Image default
নগর পরিচিতি

গণতন্ত্রের আঁতুড়ঘর- এথেন্স

“এক শহর, দুই দেবতা’’  এ যেন এক  চিরন্তন দ্বন্দ্ব!!!!

অ্যাথেনা ও পোসেইডনের প্রতিযোগিতায় জন্ম নেয় এথেন্স। কিন্তু এই নগরীর ভাগ্যে কি শুধুই গৌরব আছে? নাকি এর মাটির নিচে চাপা পড়ে আছে দেবতাদের অভিশাপ, বিশ্বাসঘাতকতা আর রক্তাক্ত ইতিহাস?

গ্রিসের হৃদয় ও পশ্চিমা সভ্যতার প্রাচীনতম ধ্রুবতারা এথেন্স। এথেন্স সভ্যতার এক অনন্য প্রদীপ। যার আলো প্রাচীন থেকে আধুনিক সভ্যতার পথ দেখিয়েছে। এই সেই শহর, যেখানে গণতন্ত্রের বীজ বোনা হয়েছিল। যেখানে দর্শন ও জ্ঞানের আলো জ্বালিয়েছিলেন সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটলের মতো মনীষীরা ।

এথেন্স শুধু একটি শহর নয়। এটি একটি জীবন্ত ইতিহাস। যেখানকার প্রতিটি পাথরের টুকরো, প্রতিটি স্থাপত্যের রেখা নিয়ে যাবে মহাকাব্যিক অতীতে।

দেশ গ্রীস
রাজধানী  এথেন্স 
আয়তন ৩৮.৯৬ বর্গকিলোমিটার 
জনসংখ্যা  ৩৭ লক্ষ 
ভাষা গ্রীক,ইংরেজি 
মুদ্রা  ইউরো (€) 

ম্যাপ

এথেন্সের আয়তন ও জনসংখ্যা

এথেন্স গ্রীসের রাজধানী এবং বৃহত্তর শহর হিসেবে পরিচিত। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপের বলকান উপদ্বীপের দক্ষিণাংশে সারোনিক উপসাগরের (Saronic Gulf) কাছাকাছি এই সুন্দর শহরটি অবস্থিত। 

এথেন্স পাহাড়বেষ্টিত একটি উপত্যকা। যার চারপাশে রয়েছে পেন্টেলিকাস, হাইমেটাস, পারনিথা, এবং এগালেওস পর্বতমালা। 

ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীন নগরী এথেন্স। ৩৮.৯৬ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এই প্রাচীন নগরীটিতে প্রায় ৩৭ লক্ষ মানুষ বাস করে। অর্থ্যাৎ, গ্রীসের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩৭% লোক এথেন্সে বাস করে।

এথেন্সের জলবায়ুতে ভূমধ্যসাগরীয় (Mediterranean climate) প্রভাব রয়েছে। এথেন্সের জলবায়ু শুষ্ক এবং রৌদ্রোজ্জ্বল। এটি ইউরোপের সবচেয়ে রৌদ্রোজ্জ্বল শহরগুলোর মধ্যে একটি। এখানে বছরে গড়ে ২৮০০ থেকে ৩০০০ ঘণ্টা সূর্যালোকের দেখা পাওয়া যায়। এই জলবায়ুর কারণে এথেন্স সারা বছর পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্য।

এথেন্সের মিথলজি ও নামকরণের রহস্য

এথেন্সের নামকরণের কাহিনী পুরাণের এক রোমাঞ্চকর গল্প। শহরের বাসিন্দারা চেয়েছিল এই শহরের নাম কোন দেবতার নামানুসারে করতে। যে দেবতা তাদের এই শহরকে যাবতীয় বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে তার নামেই হবে এই শহরের নাম। 

যার ফলে গ্রিসের দুটি শক্তিশালী দেবতা পোসাইডন (সমুদ্রের দেবতা) এবং আথেনা ( জ্ঞান ও যুদ্ধের দেবী) এথেন্স শহরের মালিকানা দাবির জন্য প্রতিযোগিতায় নামেন।

