Image default
নগর পরিচিতি

সুপাই- গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের গভীরে লুকানো গ্রাম

সুপাই– এখনো যুক্তরাষ্ট্রের যেই গ্রামে চিঠি বহন করে বেড়ায় খচ্চর।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে দুর্গম গ্রাম হলো সুপাই। এটি একটি নেটিভ আমেরিকান গ্রাম, সেখানে পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হলো হেলিকপ্টার বা পায়ে হেঁটে যাওয়া। প্রতি বছর আনুমানিক ৫.৫ মিলিয়ন পর্যটক গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন পরিদর্শন করেন, কিন্তু খুব কম লোকই জানেন যে এই বিশাল গিরিখাতের গভীরে, প্রায় ৩,০০০ ফুট নিচে লুকিয়ে আছে একটি ছোট্ট গ্রাম সুপাই যা অ্যারিজোনা রাজ্যে অবস্থিত। যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ডের অন্যতম দুর্গম জনপদ হিসেবে পরিচিত এই গ্রামটি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের তলদেশে অবস্থিত।

দেশ আমেরিকা
রাজ্য অ্যারিজোনা
আয়তন ১.৭ বর্গমাইল (৪.৪ বর্গকিমি)
জনসংখ্যা ২০৮ জন
সুপাই ভিলেজ

সুপাই গ্রাম কেন বিশ্বের সবচেয়ে দুর্গম গ্রাম

সুপাই ভিলেজ একটি দুর্গম এলাকা, কারণ এটি হাভাসু ক্যানিয়নের গভীরে অবস্থিত, যা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের একটি শাখা। এই গ্রামে পৌঁছানোর জন্য কোনো রাস্তা নেই এবং এটি শুধুমাত্র পায়ে হেঁটে, খচ্চরে চড়ে বা হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পৌঁছানো সম্ভব। তাই এটি যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন জনপদগুলোর একটি।

হুয়ালাপাই পাহাড়চূড়া থেকে নিচের দিকে হুয়ালাপাই উপত্যকার মধ্য দিয়ে ২,০০৪ ফুট (৬১১ মিটার) নিম্নগামী হয়ে ৮ মাইল (১৩ কিলোমিটার) পর্বোতাবরোহনের মাধ্যমে সুপাইতে পৌঁছানো যায়।

সুপাই গ্রামের আদিবাসী সম্প্রদায়- নীল-সবুজ জলের মানুষ

এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে সুপাই গ্রাম হাভাসু বাজা বা “নীল-সবুজ জলের মানুষদের” আবাসস্থল হিসেবে পরিচিত। কারণ, এটি অপূর্ব নীল-সবুজ জলপ্রপাতের জন্য বিশেষভাবে বিখ্যাত। আজ তারা হাভাসুপাই জাতিগোষ্ঠী নামে পরিচিত। তারা বিশ্বাস করেন যে, এই পবিত্র ফিরোজা-নীল জল শুধু তাদের ভূমির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয় না, বরং প্রতিটি আদিবাসীর সদস্যের জীবনেও প্রবাহিত হয়।

সুপাই গ্রামের ইতিহাস

সুপাই গ্রাম হাভাসু ক্যানিয়নের ৩,০০০ ফুট গভীর তলদেশে অবস্থিত এবং এটি হাভাসুপাই জাতিগোষ্ঠীর প্রশাসনিক কেন্দ্র। হাভাসুপাই জনগণ এই অঞ্চলে এক হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বসবাস করছে এবং তাদের মাতৃভাষা এখনও হাভাসুপাই ভাষা। 

জুন ১৮৮০ সালে হাভাসুপাই সংরক্ষিত অঞ্চল প্রতিষ্ঠিত হয়, যা মূলত হাভাসু ক্যানিয়নের ঘনবসতিপূর্ণ একটি ছোট অংশে সীমাবদ্ধ ছিল, যা পূর্বে ক্যাটারাক্ট ক্যানিয়ন নামে পরিচিত ছিল। ১৯৭৫ সালে সংরক্ষিত এলাকার সীমানা সম্প্রসারিত করা হয়, যা বর্তমানে ১,৮৮,০৭৭ একর বিস্তৃত। সর্বশেষ মার্কিন জনসংখ্যা অনুযায়ী, এই আদিবাসীর সদস্য সংখ্যা প্রায় ৫০৩ জন।

