মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবনকাল ছিল ইতিহাসে এক বিরাট পরিবর্তনের যুগ। নবী মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র ইসলামের প্রবর্তক নন, বরং তিনি ইতিহাসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। সপ্তম শতকের আরব সমাজ ছিল বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত, গোত্রীয় সংঘাত তখন ছিলো স্বাভাবিক বিষয়। এমনকি সে সময় আরববাসীকে নৈতিকভাবেও দুর্বল বলা হয়েছে। সেসময় বেশিরভাগ গোত্রই বহুঈশ্বরবাদ চর্চা করতেন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই মহানবী(সা.) ইসলামের বাণী, অর্থাৎ, একেশ্বরবাদ প্রচার করেন, যা শুধু আরব ভূখণ্ড নয়, বরং সারা বিশ্বের ইতিহাস বদলে দেয়।
তাঁর জীবনকে বোঝার জন্য শুধু ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ যথেষ্ট নয়, বরং ঐতিহাসিকভাবে বিশ্লেষণ করাও গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর নবুওয়াতের পূর্ববর্তী জীবন, প্রথম ওহী, ইসলাম প্রচারে প্রতিকূলতা, মদিনায় হিজরত এবং যুদ্ধ ও কূটনীতির মাধ্যমে ইসলামী সমাজ গঠনসহ জীবনের বিভিন্ন ঘটনা —মানবসভ্যতার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
মক্কা: নবী মুহাম্মদ (সা.) এর জন্মস্থান
নবী মুহাম্মদ (সা.) ৫৭০ বা মতান্তরে ৫৭১ খ্রিস্টাব্দে মক্কা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। নবীজির জন্মের সময় মক্কা বাণিজ্যিক এবং ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল। তিনি ছিলেন হাশিমী বংশের এক মর্যাদাপূর্ণ পরিবারে জন্মগ্রহণকারী। তাঁর পিতা আবদুল্লাহ এবং মা আমিনা, দুজনেই ছিলেন মক্কার সম্মানিত পরিবার এর সদস্য।
কিন্তু তার জন্মের পূর্বেই তাঁর পিতা আব্দুল্লাহ মারা যান। তাঁকে এবং তাঁর মা আমেনাকে তার দাদা আব্দুল মুত্তালিব আপন অভিভাবকত্বে গ্রহণ করেন। আরবের প্রথা অনুযায়ী নবীজী (সা.) কে দুধ খাওয়ানোর জন্য তায়েফের নিকটবর্তী এলাকায় বসবাসকারী এক স্ত্রীলোকের কাছে দেওয়া হয়। আরবরা নিজেদের বাচ্চাদেরকে গ্রামের স্ত্রীলোকদের কাছে দিয়ে দিত, যাতে বাচ্চারা ভালোভাবে কথা শিখতে পারে এবং তাদের স্বাস্থ্য ভালো হয় ও সুন্দর হয়।
তাঁর বয়স যখন ছয় বছর তখন তার মা মদিনার আত্মীয়স্বজনের বাড়ি থেকে তাঁকে নিয়ে ফেরার সময় মাঝপথে মারা যান এবং সেখানেই সমাধিত করা হয়। পরে মোহাম্মদ (সা.) কে মক্কায় ফিরে নিয়ে আসে এক দাসী, যিনি তাঁকে তাঁর দাদার হাতে তুলে দেয়।
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শৈশবকাল
নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর শৈশব ছিল বেশ কষ্টের। পিতামাতার অকাল মৃত্যুর পর, তিনি দাদা আবদুল মুত্তলিবের তত্ত্বাবধানে বড় হন। তাঁর বয়স যখন আট বছর, তখন তাঁর লালন-পালনকারী দাদা মারা যান। অতঃপর তাঁর চাচা আবু তালিব পিতার ওসীয়্যত অনুসারে তাঁর অভিভাবকত্ব গ্রহণ করেন।