দেবতা পোসাইডন ও আথেনার যুদ্ধ

পোসাইডন প্রথমে তার তীর দিয়ে শহরের মাটিতে আঘাত করে এবং তা থেকে একটি ঝর্ণা বের হয়। তবে, সেটা ছিল শুধুমাত্র নোনা পানির ঝর্ণা, যা মানুষের কোন উপকারেই আসেনি। এরপর আথেনা এসে শহরের মাটিতে হাত রেখে একটি জলপাই গাছ তৈরি করে, যা ছিল শান্তি, প্রাচুর্য এবং সৃষ্টির প্রতীক।

শহরের মানুষ বুঝতে পারেন, আথেনার উপহার তাদের জীবনে প্রকৃত লাভ আনতে পারে। কারণ, জলপাই গাছ তাদের খাদ্য, তেল, এবং শান্তি এনে দিতে পারে। ফলে তারা আথেনাকে নিজেদের প্রধান দেবী হিসেবে গ্রহণ করে। আথেনার নামানুসারে শহরটির নামকরণ করা হয় “এথেন্স’। এথেন্সের ইতিহাসে এই ঘটনার গুরুত্ব অপরিসীম। আজও শহরটি আথেনার নামেই পরিচিত।

ইতিহাসের পাতায় এথেন্স

এথেন্স বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন শহর। যার ইতিহাস প্রায় ৩৪০০ বছরেরও বেশি পুরোনো। এথেন্সের ইতিহাস অনেক ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক ঘটনার সাক্ষী।

প্রাচীন যুগে এথেন্স

মাইকেন সভ্যতার সাথে এথেন্সের প্রাচীন ইতিহাস জড়িত। ব্রোঞ্জ যুগে (প্রায় ৩,০০০ বছর পূর্বে) শহরটি একটি ছোট মাইথিক নগরী হিসেবে পরিচিত ছিল‌। ১০০-৮০০ খ্রিষ্টপূর্ব সময়টা ছিল এথেন্সর জন্য অন্ধকার সময়। ডোরীয়দের আক্রমণের পর শহরটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সাংস্কৃতিক অবক্ষয় দেখা যায়। ৬০০-৫০০ খ্রিস্টপূর্বে এথেন্সে সোলন ও ক্লিস্টেনিসের নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।

এথেন্সের সোনালী যুগ- সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল

এথেন্সের ইতিহাসের সোনালী যুগ  শুরু হয় পেরিক্লিসের শাসনামলে (৪৮০-৩৩০ খ্রিস্টপূর্ব)। এথেন্স তখন সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিকভাবে শীর্ষে ছিল। পেরিক্লিসের শাসনামল ছিল শিল্প, সাহিত্য, স্থাপত্য এবং দর্শনের জন উপযুক্ত সময়। এ সময়ের উল্লেখযোগ্য স্থাপত্য কীর্তি ছিল পার্থেনন মন্দির, যা আজও বিশ্ব বিখ্যাত। এই সময়ে সক্রেটিস, প্লেটো এবং অ্যারিস্টটল এর মতো মহান ব্যক্তিত্বরা এথেন্সে বসবাস করতেন। যাদের চিন্তা-ভাবনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। 

স্পার্টা ও এথেন্স যুদ্ধ

পেরিক্লিসের যুগে এথেন্স সাংস্কৃতিক ও সামরিক শক্তিতে শীর্ষে পৌঁছায়। ৪৩১-৪০৪ খ্রিস্টপূর্বে এথেন্স  স্পার্টার সঙ্গে পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধে জড়ায়। এই যুদ্ধ ২৭ বছর স্থায়ী ছিল। যার কারণে এথেন্সের সামরিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা দূর্বল হয়ে পড়ে। 

