বর্তমানে শুধু ছবি সংগ্রহর জন্যই ড্রোন ব্যবহার করা হয়না। এটা ব্যবহার করা হচ্ছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে, সিনেমার শুটিং এর ক্ষেত্রে ইত্যাদি ক্ষেত্রে।
ড্রোন হচ্ছে এক বিশেষ ধরনের মানবহীন পাখিসদৃশ যন্ত্রবিশেষ (Unmanned Aerial Vehicle) যাকে সংক্ষেপে UAV বলা হয়। ড্রোনের অনেকগুলো নাম আছে। এটার আরেকটা নাম মাল্টিরোটর। এটার জন্মটাই হয়েছে মূলত সামরিক কাজে যেখানে এটার নাম unmanned combat aerial vehicle।
ড্রোন শব্দের অর্থ গুণগুণ করা; এটা কোনো সায়েন্টিফিক নাম না। ড্রোন নামটা সাধারণ মানুষের দেয়া, কারণ প্রথম দিককার মনুষ্যবিহীন সামরিক উড়ন্ত যানগুলোর আওয়াজ নাকি অনেকটাই ছিল পুরুষ মৌমাছির (ড্রোন) ডানা ঝাপটানোর আওয়াজের মতোই।
ড্রোনের ইতিহাস ও বিবর্তন
হেলিকপ্টার বা এই জাতীয় অন্যান্য গগণচারী যানের সাথে ড্রোনের মূল পার্থক্য হচ্ছে, হেলিকপ্টার বা এই জাতীয় কোনো যান চালানোর জন্য এক বা একাধিক মানুষের প্রয়োজন হলেও ড্রোন চালানোর জন্য কোনো মানুষের দরকার হয় না। দূর থেকেই তারহীন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে অথবা আগে থেকে নির্ধারিত প্রোগ্রামিং দ্বারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে ড্রোন নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
ড্রোনের ইতিহাস
ড্রোন কিভাবে আবিষ্কার হলো এবং ড্রোন প্রযুক্তির ইতিহাস জানতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৮৪৯ সালে।
ড্রোনের ইতিহাসটা খুব মজার আর অদ্ভুত। অস্ট্রিয়া থেকে যখন ভেনিস স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, তখন ১৮৪৯ সালে ইতালির কাছে ড্রোনের ইতিহাস খুঁজে পেয়েছিলেন অনেকে । অস্ট্রিয়ান সৈন্যরা গরম বাতাস, হাইড্রোজেন বা হিলিয়াম ভর্তি বেলুন দিয়ে বোমা সজ্জিত করে ভেনিস আক্রমণ করে । কয়েকটা ঠিকমতো কাজও করেছিলো বটে তবে কিছু বেলুন আবার বাতাসে ঘুরে গিয়ে অস্ট্রিয়ানদের উপরেই পড়েছিলো।
এরপর প্রথম মানুষবিহীন বেতার নিয়ন্ত্রিত বিমান ব্যবহার করা হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধে। ১৯১৮ সালে মার্কিন সেনাবাহিনী পরীক্ষামূলক ভাবে একটি চালকবিহীন ‘ফ্লাইং বম্ব’ বিমান তৈরি করেছে, যা কখনই মোকাবিলায় ব্যবহার করা হয়নি ।

প্রথম ড্রোন ব্যবহারের ইতিহাস
প্রথম সামরিক কাজে ড্রোনের ব্যবহার করা হত। বর্তমানে শুধু ছবি সংগ্রহর জন্যই ড্রোন ব্যবহার করা হয়না। এটা ব্যবহার করা হচ্ছে যুদ্ধ ক্ষেত্রে, সিনেমার শুটিং এর ক্ষেত্রে ইত্যাদি ক্ষেত্রে। এমনকি গবেষণা, কৃষি, পরিবহনসহ বহু ক্ষেত্রে এখন এটি ব্যবহৃত হয়।
ড্রোন আবিষ্কার করেছেন (আব্রাহাম কারেম) তাকে ইউএভি প্রযুক্তির জনক বলা হয়। আব্রাহাম কারেম ২৭ জুন ১৯৩৭ সালে ইরাকের বাগদাদে আসিরিয়ান ইহুদি দম্পতির ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। আব্রাহাম কারেম জন্মের ১৪ বছর পরেই ১৯৫১ সালে তাঁর পরিবারের মানুষ তাঁকে নিয়ে ইসরাইলে চলে যায় এবং আব্রাহাম কারেম সেখানেই বড়ো হয়ে উঠতে থাকে।
ছোটবেলা থেকেই আব্রাহাম কারেমের (অ্যারোনটিক্সের) প্রতি আবেগ অনেক বেশি ছিলো। আব্রাহাম কারেম ১৪ বছর বয়সে (বিমানের মডেল ) তৈরী করতে শুরু করেছিলো। আর তখন থেকেই তাকে (ইউএভি) ড্রোন প্রযুক্তির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
