Image default
ইউরোপদেশ পরিচিতি

প্রাগ- ইউরোপের শত মিনারের শহর

কখনো কি এমন কোনো ঘড়ি দেখেছেন, যা শুধু সময়ই নয় বরং রাশিচক্র, দিন-রাতের বিভাজন আর ঋতু পরিবর্তনের খবরও জানিয়ে দেয়? এ যেন জ্যোতির্বিদ্যা, বিজ্ঞান আর শিল্পের এক অপূর্ব সম্মিলন। 

হ্যাঁ, বলছি প্রাগের বিখ্যাত অ্যাস্ট্রোনোমিকাল ক্লক–এর কথা। আর এই ঘড়ির মতোই বিস্ময়কর প্রাগ শহরটিও, যেখানে ওল্ড টাউনের মধ্যযুগীয় দুর্গ আর প্রাসাদ থেকে শুরু করে আধুনিক কাচের অট্টালিকা পর্যন্ত সবই চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। আর এর রূপে মুগ্ধ হয়ে প্রতিবছর হাজারো মানুষের আনগনা হয় এই শহরে। 

আজকের লেখায় আমরা জানব ‘আ সিটি অব হান্ড্রেড স্পায়ার্স’ খ্যাত শহর প্রাগ সম্পর্কে নানা জানা-অজানা তথ্য।

প্রাগ এর অবস্থান ও আয়তন

চেক প্রজাতন্ত্রের মধ্যভাগে অবস্থিত বৃহত্তম শহর ও রাজধানীর নাম প্রাগ। এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের ১৪তম বৃহত্তম শহর। এছাড়াও এটি বোহেমিয়ার ঐতিহাসিক রাজধানী। 

ভলটাভা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরের মূল অংশে প্রায় ১৩ লক্ষ মানুষ বসবাস করে। শহরটিতে সাধারনত নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। মজার বিষয় হলো, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মধ্যে এই শহরটিতেই বেকারত্বের হার সর্বনিম্ন। 

ম্যাপ

 ‘শত মিনারের শহর’ প্রাগ এর ইতিহাস

প্রাগকে প্রায়শই ‘আ সিটি অব হান্ড্রেড স্পায়ার্স’ বলা হয়, অর্থাৎ, প্রাগ হলো শত মিনারের শহর। এই নামকরণের পেছনে আবার একটি মজার ঘটনা রয়েছে। ১৯ শতকের দিকে বেরনারদো বোলযানো নামের একজন গবেষক উঁচু থেকে প্রাগ শহরে ১০৩টির মতো প্যাঁচানো উঁচু অট্টালিকা ও গম্বুজ আকারের ক্যাথেড্রাল গণনা করেছিলেন। আর এখান থেকেই শহরটির এই বিশেষ নাম দেওয়া হয়। এই নামটি শুধু সংখ্যা নয়, বরং ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের একটি প্রতীক।

আর এই ঐতিহাসিক সৌন্দর্য্যের কারণ হলো এই অঞ্চলটি প্রাচীন বোহেমিয়া রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। বোহেমিয়া বলতে সেই প্রাচীন চেক অঞ্চলভুক্ত রাজ্যগুলোকে বোঝানো হতো, যেখানে বোহেমিয়ান রাজা; বিশেষ করে পবিত্র রোমান সম্রাটরা বসবাস করতো।

প্রাগের অতীত ইতিহাসে চোখ রাখলে দেখা যায়, নবম শতাব্দীতে এটি একটি নগর কেন্দ্র হিসেবে আবির্ভূত হয়। খ্রিস্টাব্দ ৮৮০ সালে প্রিমিস্লাভ রাজবংশের রাজপুত্র বরিবোস প্রাগ ক্যাসেল নির্মাণের মাধ্যমে শহরের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং এখান থেকেই শুরু হয় প্রাগের গৌরবময় যাত্রা। পরবর্তীতে একই রাজবংশের কিছু সদস্য বাইজেন্টাইন মিশনারি সিরিল কর্তৃক আনা খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করলে শহরের সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় পরিচয়ে যুক্ত হয় এক নতুন অধ্যায়।

