চীনের ইউনান প্রদেশের গভীরে লুকিয়ে আছে এক পাথরের গোলকধাঁধা। প্রতিটি পাথরের রয়েছে নিজস্ব নাম এবং গল্প। এটি শুধু একটি দর্শনীয় স্থান নয়, এটি এক হারানো রাজ্যের ইতিহাস আর প্রেমের উপাখ্যান। চলুন, হারিয়ে যাই প্রকৃতির এই বিস্ময়কর পাথরের বনে।
কল্পনা করুন, আপনি এমন এক জঙ্গলে হারিয়ে গেছেন, যেখানে কোনো সবুজ গাছপালা নেই, নেই কোনো লতাগুল্মের সমারোহ। তার বদলে আপনার চারপাশে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ ধারালো পাথরের স্তম্ভ। কোনোটি দেখতে তলোয়ারের মতো ধারালো, কোনোটি বিশাল আকৃতির পশুর মতো, আবার কোনোটি যেন কোনো ধ্যানমগ্ন ঋষি। পুরো এলাকাটি যেন এক পাথরের গোলকধাঁধা, যার মধ্যে দিয়ে হাঁটার সময় নিজেকে মনে হবে কোনো রূপকথার রাজ্যের অংশ, যেখানে সময় লক্ষ লক্ষ বছর ধরে থেমে আছে।
এটি কোনো কল্পনা নয়, এটিই চীনের বিখ্যাত ‘স্টোন ফরেস্ট’ বা ‘শিলিন’ (Shilin)। চীনের ইউনান প্রদেশের রাজধানী কুনমিং থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই স্থানটি প্রকৃতির এক অবিশ্বাস্য এবং বিস্ময়কর সৃষ্টি। এটি শুধু একটি পর্যটন কেন্দ্র নয়, এটি একটি জীবন্ত ভূতাত্ত্বিক জাদুঘর, যা প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বা ২৭ কোটি বছরের দীর্ঘ ইতিহাস নিজের বুকে ধারণ করে আছে।
কীভাবে তৈরি হলো এই পাথরের বন? এর পেছনের বৈজ্ঞানিক রহস্যটাই বা কী? স্থানীয় মানুষের লোককথায় এই বনকে ঘিরে কি রহস্যময় গল্প প্রচলিত আছে?
কোথায় এই পাথরের বন এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ?
চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত ইউনান প্রদেশ তার অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত। আর এই প্রদেশের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো শিলিন, অটোনোমাস কাউন্টিতে অবস্থিত এই স্টোন ফরেস্ট। প্রায় ৪০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত এই বিশাল পাথরের বনটিকে ২০০৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান (UNESCO World Heritage Site) হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। এটি দক্ষিণ চীনের কার্স্ট ভূমিরূপের একটি অংশ, যা তার অনন্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত।
স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভাষায় এই স্থানটিকে বলা হয় ‘শিলিন’, যার অর্থই হলো ‘পাথরের বন’। এটি শুধু চীনের নয়, সারা বিশ্বের ভূতত্ত্ববিদ, বিজ্ঞানী এবং পর্যটকদের কাছে এক অপার কৌতূহলের বিষয়। এটি প্রকৃতির এক টাইম ক্যাপসুল, যা আমাদের পৃথিবীর অতীত সম্পর্কে জানতে সাহায্য করে।
স্টোন ফরেস্টের গঠন প্রক্রিয়া: সমুদ্রের তলদেশ থেকে আকাশের বুকে
