Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

সৌদি আরব- মরুর নিচে লুকিয়ে থাকা সবুজ ইতিহাস

সৌদি আরব মানেই  কি শুধু মরুভূমি, পেট্রোলিয়ামের গন্ধ আর আকাশ ছোঁয়া স্কাইলাইন????

আজকের সৌদি আরব মানেই বিস্তীর্ণ ধুধু মরুভূমি, উষ্ণতা ও ধুলোর রাজত্ব। কিন্তু আপনি কি জানেন কয়েক হাজার বছর আগে এই মরুভূমি ছিল সবুজ তৃণভূমি, নদী-নালা, জলাশয় ও প্রাণবন্ত কৃষির কেন্দ্র। কি গল্প মনে হলো? গল্প মনে হলেও এটিই প্রকৃত বাস্তবতা।

আধুনিক বিজ্ঞান, উপগ্রহচিত্র ও প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা আমাদের সামনে খুলে দিয়েছে সৌদি আরবের এক বিস্ময়কর পুরাতন অধ্যায়। যেখানে মরুভূমির উষ্ণ বালির নিচে ঘুমিয়ে আছে এক সময়ের কৃষিনির্ভর সভ্যতার গল্প। চলুন ফিরে যাই সেই হারানো সবুজ সৌদি আরবে।

সৌদি আরবের সবুজায়ন

সবুজ আরব

সৌদি আরবের বর্তমান রূপ সৃষ্ট হয়েছে প্রাকৃতিক জলবায়ু পরিবর্তনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ায়। প্রায় ৮,০০০–১০,০০০ বছর আগে হোলোসিন যুগে আফ্রিকার বর্ষার রেখা উত্তরে সরে আসায় সৌদি আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ঢেকে যায় সবুজ তৃণভূমিতে। যার ফলে সৌদি আরবে তৈরি হয় গ্রীষ্মমন্ডলীয় জলবায়ু।

নাসা ও ইউরোপীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থার উপগ্রহচিত্রে আজও দেখা যায় শুকিয়ে যাওয়া নদীর পথ, হারিয়ে যাওয়া হ্রদ, এমনকি প্রাচীন কূপ ও খাল। এসব প্রমাণ করে যে মরুর বুকে এক সময় প্রবাহমান জলের ধারা ছিল। 

“ধুধু বালির ঢেউ, তপ্ত সূর্য আর উটের কর্কশ হাঁক” সৌদি আরব মানেই যেন প্রাকৃতিক নিষ্ঠুরতার প্রতীক। কিন্তু এই নিষ্ঠুরতার মধ্যেই একসময় ছিল সবুজ বন-বনানী, বয়ে যাওয়া নদী আর গরু-ছাগলে ভরা খামারঘর। 

চলুন  সেই প্রাণবন্ত সবুজ আরব সম্পর্কে আরও কিছু তথ্য জেনে নিই।

মানব বসতির গোড়াপত্তন 

এই উর্বর ভূখণ্ডে গড়ে ওঠে প্রাচীন মানববসতি। যারা শুরুতে ছিল শিকারি ও সংগ্রাহক। কিন্তু পরিবেশের সুযোগ নিয়ে তারা ধীরে ধীরে কৃষিকাজ ও পশুপালনে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে। আল-উলা,খায়বার, তায়িমা ও আল-ফাও ছিল প্রাথমিকভাবে গড়ে ওঠা এমন কিছু জনপদ। যেখানে স্থায়ী বসবাস, সেচব্যবস্থা, খাদ্য মজুত ও পশু লালনের নিদর্শন পাওয়া গেছে। 

কৃষির সূচনা 

কোথায়, কখন এবং কিভাবে?

