প্রাকৃতিক সম্পদ আর সৌন্দর্যে ভরপুর আফগানিস্তান। তালেবান সরকারের হাতে দেশের শাসনভার যাওয়ার পর থেকে নিষাধাজ্ঞাসহ নানান সমালোচনায় মুখর দেশটি। আন্তর্জাতিক সমর্থন ও সহায়তা ছাড়া আফগানিস্তান কি তবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে?
আফগানিস্তান! নামটা শুনলেই চোখের সামনে ভেসে উঠে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাবুলিওয়ালার কথা, যে বিশালদেহী বলশালী মানুষটি আফগানিস্তানের কাবুল শহর ছেড়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন জীবিকার সন্ধানে।
এই দেশের পরতে পরতে লুকিয়ে আছে দীর্ঘ যুদ্ধের পটভূমি, যুদ্ধবিধ্বস্ত জাতি এবং তাদের ঘুরে দাঁড়াবার ইতিহাস। প্রাচ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ সংযোগস্থলে দাঁড়িয়ে থাকা এই ভূখণ্ড যুগে যুগে দেখেছে কত সাম্রাজ্যের উত্থান-পতন, কত রক্তক্ষয়ী সংঘাত। সাথে আছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর প্রাচীন সভ্যতা ও সংস্কৃতির এক অকৃত্রিম ভাণ্ডার।
চলুন আমরা সেই আফগানিস্তানের গভীরে ডুব দিই, জানার চেষ্টা করি দেশটির মাটি, মানুষ আর জীবনযাত্রার কথা।
রাজধানী | কাবুল |
সরকারি ভাষা | দারি এবং পশতু |
জনসংখ্যা | ৪১.৪৫ মিলিয়ন |
মোট আয়তন | ২,৫১,৮২৫ বর্গমাইল |
মুদ্রা | আফগানি |
সময় অঞ্চল | GMT+4.5 |
আফগানিস্তানের ভৌগোলিক অবস্থান, ভূপ্রকৃতি ও জলবায়ু
আফগানিস্তানের দিকে তাকালে প্রথমেই চোখে পড়বে আকাশ ছোঁয়া পাহাড়ের সারি। হিন্দুকুশ পর্বতমালার বিশাল প্রাচীর যেন দেশটির বুক চিরে দাঁড়িয়ে আছে। এই পাহাড়গুলো শুধু যে দেশটির শোভা বাড়িয়েছে তাই নয়, এর ভূ-রাজনীতিতেও রেখেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
দেশটির উত্তরে রয়েছে উর্বর সমভূমি, যেখানে কৃষিকাজ হয়, আবার দক্ষিণে গেলে দেখা মিলবে রুক্ষ মালভূমি আর মরুভূমির। এই বৈচিত্র্যপূর্ণ ভূখণ্ড আফগানিস্তানকে করেছে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঐশ্বর্যশালী।
জলবায়ুর কথা যদি বলি, তবে এখানে ঋতুর খেলা বেশ স্পষ্ট। গ্রীষ্মকালে সূর্যের তেজ এতটাই প্রখর হয় যে তাপমাত্রা সহজেই ৪০ ডিগ্রি ছাড়িয়ে যায়। ধুলোঝড় আর রুক্ষ বাতাস এর নিত্যসঙ্গী। তবে শীতকালে দেশটির চেহারা একেবারে পাল্টে যায়। পাহাড়চূড়া ঢেকে যায় সাদা বরফের চাদরে, আর তাপমাত্রা নেমে আসে হিমাঙ্কের অনেক নিচে।
কাবুলের মতো শহরগুলোতে শীত বেশ ঠান্ডা আর কষ্টদায়ক হয়। তবে এই প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেও আফগানিস্তানের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে আছে, একদিকে প্রকৃতি, অন্যদিকে শত্রুর সাথে লড়াই করে জীবনযাপন করে আসছে মাথা উঁচু করে।
ম্যাপ
আফগাস্তানের আয়তন এবং জনসংখ্যা
আফগানিস্তানের আয়তন প্রায় ৬ লাখ ৫২ হাজার বর্গ কিলোমিটার, যা অনেক ইউরোপীয় দেশের চেয়েও বড়। এই বিশাল ভূখণ্ডে বাস করে প্রায় চার কোটির কাছাকাছি মানুষ। তবে জনসংখ্যার ঘনত্ব সব জায়গায় সমান নয়। উর্বর সমভূমি আর শহরগুলোর আশেপাশে মানুষের ভিড় বেশি, অন্যদিকে পাহাড়ী আর মরু অঞ্চলগুলোতে জনবসতি তুলনামূলকভাবে কম।