৯৭৩ সালে প্রথম বিশপ পদ সৃষ্টির মাধ্যমে এই শহরে খ্রিস্টধর্মের প্রভাব বাড়তে শুরু করে, যা শহরের সমাজ-সংস্কৃতির ভিত গড়ে দেয়। চতুর্দশ শতকে এসে রাজা চতুর্থ চার্লসের শাসনে প্রাগ বাণিজ্য, শিল্প, শিক্ষা ও স্থাপত্যের স্বর্ণযুগে প্রবেশ করে। তবে হুসাইট যুদ্ধসহ নানা ধর্মীয় সংঘাতও শহরের অন্ধকার অধ্যায় হয়ে দাঁড়ায়। 

১৬০৬ সালে প্রাগ দুর্গ

সময়ের সাথে রেনেসাঁ এসে প্রাগকে নতুন রূপ দেয়, আর উনিশ শতকের শিল্পায়ন ও বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি একে “লিটল জেরুজালেম” নামে পরিচিত করে তোলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি দখল, পরবর্তীতে কমিউনিজম এবং প্রাগ বসন্তের ব্যর্থতা শহরকে কঠিন সময়ের মুখোমুখি করে। অবশেষে ১৯৮৯ সালের ভেলভেট রেভোলিউশন শান্তিপূর্ণভাবে কমিউনিজমের অবসান ঘটায় এবং ১৯৯৩ সালে চেক প্রজাতন্ত্রের জন্মের মধ্য দিয়ে প্রাগ নতুন পরিচয়ে বিশ্বদরবারে প্রতিষ্ঠিত হয়।

শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চায় প্রাগ

প্রাগ শুধু প্রাচীন ইতিহাসেই সমৃদ্ধ নয়, শিক্ষা ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রেও প্রাগ দীর্ঘকাল ধরে অগ্রগামী। এখানে রয়েছে মধ্য ইউরোপের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয় চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়, যা ১৩৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত আছে অ্যাকাডেমি অফ আর্টস, অ্যাকাডেমি অফ মিউজিক, এবং বিশ্ববিখ্যাত চেক একাডেমি অফ সায়েন্স। এই প্রতিষ্ঠানগুলো আজও প্রাগের জ্ঞান-ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বহন করে চলেছে।

চার্লস বিশ্ববিদ্যালয়

শুধু তাই নয়, প্রাগের আকাশে জ্বলজ্বলে তারার মতো ছড়িয়ে আছেন বহু বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। ১৭শ শতাব্দীর বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ টাইকো ব্রাহে এখানেই গবেষণা করেছেন। আর আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব আলবার্ট আইনস্টাইন ১৯১১ থেকে ১৯১২ সাল পর্যন্ত প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা করেছেন। আর এই সময়েই তিনি রচনা করেন তাঁর বিখ্যাত গবেষণাপত্র “The Theory of Relativity”, যা পরবর্তীতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি স্থাপন করে।

প্রাগের পর্যটন

ঐতিহ্য, গতিশীলতা এবং আধুনিকতার বর্ণিল মিশেলের এ শহর পর্যটকদের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি গন্তব্যস্থল। প্রতিবছর এই শহরে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৬৪ লক্ষ পর্যটক ঘুরতে আসেন। লন্ডন, প্যারিস, ইস্তানবুল এবং রোম এর পর পঞ্চম সর্বাধিক জনপ্রিয় ইউরোপীয় শহর এই প্রাগ। প্রাগ দর্শনে বের হলে আপনার জন্য সবথেকে উপযোগী বাহন হতে পারে বাস। বাস ভ্রমণের পাশাপাশি পায়ে হেঁটে প্রাগ দর্শনও বেশ উপভোগ করবেন।

