Image default
ইতিহাস ১০১

তলোয়ারের যুগ থেকে আজকের জাপান: সামুরাইদের ইতিহাস

যুদ্ধের ময়দানে পরাজয় মানেই তাদের কাছে লজ্জা, আর সেই লজ্জা মুছতে তারা বেছে নিত আত্মহননের পথ। 

জাপানের দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অভিযাত্রায় সামুরাইরা শুধু তলোয়ারের কারিগরই ছিল না, বরং তারা ছিল সেসময়ের রাষ্ট্রের মেরুদণ্ড। সামরিক শৃঙ্খলা, নির্ভুল কৌশল এবং অটল নৈতিকতার সমন্বয়ে গঠিত এই যোদ্ধা শ্রেণী মধ্যযুগীয় ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষা থেকে শুরু করে জাপানি সমাজের মূল্যবোধ গঠনেও রেখেছে অনন্য ভূমিকা।

মেইজি পুনর্গঠনের আধুনিক ঢেউ তাদের সামরিক শক্তি মুছে দিলেও, বুশিদো-র আনুগত্য, আত্মসম্মান ও কর্তব্যবোধ আজও জাপানের সমাজ, শিক্ষা এবং সংস্কৃতিতে প্রবাহমান। কে ছিল এই সামুরাই?

এই লেখায় আমরা এই যোদ্ধা শ্রেণীর পরিচয় উত্থান, গৌরব, পতন একত্রে অনুসন্ধান করব।

কারা এই সামুরাই 

সামুরাই” শব্দটি এসেছে জাপানি “সাবুরাউ” শব্দ থেকে। যার অর্থ “প্রভুর পাশে থাকা”। জাপানের ইতিহাসের এক গর্বিত ও অসাধারণ যোদ্ধা ছিল “সামুরাই”। যুদ্ধ নীতির পাশাপাশি তাদের সততা, শৃঙ্খলা এবং ন্যায়পরায়ণতাও ছিল বেশ প্রশংসিত। ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা সামুরাইরা, “বুশিদো কোড” নামক একটি নীতি অনুসরণ করে তাদের জীবন পরিচালনা করত। আর এই নীতির মূল বার্তা ছিল বীরত্ব, ন্যায়পরায়ণতা, সততা, ধৈর্য ও আত্মসংযমের মাধ্যমে সকল পরিস্থিতির মোকাবিলা করা।

সামুরাইদের উত্থান: যোদ্ধা শ্রেণীর জন্ম

আজকে আমরা বিভিন্ন সিনেমা কিংবা এনিমেতে তলোয়ার হাতে যেই যোদ্ধা সামুরাইরকে দেখি তাদের জন্ম কিন্তু হঠাৎ করে হয়নি। তাদের এই উত্থানের পেছনে রয়েছে দীর্ঘ এক ইতিহাস। 

চলুন এক নজরে এই যোদ্ধাদের ইতিহাস সম্পর্কে জেনে আসি।

জাপানের ইতিহাসের সবচেয়ে পরিচিত এই যোদ্ধাদের উত্থান হয়েছিল মধ্যযুগীয় জাপানে। ৮ম থেকে ১২শ শতকে যখন জাপানে কেন্দ্রীয় শাসনের শক্তি অনেকটাই কমে যায়। তখন সম্রাট কিয়োটোর ক্ষমতাও ধীরে ধীরে সীমিত হতে শুরু করে। যার ফলে দূরবর্তী গ্রাম ও অঞ্চলগুলোতে সম্রাট কিয়োটোর প্রভাব তেমন একটা খাঁটত না। আর ঠিক সেই সময়ে বড় বড় জমিদার বা দাইম্যোরা নিজেরাই গ্রামাঞ্চলের প্রশাসন, নিরাপত্তা এবং রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব নেয়। 

তাদের জমি, ফসল আর প্রজাদের রক্ষার জন্য প্রয়োজন পড়ে পেশাদার যোদ্ধার। ঠিক এই প্রয়োজন থেকেই গড়ে ওঠে বুশি বা বুশিদো মানসিকতায় গড়া একদল প্রশিক্ষিত শক্তিশালী, এবং অনুশাসিত যোদ্ধা। যাদের আমরা “সামুরাই” নামে চিনি।

