যেখানে নারী-পুরুষ ইচ্ছে মত যে কারো সাথে রাত কাটাতে পারে এবং যে কাউকে বিয়েও করতে পারে। এমনকি বিবাহিত নারীও এই রীতিনীতির বাইরে নয়!
বিশ্বাস হচ্ছে না? পাকিস্থানের হিন্দুকুশ পর্বতমালায় রয়েছে কালাশ নামে পরিচিত এমনই এক অদ্ভুদ নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী নারী, ভিন্নধর্মী সংস্কৃতির কারণে এই স্থান এবং এই জনগোষ্ঠী, আজ মানুষের কৌতূহলের কেন্দ্রস্থল।
আজকের লেখায়, কালাশ জনগোষ্ঠী এবং তাদের অবিশ্বাস্য নিয়ম-কানুন সম্পর্কে জানবো নানা জানা-অজানা তথ্য।
কালাশ জনগোষ্ঠী
পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখোয়া প্রদেশের চিত্রল জেলার দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় কালাশ জনগোষ্ঠীর মানুষের দেখা মেলে। আর মজার বিষয় হলো, পাকিস্তানের চিরায়ত জীবনধারার সঙ্গে এই জনগোষ্ঠীর মানুষের জীবনধারার কোনো মিলই নেই। এই সম্প্রদায়ের মানুষদের অতুলনীয় সৌন্দর্য, রঙিন জীবনধারা, ধর্মীয় বিশ্বাস, আধ্যাত্মিক রীতি এবং সামাজিক চলাফেরা; সব মিলিয়ে প্রায় সকল দিক দিয়ে তারা সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র, যা অন্য যে কোনও সম্প্রদায়ের সঙ্গে তুলনা করা প্রায় অসম্ভব।
কালাশ জনগোষ্ঠীর উৎপত্তি
কালাশ জনগোষ্ঠীর গল্প মানেই অদম্য টিকে থাকার কাহিনি, রহস্য, আর এক অনন্য সংস্কৃতির বর্ণিল যাত্রা। কালাশদের গল্পের শুরু হয় মূলত আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট এর সময় থেকে। লোকমুখে প্রচলিত রয়েছে, এই জনগোষ্ঠীর মানুষেরা তারই সৈন্যসামন্তের বংশধর।
আজ থেকে প্রায় ২০০০ বছর আগে আলেকজান্ডার দ্যা গ্রেট ভারতীয় উপমহাদেশে অভিযানে এসে এই এলাকা জয় করেছিলেন৷ সে সময় আলেকজান্ডার এর সেলুকাস নামের এক সেনাপতি, কিছু সৈন্যসামন্ত নিয়ে পাহাড়ি উপত্যকায় বসবাস শুরু করেন এবং স্থানীয় মহিলাদের বিয়ে করেন৷ সেই থেকেই কালাশদের উৎপত্তি। পরে আলেকজান্ডার সৈন্যসহ গ্রীসে ফেরত চলে গেলেও এরা এখানেই রয়ে যায়।

বর্তমানে কালাশ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা প্রায় ৪ থেকে ৫ হাজার। যদিও এ সংখ্যাটি ধীরে ধীরে অনেকটাই কমে গিয়েছে৷ তাদের কালাশা নামে নিজস্ব ভাষা রয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, এ ভাষার কোনো স্বীকৃত লিখিত লিপি নেই। আর তাই পুরোপুরি মৌখিকভাবে প্রচলিত হওয়া এই ভাষাটিকে সংরক্ষণ করা, বর্তমানে অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকাল মাত্র কয়েক হাজার মানুষই কালাশা ভাষায় কথা বলে। তাই ভাষাটি ইতোমধ্যেই “বিপন্ন ভাষা” হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়েছে।
কালাশ জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি
পাকিস্তানের ইসলামিক সংস্কৃতির ভেতরে থেকেও কালাশ জনগোষ্ঠীর ধর্মবিশ্বাস একেবারেই আলাদা। কালাশ জনগোষ্ঠী দক্ষিণ এশিয়ার শেষ জীবিত বহুদেববাদী সম্প্রদায়গুলোর একটি হিসেবে ধরা হয়। কারণ, গাছ-গাছালি, নদী-নালা, পাহাড় আর আকাশকে তারা পূজা করে ।