আজ আমরা যে বিশাল পাথরের স্তম্ভগুলো দেখতে পাই, সেগুলো একদিনে বা এক বছরে তৈরি হয়নি। এর পেছনে রয়েছে লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি বছরের ভূতাত্ত্বিক পরিবর্তন, পানি এবং বাতাসের নিরলস শিল্পকর্ম। এই জটিল প্রক্রিয়াটিকে কয়েকটি ধাপে ভাগ করা যায়।
প্রথম ধাপ – সমুদ্রের জন্ম
আজ থেকে প্রায় ২৭০ মিলিয়ন বছর আগে, পারমিয়ান যুগে এই পুরো এলাকাটি ছিল এক বিশাল সমুদ্রের নিচে। কোটি কোটি বছর ধরে এই সমুদ্রের তলদেশে সামুদ্রিক প্রাণী, শ্যাওলা, প্রবাল এবং অন্যান্য খনিজ পদার্থ জমে লাইমস্টোন বা চুনাপাথরের এক বিশাল স্তর তৈরি হয়, যা শত শত মিটার পুরু ছিল।
দ্বিতীয় ধাপ – ভূমির উত্থান
সময়ের সাথে সাথে, ভূ-আন্দোলন বা টেকটোনিক প্লেটের সঞ্চালনের ফলে এই সমুদ্রের তলদেশ ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু করে এবং এক বিশাল মালভূমিতে পরিণত হয়। সমুদ্রের জল সরে যাওয়ার পর, বাতাসের সংস্পর্শে আসে সেই নরম চুনাপাথরের বিশাল স্তর।
তৃতীয় ধাপ – প্রকৃতির ভাস্কর্য
এরপর শুরু হয় প্রকৃতির আসল কারিগরি। বৃষ্টি, বাতাস এবং অম্লীয় জল এই ক্ষয় প্রক্রিয়ার প্রধান কারিগর। বাতাসে থাকা কার্বন ডাই অক্সাইড বৃষ্টির পানির সাথে মিশে এক ধরনের মৃদু কার্বনিক অ্যাসিড তৈরি করে। এই অ্যাসিডিক জল লক্ষ লক্ষ বছর ধরে চুনাপাথরের উপর কাজ করতে থাকে। চুনাপাথর তুলনামূলকভাবে নরম হওয়ায়, এই পানির প্রবাহ সহজেই এর দুর্বল অংশগুলোকে ক্ষয় করে ফেলতে শুরু করে। পাথরের ফাটল বরাবর পানি চুইয়ে ভেতরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে পাথরকে চিনির মতো দ্রবীভূত করতে থাকে।
চূড়ান্ত রূপ
এই নিরন্তর ক্ষয় প্রক্রিয়ার ফলে, পাথরের নরম অংশগুলো ধুয়ে মুছে পরিষ্কার হয়ে যায় এবং কঠিন ও ঘন অংশগুলো স্তম্ভের আকারে দাঁড়িয়ে থাকে। লক্ষ লক্ষ বছরের এই প্রাকৃতিক ভাস্কর্যের ফলেই তৈরি হয়েছে আজকের এই বিস্ময়কর স্টোন ফরেস্ট, যার প্রতিটি পাথর যেন এক একটি আলাদা শিল্পকর্ম।
সহজ কথায়, স্টোন ফরেস্ট হলো প্রকৃতির এক বিশাল ভাস্কর্যের বাগান, যার শিল্পী হলো পানি এবং বাতাস, আর ক্যানভাস হলো ২৭০ মিলিয়ন বছরের পুরোনো চুনাপাথর।
স্টোন ফরেস্টের রহস্য: আশিমার করুণ প্রেমকাহিনী
বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা যতই যৌক্তিক হোক না কেন, স্থানীয় মানুষের কাছে এই পাথরের বন শুধু কিছু ভূতাত্ত্বিক গঠন নয়। এর সাথে জড়িয়ে আছে তাদের সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং করুণ লোকগাথা। স্টোন ফরেস্টকে ঘিরে সবচেয়ে জনপ্রিয় যে গল্পটি প্রচলিত, তা হলো আশিমা (Ashima) নামের এক সুন্দরী তরুণীর প্রেমকাহিনী।