ওল্ড টাউন স্কয়ার

বিশেষ করে পায়ে হেঁটে প্রাগের ওল্ড টাউন স্কয়ার ঘোরার মজাই আলাদা। এটি প্রাগের সবচেয়ে পুরানো এবং জনপ্রিয় জায়গাগুলোর একটি। এই স্কয়ারের কেন্দ্রে রয়েছে প্রাগের বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি। এখানকার মূল আকর্ষণ হচ্ছে, এখানে প্রতি ঘন্টায় ছোট্ট কিন্তু চমকপ্রদ মেকানিকাল শো উপস্থাপন করা হয়।

প্রাগের এই অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ঘড়ি তার জটিল প্রযুক্তি এবং অনন্য নকশার কারণে হাজার হাজার পর্যটকের আকর্ষণ কেন্দ্র। আরও মজার বিষয় হলো, ঘড়ির দিকে তাকালে শুধু সময়ই নয়, তারিখ, মাস এবং রাশিচক্রের চিহ্নও দেখতে পাওয়া যায়।

ওল্ড টাউন স্কয়ার

লেসার টাউন

প্রাগের সবথেকে নান্দনিক হচ্ছে প্রাগের লেসার টাউন। আর এই লেসার টাউন স্কয়ারর ল্যান্ডমার্ক হল রাজকীয় সেন্ট নিকোলাস চার্চ। ওল্ড টাউন স্কয়ারর কেন্দ্রবিন্দুতেই দেখা মিলবে বিখ্যাত এই চার্চের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় চেক আর্মির ঘাঁটি ছিল এই নিকোলাস চার্চ। সেন্ট নিকোলাস চার্চটি একাধারে গীর্জা এবং অন্যদিকে ক্লাসিকাল কনসার্টের অন্যতম প্রেক্ষাগৃহ বা মঞ্চ।

এছাড়াও, চার্চের বাইরে বের হতেই রাস্তার দুপাশ ঘিরে রয়েছে অসংখ্য রেস্তোঁরা, পাব, দোকানপাট, ব্যুটিক এবং স্থানীয় লোকজনের ব্যারক স্টাইলের ঘরবাড়ি। এই ব্যারক স্টাইলে নির্মিত বাড়িগুলোর চোখ ধাঁধানো নির্মাণ শৈলী দেখে যে কেউ অবাক হতে বাধ্য হবেন।

পেট্রিন টাওয়ার

প্রাগের সবচেয়ে প্রতীকী আকর্ষণগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে পেট্রিন টাওয়ার। ৬৩.৫ মিটার উচ্চ এই টাওয়ার থেকে পুরো শহরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখা যায়। এটি ১৮৯১ সালে প্রাগ জুবিলি প্রদর্শনীর জন্য নির্মিত হয় এবং শহরের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে পরিচিত।

মজার বিষয় হলো, এই টাওয়ারের পর্যবেক্ষণ ডেকে পৌঁছাতে হলে ২৯৯টি সিঁড়ি বেয়ে ডাবল হেলিক্স ডিজাইনে উপরে উঠতে হবে। অবাক হওয়ার কিছু নেই, এখানে লিফটর ব্যবস্থাও রয়েছে। এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ারে আরও রয়েছে সুন্দর পেট্রিন গার্ডেনস, ম্যাজিক মিররস, অবজারভেটরি এবং টেলিস্কোপ, যা পর্যটকদের ভ্রমণকে আরও আনন্দদায়ক করে তোলে।

পেট্রিন টাওয়ার

চার্লস ব্রিজ ও শহরের সমস্ত ডিম

শহরটিতে এরপর রয়েছে চার্লস ব্রিজ। প্রাগের ভলটাভা নদীর উপর সতেরটি সেতুর মধ্যে চার্লস ব্রিজ অন্যতম। চেক রাজা চতুর্থ চার্লসের নামানুসারে ১৩৫৭ সালে এই সেতু নির্মিত হয়। এখানে একবার না ঘুরে আসলে প্রাগ ভ্রমণ কিছুটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। কারণ, এই ব্রিজের দুই পাশে ৩০টি ভাস্কর্য সাজানো আছে, যা প্রায় সবই ক্যাথলিক সেইন্টদের প্রতীক। 