কালাশ জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে আলোচিত দিক হলো তাদের উৎসব। রঙিন পোশাক, ঢোল-বাদ্য, নাচ-গান—সব মিলিয়ে এই উৎসবগুলো কেবল আনন্দের জন্য নয়, বরং গভীরভাবে ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় উৎসবগুলোর একটি হলো চিলম জোশি, যা প্রতি বছর মে মাসে বসন্তকে স্বাগত জানাতে অনুষ্ঠিত হয়। চার দিন ধরে চলা এ উৎসবে, গান, নাচ আর আনন্দে মুখরিত থাকে পাহাড়ি গ্রামগুলো। মজার ব্যাপার হচ্ছে, তরুণ তরুণীদের মধ্যে অনেকে এই উৎসবেই নিজেদের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়।

এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরেকটি বড় উৎসব হলো উচাও, এটি মূলত ফসল কাটার উৎসব। গ্রীষ্মের শেষে এই উৎসবটি পালিত হয়। এই উৎসবে কালাশরা ভালো ফসলের জন্য তাদের দেব-দেবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানায়। তারা দেবতাদের উদ্দেশ্যে খাবার নিবেদন করে, পবিত্র নৃত্য পরিবেশন করে এবং বড় বড় অগ্নিকুণ্ড জ্বালায়।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হলো চাওমোস, যা ডিসেম্বর মাসে পালিত হয়। এটি আসলে কালাশদের নববর্ষ। চাওমোসই তাদের দীর্ঘতম এবং সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব, যা টানা দুই সপ্তাহ ধরে চলে। কালাশ উৎসবগুলোর সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যময় দিক হলো তাদের নাচ আর সংগীত। উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে পুরুষ-নারী সবাই মিলে বড় বড় বৃত্ত তৈরি করে, ঢোলের তাল মিলিয়ে ছন্দময় নৃত্য পরিবেশন করে। তাদের বিশ্বাস, তাদের লোকসংগীতে আছে গভীর আধ্যাত্মিকতা, যা পাকিস্তানের অন্য কোথাও পাওয়া যায় না।
কালাশদের আলোচিত নারী প্রথা
কালাশ জীবনের আরেকটি অনন্য দিক হলো বাশালি প্রথা। এটি নারীর প্রাকৃতিক ঋতুচক্র এবং গর্ভাবস্থাকে সম্মান জানানোর গভীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। যখন কোনো নারী মাসিক অবস্থায় থাকে কিংবা সন্তানসম্ভবা হয়, তখন তাকে কিছুদিনের জন্য গ্রাম থেকে আলাদা একটি কুঁড়ে ঘরে থাকতে হয়। আর একেই বলা হয় বাশালি। তবে এটি শাস্তি হিসেবে নয়, কিংবা এই প্রথা বৈষম্যের কোনো রূপও নয়। বরং, এটি নারীর জন্য একধরনের বিশ্রাম, আত্মমন্থন আর আধ্যাত্মিক পরিশুদ্ধির সময়।
কালাশ জনগোষ্ঠীর কথা উঠলেই বিশেষভাবে আলোচনায় আসে তাদের নারীরা। তাদের অনন্য রূপ, সৌন্দর্য আর সাজসজ্জা যেন চারপাশকে মুগ্ধ করে তোলে। কালাশ নারীদের অনেকেই পৃথিবীর অন্যতম সুন্দরী বলে বর্ণনা করেন। ফর্সা গায়ের রং, তীক্ষ্ণ মুখাবয়ব, আর নীল কিংবা সবুজ চোখে এক অপার্থিব মায়া। পাকিস্তানের অন্য জাতিগোষ্ঠীর তুলনায় তাদের এই ভিন্ন রূপ অনেককেই অবাক করে তোলে।

কালাশ নারীদের সৌন্দর্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য তাদের ঐতিহ্যবাহী পোশাক। তারা পরে লম্বা কালো পোশাক, যার উপর রঙিন সুতার সূক্ষ্ম কারুকাজ করা থাকে। গলায় থাকে ভারী পুঁতির মালা। সবচেয়ে আকর্ষণীয় হলো তাদের বিশেষ মাথার অলঙ্কার। স্থানীয়ভাবে একে বলা হয় শো-শুট। এটি শাঁস, পুঁতি আর পালক দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি করা হয়।