যুদ্ধ শেষে, স্পার্টার কাছে এথেন্স পরাজিত হয়। পেলোপনেসিয়ান যুদ্ধের পর এথেন্স ধীরে ধীরে তার প্রভাব হারাতে শুরু করে। পরবর্তীতে এথেন্সের শাসনব্যবস্থা ম্যাসেডোনিয়ার আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের অধীনে চলে যায়। আলেকজান্ডারের শাসন শেষে এথেন্স রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। রোমান সাম্রাজ্যের সময় এথেন্স শিক্ষা ও দর্শনের কেন্দ্র হিসেবে গুরুত্ব পরিচিতি পায়।

মধ্যযুগে এথেন্সঃ ক্রুসেড

মধ্যযুগে এথেন্সের ইতিহাস নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। যার প্রতিটি দিকই শহরটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে নতুনভাবে গড়ে তুলেছিল। এথেন্স প্রথম দিকে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। এথেন্সে তখন খ্রিস্টান ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায়। অনেক প্রাচীন মন্দির গির্জায় পরিণত হয়।

১২০৪ সালে চতুর্থ ক্রুসেডের সময় বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় এবং এথেন্স লাতিনদের হাতে চলে যায়। এথেন্সে এক নতুন শাসন ব্যবস্থা গড়ে ওঠে, যা ছিল পশ্চিমা ইউরোপীয়দের দ্বারা প্রভাবিত। ১৪৩০ সালে অটোমানরা এথেন্স দখল করে এবং শহরটির চরিত্রে একটি নতুন পরিবর্তন আসে।

ক্রুসেডের যুদ্ধে খ্রিষ্টানদের পরাজয়

প্রাচীন গির্জাগুলোর মসজিদে পরিণত হয়। অটোমান স্থাপত্যের প্রভাব বাড়ে এবং এথেন্সের কিছু ঐতিহাসিক ভবন মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। অটোমান শাসনের সময় গ্রীক জনগণ বিদ্রোহের চেষ্টা করলেও তারা পুরোপুরি স্বাধীনতা লাভ করতে পারেনি।

এত  পরিবর্তন সত্ত্বেও, এথেন্স  গ্রীক এবং রোমান কীর্তির দ্বারা প্রাচীন ঐতিহ্য এবং ইতিহাস ধরে রেখেছিল। ১৮৩৪ সালে গ্রীক স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে এথেন্স আবার গ্রীসের অংশ হয়ে ওঠ। এথেন্সের ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক গুরুত্ব নতুন করে মাথাচাড়া দেয়।

আধুনিক যুগে এথেন্স

১৮৩৪ সালে গ্রীস স্বাধীনতা অর্জন করে। পরবর্তীতে এথেন্সকে গ্রীসের নতুন রাজধানী করা হয়। বর্তমানে এটি একটি প্রধান সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক কেন্দ্র হিসেবে বিশ্বের মধ্যে পরিচিত।

এথেন্সের ইতিহাস কেবল গ্রীস বা ইউরোপের ইতিহাসের অংশ নয়। বরং এটি মানব সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যার প্রভাব আজও পুরো পৃথিবীতে রয়েছে।

এথেন্সের দর্শনীয় স্থান ও পর্যটন আকর্ষণ

ইতিহাস, সংস্কৃতি ও আধুনিকতায় সমৃদ্ধ একটি শহর এথেন্স। এটি এমন একটি শহর যেখানে অতীত ও বর্তমান একসাথে মিশে আছে। এক্রোপোলিস থেকে শুরু করে আধুনিক ক্যাফে ও বাজার এমনকি প্রতিটি অলিগলিতে রয়েছে ঐতিহ্যও আধুনিকতার সংমিশ্রণ। 

এক্রোপলিস ও পার্থেনন

এথেন্সের সবচেয়ে জনপ্রিয় স্থান হলো এক্রোপলিস। এই স্থাপনাটি খ্রিস্টপূর্ব ৫ম শতাব্দীতে নির্মিত হয়, যা গ্রিক সভ্যতার প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। পাহাড়ের ওপরে অবস্থিত এই স্থাপনাটি দেবী অ্যাথেনা-কে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছে। পার্থেনন অ্যাক্রোপলিসের সবচেয়ে বিখ্যাত মন্দির। 