আব্রাহাম কারেম টেকনিয়ন থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে গ্র্যাজুয়েশন লাভ করেন এবং তিনি সকল ইসরায়েলি বিমান বাহিনীর জন্য (ইয়োম কিপপুর) যুদ্ধের সময় তার প্রথম ড্রোন আবিষ্কার করেছিলেন।

বাংলাদেশে ড্রোন প্রযুক্তির আবিষ্কারক কে
বাংলাদেশে ড্রোন প্রযুক্তির আবিষ্কারক হিসেবে নির্দিষ্ট করে কারো নাম বলা কঠিন, তবে বেশ কয়েকজন ব্যক্তি ও গবেষণা দল এই ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন। ড. জাফর ইকবাল ড্রোন গবেষণা দলের প্রধান ছিলেন।
যুদ্ধক্ষেত্রে ড্রোন ব্যবহার
সামরিক অস্ত্রশস্ত্রে প্রতিটি দেশই এখন অনেক উন্নত হয়ে উঠেছে। এর মধ্যে নবতম সংযোজন ড্রোন। আধুনিক সময়ে বড় বড় যুদ্ধে ড্রোন ব্যবহার করতে দেখা গেছে। ড্রোন হলো মানববিহীন যুদ্ধবিমান, যা আধুনিক অস্ত্র এবং ক্ষেপণাস্ত্র দ্বারা সুসজ্জিত থাকে। এসব ক্ষেপণাস্ত্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্যবস্তুর ওপর আঘাত হানতে পারে।
এমনকি ড্রোনের আঘাতে যুদ্ধের ট্যাঙ্কও নিমিষে উড়ে যেতে পারে। আধুনিক ড্রোনের সামনের ছুঁচালো অংশে একটি সেন্সর যুক্ত ক্যামেরা বসানো থাকে যা দিয়ে লক্ষ্যবস্তুর ওপর নজরদারি চালানো হয়। মূলত স্থিতিশীলতার জন্য এসবের শেষ ভাগ ভি-আকৃতির হয়।
এগুলো মূলত জিপিএস বা লেজার পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা যুক্ত থাকে। ক্যামেরার মাধ্যমে লক্ষ্যবস্তুর গতিবিধির ওপর নজর রেখে এই ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমা নিক্ষেপ করা হয়। ড্রোনের দৈর্ঘ্য সাধারণত ১১ মিটার বা ৩৬ ফুট-এর আশেপাশে থাকে। উচ্চতা হয় ৩.৫-৪ মিটার। একটি রিপার ড্রোন প্রতি ঘণ্টায় সর্বাধিক ৪৬৩ কিলোমিটার যাত্রাপথ অতিক্রম করতে পারে। সামরিক ড্রোনের আদর্শ উদাহরণ ‘এমকিউ-১ প্রিডেটর’। এটি আমেরিকার একটি সামরিক ড্রোন। আমেরিকার সঙ্গে আফগানিস্তান, ইরাক যুদ্ধে এটি অন্যতম প্রধান অস্ত্র হয়ে উঠেছিল।
ড্রোনের উত্তরসূরি রিপার ড্রোনের তুলনায় বড় এবং ভারী ক্ষেপণাস্ত্র বহনে সক্ষম। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে বাগদাদ বিমানবন্দরের বাইরে ইরানি জেনারেল কাসেম সোলেইমানিকে হত্যায় রিপার ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। আধুনিক সময়ে কয়েকটি রক্তাক্ত যুদ্ধের সাক্ষ্য বহন করেছে ড্রোন।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাস, বিশ্ব তখন ব্যস্ত করোনা মহামারির ভয়াল ডেল্টা সংক্রমণ মোকাবিলায়। ঠিক তখনই যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে ককেশাসে। নগরনো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে বৈরী প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করে আজারবাইজান। এ যুদ্ধে অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান না থাকা আজারবাইজানের মূল হাতিয়ারই ছিল তুরস্ক ও ইসরায়েল থেকে কেনা অত্যাধুনিক সব ড্রোন; যার সাহায্যে আর্মেনিয়ার আকাশ-প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ ধবংস করে দিয়ে আকাশপথে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ নেয় দেশটি। আজেরি ড্রোনের ছোঁড়া ক্ষেপণাস্ত্র ও বোমায় বিদ্ধস্ত হয় আর্মেনিয় সেনাবাহিনীর অসংখ্য সাঁজোয়া যান, ট্যাঙ্ক ও গোলন্দাজ ইউনিট।