সুপাই গ্রামের দৈনন্দিন জীবন

গ্রীষ্মকালে হাভাসুপাই জাতিগোষ্ঠী গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিম দিকের পার্শ্ববর্তী ক্যানিয়নগুলোতে, বিশেষ করে হাভাসু ক্যানিয়নে বসবাস করত। শীতের সময় তারা গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের পশ্চিম অংশের উঁচু মালভূমিতে উঠে যেত এবং পাইনিওন ও জুনিপার গাছের বনাঞ্চলের মাঝে অস্থায়ী ক্যাম্প তৈরি করে বসবাস করে।

গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে হাইকিং

ঐতিহ্যগতভাবে, হাভাসুপাই জাতিগোষ্ঠীর কৃষিকাজ ও চাষাবাদ মূলত বসন্ত ও গ্রীষ্মকালে হয়। শরৎ ও শীতকালে শিকার ও তারা খাদ্য সংগ্রহের কাজ করে। কৃষিক্ষেত্রের চাষাবাদ ও সেচ ব্যবস্থায় পুরো পরিবার সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। মাঝে মাঝে পরিবারগুলো মালভূমিতে গিয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা কররে এবং শিকার করে। হাভাসুপাই জনগণ নিয়মিতভাবে তাদের কৃষিক্ষেত্র পরিদর্শন করে।

খরার সময়, তারা মাঠের আশেপাশে আশ্রয়কেন্দ্র এবং পরবর্তীতে ঘর নির্মাণ করতে শুরু করে, যাতে তারা শস্যক্ষেত্রকে কীটপতঙ্গ এবং প্রতিবেশী ইয়াভাপাই জাতিগোষ্ঠীর আক্রমণ থেকে রক্ষা করতে পারে। হাভাসুপাইদের গোলাকৃতির ছাদযুক্ত ঘর তৈড়ি করে, যা খড়, উইলো গাছের ডাল এবং সরল কাঠের শাখা দিয়ে তৈরি করা হয়। রাতের বেলায় তারা মাদুরে মাথা পূর্বদিকে রেখে ঘুমায়, যেন মন্দ স্বপ্ন এড়ানো যায়।

গ্রীষ্মকালে হাভাসুপাইরা তাদের বাড়ির বাইরে রান্না করে। পরিবারের সব সদস্য একসঙ্গে খাবার খায়। নারী ও শিশুরা পুরুষদের সাথে খায়, তবে যদি কোনো পুরুষ অতিথি আসে, তখন তারা আলাদাভাবে খাওয়ার ব্যবস্থা করে।

হাভাসুপাই আদিবাসী

সুপাই গ্রামের সমাজ ও সংস্কৃতি

হাভাসুপাইদের বুননশিল্পে দুটি প্রধান কৌশল ব্যবহৃত হয়—বাঁধাই ও কুণ্ডলী পাকানো। যার মাধ্যমে তারা ঝুড়ি তৈরি করে। ঝুড়িগুলো গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত হয়। সাধারণত আকাসিয়া গাছের শাখা দিয়ে এই ঝুড়িগুলো তৈরি করা হয়। হাভাসুপাই নারীরাই ঝুড়ি তৈরির কাজ করে থাকে। তাদের তৈরি কুণ্ডলী পাকানো ট্রে ও বাটিগুলো নেটিভ আমেরিকান শিল্পে সূক্ষ্ম কারুকাজের জন্য সুপরিচিত।

ঐতিহাসিকভাবে, হাভাসুপাইরা শীতকালে হরিণের চামড়া দিয়ে তৈরি পোশাক পরে থাকে। গ্রীষ্মকালে পুরুষরা শার্ট, মোকাশিন(জুতা), কোমরবন্ধনী, হেডব্যান্ড এবং লেগিংস পরে। নারীরা সাধারণত ছোট একটি এপ্রন বা কম্বল দিয়ে তৈরি পোশাক, দুটি এপ্রন (একটি লম্বা ও একটি ছোট), এবং মোকাশিন পরিধান করে। তবে তারা সাধারণত খালি পায়েই চলাফেরা করত এবং শুধুমাত্র মাঠে কাজ করার সময় বা দীর্ঘ ভ্রমণের ক্ষেত্রে মোকাশিন ব্যবহার করে। অন্যদিকে, পুরুষরা সবসময় মোকাশিন পরে।

