Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

নিঝুম দ্বীপ: বাংলাদেশে এমন জায়গা আছে ভাবতে পারেন?

ভাবুন এমন একটা জায়গা, যেখানে না আছে গাড়ির হর্ণ, না শহরের কোলাহল। আছে শুধু ঢেউয়ের শব্দ, বাতাসে লবণের গন্ধ, আর দূরে কোথাও হরিণের দৌড়ের শব্দ। এ যেন প্রকৃতির বুকের ভেতর লুকানো এক নিঃস্তব্ধ স্বর্গ নিঝুম দ্বীপ। 

বঙ্গোপসাগরের এই ক্ষুদ্র অথচ বিস্ময়কর ভূমিখণ্ডে সময় যেন থেমে আছে নিজের মতো। এখানে প্রতিটি সকাল শুরু হয় পাখির ডানার ঝাপটায়, আর শেষ হয় সোনালি সূর্যাস্তের নিঃশব্দ আলোয়।

নিঝুম দ্বীপের অবস্থান

প্রায় ১৪ হাজার ৫০ একর আয়তন বিশিষ্ট নিঝুম দ্বীপ নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত। বঙ্গপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা শান্ত এই দ্বীপটি বল্লার চর, কামলার চর, চর ওসমান এবং চর মুরি সহ বেশ কিছু ছোট চরের সমন্বয়ে গঠিত। 

১৯৪০ সালে প্রকৃতির নিজস্ব ছন্দে গড়ে ওঠা এই দ্বীপটি, আজ বাংলাদেশের এক অনন্য প্রাকৃতিক বিস্ময় হিসেবে বেশ পরিচিত হয়েছে। এমনকি, নিঝুম দ্বীপের প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল এই দ্বীপটিকে জাতীয় উদ্যান হিসেবে ঘোষণা করেন। 

নিঝুম দ্বীপের ইতিহাস

বৈচিত্র্যময় এই দ্বীপের নামকরণের ইতিহাসও বেশ বিচিত্র। স্থানীয়ভাবে বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত   এই দ্বীপটিকে কেউ বলে ইছামতি, কেউ বা বাউলার চর, আবার কারো কাছে এটি চর ওসমান নামেও পরিচিত। চরের বাসিন্দাদের মুখে-মুখে গড়ে ওঠা এই নামগুলোই আজও যেন দ্বীপটির অতীতের ইতিহাস ও কাহিনীকে জীবন্ত রাখে।

বসতি গড়ে উঠার একদম শুরুর দিকে এই দ্বীপের নাম ছিল চর ওসমান । লোকমুখে শোনা যায় এখানে বসতি গড়া প্রথম মানুষটির নাম ছিল ওসমান। আর তারই নামানুসারেই এই দ্বীপের নামকরণ করা হয়েছিল চর ওসমান। শুধু তাই নয় একসময় দ্বীপের  বিভিন্ন স্থানে দেখা যেতো বালুর ঢিবি বা টিলার মতো জায়গা। আর এই কারণেই দ্বীপের নামের সঙ্গে জুড়ে যায় বাইল্যার ডেইল বা বাউলার চর শব্দগুলো।

নিঝুম দ্বীপে মাছ ধরা

তাছাড়া ও একসময় দ্বীপের আশেপাশের  এলাকায় প্রচুর ইছা মাছ বা চিংড়ি মাছ ধরা পড়তো বিধায়, জেলেরা এই দ্বীপের নাম দেয় ইছামতির দ্বীপ। বৈচিত্র্যময় এই নামগুলো দ্বীপের ভৌগোলিক এবং প্রশাসনিক পরিচয়কে নির্দেশ করলেও শান্ত–শীতল দ্বীপের পরিবেশের সাথে এই নামগুলো খুব একটা মিলতো না।

জেনে অবাক হবেন, ১৯৭০ এর ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি  যখন একদম জনমানব শূন্য হয়ে যায়। তখন হাতিয়ার তৎকালীন সংসদ সদস্য আমিরুল ইসলাম কালাম দ্বীপটিতে পরিদর্শনে গিয়ে দ্বীপটির জনমানবশূন্য পরিবেশ দেখে নামকরণ করেন “নিঝুম দ্বীপ”। আর সেই থেকেই ধীরে ধীরে দ্বীপটি তার নতুন নাম নিঝুম দ্বীপ নামে পরিচিতি পেতে শুরু করল। অর্থাৎ, যেখানে নেই কোন গাড়ির হর্ণ, না আছে শহরের কোলাহল। আছে শুধু ঢেউয়ের গর্জন, হরিণের পদধ্বনি আর পাখির ডানার মৃদু ঝাপটা।