সৌদি আরবে কৃষির সূত্রপাত ঘটে মূলত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় এলাকায়। বিশেষ করে আল-উলা,তায়িমা, ও আল-ফাও অঞ্চলে। প্রায় ৭,০০০ বছর আগে এখানকার মানুষ পশু শিকার ও খাদ্য সংগ্রহে নির্ভরতা কমিয়ে স্থায়ীভাবে কৃষিকাজে যুক্ত হয়।

সাধারণভাবে গম ও যবের মতো শস্য এখানে চাষ হতো পাহাড়ঘেরা উপত্যকায়। যেখানে জলাশয়ের পানি সহজলভ্য ছিল। প্রাচীন কৃষকরা কূপ খনন করত, খাল কেটে সেচ দিত, এবং ফসল মজুদ রাখার জন্য ব্যবহার করত মাটির গোলাঘর।

মরুতে পাওয়া প্রাচীন কৃষি সরঞ্জামের অংশ প্রমাণ করে যে এখানে কেবল চাষই হতো না বরং একটি সুসংগঠিত কৃষি অর্থনীতি ছিল। এভাবেই সর্বপ্রথম মরুভূমিতে কৃষির সূত্রাপাত ঘটে।

সৌদির মরুভুমিতে কৃষি কাজ

খাদ্য উৎপাদন 

সেই সময় তাদের খাদ্য মূলত খেজুর, যব, গম, বাদাম ও বন্য ফলমূল থেকে আসত। খেজুর গাছ শুধু ফলই দিত না, বরং গাছের প্রতিটি অংশ ছিল ব্যবহারযোগ্য। পাতা দিয়ে বাড়িঘর তৈরি, গুঁড়ি দিয়ে আসবাব এবং খেজুর থেকে তৈরি হতো মিষ্টান্ন। তারা এমনকি খাদ্য সংরক্ষণের কৌশলও জানত। বালির নিচে খাদ্য মজুত করা, রোদে শুকিয়ে রাখা শস্য, এবং মাটির কলসিতে পানি জমিয়ে রাখা ছিল  তখনকার সাধারণ প্রথা।

পশুপালন

এই সবুজ সৌদি ছিল এক বিশাল খামারের মতো। উট, গরু, ছাগল ও ভেড়া পালনের মাধ্যমে সৌদি আরব গড়ে তোলে এক সমৃদ্ধ পশুপালন-নির্ভর অর্থনীতি। সৌদির প্রাচীন গুহাচিত্রে দেখা যায় গরু, ভেড়া, ছাগল ও উটের চারণের দৃশ্য। গৃহপালিত পশু শুধু খাদ্য সরবরাহ করত না বরং ছিল পরিবহনের বাহন, কাপড়ের উপকরণ এবং ব্যবসার সম্পদ।

উট ছিল মরুভূমির জাহাজ‌। পানির উৎস খোঁজার কাজে, যাযাবর জীবনধারায় এমনকি সীমানা অতিক্রমে এর গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

বিভিন্ন অঞ্চলে গবাদিপশুর কৃত্রিম আশ্রয় এবং ঘাস উৎপাদনের জন্য মাটি খুঁড়ে জলাভূমি তৈরি করা হতো। যা ছিল অত্যন্ত উন্নত পশুপালন প্রযুক্তির নিদর্শন।

সৌদি আরবে পশু পালন

ধর্ম ও কৃষি

প্রাচীন সৌদি আরবে কৃষি শুধু জীবিকা নয়, বরং এটি ছিল আধ্যাত্মিক জীবনধারা। এখানে কৃষিকাজের সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস এমনভাবে সম্পৃক্ত ছিল যে তা প্রকৃতির প্রতি এক গভীর শ্রদ্ধাবোধের উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

প্রাচীন আরবরা বিশ্বাস করত উর্বরতা এবং ফসল সরাসরি ঈশ্বরের দান। এবং এই দানের সাথে তাদের দৈনন্দিন জীবন চলত। মরুভূমির কঠোর পরিবেশে, যেখানে পানি ছিল সীমিত, যেখানে খেজুর গাছের জন্ম ছিল এক বিশাল আশীর্বাদ। এ কারণে এই গাছকে অনেক জায়গায় ‘ঈশ্বরের বৃক্ষ’ হিসেবে পূজা করা হতো। খেজুরের পাতা, গাছ, ফল প্রত্যেকটি অংশ ছিল তাদের জীবনযাত্রার অঙ্গ, যা শুধু খাদ্য নয়, জীবনের প্রতীকও ছিল।