প্রায় ৬০০ বছরের পুরনো এই ব্রিজটি রাতের আলোয় অন্যরকম সৌন্দর্য ধারণ করে। নদীর ওপরে ব্রিজের ওপর দাঁড়িয়ে শহরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য উপভোগ করার অভিজ্ঞতা একেবারেই অনন্য।

তবে, অবাক করা বিষয় হলো, এই ব্রিজের নির্মাণে করতে গিয়ে নাকি প্রাগ শহরের সমস্ত ডিম শেষ হয়ে গিয়েছিল! শুনে অবাক লাগতে পারে, লোকমুখে শোনা যায়, ১১শ’ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ভলটাভা নদীর উপর এই সেতু নির্মাণের চেষ্টা চলছিল। সেতুর পাথরের মতো শক্ত করতে বালির বস্তায় ডিম ও অন্যান্য উপাদান মেশানো হতো। একসময় দেখা গেলো, শহরে আর ডিম পাওয়া যাচ্ছে না। তখন গ্রামের বিভিন্ন এলাকা থেকে ডিম আনা শুরু হলো। সেকালে চার্লস ব্রিজকে মূলত অপরাধী দমনে ব্যবহার করা হতো। রাজতন্ত্রবিরোধী, সামাজিক অপরাধী, চোর ডাকাত, ধোঁকাবাজদের ব্রিজের ওপর থেকে নদীতে নিক্ষেপ করা হতো। 

চার্লস ব্রিজ

সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রি

প্রাগের আরেক গুরুত্বপূর্ণ দর্শনীয় স্থান হচ্ছে সেন্ট অ্যাগনেস মনাষ্ট্রি। এর সামনেই দেখতে পাবেন ‘পাউডার গেট’। এই প্রবেশদ্বার দেখতে অনেকটা মুঘল সম্রাটের ‘বুলন্দ দরওয়াজ’ অথবা ‘গেট ওয়ে অফ ইন্ডিয়া’ র মত। 

এই প্রবেশদ্বার মূলত প্রাগের ওল্ডটাউনকে নিউটাউন থেকে পৃথক করেছে। ১৭শ শতকে এটি গানপাউডার সংরক্ষণের জন্য ব্যবহৃত হতো, সেখান থেকেই এর নামকরণ হয় “Powder Gate”। রাজকীয় শোভাযাত্রার সূচনা হতো এখান থেকে, যা একে আরও ঐতিহাসিক মর্যাদা এনে দিয়েছে। আজকের দিনে পর্যটকরা টাওয়ারটিতে উঠে প্রাগ শহরের অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।

প্রাগ ঘুরতে এসে প্রাগ দুর্গ দেখা মিস করবেন, তা একেবারেই চলবে না। কারণ, এটি শুধু প্রাগের নয় বরং পুরো চেক প্রজাতন্ত্রের সবচেয়ে বড় এবং প্রতীকী স্থাপনাগুলোর মধ্যে একটি। এটি এক ধরনের ছোট শহরের মতো, যেখানে বিভিন্ন যুগের ইতিহাসের ছোঁয়া এসে মিলিত হয়েছে। 

দুর্গের মধ্যে ঢুকতেই দেখতে পাবেন রাজকীয় অ্যাপার্টমেন্ট, সুন্দর প্রাসাদ, গির্জা, জাদুঘর, আর্ট গ্যালারি এবং প্রশস্ত বাগান। এখানে ভ্রমণ করলে আপনি প্রাচীন রাজা-রাণীদের জীবনধারার ছোঁয়া অনুভব করতে পারবেন।

প্রাগের ইহুদি কোয়ার্টার 

প্রাচীন ইহুদি সম্প্রদায়ের জীবন ধারার ছোঁয়া উপভোগ করতে চাইলে আপনাকে চলে যেতে হবে প্রাগের ইহুদি কোয়ার্টারে। এই ইহুদি কোয়ার্টার বা যোসেফোভ ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানের অন্তর্ভুক্ত। এখানে বেশ কয়েকটি প্রাচীন সিনাগাগ, কবরস্থান এবং জাদুঘর রয়েছে। স্থানটি শুধুই পর্যটন কেন্দ্র নয়, বরং ইতিহাসের সাক্ষ্য। প্রাগের বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক পরিচয়ের প্রমাণ হলো এই ইহুদি কোয়ার্টার। 