একসময় পশ্চিমা সমাজের সংস্পর্শে আসার পর হাভাসুপাইদের ওপর ধীরে ধীরে শ্বেতাঙ্গদের পোশাক গ্রহণের চাপ বাড়তে থাকে। ফলে, হাভাসুপাই পুরুষরা টুপি পরতে শুরু করে, আর নারীরা দীর্ঘ, ঢিলেঢালা স্কার্ট পরার অভ্যাস গড়ে তোলে।

হাভাসু জলপ্রপাত

সুপাই গ্রামের মূল আকর্ষণ হলো, হাভাসু জলপ্রপাত, যা গ্র্যান্ড ক্যানিয়ন অঞ্চলে সর্বাধিক পরিচিত। এই জলপ্রপাতের বিখ্যাত ফিরোজা ও নীল/সবুজ পানি যখন,  লাল এবং উজ্জ্বল কমলা রঙের পাহাড়ের গহ্বরে গিয়ে পড়ার দৃশ্য পর্যটকদের সবথেকে বেশি আকর্ষণ করে। হাভাসু জলপ্রপাতে সবচেয়ে সহজে পৌঁছানো যায়,বলে এটি সবচেয়ে বিখ্যাত। এখানে অন্যান্য জলপ্রপাতের মধ্যে রয়েছে, নাভাজো ফলস, ফিফটি ফুট ফলস, মুনি ফলস এবং বিভার ফলস।

হাভাসু জলপ্রপাত

সুপাই ভিলেজ কীভাবে যাবেন?

সুপাই পৌঁছানোর একমাত্র উপায় হল একটি দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়া, যেখানে সংকীর্ণ বাঁক, আকাশচুম্বী বালুকাপাথরের স্তম্ভ এবং খাড়াভাবে নেমে যাওয়া পাহাড়ি খাঁজ রয়েছে।

এই গ্রামে যাওয়ার জন্য আপনাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকতে হবে! কারণ, এখানে পৌঁছানোর জন্য আপনাকে পার করতে হবে একটি চ্যালেঞ্জিং ৮ মাইল দীর্ঘ হাইকিং পথ। শুরুতে এটি সহজ মনে হতে পারে, কিন্তু ফিরে আসার সময় আপনাকে ২৫০০ ফুট উচ্চতা পেরিয়ে উঠতে হবে! তাই যারা অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন, তাদের জন্য এটি হবে একটি চরম অভিজ্ঞতা।

প্রায় চার ঘণ্টার দীর্ঘপথ পেরিয়ে রুক্ষ লালচে দেয়াল এবং কাঁটাযুক্ত ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে চলার পর, উপত্যকাটি প্রশস্ত হয়ে ওঠে এবং হাভাসু ক্রিকের ধারে সবুজ গাছপালা দেখা যায়। সুপাই গ্রামে পৌঁছে মনে হবে যেন আপনি অন্য এক যুগে প্রবেশ করেছেন। এখানে কোনো রাস্তা নেই, নেই কোনো মোটরগাড়ি। একমাত্র চলাচলের মাধ্যম হল ঘোড়া ও খচ্চর।

সুপাই গ্রামে খচ্চরের সারিবদ্ধ কাফেলা

সুপাই ভিলেজ, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সংস্কৃতির এক অপূর্ব মেলবন্ধন। এই গ্রামে ঘুরে আসলে শুধুমাত্র শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্যই উপভোগ করা যাবে না, বরং এখানে বসবাসরত মানুষের সরল জীবনযাত্রা এবং স্থানীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে পরিচিত হওয়ারও সুযোগ পাওয়া যাবে। গ্রামটির শুদ্ধ বাতাস,স্নিগ্ধ পরিবেশ এবং অদেখা সৌন্দর্য এক চিরকালীন স্মৃতি হয়ে থেকে যাবে।

তথ্যসূত্র

Related posts

গাজা- ফিলিস্তিনের প্রাচীন শহর

আবু সালেহ পিয়ার

হংকং – এক দেশ দুই নীতির শহর

পুশরাম চন্দ্র

অ্যানিমের শহর- টোকিও

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More