ডোরিক স্থাপত্যশৈলীতে তৈরি এই মন্দিরটি খ্রিস্টপূর্ব ৪৪৭-৪৩২ সালে নির্মিত হয়। এই মন্দিরে একসময় বিশাল এক সোনার ও হাতির দাঁতের তৈরি অ্যাথেনার মূর্তি ছিল। পার্থেনন পরবর্তীতে গির্জা, মসজিদ ও বারুদ মজুদাগার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। ১৬৮৭ সালে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণে এটি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বর্তমানে এটি ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য এবং গ্রীসের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ।

পার্থেনন মন্দির

প্রাচীন আগোরা

এথেন্সের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক, সামাজিক ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র ছিল প্রাচীন আগোরা। এটি এক সময় এথেনীয় গণতন্ত্রের প্রাণকেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। যেখানে নাগরিকরা মিলিত হয়ে আইন প্রণয়ন, ব্যবসা-বাণিজ্য সহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান এবং দর্শনচর্চা করতেন। 

এই সেই স্থান যেখানে সক্রেটিস তার দার্শনিক আলোচনা চালাতেন। প্লেটোর মতো চিন্তাবিদরা নতুন নতুন মতবাদ প্রচার করতেন। গণতন্ত্রের ভিত্তি স্থাপনকারী আইনগুলো এখানেই গৃহীত হতো। তাই এটিকে এথেনীয় গণতন্ত্রের জন্মভূমিও বলা হয়।

এথেন্সের প্রাচীন আগোরা অ্যাক্রোপোলিসের উত্তর-পশ্চিম দিকে অবস্থিত। বর্তমানে এটি একটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে সংরক্ষিত। পর্যটকেরা এখানে এসে গ্রিসের গৌরবময় অতীতের সাক্ষী হতে পারেন। এমনকি হেফাইসটাসের মন্দির, স্টোয়া অব আটালোস এবং অন্যান্য স্থাপনা আজও দর্শকদের মুগ্ধ করে।

প্রাচীন আগোরার স্থাপত্যেশৈলী

প্লাকা ও মোনাস্টিরাকি

এথেন্সের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ও ঐতিহাসিক দুটি এলাকা হলো প্লাকা এবং মোনাস্টিরাকি

অ্যাক্রোপলিসের ছায়ায় ঘেরা প্লাকা এথেন্সের সবচেয়ে পুরোনো এলাকা। যেখানে সরু পাথরের রাস্তা, নব্যশৈলী ভবন ও ঐতিহ্যবাহী গ্রিক ট্যাভার্না রয়েছে। 

অন্যদিকে, মোনাস্টিরাকি এথেন্সের বর্ণিল ও ব্যস্ততম বাজার। ফ্রি মার্কেট, প্রাচীন নিদর্শন ও সুস্বাদু স্ট্রিট ফুডের সমারোহ মোনাস্টিরাকি। প্লাকার শান্ত ও রোমান্টিক পরিবেশ ইতিহাসপ্রেমীদের মোহিত করবে। আর মোনাস্টিরাকির উচ্ছ্বাস ভ্রমণপ্রেমীদের শহুরে জীবনের স্বাদ দেবে।

প্যানাথেনাইক স্টেডিয়াম- অলিম্পিকের মশাল ঐতিহ্য 

এথেন্সের গৌরবময় অতীতের এক জীবন্ত প্রতীক প্যানাথেনাইক স্টেডিয়াম। এটি সম্পূর্ণ মার্বেল পাথরের তৈরি বিশ্বের একমাত্র স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামটি খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতকে প্যানাথেনাইক গেমসের জন্য নির্মিত হয়। ১৮৯৬ সালে স্টেডিয়ামটি আধুনিক অলিম্পিকের প্রথম আসরের ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হয়। 

এখানেই অলিম্পিক মশাল হস্তান্তরের ঐতিহ্য শুরু হয়। ৫০,০০০ দর্শক ধারণক্ষম এই স্টেডিয়াম ইতিহাস, স্থাপত্য ও ক্রীড়ার এক অসাধারণ সংমিশ্রণ। 