আফগানিস্তানের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হলো এর মানুষের বৈচিত্র্য। এখানে শুধু একটি জাতিগোষ্ঠী নয়, এখানে বহু ভাষা আর সংস্কৃতির মিলন ঘটেছে। পশতুন, তাজিক, হাজারা, উজবেক এমন আরও অনেক জাতি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে একসাথে বসবাস করে আসছে। এদের প্রত্যেকের নিজস্ব ভাষা, ঐতিহ্য আর জীবনযাত্রার ধরণ রয়েছে।
এই সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য আফগানিস্তানকে করেছে এক অনন্য দেশ। তবে মাঝে মাঝে এই বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেকার সম্পর্ক জটিলও হয়েছে, যা দেশটির রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রভাব ফেলেছে।
আফগানস্তানের ইতিহাস ও নামকরণ
আফগানিস্তানের মাটি যেন ইতিহাসের এক বিশাল খোলা পাতা, যেখানে যুগে যুগে নানান ঘটনার পদচিহ্ন আঁকা রয়েছে। খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকেই এই অঞ্চল ছিল বিভিন্ন সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। কখনও গান্ধার, কখনও ব্যাক্ট্রিয়া, আবার কখনও মৌর্য সাম্রাজ্যের অধীনে এসেছে এই ভূমি।
ইসলামের আগমন এখানকার ইতিহাসে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে। ধীরে ধীরে স্থানীয় সংস্কৃতিতে ইসলামের প্রভাব বিস্তার লাভ করে এবং বিভিন্ন ইসলামিক রাজবংশের উত্থান ঘটে। ঘজনভি, ঘুরি, তৈমুর লং-এর মতো শাসকরা এই অঞ্চলের উপর দিয়ে তাদের ক্ষমতার রথ ছুটিয়েছেন।
“আফগানিস্তান” নামেরও রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। মনে করা হয়, “আফগান” শব্দটি মূলত একটি জাতিগোষ্ঠীর নাম থেকে এসেছে। কালক্রমে এই শব্দটি পুরো অঞ্চলের পরিচয় হয়ে ওঠে। বিভিন্ন সময়ে এই ভূখণ্ড বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল, তবে আঠারো শতকে দুররানি সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠার পর থেকে “আফগানিস্তান” নামটি মোটামুটি স্থায়ী রূপ লাভ করে। এই নাম শুধু একটি দেশের পরিচয় নয়, বরং এর দীর্ঘ ও সংগ্রামী ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি।
শাসন ব্যবস্থা ও রাজনীতি
আফগানিস্তানের শাসন ব্যবস্থা বরাবরই এক জটিল ধাঁধা। অতীতে দেশটিতে উপজাতিভিত্তিক নেতৃত্বের একটা শক্তিশালী প্রভাব ছিল অর্থাৎ বিভিন্ন গোত্রের সর্দাররা নিজ নিজ অঞ্চলে ক্ষমতা ধরে রাখতেন। জাতীয় পর্যায়ে “লয় জিরগা” নামক এক ঐতিহ্যবাহী সমাবেশের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হতো। এই লয় জিরগা বিভিন্ন সংকটময় মুহূর্তে জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে কাজ করত।
তবে আধুনিক যুগে আফগানিস্তানের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বহুবার পরিবর্তিত হয়েছে। রাজতন্ত্রের অবসান, বামপন্থী সরকারের উত্থান এবং পরবর্তীতে সোভিয়েত ইউনিয়নের হস্তক্ষেপ দেশটির রাজনীতিতে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। পরবর্তীতে দীর্ঘ গৃহযুদ্ধ, তালেবানের উত্থান এবং মার্কিন সামরিক বাহিনীর অবস্থান দেশটির শাসন ব্যবস্থাকে আরও অস্থির করে তোলে।