তাছাড়া, ড্রোন শুধু আঘাতই হানে না, নজরদারির মাধ্যমে দেয় শত্রুর অবস্থান ও গতিবিধি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ সব তথ্য। এসব কিছুই কারাবাখ যুদ্ধে আজারবাইজানের জয় ছিনিয়ে আনে। যুদ্ধে ড্রোনের ব্যবহার নতুন কিছু না হলেও, এই যুদ্ধের ফলাফল সামরিক পর্যবেক্ষকদের বিস্মিত করেছিল। সবচেয়ে খ্যাতি পায় তুরস্কের তৈরি বাইরাক্তার টিবি-২ এর মতো ড্রোনগুলো।

বাণিজ্যিক কাজে ড্রোনের ব্যবহার
প্রযুক্তির উন্নতির ফলে এখন বিভিন্ন আকার, ওজন ও ডিজাইনের ড্রোন তৈরি করা হচ্ছে। এসব আকাশযান বিভিন্ন ধরনের সেন্সর পে-লোড বহনে সক্ষম। কৃষি, নির্মাণ, জ্বালানি, বিনোদন ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোয় এর ব্যবহার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে।
বাণিজ্যিক ড্রোনের ব্যবহার আরো বাড়বে। এটি ভবিষ্যতে প্রযুক্তি খাতের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজারে পরিণত হতে পারে। এরিয়াল ফটোগ্রাফি, দ্রুত ডেলিভারি, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, মানচিত্র তৈরি, ভবন পরিদর্শন, ফসলের অবস্থা দেখা, মালামাল পরিবহন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও আবহাওয়া পূর্বাভাসের মতো খাতগুলোয় ড্রোন ব্যবহার হচ্ছে। এসব ভিন্ন ভিন্ন কাজের জন্য ড্রোন ব্যবহার বাজার সম্প্রসারণে সাহায্য করছে। ড্রোনের সুবিধা হলো, এটি এমন কাজ করতে পারে, যা মানুষের জন্য কঠিন বা বিপজ্জনক। এ কারণে বিভিন্ন শিল্পে ড্রোনের ব্যবহার বাড়ছে।
আধুনিক ড্রোনের ইতিহাস
আজকের আধুনিক যেসব ড্রোন দেখা যায় তা কিন্তু রাতারাতি তৈরি হয়নি। ড্রোনের সাথে মিলিটারি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার কয়েক যুগ সম্পর্ক রয়েছে। মিলিটারি ব্যবস্থায় যেখানে মানুষের কাছে পৌঁছানো দুর্গম এমন সব স্থানে ‘মনুষ্যবিহীন বিশেষ সুবিধা’র জন্য প্রথম দিকে ড্রোনের চিন্তাভাবনা করা হয়। বিগত শতাব্দীর ৩য় দশকের দিকে পুনঃব্যবহারযোগ্য রেডিও ব্যবস্থা আবিষ্কৃত হলে আকাশযানে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এক রাতারাতি পরিবর্তন আসে। পরবর্তীতে সামরিক বিভাগে ব্যবহারের জন্য ‘ক্লাসিক ক্যামেরা এবং সেন্সরসমৃদ্ধ’ ১ম মিলিটারি ড্রোন তৈরি করা হয়।
আধুনিক প্রযুক্তির উত্তরণের সাথে সাথে এখন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাসহ ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যবহারের জন্য বিভিন্ন কোম্পানি ড্রোন নির্মাণ করছে। বর্তমানে গুগল, অ্যামাজনের মতো বড় বড় কোম্পানি পণ্য পরিবহণ, যোগাযোগ রক্ষা, তথ্য পরিবহণসহ নানা কাজে সার্থকতার সাথে ড্রোনকে কাজে লাগাচ্ছে। ফেসবুক আজ ড্রোনের মাধ্যমে পৃথিবীর প্রত্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ‘ইন্টারনেট সেবা’ পৌঁছে দিচ্ছে। মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায়ও আজকাল ড্রোন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
তথ্যসূত্রঃ
১.https://bigganchorcha.com/others/drone/
২.https://archive.roar.media/bangla/main/tech/drones
৩.https://www.techbnnews.com/2022/05/what-is-a-drone-discover-drones-the-use-of-drones.html
৪.https://m.dailyinqilab.com/article