প্যানাথেনাইক স্টেডিয়াম

জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর

এথেন্সের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরগুলির মধ্যে একটি। এটি এথেন্স শহরের কেন্দ্রে অবস্থিত। ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত জাদুঘরটি গ্রীক সভ্যতার নানা যুগের নিদর্শন প্রদর্শন করে। অনেক প্রাচীন শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, মুদ্রা, গহনাসহ প্রাচীন পেইন্টিং জাদুঘরটিতে রাখা হয়েছে। 

জাদুঘরটি ১৮৭৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তারপর থেকে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দর্শকদের আকর্ষণ করে আসছে। এথেন্সের এই জাদুঘরটি প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা এবং অধ্যয়নের জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এটি ইতিহাস প্রেমীদের কাছে একটি পর্যটন গন্তব্য হিসেবেও জনপ্রিয়।

এথেন্সের জাতীয় প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘর

লাইকাভিটাস পাহাড়  

এথেন্সের লাইকাভিটাস পাহাড় শহরের একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য। এটি শহরের কেন্দ্র থেকে প্রায় ৩০০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। এটি এথেন্সের উচ্চতম পয়েন্টগুলোর মধ্যে একটি। এথেন্সের সৌন্দর্য পুরোপুরি ভাবে উপভোগ করতে চাইলে লাইকাভিটাস পাহাড়ে যেতে হবে। 

পাহাড়টির শীর্ষ থেকে শহরের চমৎকার দৃশ্য দেখা যায়। পাহাড়ের চূড়ায় ওঠার জন্য ক্রেমলার (রেলগাড়ি) ব্যবস্থা রয়েছে, তবে পায়ে হেঁটেও ওঠা সম্ভব। 

পাহাড়ের শীর্ষে একটি সুন্দর সেন্ট জর্জের চার্চ (St. George’s Church) রয়েছে, যা ঐতিহাসিক এবং আর্কিটেকচারালভাবে আকর্ষণীয়।

লাইকাভিটাস পাহাড়

টেম্পল অব জিউস 

এই মন্দিরটি “অলিম্পিয়ান জিউসের মন্দির” নামেও পরিচিত। এই মন্দিরটি এথেন্স শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রাচীন গ্রীসের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। গ্রীক দেবতা জিউসকে শ্রদ্ধা জানাতে মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল। প্রায় ২১৩ ফুট দীর্ঘ এবং ৯৮ ফুট প্রশস্ত মন্দিরটিকে ঐসময়ের অন্যতম বৃহৎ মন্দির হিসেবে বিবেচনা করা হতো।

বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মানবসৃষ্ট ক্ষতির কারণে মন্দিরটি আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত। তবে এর কিছু কলাম এখনও দাঁড়িয়ে আছে, যা প্রাচীন গ্রীসের স্থাপত্যের গৌরব এবং জিউসের প্রতি শ্রদ্ধার চিহ্ন। 

টেম্পল অব জিউস

এক্সারচিয়া ও গাজি 

এথেন্সের এক্সারচিয়া এবং গাজি দুইটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এলাকা। কিন্তু দুটোই আপনাকে অনন্য অভিজ্ঞতা দিতে পারে। আপনি যদি বিকল্প সংস্কৃতি, বিদ্রোহী মনোভাব, আর্ট, ও রাজনৈতিক আলোচনার প্রতি আগ্রহী হন, তাহলে এক্সারচিয়া আপনার জন্য পারফেক্ট। অথবা আপনি যদি আধুনিক নাইটলাইফ, পার্টি, এবং ট্রেন্ডি ক্যাফেগুলো উপভোগ করতে চান, তাহলে গাজি হবে আপনার সেরা পছন্দ। 

এথেন্স শুধুমাত্র তার প্রাচীন ঐতিহ্যের জন্যই পরিচিতি নয়। বরং, আধুনিক জীবনধারা, খাবার ও সংস্কৃতির জন্যও দারুণ আকর্ষণীয়। তবে এথেন্সে ভ্রমণ ও ঘুরে দেখা আপনার কাছে অবশ্যই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হবে!!