তাঁর জীবনের প্রথমদিকের এই ধৈর্যের পরীক্ষাগুলো তাঁকে পরবর্তীতে আত্মনির্ভরশীল, ধৈর্যশীল ও বিচক্ষণ করে তোলে। তাঁর জীবনের এই সংকটময় সময়কে বলা যায় তার, পরবর্তী নেতৃত্বের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি।
নবুয়তের পূর্বে নবী মুহাম্মদ (সা.) এর চারিত্রিক গুণাবলী
মোহাম্মদ (সা.), বাণিজ্যিক কারণে চাচা আবু তালিবের সঙ্গে দুই-তিনবার আরবের বাইরে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন। বাল্যকাল থেকে তার ব্যক্তিত্বে চিন্তা ভাবনা করার বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হতো। মানুষের লড়াই ঝগড়ার মধ্যে তিনি কখনোই নিজেকে জড়াতেন না, বরং, লড়াই ও কলহ মিটিয়ে ফেলার চেষ্টাই করতেন তিনি।
একবার মক্কা এবং তার আশেপাশে গোত্রগুলো যুদ্ধবিগ্রহ দেখতে দেখতে মক্কার কিছু সংখ্যক চিন্তিত যুবক একটি সংঘ গঠন করল। মুহাম্মদ (সা.) খুব উৎসাহের সঙ্গে সেই সংঘের সদস্য হয়েছিলেন এবং একা হলেও তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এমনকি জীবনের শেষ পর্যায় পর্যন্ত তিনি এখানে কৃত শপথের মর্যাদা রক্ষা করেছেন।
নবী (সা.) এবং হযরত খাদিজা (রা:) এর বিবাহ
মোহাম্মদ (সা.) এর বয়স যখন ২৫ বছর, তখন তার সততা ও খোদাভীতির কথা ছড়িয়ে পড়লো। লোকজন তার দিকে আঙ্গুল তুলে দেখাতো এবং বলতো, ‘দেখ! ওই একজন সৎ মানুষ যাচ্ছেন, একজন আমানতদার মানুষ যাচ্ছেন।’’ এই সকল কথা মক্কার একজন সম্পদশালী নারীর কানেও পৌঁছে গেল। তিনি চাচা আবু তালিবের কাছে বলে পাঠালেন যে, তিনি যেন তাঁর ভাতিজা মুহাম্মদকে বলেন যে, তার যে সমস্ত মালামাল সিরিয়ার বাণিজ্য কাফেলার সঙ্গে যাচ্ছে, তিনি যেন তার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
এই বাণিজ্য সফরে মহানবী (সা.) যথেষ্ট সফলতা লাভ করলেন এবং আশাতিরিক্ত মুনাফা করে ফিরে এলেন। খাদিজা (রা.), মুহাম্মদ (সা.) এর সঙ্গে যারা ছিলেন তাদের কাছ থেকে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলেন এটি শুধুমাত্র সম্ভব হয়েছে বাণিজ্য কাফেলার নেতা অর্থাৎ মোহাম্মদ (সা.) এর সততা ও দক্ষতার কারণে। ব্যাপারটা হযরত খাদিজার উপর বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করল। এবং তিনি চল্লিশ বছর বয়সে, দুবার বিধবা হওয়ার পরও মহানবী (সা.) কে বিবাহ প্রস্তাব দিলেন।
মনে হবে এই বিবাহের মাধ্যমে একজন গরিব ও এতিম যুবকের জন্য সম্পদের দুয়ার খুলে গেল। কিন্তু সেই সম্পদের ব্যবহার তিনি যেভাবে করেছিলেন তা সারা পৃথিবীর জন্য একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) প্রথম ওহী
হযরত রাসূলে করীম (সা.) এর বয়স যখন ত্রিশ বছর পার হল, তখন তাঁর হৃদয় আল্লাহর এবাদত করার প্রেরণা পূর্বে চাইতে আরও বেশি হতে লাগলো। শহরবাসীদের দুষ্কৃতি ও মন্দ কাজের প্রতি বিরূপ হয়ে তিনি অবশেষে মক্কা থেকে দুই/তিন মাইল দূরের এক পাহাড়ে আল্লাহ এবাদতের জন্য একটা স্থান করে নিলেন। জায়গাটা ছিল পাহাড়ের উপরের দিকে পাথরঘেরা ছোট্ট একটি গুহা; হেরা গুহা।