তবে কালাশ নারীরা শুধু রূপেই নয়, আত্মবিশ্বাস আর ব্যক্তিত্বেও সমানভাবে অনন্য। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ঐতিহ্যবাহী সমাজে যেখানে নারীরা নানা সীমাবদ্ধতায় আবদ্ধ, সেখানে কালাশ নারীরা উপভোগ করে ব্যাপক সামাজিক স্বাধীনতা। তারা নিজেরাই জীবনসঙ্গী বেছে নিতে পারে, পুরুষদের সঙ্গে খোলামেলা মেলামেশা করতে পারে, এমনকি ইচ্ছা করলে বিবাহ বিচ্ছেদের সিদ্ধান্তও নিতে পারে। তাদের এই সাহস, স্বাধীনতা আর স্বকীয়তা কালাশ সমাজকে গোটা পাকিস্তানেই আলাদা করে তুলেছে।
আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, এখানে এক গ্রামের কালাশ বধূকে ছিনতাই করে নিয়ে যায় অন্য গ্রামের কালাশ পুরুষ। কারণ রীতি অনুযায়ী এই গোত্রে স্ত্রী ছিনতাই করা কোন অপরাধ নয়। এক্ষেত্রে শুধু বধূর সম্মতি থাকতে হয়। স্থানীয় ভাষায় এই প্রথাকে বলা হয় ঘোনাদস্তুর প্রথা৷
তাদের আরো একটি অদ্ভুত রীতি হল, যখন কোন ছেলে কিশোর বয়স থেকে যৌবনে পা রাখে, ছেলেটিকে তখন পুরো গ্রীষ্মকালের জন্য কিছু ভেড়া নিয়ে উঁচু পাহাড়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়৷ গ্রীষ্মের প্রচণ্ড তাপ দাহ আর কষ্ট থেকে বেঁচে ফিরতে পারলে, তখন তাঁকে ঘিরে বাদুলোক উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। এই উৎসবে ছেলেটিকে নিজের ইচ্ছেমতো, গ্রামের যেকোনো বিবাহিত অথবা অবিবাহিত নারীকে পছন্দ করার সুযোগ দেয়া হয়। এরপর পছন্দ করা সেই নারীকে নিয়ে কিশোরকে চলে যেতে হয় গ্রাম থেকে দূরবর্তী কোন নির্জন স্থানে।
শুনে অবাক হবেন যে, কালাশ জনগোষ্ঠী মৃত্যুকে শোকের বিষয় হিসেবে দেখে না। বরং তারা এটিকে জীবনের একটি স্বাভাবিক সমাপ্তি এবং প্রাকৃতিক প্রবাহের অংশ হিসেবে গণ্য করে। কারও মৃত্যু হলে তারা শোকের বদলে নাচ, গান ও ভোজের মাধ্যমে সেই জীবনকে উদযাপন করে।
কালচারাল হেরিটেজ কালাশ জনগোষ্ঠী
কালাশ জনগোষ্ঠী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তাদের প্রাচীন ঐতিহ্য আঁকড়ে ধরে রেখেছে। কিন্তু আজকের দিনে এসে তাদের জীবনযাত্রা তীব্র হুমকির মুখে। এমনকি কালাশ গোষ্ঠী ২০০৮ সাল থেকে ইউনেস্কোতে তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ‘ইনট্যাঞ্জিবল কালচারাল হেরিটেজ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে আসছে। তবে নানা আন্তর্জাতিক ও প্রক্রিয়াগত কারণে এখনো তারা সম্পূর্ণ সফল হতে পারেনি। এছাড়া, দ্রুত আধুনিকায়ন, ধর্মান্তর, অর্থনৈতিক সমস্যা আর পরিবেশগত বিপর্যয়—সব মিলিয়ে এই ছোট জনগোষ্ঠীর ওপর তৈরি হয়েছে প্রবল চাপ।

কালাশদের প্রাচীন ধর্ম বিশ্বাস, রঙিন উৎসব, আকর্ষণীয় পোশাক আর আলাদা জীবনধারা শুধু পাকিস্তানেই নয়, পুরো বিশ্বেই আলোচনার বিষয়। চারপাশে ইসলামিক সংস্কৃতির আধিপত্য থাকলেও কালাশরা এখনো ধরে রেখেছে নিজেদের বহুদেবতাবাদী ধর্ম আর পুরনো ঐতিহ্য। সকল বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এই জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি এভাবেই ধরে রাখুক।