এথেন্সের সংস্কৃতি 

এথেন্সের খাবার

এথেন্সের সংস্কৃতি এবং খাবার একে অপরের সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত‌। এথেন্সের খাবার গ্রীক সংস্কৃতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাদ, দাম এবং স্বাস্থ্যকর উপাদানের জন্য এথেন্সের খাবারের সুখ্যাতি বিশ্বব্যাপী। 

সুজুকি 

এথেন্সের অন্যতম জনপ্রিয় খাবার সুজুকি। খাবারটি ছোট ছোট মাংসের টুকরো দিয়ে বানানো হয়। মাংস মেরিনেট করে কাঠের লাঠিতে গেঁথে গ্রিল বা পুড়ে ব্রেডের সাথে পরিবেশন করা হয় সুজুকি। পরবর্তীতে, টাজিকি সস ( দই আর শসার সস), টমেটো এবং পেঁয়াজ দিয়ে সাজানো হয়। গ্রিসের রাস্তায় বা রেস্তোরাঁতে এটি খুব জনপ্রিয় এবং সুস্বাদু খাবার হিসেবে পরিচিত। 

মুসাকা

মুসাকা একটি জনপ্রিয় গ্রিক খাবার।  এটি একধরণের বেকড ডিশ। তিনটি স্তরে তৈরি করা হয় এই জনপ্রিয় খাবারটি ।

ভাজা পটেটো, মাংস এবং বেসামেল সস (দুধ ও মাখন দিয়ে তৈরি) এই তিনটি স্তর একসাথে ওভেনে বেক করে তৈরি হয় মুসাকা। ফলে মুসাকাটি সুমিষ্ট এবং ক্রিস্পি হয়। গ্রিক সংস্কৃতির  সুস্বাদু খাবার মুসাকা এথেন্সের রাস্তা কিংবা ছোট বড় স্থানীয় রেস্তোরাঁগুলোতে পাওয়া যায়।

ডলমাদেস 

ডলমাদেস হল এক প্রকার বিশেষ রোল, যা মাংস,চাল ও মসলা মিশিয়ে আঙ্গুর পাতা দিয়ে মুড়িয়ে তৈরি করা হয়। এটি লেবুর সস এবং জলপাই তেল দিয়ে পরিবেশন করা হয়। এই খাবারটি যেকোন উৎসব ও পারিবারিক অনুষ্ঠানের বিশেষ অংশ।

হলভা 

হলভা হল একটি মিষ্টি ডেজার্ট। এটি সেমোলিনা, চিনির সিরাপ, মধু এবং বাদাম দিয়ে তৈরি হয়। এথেন্সে হালভা সাধারণত ধর্মীয় উপবাসের সময় খাওয়া হয়।কারণ এটি দুধ বা ডিম ছাড়া তৈরি করা হয়। তবে সাধারণ সময়েও এটি একটি জনপ্রিয় মিষ্টি।

এথেন্সের উৎসব

এথেন্সের প্রধান উৎসবগুলো শহরের সাংস্কৃতিক ও ঐতিহ্যগত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এগুলো প্রাচীন থেকে আধুনিক পর্যন্ত নানা ঐতিহাসিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে উদযাপিত হয়।

এথেন্স অ্যান্ড এপিডাউরাস ফেস্টিভ্যাল

এই উৎসবটি প্রাচীন গ্রিক নাট্যশিল্পের অন্যতম বড় সাংস্কৃতিক উৎসব, যা গ্রীষ্মকাল অর্থাৎ জুন থেকে আগস্ট মাসব্যাপী উদযাপিত হয় । এ উৎসবটি মূলত গ্রীক নাট্যোৎসব, যেখানে প্রাচীন গ্রীক নাটক এবং আধুনিক সঙ্গীত, নৃত্য, অপেরা ইত্যাদি প্রদর্শিত হয়। 