চল্লিশ বছর বয়সে এমনি এক দিনে, নবী মোহাম্মদ(সা.) হেরা গুহার মধ্যে এক কাশফ(দিব্যদৃষ্টি) দেখতে পেলেন যে, এক ব্যক্তি তাকে সম্বোধন করে বলছেন যে “পড়ুন” । তিনি উত্তর দিলেন, ‘আমি তো পড়তে জানি না’’। এর উত্তরে, সে ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই কথা বললেন। তৃতীয়বারে নবীজি (সা.) পড়তে পারলেন।
এই ঘটনা ইসলামের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, যা মুসলিমদের বিশ্বাস অনুযায়ী, তাকে এই দিনে আল্লাহর পক্ষ থেকে ‘রাসুল’ বা ‘দূত’ হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। এর তিন বছর পর নিয়মিত ভাবে কুরআন নাযিল হওয়া শুরু করে।
প্রথম ইসলাম প্রচার ও প্রতিক্রিয়া
প্রথমে নবী মুহাম্মদ (সা.) তাঁর পরিবারের মধ্যে ইসলাম প্রচার শুরু করেন। তবে মক্কার কুরাইশরা এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে, কারণ তারা মনে করেছিল যে, এটি তাদের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতে হুমকি হতে পারে। শুরুর দিকে ইসলাম গ্রহণকারীদের সংখ্যা ছিল খুবই কম, তবে তাদের মধ্যে ছিলেন নবী মুহাম্মদ (সা.) এর স্ত্রী খাদিজা, তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু আবু বকর, এবং অন্যান্য লোক।
নিকট আত্মীয়দের মধ্যে প্রচারের পর তিনি মক্কাবাসীর ভেতরে আল্লাহর বাণী প্রচার আরম্ভ করলেন। তাতেও যখন খুব বেশি সারা মিলল না, তখন আগত তীর্থযাত্রীদের তাবুতে গিয়ে গিয়ে তাদের মাঝে প্রচার করলেন। তারাও যখন সাড়া তেমন দিল না, তখন তিনি নিকটের বড় শহর তায়েফ-এ গেলেন। সেখানে গিয়ে তাকে রক্তস্নাত হতে হলো, তবে মাত্র একজন ক্রীতদাস তার সত্যতা স্বীকার করলেন।
এদিকে মক্কায় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনার অপরাধে বিশ্বাসীরা অত্যাচারিত হতে থাকলেন। এসব সহ্য করতে না পেরে একসময় তারা আবিসিনিয়ায় হিজরত করলেন। এদিকে আবার মাঝে দুই তিন বছর মক্কার মুসলমানগনকে সকল সহায়তা করা থেকে বিরত থাকে, এমন অবস্থায় আবু তালেব এর উপত্যকায় ঘরহারা ও ক্ষুধার্ত অবস্থায় তারা অবস্থান করতেন।
পরবর্তীতে মদিনা থেকে একদল মানুষ এসে মক্কার অদূরে আকাবায় নবীজির সাথে সাক্ষাৎ করলেন ও ইসলাম গ্রহণ করলেন। এভাবেই আস্তে আস্তে হিজরতের ভিত্তি স্থাপিত হলো।
নবীজির মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত
মক্কার কঠোর প্রতিক্রিয়ার কারণে, নবী মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর অনুসারীরা ঐশী নির্দেশে মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করতে বাধ্য হন। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে এই হিজরত ইসলামী ক্যালেন্ডারের শুরুর বিন্দু হিসেবে গণ্য হয়।
মদীনায় মুসলমান ছাড়াও ছিল পৌত্তলিক দুই গোত্র অওস ও খাযরাজ, এবং ইহুদী তিন গোত্র বনু কুরাইযা, বনু কায়নুকা ও বনু নযীর। এদের সকলকে নিয়ে এক তাঁর নেতৃত্বে মদীনা রাষ্ট্রের ভিত্তি রচিত হয়।
মদিনা শহরের সংবিধান- মদিনা সনদ