প্রাগের ইহুদি কোয়ার্টার

পেট্রিন পাহাড়

শহরের কোলাহল থেকে দূরে কিছুটা সতেজতার অনুভূতি পেতে চায়লে পর্যটকেরা পেট্রিন পাহাড় ভ্রমণ করতে যান। পেট্রিন পাহাড় প্রাগ শহরের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক নিদর্শন। পাহাড়ের শীর্ষ থেকে প্রাগ শহরের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখার এ অনুভূতি অন্য কোথাও পাওয়া যায় না। এছাড়াও এখানে একটি টাওয়ার রয়েছে, যা আইফেল টাওয়ারের নকশায় তৈরি। অনেকে এখানে পিকনিক করতে আসেন। আবার হাঁটাহাঁটির জন্য জায়গাটি অনেক দর্শনার্থীদের কাছে খুবই প্রিয়। বিশেষ করে সন্ধ্যায় যখন সূর্যাস্তের আভায় পুরো শহর  সোনালি আলোয় ঢাকা পড়ে তখন এই পাহাড়ে মানুষ ভিড় জমায়।

প্রাগ চিড়িয়াখানা

শহরের জীববৈচিত্রের সাথে খানিকটা সময় কাটানোর এখানে রয়েছে প্রাগ চিড়িয়াখানা। চিড়িয়াখানাটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এটি ইউরোপের অন্যতম সেরা চিড়িয়াখানা হিসেবে পরিচিত। এখানে প্রায় ৫০ হেক্টরের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ৫০০০ প্রজাতির প্রাণী বাস করে, এবং মোট ৬০ টিরও বেশি জায়গায় বিভিন্ন প্রাণী দেখা যায়। এখানকার সবথেকে বিশেষ দিক হচ্ছে, চিড়িয়াখানায় কোন বিশাল লোহার খাঁচা নেই, সবকিছুই প্রাকৃতিক পরিবেশের কাছাকাছি তৈরি করা হয়েছে, যাতে প্রাণীরা যেন প্রকৃতিতে অবস্থানের মতো অনুভূতি পান। শুধু প্রাণী নয়, এখানে প্রচুর সবুজ এলাকাও রয়েছে, যেখানে হাঁটাহাঁটি করে মনোরম পরিবেশে সময় কাটাতে পারবেন।

ভিশেরাড 

আপনার প্রাগ দর্শনের সব থেকে অন্যতম অভিজ্ঞতা হয়ে থাকতে পারে বোহেমিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানা। আর  বোহেমিয়ার সংস্কৃতি দেখার সব থেকে উৎকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে ভিশেরাড। ভিশেরাড হল প্রাগের এক প্রাচীন দুর্গ, যা বোহেমিয়ার ইতিহাস ও সংস্কৃতির গভীরতা ধারণ করে। এটি পর্যটকদের ইতিহাসের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের একটি অনন্য সুযোগ করে দেবে। দুর্গের প্রাচীর, প্রাচীন কবরস্থান এবং চারপাশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এখানে ভ্রমণকে আরও স্মরণীয় করে তোলে। শহরের একেবারে উঁচু থেকে থেকে প্রাগের বিস্তৃত দৃশ্য উপভোগ করা যায়, যা ছবি তোলার জন্য খুবই চমৎকার।

ন্যাশনাল মিউজিয়াম 

এছাড়াও, আপনার প্রাগ ভ্রমণে ন্যাশনাল মিউজিয়ামও অবশ্যই দেখার মতো স্থান। এটি ওয়েন্সেসলাস স্কয়ারে অবস্থিত এবং চেক প্রজাতন্ত্রের ইতিহাস, বোহেমিয়া, মোরাভিয়া ও স্লোভাকিয়ার প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের বিশাল সংগ্রহ প্রদর্শন করে। মিউজিয়ামে প্রাগের প্রাগৈতিহাসিক ইতিহাস, প্রাকৃতিক ইতিহাস, ভূতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব এবং প্রাণীবিদ্যার অনেক গুরুত্বপূর্ণ বস্তু রয়েছে। জাদুঘরের গম্বুজ থেকে প্রাগ এবং আশেপাশের মনোরম দৃশ্য দেখার সুযোগ পাবেন।