সামুরাই

সামুরাইদের জন্ম মূলত সামাজিক ও রাজনৈতিক চাহিদার ফল। প্রভু বা জমিদারদের ব্যক্তিগত সৈন্যদল হিসেবে যাত্রা শুরু করলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা নিজস্ব আচরণবিধি, নৈতিকতা দিয়ে তাদের নিজস্ব পরিচয় ও মর্যাদা তৈরি করেছিল। 

১২শ শতকের শেষ দিকে যখন মিনামোতো বংশের যোদ্ধারা সম্রাটীয় দরবারের বদলে নিজস্ব সামরিক সরকার (শোগুনাত) প্রতিষ্ঠা করে, তখন সামুরাইদের অবস্থান চূড়ান্তভাবে পাকা পোক্ত হয়। তখন তারা আর শুধু সৈন্য নয়, বরং তারা হয়ে ওঠে শাসক শ্রেণী। এভাবেই এই যোদ্ধা শ্রেণী জাপানের রাজনৈতিক, সামাজিক আর সাংস্কৃতিক জীবনে গভীর ছাপ ফেলে।

সামুরাইদের সামাজিক মর্যাদা

তৎকালীন সময়ে জাপানে সামুরাই ছিল বেশ সম্মান ও মর্যাদার অধিকারী। সাহস, আনুগত্য, সততা ও সম্মানই যেন তাদের জীবনযাপনের মূলনীতি।

সামুরাইদের মর্যাদা অনেকাংশেই  নির্ভর করত তাদের পোশাক, আচরণ, তাদের শিল্প ও সংস্কৃতি এমনকি রুচির ওপর। সামুরাইদের পোশাক ছিল তাদের সম্মান, শৃঙ্খলা ও পরিচয়ের প্রতীক। সাধারণ সময়ে  সামুরাইরা আরামদায়ক “কিমোনা” (সামুরাইদের পোশাক) পরলেও যুদ্ধের সময় দেহ রক্ষার জন্য আর্মার (Yoroi ) নামক একটি  বিশেষ পোশাক পরত। ধাতু ও চামড়ার তৈরি এই বিশেষ পোশাকটি সামুরাইদের সাহস ও শৃঙ্খলার প্রতীক হিসেবে কাজ করত। 

চা অনুষ্ঠান, ক্যালিগ্রাফি, নোহ থিয়েটার ইত্যাদি সবই যেন তাদের রুচির বহিঃপ্রকাশ। সাধারণ মানুষের কাছে সামুরাই শাসন ও নিরাপত্তার প্রতীক হলেও, তৎকালীন রাজাদের কাছে তারা ছিল বিশ্বস্ত সৈনিক ও উপদেষ্টা। মর্যাদা, নীতি এবং সংস্কৃতির ধারক এই যোদ্ধারা সমাজে এক অনন্য অবস্থান পেতেন।

সামুরাইদের  কাতানা (তলোয়ার)

সামুরাইদের গর্ব ছিল তাদের কাতানা। লম্বা, বাঁকা ও একপিঠে ধার যুক্ত কাতানা শুধু লড়াইয়ের হাতিয়ারই ছিল না, বরং এটি ছিল তাদের আত্মার প্রতীক। তবে, আপনি জানলে অবাক হবেন যে, এই যোদ্ধারা যদি কখনও কোন যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত হত, অনেক সময় তখন তারা সেপুকু বা আত্মহত্যা করত। 

যুদ্ধের ময়দানে পরাজয় মানেই যেন তাদের কাছে লজ্জা, আর সেই লজ্জা মুছতে  তারা বেছে নিত আত্মহননের পথ। যা তাদের নৈতিক ও ব্যক্তিগত মর্যাদার একটি চূড়ান্ত প্রকাশ।