মদিনায় নবী মুহাম্মদ (সা.) একটি ঐতিহাসিক সংবিধান প্রণয়ন করেন, যা ‘মদিনার সনদ’ নামে পরিচিত। এই চুক্তিতে, মদিনার মুসলিম, ইহুদি এবং অন্যান্য সম্প্রদায় একত্রিত হয়ে স্বাধীনভাবে নিজেদের ধর্ম পালন করার সিদ্ধান্ত নেয়। এছাড়াও এটি ছিল প্রথম বহুজাতিক রাষ্ট্রের ভিত্তি। মদীনায় নাগরিক সুযোগ-সুবিধা গড়ে তোলা, শিক্ষা, বিচার, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা হয় এই সনদের মাধ্যমে।
মদিনা শহর
মদিনা ছিল ইসলামের প্রারম্ভিক কেন্দ্র। মদিনা শহরে এসে নবী মুহাম্মদ (সা.) ইসলামের প্রচার কার্যক্রমকে আরও শক্তিশালী করেন। ইহুদিদের সঙ্গে মেলামেশা থাকার কারণে আউস ও খাজরাজ গোত্রের লোকেরা বাইবেলের বিভিন্ন ভবিষ্যৎবাণী সম্পর্কে জানতো। তাই তীর্থ যাত্রীদের কাছে যখন মদিনাবাসী মোহাম্মদ (সা.) এর দাবি শুনল, তখন তাদের মনে তাঁর সত্যতার প্রভাব বিস্তার করেছিল। শহরের মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হয়, এবং তিনি মদিনা ভিত্তিক একটি শক্তিশালী ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন।
মদিনায়, নবী মুহাম্মদ (সা.) একাধারে শাসকীয় ও ধর্মীয় কার্যক্রম চালিয়ে ইসলামের সম্প্রসারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তাঁর নেতৃত্বে, মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ইসলামের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক মূলনীতি মদিনা শহরে প্রতিষ্ঠিত হয়।
বদর যুদ্ধ
হিজরতের পর হিজরতের দুই বছর পর সিরিয়া থেকে মক্কার একটি বাণিজ্য কাফেলা আসছিল। আবু সুফিয়ানের নেতৃত্বে সিরিয়া থেকে আসা কুরাইশদের সেই বিশাল বাণিজ্য কাফেলা মক্কার দিকে যাচ্ছিল। এই কাফেলায় প্রচুর সম্পদ ছিল এবং এটি মক্কার অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। নবী মুহাম্মদ (সা.) সংবাদ পান যে, এই কাফেলাটি মুসলমানদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হতে পারে এবং এটি আক্রমণ করা হলে কুরাইশদের অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করা সম্ভব হবে। নবীজি (সা.) কিছু সাহাবিকে সঙ্গে নিয়ে কাফেলাটি আটকানোর উদ্দেশ্যে বের হন।
এদিকে মক্কায় সংবাদ পৌঁছালে, কুরাইশরা এই ঘটনাকে নিজেদের অস্তিত্বের জন্য হুমকি মনে করে এবং আবু জাহলের নেতৃত্বে এক হাজার সৈন্য নিয়ে বদরের দিকে অগ্রসর হয়। বদরের মুসলমানদের সংখ্যা ছিল মাত্র ৩১৩ জন, তাদের ঘোড়া ছিল মাত্র দুইটি এবং উট ছিল প্রায় ৭০টি। এর বিপরীতে কুরাইশদের বিশাল বাহিনী ছিল ১০০০ সৈন্য, ১০০টি ঘোড়া এবং ৭০০ উট। কিন্তু আল্লাহর সাহায্য ও নবীজির (সা.) কৌশলের ফলে মুসলমানরা বিজয় অর্জন করেন। এই যুদ্ধে কুরাইশদের প্রায় ৭০ জন নিহত হয়, তাদের মধ্যে আবু জাহলসহ অনেক শীর্ষ নেতা ছিলেন। আরও ৭০ জন বন্দি হয়। এদিকে মুসলমানদের মাত্র ১৪ জন শহীদ হন।
এটি ইসলামের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক বিজয় ছিল। এই বিজয়ের মধ্যে দিয়ে মদিনায় মুসলমানদের সামরিক শক্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। আর, কুরাইশদের মধ্যে ভয় ও আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা প্রতিশোধের পরিকল্পনা করে।