রক্তাক্ত গৃহযুদ্ধের পর নব্বই দশকে দেশটিতে কঠোর ইসলামি শাসন ব্যবস্থা আরোপ করে তালেবান গোষ্ঠী। পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের অভিযানের মুখে ২০০১ সালে তারা ক্ষমতাচ্যুত হয়। ২০২১ সালে বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে আফগানিস্তান ছেড়ে যায় মার্কিন নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা জোট। ক্ষমতায় ফেরে রক্ষণশীল তালেবান।
আফগানিস্তানের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটনা
১৯৭৮: তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ দাউদ খানের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয় কমিউনিস্টরা। তারা ভূমি বণ্টন সংস্কার শুরু করে। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে উসকে দেয় এবং রাজনৈতিক ভিন্নমতাদর্শীদের দমন করে। পরবর্তীতে গৃহযুদ্ধ আরও ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৭৯: সোভিয়েত সেনাবাহিনী আক্রমণ করে এবং কমিউনিস্ট সরকারকে সমর্থন করে। ওই যুদ্ধে ১০ লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারায়।
১৯৮৯: সোভিয়েত সেনাদের শেষ দলটি আফগানিস্তান ত্যাগ করে। মার্কিন ও পাকিস্তান সমর্থিত মুজাহিদিনরা সোভিয়েত-প্রতিষ্ঠিত আফগান শাসক নাজিবুল্লাহকে উৎখাত করে। এতে গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত হয়।
১৯৯৬: তালেবান কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং ইসলামিক কঠোর নিয়ম চাপিয়ে দেয়।
২০০১: যুক্তরাষ্ট্রে ১১ সেপ্টেম্বরে ভয়াবহ হামলার পর সামরিকভাবে হস্তক্ষেপ করে যুক্তরাষ্ট্র। কাবুল থেকে তালেবানদের উৎখাত করা হয় এবং হামিদ কারজাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান হন।
২০১৪: আশরাফ গণি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে মিশন শেষ করে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটো। এরপরই আফগান বাহিনীর কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর করে। কিন্তু আফগান বাহিনী ধারাবাহিকভাবে হামলার মুখোমুখি হয়।
২০২১: মার্কিন বাহিনী প্রত্যাহারের পর তালেবানরা কাবুল পুনরায় দখল করে।
তালিবান ক্ষমতা গ্রহণের পর আফগানিস্তানের অবস্থান
মার্কিন সাম্রাজ্য হটিয়ে আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা গ্রহণ দেশটির ইতিহাসে এক নতুন যুগের সূচনা করেছে। তাদের শাসন ব্যবস্থা শরিয়া আইনের কঠোর ব্যাখ্যার উপর ভিত্তি করে গঠিত, যেখানে নারী অধিকার এবং অন্যান্য নাগরিক স্বাধীনতার উপর অনেক বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। এছাড়া ২০২১ সালে আফগানিস্তানে ফের ইসলামিক শাসন ফিরে আসার পর দেশটির মিডিয়ার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করে আসছে তালেবান প্রশাসন। ইতোমধ্যেই নিয়মকানুনে এদিক সেদিক হওয়ার কারণে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে একাধিক সংবাদমাধ্যম।
আফগানস্তানের পর্যটন আকর্ষণ