সামুরাইদের কাতানা

তোকুগাওয়া যুগ :সামুরাইদের পতনের সূচনা 

১৬০৩ সাল। জাপানের শাসনভার নিলেন তোকুগাওয়া ইয়েসু। গড়ে তুললেন একটি কেন্দ্রীভূত ও শান্তিপূর্ণ শাসন ব্যবস্থা (এডো শাসনব্যবস্থা)। তোকুগাওয়া শাসনের সময় জাপানে দীর্ঘকাল শান্তি থাকায় সামুরাইদের যুদ্ধের দক্ষতা প্রায় অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে।

যুদ্ধের দক্ষতা কিঞ্চিত অপ্রয়োজনীয় হলেও তখনও সমাজে সামুরাইদের বেশ উচ্চ মর্যাদাই ছিল। তারা জমি থেকে কর পেত, প্রশাসনিক কাজে নিয়োজিত থাকত, তবে যুদ্ধের সুযোগ কমে যাওয়ায় তাদের মূল পরিচয় অর্থাৎ যোদ্ধা ধীরে ধীরে বিলীন হয়ে যেতে থাকে। 

তোকুগাওয়া যুগের শান্তি সামুরাইদের জন্য একদিকে মর্যাদা এনে দিলেও, অন্যদিকে তাদের মূল পরিচয় ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে শুরু করে। এভাবেই শুরু হয় সামুরাই শ্রেণীর পতনের পথ।

মেইজি যুগের শুরু: পুরনো জাপানের ইতি

সালটা তখন ১৮৬৮। জাপানের ইতিহাসে এলো এক নাটকীয়  মোড়। তোকুগাওয়া শোগুনশিপের ২৬৫ বছরের শাসনের ইতি ঘটিয়ে সম্রাট মেইজি ক্ষমতা তুলে নিলেন নিজের হাতে। এর মাধ্যমে শেষ হলো এডো যুগের দীর্ঘস্থায়ী সামন্ততান্ত্রিক শাসন এবং শুরু হলো আধুনিক জাপানের যাত্রা।

তখনকার জাপান ছিল একেবারে পুরনো কাঠামোর মধ্যে আটকে থাকা এক দ্বীপ-রাষ্ট্র। চারশত বছরেরও বেশি সময় ধরে বাইরের বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বেশ সীমিত। বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত, বিদেশি সংস্কৃতি প্রবেশ প্রায় নিষিদ্ধ এমন এক কাঠামো যেখানে সামন্তপ্রভু (দাইমিয়ো), আর শোগুনদের হাতে ছিল আসল ক্ষমতা আর সম্রাট ছিলেন শুধু এক প্রতীকী মুখপাত্র।

আর এই অস্থিরতার ফলেই জন্ম নিল “মেইজি পুনর্গঠন” বা Meiji Restoration। সম্রাট মেইজি ও তাঁর সংস্কারক সহযোগীরা বুঝেছিলেন যে, যদি পুরনো সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে না ফেলা হয়, তবে পশ্চিমা শক্তির কাছে জাপান হেরে যাবে। তাই শুরু হলো এক বিশাল কর্মযজ্ঞ। আগে জমিদারদের কাছ থেকে নিয়মিত বেতন (স্টাইপেন্ড), দুই তলোয়ার বহন করার বিশেষাধিকারসহ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণ মূলত সামুরাইদের হাতেই ছিল। 

মেইজি সংস্কারের মাধ্যমে তাদের এসব বিশেষ সুবিধাগুলো ধীরে ধীরে বাতিল করা হয়। স্টাইপেন্ড বন্ধ করা হয়, দুই তলোয়ার বহনের অধিকার তুলে নেওয়া হয়, এমনকি সাধারণ নাগরিকদের নিয়ে আধুনিক সেনাবাহিনী গঠন করা হয়। ফলে, সামুরাইদের শতাব্দীর প্রাচীন মর্যাদা, পরিচয় এবং জীবনযাপন হাতছাড়া হতে শুরু করে। ১৮৬৮ সালের এই পরিবর্তন শুধু শাসনব্যবস্থার নয় বরং জাপানের সংস্কৃতি, সমাজ ও মানসিকতারও এক বিরাট বিপ্লব।

তবে, এতো সহজেই কি হার মেনে নিয়েছিল এই বীর যোদ্ধারা? 