উহুদ যুদ্ধ
বদরের যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কাফেরদের সৈন্যরা পালিয়ে গেলেও, যাওয়ার সময় তারা ঘোষণাও দিয়ে যায় যে, তারা আগামী বছর পুনরায় মদিনা আক্রমণ করবে এবং তাদের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিবে। ৬২৫ খ্রিস্টাব্দে বা তিন হিজরীতে বদর যুদ্ধের পরাজয়ের প্রতিশোধ নিতে কুরাইশরা ৩০০০ সৈন্যের বিশাল বাহিনী নিয়ে মদিনার কাছের উহুদ পর্বতের পাদদেশে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। এদিকে নবী মুহাম্মদ (সা.)ও মদিনার বাইরে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং প্রায় ৭০০ মুসলিম সৈন্য নিয়ে উহুদের ময়দানে অবস্থান নেন।
উহুদ যুদ্ধে মুসলমানরা প্রথমে কুরাইশদের বিরুদ্ধে জয়ী হলেও, কিছু ভুলের কারণে পরবর্তীতে মুসলমানরা পরাজিত হন। উহুদ পর্বতের এক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ৫০ জন ধনুকধারী মুসলিম সেনা নিয়োগ করা হয়েছিল, যাদের নির্দেশ ছিল যেমনই হোক, অবস্থান না ছাড়ার। মুসলমানরা যখন কুরাইশ বাহিনীকে পরাজিত মনে করে যুদ্ধের ময়দানে মালামাল সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তখন ওই ধনুকধারীদের অনেকেই অবস্থান ত্যাগ করে। এই সুযোগে কুরাইশ নেতা খালিদ বিন ওয়ালিদ পেছন থেকে আক্রমণ করে মুসলমানদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলে দেয়।
উহুদ যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য বড় এক শিক্ষা হয়ে ওঠে—যে নিষ্প্রাণ লোভ ও শৃঙ্খলার অভাব পরাজয়ের কারণ হতে পারে। কুরাইশদের যদিও কোন বড় জয় হয়েছিল না, তবুও মুসলমানদের অনেকের মনোবল কিছুটা দুর্বল হয়েছিল এই ঘটনায়।
খন্দক যুদ্ধ
বদর ও উহুদ যুদ্ধের পর কুরাইশরা আবারও মুসলমানদের নির্মূল করতে বৃহৎ জোট গঠন করে। ঐতিহাসিকদের মতে, এই জোটে কুরাইশ, ইহুদি গোত্র বনু নাদির, বনু গাতাফান ও অন্যান্য গোত্র মিলিয়ে প্রায় ১০,০০০-২৪০০০ পর্যন্ত সৈন্য ছিল। পারস্য থেকে আগত সাহাবি সালমান ফারসি (রাঃ) মহানবী (সা.) কে শত্রুদের ঠেকাতে শহরের চারপাশে গভীর পরিখা (খন্দক) খননের পরামর্শ দেন।
আরবের জন্য এটি ছিল এক অভিনব যুদ্ধ কৌশল, যা কুরাইশদের অগ্রযাত্রাকে থামিয়ে দেয়। ২০ দিনেরও বেশি সময় ধরে যুদ্ধ চলে। এদিকে প্রবল ঝড় এবং খাদ্য সংকটের কারণে কুরাইশরা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।
বনু কুরাইযার ঘটনা
বনু কুরাইজা নামক এক ইহুদি উপজাতি মদিনার মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল। খন্দক যুদ্ধে মদিনার ইহুদি গোত্র বনু কুরাইযা মুসলমানদের সঙ্গে করা শান্তিচুক্তি ভঙ্গ করে কুরাইশদের সহযোগিতা করেছিল। যুদ্ধের পর মুসলমানরা তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