অনেকের মনে আফগানিস্তানের একটি ধূসর ছবি আঁকা থাকলেও, এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। উঁচুনিচু পর্বতমালা, গভীর উপত্যকা আর দিগন্ত বিস্তৃত প্রান্তর—প্রকৃতির এক অসাধারণ ক্যানভাস যেন এখানে বিছানো। চলুন জেনে নিই আফগানিস্তানের কিছু দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে-
বামিয়ান উপত্যকা
বামিয়ান উপত্যকা, ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে স্বীকৃত, আফগানিস্তানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক স্থানগুলোর একটি। এটি ছিল বৌদ্ধ ধর্মের একটি প্রধান কেন্দ্র, যেখানে একসময় ছিল বিশাল দুইটি বুদ্ধ মূর্তি।
ধারণা করা হয়, এই মূর্তিগুলো ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। তালেবান শাসনামলে মূর্তিগুলো ধ্বংস করা হলেও স্থানটির ধ্বংসাবশেষ এখনও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। বামিয়ানের চারপাশের পাহাড়ি দৃশ্যের সাথে ঐতিহাসিক এই স্থাপত্য, স্থানটিকে অনন্য করে তুলেছে।
হেরাত মসজিদ ও দুর্গ
হেরাত শহর আফগানিস্তানের প্রাচীনতম শহরগুলোর একটি। এই শহরটি তার মসজিদ এবং দুর্গের জন্য বিখ্যাত।
হেরাত মসজিদটি মোঘল স্থাপত্যের একটি উজ্জ্বল উদাহরণ, যেখানে মসজিদের দেওয়ালে দারুণ সব প্রাচীন কারুকার্য দেখতে পাওয়া যায়। মসজিদটি ১৪ শতকে নির্মিত এবং এটি আফগানিস্তানের অন্যতম বৃহত্তম মসজিদ।
এই শহরে আছে আরেকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন, হেরাত দূর্গ। এটি আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের সময়ে নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষামূলক স্থাপনা। দুর্গটি বর্তমানে একটি জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হয় এবং এতে সংরক্ষিত রয়েছে বিভিন্ন মধ্যযুগীয় অস্ত্র ও ঐতিহাসিক নিদর্শন।
কান্দাহার মসজিদ
কান্দাহারের মসজিদটি মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-এর চাদরের একটি অংশ সংরক্ষণের জন্য পরিচিত। এটি আফগান সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এছাড়া, মসজিদের চারপাশে মনোরম পরিবেশ ও স্থানীয় বাজার পর্যটকদের আকর্ষণ করে। তাছাড়া নবীজীর স্মৃতি বহনকারী চাদর সংরক্ষণের কারণে মসজিদটির ধর্মীয় তাৎপর্যও পর্যটকদের কাছে বেশি।
মাজার-ই-শরিফের নীল মসজিদ
মাজার-ই-শরিফ শহরের নীল মসজিদ, যা ব্লু মস্ক নামেও পরিচিত। মনোমুগ্ধকর এই মসজিদটি তার অত্যাশ্চর্য নীল টাইলসের স্থাপত্যের জন্য বিখ্যাত। এটি ইসলামী স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন। স্থানীয়দের মতে, হজরত আলীর সমাধিস্থল এখানে রয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে এই স্থান।
ব্যান্ড-ই-আমির জাতীয় উদ্যান
হিন্দুকুশের রুক্ষ পাহাড়ে অবস্থিত, ব্যান্ড-ই-আমির ন্যাশনাল পার্ক একটি প্রাকৃতিক বিস্ময় যার সৌন্দর্যে যেকোনো পর্যটক মুগ্ধ হতে বাধ্য। স্বচ্ছ নীলাভ হ্রদগুলোর সাথে উদ্যানের চারপাশে দাঁড়িয়ে থাকা সুউচ্চ পর্বতশ্রেণি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক চমৎকার অনুভূতি দেবে। এই হ্রদগুলো ছয়টি বড় জলাশয় নিয়ে গঠিত। এই উদ্যানে পর্যটকরা নৌকাভ্রমণ, পিকনিক এবং ট্রেকিং করতে পারেন।