স্ট্রাহভ মঠ 

অপরদিকে, স্ট্রাহভ মঠ প্রাগের আরেকটি ঐতিহ্যবাহী স্থান। আপনি যদি ইতিহাসপ্রেমী হয়ে থাকেন তাহলে এটি হয়ে উঠতে পারে আপনার জন্য একটু অন্যতম গন্তব্য। ১১৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত এই মঠের প্রধান আকর্ষণ হলো  চার্চ অফ দ্য অ্যাসাম্পশন অফ দ্য ভার্জিন মেরি এবং চার্চ অফ দ্য সেন্ট চার্লস দ্য গ্রেট। এই চার্চ দু’টি তার বিস্ময়কর বারোক স্থাপত্য এবং জটিল সজ্জার জন্য বিখ্যাত। ভিতরে প্রবেশ করলে আপনি দেখতে পাবেন উচ্চ খিলান, অলঙ্কৃত বেদী, চমৎকার ফ্রেস্কো এবং সোনালি অলংকরণ। চার্চদুটো  মধ্যযুগীয় শিল্পকলার ঐতিহ্যবাহী  নিদর্শন বহন করে।

এছাড়া, এখানকার স্ট্রাহভ লাইব্রেরি ইতিহাসপ্রেমীদের জন্য এক মূল্যবান জায়গা। জেনে অবাক হবেন যে এখানে,  ২,০০,০০০- এরও বেশি খণ্ড এবং মধ্যযুগীয় পাণ্ডুলিপি সংরক্ষিত রয়েছে। এটি বিশ্বের সবচেয়ে মূল্যবান এবং ভালোভাবে সংরক্ষিত ঐতিহাসিক গ্রন্থাগারগুলোর মধ্যে একটি। গ্রন্থাগারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো এর দুটি ঐতিহাসিক পাঠাগার কক্ষ।এর মধ্যে একটি হচ্ছে ফিলসফি হল এবং অন্যটি থিওলজি হল । উঁচু কাঠের বুকশেলফ, অলঙ্কৃত ছাদচিত্র, প্রাচীন গ্লোব এবং নিখুঁত কারুকাজ এই হলগুলোকে যেন একটি জীবন্ত জাদুঘরে পরিণত করেছে। 

উইশ ওয়াল

আরও মজার বিষয় হলো, সারাদিনের প্রাগ ভ্রমণ শেষে ভলটাভা নদীর পাশ দিয়ে নিরবে হাঁটতে হাঁটতে  দেখতে পাওয়া যায় উইশ ওয়াল, বাংলায় যাকে ইচ্ছে দেওয়াল বলা হয়। বিশ্বাস করা হয়, এই দেয়ালে যদি মনের কথা লিখে রাখা হয়, তবে তা পূর্ণ হয়। স্থানীয়রা তো বটেই, এখন অনেক দর্শনার্থীও এই উইশ ওয়ালে বিশ্বাস রাখে এবং তাদের ইচ্ছে লিখে সেখানে টাঙিয়ে রাখে। যে কেউ চাইলেই নিজের মনের কোনো ইচ্ছা এই দেয়ালে লিখে রেখে আসতে পারে।

উইশ ওয়াল

প্রাগের সংস্কৃতি

প্রাগ মানুষের পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হওয়ার আরও কিছু কারণ রয়েছে। 

