো মূলত তিনটি ভিন্ন জেনেটিক গোষ্ঠীর মানুষের।
* প্রথম গ্রুপ : এই গ্রুপের ২৩টি কঙ্কাল ছিল দক্ষিণ এশীয় বংশোদ্ভূত, যা আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষের সাথে মিলে যায়। কার্বন ডেটিং অনুযায়ী, তারা প্রায় ৮০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে মারা গিয়েছিল, যা আগের শিলাবৃষ্টির তত্ত্বকে সমর্থন করে।
* দ্বিতীয় গ্রুপ : এই গ্রুপের ১৪টি কঙ্কাল ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন বংশোদ্ভূত। তাদের ডিএনএ-এর সাথে বর্তমান গ্রিস এবং ক্রিট দ্বীপের মানুষের ডিএনএ-এর মিল পাওয়া যায়! আরও আশ্চর্যের বিষয় হলো, তারা মারা গিয়েছিল অনেক পরে, প্রায় ১৮০০ খ্রিস্টাব্দের কাছাকাছি সময়ে।
* তৃতীয় গ্রুপ : একটি মাত্র কঙ্কাল পাওয়া যায়, যার জেনেটিক উৎস ছিল দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া।
নতুন রহস্যের জন্ম:
এই গবেষণাটি কয়েকটি পুরনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার পরিবর্তে, জন্ম দিয়েছে আরও অনেক নতুন এবং গভীর রহস্যের:
- নবম শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ার এই তীর্থযাত্রীরা (সম্ভবত) কারা ছিলেন এবং কেন তারা এই দুর্গম পথে যাত্রা করেছিলেন?
- তার প্রায় ১,০০০ বছর পর, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের (গ্রিস/ক্রিট) একদল মানুষ কেন এবং কীভাবে হিমালয়ের এই প্রত্যন্ত কোণায় এসে মারা গেল? তাদের যাত্রার উদ্দেশ্য কী ছিল?
- দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ওই একজন ব্যক্তিই বা সেখানে কী করছিলেন?
বিজ্ঞানীরা এখনও এই প্রশ্নগুলোর কোনো নিশ্চিত উত্তর খুঁজে পাননি। দ্বিতীয় গ্রুপটির ক্ষেত্রে কোনো মহামারী বা বড় কোনো ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যায়নি, যা তাদের দলবদ্ধ মৃত্যুকে ব্যাখ্যা করতে পারে।
রূপকুন্ড ভ্রমণ: এক রোমাঞ্চকর এবং চ্যালেঞ্জিং অভিজ্ঞতা
রূপকুন্ড লেক এখন ভারতের অন্যতম জনপ্রিয় এবং চ্যালেঞ্জিং ট্রেকিং রুটগুলোর একটি। যারা রোমাঞ্চ, প্রকৃতি এবং রহস্য ভালোবাসেন, তাদের জন্য এই ট্রেকিং এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।
- সঠিক সময়: রূপকুন্ড ট্রেকিং-এর জন্য সেরা সময় হলো বর্ষার আগে (মে-জুন) এবং বর্ষার পরে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর)। এই সময়ে আবহাওয়া তুলনামূলকভাবে ভালো থাকে এবং বরফ কম থাকায় কঙ্কাল দেখার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- কীভাবে যাবেন: এই ট্রেকিং সাধারণত লোহাজুং নামক একটি ছোট গ্রাম থেকে শুরু হয়। কাঠগোদাম পর্যন্ত ট্রেনে এবং সেখান থেকে গাড়িতে করে লোহাজুং পৌঁছাতে হয়।
- চ্যালেঞ্জ: এটি কোনো সহজ ট্রেক নয়। প্রায় ৭-৯ দিনের এই ট্রেকিং-এ আপনাকে দুর্গম পাহাড়ি পথ, জঙ্গল এবং বরফের উপর দিয়ে হাঁটতে হবে। উচ্চতাজনিত অসুস্থতা (Altitude Sickness) একটি বড় ঝুঁকি, তাই শারীরিক সক্ষমতা এবং সঠিক প্রস্তুতি থাকা অত্যন্ত জরুরি।
রূপকুন্ডের কঙ্কাল হ্রদ শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি প্রকৃতির বুকে লেখা এক অসমাপ্ত রহস্যের দলিল। এটি আমাদের দেখায় যে, বিজ্ঞান যতই অগ্রসর হোক না কেন, পৃথিবীর বুকে এখনও এমন অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে, যার সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা আমাদের কাছে নেই।
শিলাবৃষ্টির তত্ত্ব, নন্দাদেবীর অভিশাপ এবং বিভিন্ন মহাদেশের মানুষের সমাবেশের মতো নানা ঘটনা মিলেমিশে রূপকুন্ডকে এক অনন্য এবং রহস্যময় স্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছে। এই কঙ্কালগুলো হয়তো কোনোদিনও তাদের পুরো গল্প আমাদের বলতে পারবে না, কিন্তু তারা চিরকাল হিমালয়ের বুকে শুয়ে থেকে আমাদের মনে করিয়ে দেবে প্রকৃতির বিশালতা, ইতিহাসের গভীরতা এবং মানুষের ভঙ্গুর অস্তিত্বের কথা।
তথ্যসূত্র –
- https://www.thewall.in/magazine/feature-the-mystery-of-skeleton-lake-roopkund-gets-deeper/tid/26338
- https://storymirror.com/read/bengali/story/rhsymy-ruupkundd/i28k27hn
- https://www.sciencing.com/frozen-lake-in-the-himalayas-13721442/
- https://dailynewsreel.in/roop-kund-skeleton-lake/
- https://bengali.news18.com/news/off-beat/uttarakhand-roopkund-lake-skeleton-mystery-know-the-details-here-smj-1326915.html