২০১৩ সালে নিঝুম দ্বীপ জাহাজমারা ইউনিয়ন থেকে পুরোপুরি আলাদা হওয়ার মাধ্যমে নিজের ইতিহাসে লিখল নতুন এক অধ্যায়। শুরু হলো স্বতন্ত্র এক ইউনিয়ন হিসেবে পথ চলা। স্বতন্ত্র প্রশাসনিক মর্যাদা পেতেই নিঝুম দ্বীপের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এমনকি অর্থনীতিতেও ঢুকে পড়ল নতুন রঙ এবং নতুন গতি।

নিঝুম দ্বীপের মূল আকর্ষণ

নিঝুম দ্বীপের মূল আকর্ষণ হলো, এর বিস্তীর্ণ ও নির্জন সৈকত। 

নামা বাজার সৈকত

দ্বীপে প্রবেশ করলে প্রথমেই চোখে পড়ে বিস্তৃত সাদা বালির সৈকত, ঢেউয়ের শব্দ,  শীতল হাওয়া, আর সূর্যাস্তের দৃশ্য। সব মিলিয়ে এ যেন এক অদ্ভুত মানসিক প্রশান্তি। সাগর পাড়ে বসে সূর্যাদয় ও সূর্যাস্তের দৃশ্য উপভোগ করার মজাই যেন আলাদা। সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখার জন্য এখানকার সেরা জায়গাটি হলো “নামা বাজার সৈকত”। 

নামা বাজার সৈকত

ম্যানগ্রোভ বন

আপনি যদি প্রকৃতিপ্রেমী হন, তাহলে তো কথাই নেই। সৈকতের পাশেই আছে বিস্তৃত এক ম্যানগ্রোভ বন। যেখানে আছে নানা প্রজাতির গাছ, পাখি ও ছোট বড় অসংখ্য জলজ উদ্ভিদ। তবে নিঝুম দ্বীপের বিশেষত্ব হচ্ছে চিত্রা হরিণ। একসঙ্গে এতো চিত্রা হরিণ দেশের আর কোথাও দেখা যায় না।

পাখিপ্রেমীদের স্বর্গ

তবে, নিঝুম দ্বীপ মূলত পাখিপ্রেমীদের জন্য স্বর্গ। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখির বসবাস এই দ্বীপটিতে। শীতকালে নিঝুম দ্বীপে সরালি, জিরিয়া, লেনজা, পিয়ং, রাঙ্গামুড়ি, চখাচখি, ভূতিহাঁস,পেলিক্যানসহ হাজারো অতিথি পাখির আগমন ঘটে। 

নিঝুম দ্বীপের পরিযায়ী পাখি

এছাড়াও বছরজুড়ে সামুদ্রিক ঈগল, শঙ্খচিল, বকসহ নানা স্থানীয় পাখির আনাগোনা তো আছেই। এসব পাখিদের কলতান, উড়ন্ত পাখির ঝাঁক আর ঘাসের মধ্যে তাদের খেলা—সব মিলিয়ে মনে হয় যেন জীবন্ত কোন সাফারি।

নিঝুম দ্বীপে ক্যাম্পিং 

এদিকে নিঝুম দ্বীপ মানেই ক্যাম্পিং। আর ক্যাম্পিংয়ের জন্য সবচেয়ে ভালো জায়গা হলো নামা বাজার সৈকতের কাছে অবস্থিত বিশাল খোলা মাঠটি। প্রায় ছয় মাইলের ক্যাম্পিং স্পষ্ট টি যেন নিঝুম দ্বীপের অ্যাডভেঞ্চার দ্বিগুণ বাড়িয়ে দেয়। অ্যাডভেঞ্চার প্রেমীরা খুব সহজেই জাহাজমারা বাজার থেকে ক্যাম্পিংয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সব আইটেমই পেয়ে যাবেন। তাছাড়াও কেউ চাইলে তাঁবু ভাড়া করেও ক্যাম্পিং ফিল নিতে পারবেন।

নিঝুম দ্বীপে ক্যাম্পিং

নিঝুম দ্বীপের প্রতিটি স্থান যেন নীরব সৌন্দর্যে মোড়া এক স্বপ্নরাজ্য। নামা বাজার, জাহাজমারা ঘাট, চৌধুরী খাল, কবিরাজের চর, এমনকি বন বিভাগের হরিণের বন সহ, সব জায়গাই যেন নিজস্ব সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ। এই দ্বীপের নামা বাজারে গেলে দেখা মিলবে দ্বীপের বাসিন্দাদের সহজ সরল জীবনযাত্রা ও স্থানীয় মানুষের হাসিমাখা মুখ। আর জাহাজমারা ঘাটে বসে দেখা যায়, সমুদ্রের বিশালতা আর সূর্যাস্তের রঙিন আভা। আর হরিণের বনে হাঁটলে মনে হয় যেন আপনি প্রকৃতির হৃদয়ের গভীরে প্রবেশ করেছেন।