চেক বিয়ার পান

এখানে পুরনো দুর্গ আর ঘুরে বেড়ানোর জন্য আছে সুন্দর মধ্যযুগীয় রাস্তাগুলোর পাশাপাশি রয়েছে চেক বিয়ার। চেক বিয়ার খেতে চাইলেও এখানে আছে প্রচুর জায়গা। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রিয় পানীয় হলো বিয়ার। মাথাপিছু হিসাব করলে, চেকরা বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিয়ার পান করে। যদি আপনি বিয়ার পছন্দ না করেন, তবে ওয়াইন আপনার জন্য বিকল্প পানীয় হতে পারে। চেকদের দেশীয় উৎপাদিত ওয়াইনের মাত্র ৩০ শতাংশই রপ্তানি করা হয়, বাকিটা চেকরা নিজেদের জন্য সংরক্ষণ করে রাখে। 

চেকদের আরও একটি নিজস্ব কোমল পানীয় হলো কোফোলা। এটি তাদের কমিউনিস্ট আমলে তৈরি হয়েছিল, কারণ তখন পশ্চিমা দেশ থেকে কোমল পানীয় আমদানি করা হতো না। শহরের বেশিরভাগ রেস্তোরাঁতে এটি সহজে পাওয়া যায়।

প্রাগের খাবার

এছাড়াও, এই শহরের কিছু জনপ্রিয় খাবার রয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, প্রাগে দুপুরের খাবারকে দিনের প্রধান খাবার হিসেবে ধরা হয়। আর এখানে দুপুরের খাবার হিসেবে শুকর এবং গরুর মাংস অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রাগের সবচেয়ে পরিচিত ডিশগুলোর মধ্যে একটি হলো গুলাস। এটি গরুর মাংসের স্টু, যা পেপারিকা ও পেঁয়াজ দিয়ে রান্না করা হয়। মাংস অত্যন্ত নরম, প্রায় হাড় থেকে আলাদা হয়ে যায়। এরসাথে সাধারণত ডাম্পলিং বা নেডলিকি পরিবেশন করা হয়। ডাম্পলিং মাংসের গ্রেভি শোষণ করে ফেলে, এর ফলে খাবারের স্বাদ আরও বেড়ে যায়। চেকরা খাবার খাওয়ার সময় কাঁটাচামচ ব্যবহার করে। কিছু গুলাসের গ্রেভি এত সুস্বাদু হয় যে, শেষ পর্যন্ত কেউই প্লেট ছাড়তে চায় না।

প্রাগ সারা বছর পর্যটকদের ভিড় দেখতে পাওয়া যায়, তবে ডিসেম্বর মাসে শহরটি একটি বিশেষ নান্দনিক রূপ ধারণ করে। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে ক্রিসমাস মার্কেটগুলো বসে, যা দর্শনার্থীদের চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য উপহার দেয়। এখানকার বাসিন্দারা খুব সাংস্কৃতিক মনোভাবাপন্ন। উৎসবের দিনগুলো বিশেষ করে বসন্তে শহরটি এক ভিন্ন রূপে দেখা যায়। এ সময়টাতেই মূলত ঐতিহ্যবাহী উৎসবগুলোর আয়োজন হয়।

ছবির মত শহর প্রাগ ইউরোপীয় সাহিত্যের অন্যতম কারিগর। ওল্ড টাউন থেকে শুরু করে প্রাচীন বোহেমিয়ান সংস্কৃতি, ঐতিহ্যবাহী খাবার, এবং মানুষের আন্তরিকতা; সবমিলিয়ে প্রাগ বিশ্বের মানুষকে এর দিকে আকর্ষণ করে যাচ্ছে। প্রাগ তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে বিশ্ব মানচিত্রে অন্যতম জায়গা দখল করে থাকুক এই কামনায় শেষ করছি বিশ্বপ্রান্তরের আজকের পর্ব। 

তথ্যসূত্রঃ

Related posts

আটলান্টিকের মুক্তো: বাহামা দ্বীপপুঞ্জ

ত্রিনিদাদ ও টোবাগো- ভারতীয় গান, হিন্দি সিনেমা আর বলিউডে ভরা ক্যারিবিয়ান দেশ

সলোমন দ্বীপপুঞ্জ: সাগরের বুকে এক অজানা পৃথিবী

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More