পাঞ্জশির উপত্যকা
হিন্দুকুশ পর্বতমালার কোলে অবস্থিত পাঞ্জশির উপত্যকা তার সবুজ প্রকৃতি এবং স্ফটিক স্বচ্ছ নদীর জন্য বিখ্যাত। এটি আফগানিস্তানের অন্যতম সুন্দর প্রাকৃতিক স্থান। পর্যটকরা চাইলে এখানে ট্রেকিং ও মাছ ধরার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন। পাঞ্জশির উপত্যকা ঐতিহাসিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি ছিল আফগান মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী দুর্গ। এখানে আহমদ শাহ মাসুদের সমাধিস্থলও রয়েছে।
জাতীয় জাদুঘর
কাবুলে অবস্থিত জাতীয় জাদুঘর আফগানিস্তানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ভাণ্ডার। এখানে ৫০,০০০-এরও বেশি নিদর্শন রয়েছে, যা দেশটির প্রাচীন ইতিহাস,ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন সভ্যতার জীবনযাত্রাকে সংরক্ষণ করছে। এছাড়াও এই জাদুঘরে দেখা মিলবে আফগানিস্তানের প্রাচীন মুদ্রা, পোশাক, অস্ত্র এবং দৃষ্টিনন্দিত স্থাপত্য শিল্পের।
আফগানিস্তান ভ্রমণ কি নিরাপদ?
তবে একটা প্রশ্ন নিশ্চয়ই আপনার মনে ঘুরপাক খাচ্ছে, আফগানিস্তান ভ্রমণ কি নিরাপদ? সত্যি বলতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে অনেক দেশই তাদের নাগরিকদের আফগানিস্তান ভ্রমণে নিরুৎসাহিত করে। তবে বর্তমানে অনেক পর্যটকই আফগানিস্তানের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্বাদ নিতে ভ্রমণে আসছেন। যুক্তরাজ্যভিত্তিক ট্রাভেল এজেন্সি লুপিন ট্রাভেলের প্রতিষ্ঠাতা ডিলান হ্যারিস ২০২৩ সালে ব্রিটিশ গণমাধ্যমে জানিয়েছেন, ২০২৪ সালে আফগানিস্তান ভ্রমণের জন্য তাঁদের সবচেয়ে বেশি টিকিট বিক্রি হয়েছে অথচ ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর আফগানিস্তান ভ্রমণকে ‘অত্যন্ত বিপজ্জনক’ বলে উল্লেখ করে থাকে।
ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি
আফগানিস্তানের সংস্কৃতি দারুণ বৈচিত্র্যময়। এখানে রয়েছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ঐতিহ্য ও নান্দিকতার ছোঁয়া।
আফগানদেত পোশাক-পরিচ্ছদের দিকে তাকালে এর পরিচয় পাওয়া যায় সহজেই। পশতুনদের ঢিলেঢালা পেরাহান তুম্বান থেকে শুরু করে তাজিকদের কারুকার্যময় পোশাক—প্রত্যেক অঞ্চলের রয়েছে নিজস্ব ফ্যাশন এবং স্টাইল।
ভাষার ক্ষেত্রেও আফগানিস্তানে রয়েছে বৈচিত্র্য। পশতু এবং দারি হলো আফগানদের প্রধান ভাষা, তবে উজবেক, তুর্কমেনিসহ আরও অনেক ছোট ছোট জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা প্রচলিত আছে। এদেশের বেশিরভাগ মানুষ ইসলাম ধর্মের অনুসারী। ইসলাম এখানকার মানুষের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের আচার-অনুষ্ঠান, সামাজিক রীতিনীতি—সবকিছুতেই ইসলামের গভীর প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এছাড়া সঙ্গীত, নৃত্য আর লোককাহিনীর এক সমৃদ্ধ ভান্ডার রয়েছে আফগান সংস্কৃতিতে। বিভিন্ন ধরনের বাদ্যযন্ত্র, যেমন রবাব, তানপুরা এখানকার ঐতিহ্যবাহী সঙ্গীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