নিঝুম দ্বীপের স্থানীয় জীবনধারা

প্রাকৃতিক পরিবেশের পাশাপাশি নিঝুম দ্বীপের স্থানীয় গ্রাম এবং গ্রামে বসবাসকারী বাসিন্দাদের জীবনধারাও বরাবরই পর্যটকদের আকর্ষণ করে আসছে। এখানকার মানুষদের মাছ ধরা, নৌকা চালানো, তাদের সহজ জীবনধারণ, আতিথেয়তা এবং প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে থাকা; সবকিছুই যেন দ্বীপের সৌন্দর্যকে আরও বেশি জীবন্ত করে তোলে।

দ্বীপটিতে মাত্র তিনটি বাজার আছে; যার মধ্যে “নামা বাজার” ই প্রধান। এই নামা বাজারই যেন নিঝুম দ্বীপের প্রাণকেন্দ্র। জেনে অবাক হবেন, নিঝুম দ্বীপে বিদ্যুতের ব্যবস্থা খুবই সীমিত। আর নামা বাজারই দ্বীপটির বিদ্যুতের একমাত্র প্রধান উৎস। রাত এগারোটা পর্যন্ত নামা বাজারের জেনারেটরের আলোতেই আলোকিত হয় ছোট্ট এই দ্বীপটি। এমনকি নিঝুম দ্বীপে গিয়ে পেটপূর্তি করতে চাইলেও যেতে হবে সেই নামা বাজারেই। এখানকার সামুদ্রিক মাছ ও চিংড়ি ভাজার স্বাদ সত্যিই অনন্য। আগে থেকে অর্ডার করে রাখলে তুলনামূলক ভাল খাবার পাওয়া যায়।

কেউ যদি সত্যিই যদি নিঝুম দ্বীপের নিস্তব্ধ সৌন্দর্য উপভোগ করতে চান, তবে অপেক্ষা করুন শীতের সকালগুলোর জন্য। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি স্বপ্নের এই দ্বীপটিতে পাড়ি জমানোর উপযুক্ত সময়। এ সময় আবহাওয়া থাকে ভীষণ আরামদায়ক—না খুব গরম, না খুব ঠান্ডা। তাই খুব সহজেই ঘোরা যায় বনের ভেতর, সৈকতের ধারে কিংবা ট্রলারে চেপে আশেপাশের ছোট ছোট চরগুলোতে। তাছাড়াও এ সময়ে সাগরের ঢেউ থাকে শান্ত, বাতাসে থাকে শীতলতার গন্ধ এবং বনজুড়ে ছুটে বেড়ায় শত শত চিত্রা হরিণের দল। তবে বর্ষাকালে দ্বীপের  প্রকৃতি  যেন অন্য রূপে জেগে ওঠে। তখন সাগর থাকে উত্তাল আর যাতায়াত বেশ ঝুঁকিপূর্ণ। তাই অভিযাত্রী অথবা প্রকৃতিপ্রেমী না হলে, শীতকালই হবে আপনার নিঝুম দ্বীপ যাত্রার সেরা সময়।

প্রকৃতির নীরব কোলে কিছুটা সময় কাটাতে চাইলে নিঝুম দ্বীপের মতো জায়গা আর দ্বিতীয়টি নেই। এ দ্বীপ যেন প্রকৃতির হাতে আঁকা এক নিঃস্তব্ধ চিত্রপট। নিঝুম দ্বীপের প্রতিটি কোণেই আছে নীরবতা, সবুজ আর শান্তির ছোঁয়া। যেখানে শহরের কোলাহল ভুলে মানুষ সত্যিই কিছুটা “নিঝুম” সময় কাটাতে পারে।  

তথ্যসূত্রঃ 

https://vromonguide.com/place/nijhum-dwip 

https://bangla.thedailystar.net/life-living/travel/news-531716

Related posts

আন্দামান নিকোবর- সমুদ্রের বুকে রহস্যময় কারাগার ও প্রাচীন জনগোষ্ঠীর দ্বীপ

দাশত-ই লুত: পৃথিবীর উষ্ণতম মরুভূমি

বিশ্বের নিষ্ঠুরতম মানুষ: আইভান দ্য টেরিবল

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More