লোককথা অনুযায়ী, আশিমা ছিল এক অসাধারণ সুন্দরী এবং দয়ালু মেয়ে। সে আহেই (Ahei) নামের এক সাহসী যুবককে ভালোবাসত। কিন্তু এক দুষ্ট ও ক্ষমতাবান ভূস্বামী আশিমার রূপে মুগ্ধ হয়ে তাকে জোর করে বিয়ে করতে চায়। আশিমা রাজি না হওয়ায়, ভূস্বামী তাকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। আহেই খবর পেয়ে তার প্রেমিকাকে উদ্ধার করতে ছুটে আসে এবং ভূস্বামীর সাথে এক ভয়ংকর প্রতিযোগিতায় নামে।
আহেই তার সাহস এবং বুদ্ধিমত্তা দিয়ে ভূস্বামীকে পরাজিত করে আশিমাকে উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কিন্তু তাদের মিলন স্থায়ী হয়নি। ফেরার পথে, প্রতিহিংসাপরায়ণ ভূস্বামী এক বিশাল বন্যার সৃষ্টি করে। সেই বন্যার জলে আশিমা ডুবে যায় এবং সেখানেই একটি পাথরে পরিণত হয়।
আজও স্টোন ফরেস্টের একটি নির্দিষ্ট পাথরকে ‘আশিমা পাথর’ হিসেবে দেখানো হয়। বলা হয়, এই পাথরটি দেখতে অবিকল আশিমার মতো, যে তার প্রেমিকের জন্য অপেক্ষা করছে। যদি কেউ তার নাম ধরে ডাকে, তবে নাকি পাথরের মধ্য থেকে তার কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। আশিমার এই করুণ কাহিনী এই পাথরের বনকে এক নতুন, মানবিক এবং রহস্যময় মাত্রা দিয়েছে। প্রতি বছর চান্দ্র ক্যালেন্ডারের ষষ্ঠ মাসের ২৪ তারিখে, স্থানীয় সানি জনগোষ্ঠী আশিমার সাহস, সৌন্দর্য এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার স্মরণে টর্চ ফেস্টিভ্যাল আয়োজন করে। এই উৎসবে তারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে, লোকসংগীত গায়, নাচ করে এবং কুস্তি ও ষাঁড়ের লড়াইয়ের মতো বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়। এটি তাদের সংস্কৃতির এক জীবন্ত ও বর্ণময় অংশ।
স্টোন ফরেস্টের ভেতরে কী কী দেখবেন?
স্টোন ফরেস্ট শুধু একটি একক এলাকা নয়, এটি কয়েকটি ভিন্ন ভিন্ন দর্শনীয় স্থানের সমন্বয়ে গঠিত। এর প্রতিটি অংশের রয়েছে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং সৌন্দর্য।
মেজর এবং মাইনর স্টোন ফরেস্ট (Major and Minor Stone Forests)
এটি পর্যটকদের কাছে সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং প্রবেশযোগ্য এলাকা। এখানকার পাথরের গঠনগুলো অত্যন্ত ঘন এবং উঁচু। এর ভেতরে হাঁটার জন্য সুন্দর রাস্তা তৈরি করা আছে। এখানে হাঁটতে থাকলে মনে হবে যেন এক পাথরের গোলকধাঁধায় প্রবেশ করেছেন, যেখানে প্রতিটি বাঁকে নতুন বিস্ময় অপেক্ষা করছে। কিছু কিছু পাথরকে তাদের আকৃতির জন্য মজার মজার নাম দেওয়া হয়েছে, যেমন ‘গণ্ডারের চাঁদ দেখা’, ‘মা ও ছেলে’ বা ‘পাখির শিকার’। এখানকার সরু পথ আর পাথরের বিশালতা আপনাকে প্রকৃতির শক্তির কাছে নগণ্য অনুভব করাবে।
নাইগু স্টোন ফরেস্ট (Naigu Stone Forest)