অর্থনীতি: সংকট আর সম্ভাবনার দোলাচল
২০২১ সালের ১৫ আগস্ট যখন তারা ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন দেশটি ছিল বৈদেশিক মুদ্রাশূন্য দুর্ভিক্ষের একটি দেশ। অর্থনীতি ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত। ফলে এই দেশটির ঘুরে দাঁড়ানো অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু তালেবান সরকার তাদের আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ব্যবসা-বাণিজ্যও পুনরুজ্জীবিত করতে পেরেছে।
এই সরকারের সবচেয়ে বড় সাফল্য কৃষিব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন। ডালিম বা আনার চাষ আফগানিস্তানের অন্যতম কৃষি। দেশটিতে প্রচুর পরিমাণ ডালিম চাষ করা হয়।
এছাড়া আফগানিস্তানে প্রচুর খনিজ সম্পদ আছে। এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশের একটি হচ্ছে বৈদ্যুতিক ব্যাটারি, যার মূল উপাদান লিথিয়াম। আর কার্যত এই লিথিয়ামের ওপর ভাসছে পুরো আফগানিস্তান।
বলা হয় আফগানিস্তানের মাটির নিচে থাকা উত্তোলনযোগ্য লিথিয়ামের সম্পদমূল্য বর্তমান বাজার অনুযায়ী তিন ট্রিলিয়ন ডলার বা তিন লাখ কোটি ডলার। এছাড়া লৌহ, স্বর্ণের খনি ও অন্যান্য রত্নভাণ্ডার তো রয়েছেই।
আফগানিস্তান নিয়ে কিছু মজার তথ্য
* একসময় আফগানিস্তান তার মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের জন্য “প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড” নামে পরিচিত ছিল।
* আফগানিস্তানের জাতীয় খেলা বুজকাশি, যা অনেকটা ঘোড়সওয়ারদের পোলোর মতো, তবে এখানে বলের বদলে একটি মৃত ছাগল ব্যবহার করা হয়!
* ডালিম হলো আফগানিস্তানের জাতীয় ফল এবং কান্দাহারের ডালিম বিশ্বজুড়ে বিখ্যাত।
* হাতে বোনা কার্পেট আফগানিস্তানের একটি ঐতিহ্যবাহী শিল্প এবং এর নকশা ও গুণমান বিশ্বজুড়ে সমাদৃত।
* কাবুলে অবস্থিত বাঘ-ই-বাবর একটি ঐতিহাসিক বাগান, যা মুঘল সম্রাট বাবরের স্মৃতি ধারণ করে।
* রবাব হলো আফগানিস্তানের জাতীয় বাদ্যযন্ত্র, যার মিষ্টি সুর এখানকার লোকসংগীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
* আফগানিস্তানে অবস্থিত হিন্দুকুশ পর্বতমালা পৃথিবীর অন্যতম উঁচু পর্বতশ্রেণী।
* আফগানরা তাদের অতিথিপরায়ণতার জন্য খুব বিখ্যাত। তারা আগন্তুকদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানায় এবং সাধ্যমতো আপ্যায়ন করে।
তথ্যসূত্র –
- https://www.bbc.com/bengali/news-58091924
- https://www.banglatribune.com/foreign/asia/793839/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%AA%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%9A%E0%A6%BF%E0%A6%A4%E0%A6%BF-%E0%A6%86%E0%A6%AB%E0%A6%97%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A6%BF%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A8
- https://www.britannica.com/place/Afghanistan/Finance
- https://www.prothomalo.com/business/economics/zvy6g2fjo6