মুসলমানরা বনু কুরাইযা গোত্রের লোকেদের অবরুদ্ধ করে রাখে এবং তারা শেষ পর্যন্ত আত্মসমর্পণ করে। তাদের বিচার করার জন্য নবী মুহাম্মদ (সা.) তাদের ইচ্ছায় আনসার নেতা সাদ ইবনে মুআজ (রা.)-কে দায়িত্ব দেন। সাদ (রা.) তাদের নিজ ধর্মীয় আইনের ভিত্তিতে রায় দেন— প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষদের মৃত্যুদণ্ড ও নারীদের বন্দি করা হয়।
হুদায়বিয়ার চুক্তি
ছয় হিজরিতে অর্থাৎ ৬২৮ খ্রিস্টাব্দে নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর সাহাবিরা কাবা শরিফ জিয়ারতের উদ্দেশ্যে মক্কা অভিমুখে রওনা হন। কিন্তু কুরাইশরা তাদের বাধা দেয়। দীর্ঘ আলোচনার পর একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, যা হুদাইবিয়ার চুক্তি নামে পরিচিত।
চুক্তির মূল শর্তাবলী ছিল মুসলমানরা ওই বছর ওমরাহ করতে পারবে না, তবে পরের বছর করতে পারবে এবং দশ বছর যুদ্ধবিরতি থাকবে। মক্কার কেউ ইসলাম গ্রহণ করে মদিনায় গেলে তাকে ফেরত পাঠাতে হবে, কিন্তু মুসলমানদের কেউ মক্কায় গেলে তাকে ফেরত দেওয়া হবে না।
অনেক সাহাবি এই চুক্তিকে অপমানজনক মনে করেছিলেন। কিন্তু নবী মুহাম্মদ (সা.) এটি কৌশলগতভাবে গ্রহণ করেন। কারণ তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে এই শান্তিচুক্তি ইসলামের দীর্ঘমেয়াদী স্বার্থ রক্ষা করবে।
মক্কা বিজয়
হুদাইবিয়ার চুক্তির দুই বছর পর কুরাইশরা চুক্তি ভঙ্গ করে। এর প্রতিক্রিয়ায় নবী মুহাম্মদ (সা.) ১০,০০০ সৈন্য নিয়ে মক্কা অভিমুখে অগ্রসর হন।
মুসলমানরা প্রায় বিনা বাধায় মক্কায় প্রবেশ করে। কুরাইশরা আত্মসমর্পণ করে এবং নবী মুহাম্মদ (সা.) সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, “আজ তোমাদের কোনো দোষ দেওয়া হবে না, তোমরা সবাই মুক্ত।” কাবা শরিফের মূর্তিগুলো ধ্বংস করা হয় এবং মক্কা ইসলামের নিয়ন্ত্রণে আসে।
কাবা শরিফের মূর্তিগুলোর অপসারণ আমাদের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ মোড় এনে দেয়। কেননা এই ঘটনাটি বিবেচিত হয় ইসলাম বিস্তারের একটি বড় পদক্ষেপ হিসেবে এবং আরব উপদ্বীপে নতুন রাজনৈতিক ও ধর্মীয় বিন্যাসের সূচনা করে।
ইতিহাসের আলোকে বিচার করলে, নবী মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবন কেবল ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে নয়, বরং একজন দক্ষ কৌশলী নেতা এবং সমাজসংস্কারক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।তিনি আরব সমাজের কাঠামো পাল্টে দেয় এবং একটি ছিন্নভিন্ন গোত্রভিত্তিক সংস্কৃতিকে এক ভিন্ন রুপ দেয়।তাঁর জীবনের হিজরত, চুক্তি, যুদ্ধ, ক্ষমা ও পুনর্গঠন এই সবগুলো ঘটনাই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে একটি বৃহত্তর রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি হিসেবে। অনুসারীদের কাছে তিনি ছিলেন প্রেরণার উৎস, কিন্তু ঐতিহাসিকদের কাছে তিনি থেকে গিয়েছেন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও নৈতিক দৃঢ়তার এক জটিল চরিত্র হিসেবে।