প্রধান এলাকা থেকে কিছুটা দূরে অবস্থিত এই অংশটি তুলনামূলকভাবে শান্ত এবং বন্য। ‘নাইগু’ শব্দের অর্থ হলো ‘কালো’। এখানকার চুনাপাথরে ম্যাগনেসিয়ামের পরিমাণ বেশি থাকায় পাথরগুলোর রঙ কালচে, যা একে এক গম্ভীর এবং রুক্ষ রূপ দিয়েছে। এখানকার পাথরগুলোর গঠন আরও বেশি ধারালো। যারা একটু অ্যাডভেঞ্চার ভালোবাসেন এবং ভিড় থেকে দূরে প্রকৃতির আদিম রূপ দেখতে চান, তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা।
ঝিইয়ুন গুহা (Zhiyun Cave)
এটি একটি বিশাল ভূগর্ভস্থ গুহা, যা লাইমস্টোনের ক্ষয়ের ফলেই তৈরি হয়েছে। এর ভেতরে রয়েছে অসংখ্য স্ট্যালাকটাইট (ছাদ থেকে ঝুলে থাকা পাথরের গঠন) এবং স্ট্যালাগমাইট (মেঝে থেকে গজানো পাথরের গঠন), যা গুহার সৌন্দর্যকে বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। গুহার ভেতরে রঙিন আলোর ব্যবহার এক পরাবাস্তব পরিবেশ তৈরি করে।
লং লেক (Long Lake)
এটি প্রায় ৩ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি শান্ত এবং সুন্দর হ্রদ। এর চারপাশের প্রাকৃতিক দৃশ্য এবং শান্ত পরিবেশ পর্যটকদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। এটি একটি কার্স্ট হ্রদ, যা একটি নিচু উপত্যকায় অবস্থিত।
দা দিয়েশুই জলপ্রপাত (Da Dieshui Waterfall)
বর্ষাকালে এই জলপ্রপাতটি তার পূর্ণরূপে আবির্ভূত হয় এবং প্রায় ৯০ মিটার উঁচু থেকে সশব্দে নিচে আছড়ে পড়ে এক অসাধারণ দৃশ্যের জন্ম দেয়।
চীনের স্টোন ফরেস্ট শুধু কিছু পাথরের সমষ্টি নয়, এটি প্রকৃতির লেখা এক মহাকাব্য, যার প্রতিটি অধ্যায় লেখা হয়েছে লক্ষ লক্ষ বছর ধরে। এটি আমাদের শেখায়, প্রকৃতিই হলো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এবং ধৈর্যশীল শিল্পী। আশিমার লোককথা এই পাথরের বনকে দিয়েছে একটি আত্মা, আর বিজ্ঞান দিয়েছে এর পেছনের অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যা। এই দুইয়ের মিশ্রণই স্টোন ফরেস্টকে এতটা অনন্য এবং রহস্যময় করে তুলেছে।
এখানে দাঁড়িয়ে যখন ২৭ কোটি বছরের পুরোনো পাথরের দিকে তাকানো হয়, তখন মানুষের জীবনকে বড্ড ক্ষণস্থায়ী মনে হয়। এটি আমাদের নিজেদের অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতা এবং মহাকালের বিশালতার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। যারা প্রকৃতির বিস্ময়কর সৃষ্টি এবং ইতিহাসের গভীরতাকে এক জায়গায় অনুভব করতে চান, তাদের জন্য চীনের এই পাথরের বন এক অবশ্য দ্রষ্টব্য স্থান।
তথ্যসূত্র –
- http://shilingeopark.com/public/park/en-US/detail-437-17832.html
- https://stoneforest.com/
- https://archive.roar.media/bangla/main/geography/stone-forest-of-shiling-where-stone-is-more-visible-than-trees
- https://www.unesco.org/en/iggp/shilin-unesco-global-geopark
- https://m.somewhereinblog.net/mobile/blog/asmarshad/29066555
- https://www.tripoto.com/trip/tripoto-60817cf27c587
- https://adarbepari.com/abroad/stone-forest-kunming-china