সামুরাইদের সংস্কার আর বিদ্রোহ

এই পরিবর্তন মানতে না পেরে প্রাক্তন সামুরাইরা একের পর এক বিদ্রোহে জড়িয়ে পড়ে। ১৮৭৪ সালে সাগা বিদ্রোহ, ১৮৭৬ সালে হাগি ও কুমামোতো অঞ্চলে ছোট বিদ্রোহ করলেও, ১৮৭৭ সালে সাইগো তাকামোরির নেতৃত্বে স্যাতসুমা বিদ্রোহটি ছিল সামুরাইদের সবচেয়ে বড় এবং শেষ বিদ্রোহ। 

তবে, শেষ পর্যন্ত আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত সরকারি বাহিনীর কাছে সামুরাইরা আর টিকতে পারল না। অবশেষে বিদ্রোহ দমন হলো, আর এভাবেই সামুরাই যুগের কার্যত সমাপ্তি ঘটল। 

তাহলে সামুরাইরা এখন কোথায়? তারা কি ইতিহাসের পাতা‌ থেকে বিলীন হয়ে গেছে?

সামুরাই আজ কোথায়

সামুরাইরা হারিয়ে যায়নি, তারা বেঁচে আছে তবে অন্য রূপে। বাস্তবে তারা আর তলোয়ার হাতে যুদ্ধে না নামলেও, বর্তমানের জাপানের সংস্কৃতিতে তাদের উপস্থিতি বেশ স্পষ্ট। তাদের বুশিদো নীতির শিক্ষা  নেতৃত্ব, আত্মসংযম এবং নৈতিকতা এখনো কর্পোরেট জগৎ ও শিক্ষাক্ষেত্রে প্রেরণা জোগায়। চা অনুষ্ঠান, ক্যালিগ্রাফি, নোহ থিয়েটারের মতো শিল্পে সামুরাইদের সৌন্দর্যবোধ আজও প্রবাহিত।

যোদ্ধার হারায়নি। তবে, তাদের তলোয়ারের জায়গায় এসেছে কেনডো, জুডো, আইকিডোর মতো মার্শাল আর্ট। যেখানে সামুরাইদের শারীরিক দক্ষতা আর মানসিক শিক্ষার মেলবন্ধন দেখা যায়। আর জনপ্রিয় সংস্কৃতিতে তো সামুরাইরা একেবারে নতুন জীবন পেয়েছে। 

বর্তমানে বিভিন্ন সিনেমা, কার্টুন আর গেমে সামুরাইদের নতুন করে দেখানো হয়। আকিরা কুরোসাওয়ার “সেভেন সামুরাই” বা “ইয়োজিম্বো” বিশ্বকে দেখিয়েছে সামুরাই নায়কের নতুন রূপ। “রুরৌনি কেনশিন” থেকে “ডেমন স্লেয়ার” অ্যানিমে ও মাঙ্গায় সামুরাই এখনো জীবন্ত।

বিভিন্ন সিনেমা, কার্টুন আর গেমে সামুরাই

আজও জাপানে অনেক পরিবার আছে যারা নিজেদের সামুরাইদের বংশধর বলে দাবি করে। তবে, সামুরাই আজ আর যুদ্ধ করে না। কিন্তু তাদের আত্মা, নীতি আর সংস্কৃতি জাপানের রক্তে আজও বইছে। তারা এখন ইতিহাসের পৃষ্ঠায় নয় বরং মানুষের মনের গভীরে বেঁচে আছে। সামুরাইরা আসলে হারায়নি; তারা রূপান্তরিত হয়েছে, যোদ্ধা থেকে আজকের প্রেরণায়।

তথ্যসূত্র

Related posts

প্রতারণার ইতিহাস – যখন মিথ্যা হয়ে ওঠে সত্য!

আবু সালেহ পিয়ার

বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর গ্যাংদের ইতিহাস: রক্তাক্ত অপরাধ, ক্ষমতার লড়াই ও অন্ধকার সাম্রাজ্য

ফাবিহা বিনতে হক

গরম থেকে স্বস্তি: এয়ার কন্ডিশনার কিভাবে বদলে দিলো মানবজীবন

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More