এথেন্স অ্যান্ড এপিডাউরাস ফেস্টিভ্যাল

এথেন্স ম্যারাথন

এথেন্স ম্যারাথন শুধুমাত্র একটি দৌড় প্রতিযোগিতা নয়, বরং, এটি এক ঐতিহাসিক যাত্রা! বিশ্বের অন্যতম পুরনো ম্যারাথন রেস হিসেবেও এটি পরিচিত। 

১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিক গেমসের অংশ হিসেবে আয়োজিত হয়েছিল এথেন্স ম্যারাথন। এটি গ্রিসের ইতিহাস এবং ক্রীড়া সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর এক বিশেষ উৎসব। যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দৌড়বিদরা অংশগ্রহণ করেন। 

এথেন্স ম্যারাথন

গ্রিক পাসকা 

গ্রিসের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব গ্রিক পাসকা, যা অর্থোডক্স খ্রিস্টানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় এথেন্সে বিশেষ ধর্মীয় মিছিল, প্রার্থনা, আলোকসজ্জা এবং ঐতিহ্যবাহী খাবারের আয়োজন করা হয়। এটি বর্তমানে একটি বড় সামাজিক অনুষ্ঠান হিসেবে পালিত হয়, যেখানে সবাই পরিবারের সাথে একত্রিত হয়ে উৎসবে অংশগ্রহণ করে।

এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব 

এথেন্স আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (AIFF) গ্রীসের এথেন্স শহরে অনুষ্ঠিত একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্ষিক চলচ্চিত্র উৎসব। এটি সাধারণত সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর মাসে আয়োজিত হয়। 

১৯৯৫ সালে শুরু হওয়া উৎসবটি বর্তমানে ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্র উৎসব হয়ে উঠেছে। চলচ্চিত্র নির্মাতারা এখানে নিজেদের নতুন কাজ প্রদর্শন করেন নতুন চলচ্চিত্র পরিচালকদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম।

এথেন্সের অর্থনীতি

এথেন্সের অর্থনীতি মূলত পর্যটন, পরিসেবা, বাণিজ্য ও শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। শহরটিতে অ্যাক্রোপোলিস ও পার্থেনন-এর মতো ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে, যা পৃথিবীর গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ।পর্যটকদের পদচারণায় এথেন্সের হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও পরিবহন খাত সমৃদ্ধ হয়।

পিরেয়াস বন্দর এথেন্সের একটি ব্যস্ততম বন্দর, যা শিপিং ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের কেন্দ্র। ব্যাংকিং, প্রযুক্তি, এবং স্টার্টআপ সংস্কৃতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিকশিত হয়েছে। ২০০৮-১০ সালের আর্থিক সংকটে এথেন্স ক্ষতিগ্রস্ত হলেও বর্তমানে বিনিয়োগ, পর্যটন, এবং প্রযুক্তির প্রসার শহরের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ভূমিকা রাখছে।

লাইসিয়াম ও একাডেমি:  জ্ঞানচর্চার দুটি কেন্দ্র

এথেন্স ছিল দর্শন, বিজ্ঞান ও শিক্ষার জন্য একটি আদর্শ স্থান। এখানে অনেক মহান দার্শনিক তাদের জ্ঞানচর্চা ও শিক্ষা বিস্তারের জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। 

এই প্রেক্ষাপটে প্লেটো প্রতিষ্ঠা করেন “একাডেমি”, আর অ্যারিস্টটল  প্রতিষ্ঠা করেন “লাইসিয়াম”। এই দুই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পশ্চিমা জ্ঞান ও দর্শনের ভিত্তি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

লাইসিয়াম ছিল প্রাচীন এথেন্সের একটি বিখ্যাত শিক্ষাকেন্দ্র ও গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান। এটি খ্রিস্টপূর্ব ৩৩৫ শতকে দার্শনিক অ্যারিস্টটল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে দর্শন, বিজ্ঞান, প্রকৃতিবিজ্ঞান, রাজনীতি, নীতিশাস্ত্র, জীববিজ্ঞান ও যুক্তিতর্ক নিয়ে অধ্যয়ন ও আলোচনা হতো।

অন্যদিকে একাডেমি ছিল প্রাচীন বিশ্বের প্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে একটি, যা খ্রিস্টপূর্ব ৩৮৭ শতকে প্লেটো প্রতিষ্ঠা করেন। এটি গণিত, দর্শন, নীতিশাস্ত্র ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণার একটি কেন্দ্র ছিল।

এথেন্স শুধুমাত্র প্রাচীন ঐতিহ্যের শহর নয়, বরং, এটি এক আধুনিক নগরী। যেখানে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সমসাময়িক জীবনযাত্রার এক অনন্য সংমিশ্রণ রয়েছে। প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ থেকে আধুনিক বাজার ও খাবারের স্বাদ, এথেন্স প্রতিটি পর্যটকের জন্যই এক স্মরণীয় অভিজ্ঞতা নিয়ে আসে।

এথেন্স নিয়ে আরও কিছু মজার তথ্য 

পশ্চিমা সভ্যতার জন্মস্থান

দর্শন, সাহিত্য এবং স্থাপত্যে অবদানের কারণে এথেন্সকে পশ্চিমা সভ্যতার দোলনা বলা হয় ।

গণতন্ত্রের জন্মস্থান

প্রাচীন গ্রীকরা খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর কাছাকাছি গণতন্ত্র আবিষ্কার করেছিল। গণতন্ত্রের সূত্রাপাত এথেনীয়দের হাত ধরেই হয়

বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি

এথেন্সের ইতিহাস ৩৪০০ বছরেরও বেশি পুরানো। এথেন্স বিশ্বের প্রাচীনতম শহরগুলির মধ্যে একটি এবং ইউরোপের দ্বিতীয় প্রাচীনতম শহর। 

ইউরোপের অন্যতম রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান

এথেন্স ইউরোপের অন্যতম রৌদ্রোজ্জ্বল স্থান হিসেবে বিখ্যাত। যেখানে বছরে গড়ে ২৮০০ থেকে ৩০০০ ঘণ্টা সূর্যালোকের দেখা পাওয়া যায়।

ম্যারাথনের উৎপত্তি এথেন্সে

১৮৯৬ সালে আধুনিক অলিম্পিক গেমসের অংশ হিসেবে এথেন্সে প্রথম ম্যারাথন দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়।

বিশ্ব বইয়ের রাজধানী এথেন্স

UNESCO ২০১৮ সালে, এথেন্সকে বিশ্ব বইয়ের রাজধানী হিসাবে মনোনীত করেছে। সারা বছর ধরে নগরীতে বই পড়া ও পাঠ সংক্রান্ত অসংখ্য কার্যক্রম পরিচালিত হয়।

ডগ প্যারেড

প্রতিবছর এথেন্সে কুকুর প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে শহরের বিভিন্ন প্রজাতির কুকুরদের অংশগ্রহণ করার সুযোগ থাকে। এটি এক ধরনের কমেডি শো।যেখানে কুকুরদের পোষাক, অভিনয় এবং বিশেষ কৌশল প্রদর্শিত হয়।

মিউজিয়াম অফ ব্রোকেন রিলেশনশিপস

 ভেঙে যাওয়া সম্পর্কের স্মৃতি,  উপহার ও চিঠি এই মিউজিয়ামে  প্রদর্শিত হয়। মিউজিয়ামটি  ভেঙ্গে যাওয়া সম্পর্কের যন্ত্রণার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে মানুষের স্মৃতি সংগ্রহ করে।

ইচ্ছা পূরণের ডাকবক্স” বা “Wishing Boxes”

এখানে পর্যটকরা বা স্থানীয়রা তাদের ইচ্ছা বা শুভেচ্ছা লিখে ছোট বাক্সে রেখে দেন।

সোর্স

Related posts

ইরানের সাজানো শহর – তেহরান

শেখ আহাদ আহসান

সাত পাহাড়ের শহর রোম

সিওলঃ কে-পপ, কে-ড্রামা এবং হাজারো গল্পের রাজধানী

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More