আরবরা আরো বিশ্বাস করত প্রকৃতি ঈশ্বরের এক বিশেষ ভাষায় কথা বলে এবং এই ভাষা বোঝার জন্য চাঁদের পূজার গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। চাঁদের অবস্থান এবং চন্দ্রপঞ্জিকা অনুযায়ী তারা বৃষ্টির সময় এবং শস্য রোপণের সঠিক সময় নির্ধারণ করত। এটি ছিল একটি আধ্যাত্মিক প্রক্রিয়া। যেখানে তারা প্রকৃতির সুরের সাথে একমত হয়ে তাদের কৃষি চক্রের পথচলা নিশ্চিত করত।

জনপদ ও শহর গঠন 

চাষ ও পশুপালনের সমন্বয়ে ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বসতি। পরবর্তীতে এ বসতি বড় হতে হতে শহর রূপে আত্মপ্রকাশ করে। যেমন উবার (Ubar), যাকে অনেকে “আটলান্টিস অব দ্য স্যান্ড” বলে থাকেন। তায়িমা ও আল-ফাও ছিল প্রাচীন সৌদির বাণিজ্যিক হাব। যেখানে কৃষিপণ্য, পশু, মশলা ও খেজুর লেনদেন হতো পারস্য ও লেভান্ট অঞ্চলের সাথে। শহরগুলোতে ছিল কূপ, গোদাম, খেজুরবাগান, বাজার এবং ধর্মীয় উপাসনালয়। এই নিদর্শনগুলো প্রমাণ করে যে সৌদি আরব কেবল মরুভূমির দেশ নয় বরং একসময়কার সমৃদ্ধ সভ্যতার কেন্দ্রও। কিভাবে এই সবুজ শ্যামল সৌদি আরব রুক্ষ মরুভূমিতে পরিণত হলো চলুন জানা যাক।

সবুজের পতন কীভাবে ঘটল

এক সময়ের সমৃদ্ধ সবুজ ভূমি যেখানে কৃষি ও পশুপালন ছিল প্রধান জীবিকা। কিভাবে সেই সমৃদ্ধ ভূমির পতন ঘটলো? 

সবুজ সৌদি আরবের পতনটি এক দীর্ঘস্থায়ী প্রক্রিয়া ছিল। যা বহু প্রাকৃতিক এবং পরিবেশগত কারণে ঘটেছিল। এর মধ্যে প্রধান কারণ ছিল জলবায়ু পরিবর্তন এবং আঞ্চলিক পরিবেশের পরিবর্তন। 

জলবায়ু পরিবর্তন

পৃথিবী সবসময়ই পরিবর্তনশীল। প্রায় ৪,০০০ বছর আগে আফ্রিকান বর্ষার রেখা দক্ষিণ দিকে সরে যাওয়া শুরু করে। যার ফলে আরব উপদ্বীপে ধীরে ধীরে শুরু হয় বৃষ্টির সংকট। নদী-নালা শুকিয়ে যায়, জলাশয় হ্রাস পায়, তৃণভূমি পরিণত হয় বালুময় ভূমিতে। মানুষজন চাষাবাদ ছেড়ে চলে যায় নতুন বসতির খোঁজে। সবুজ সৌদি হারিয়ে যায় বালির নিচে।

তীব্র খরার প্রভাব

এই সময়ের মধ্যে আরব উপদ্বীপে দীর্ঘস্থায়ী খরা দেখা দেয়। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমে যায়। ফলে কৃষি ও পশুপালনের জন্য প্রয়োজনীয় পানির সংকট সৃষ্টি হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং মাটি ক্ষয়

খরার কারণে মাটি ও ভূমির উর্বরতা কমে যেতে থাকে। যা চাষাবাদের জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে বাধা সৃষ্টি করেছিল। উদাহরণস্বরূপ তাপমাত্রা বৃদ্ধি, মাটির অর্গানিক উপাদানগুলোর ক্ষয় এবং বৃষ্টির অভাবে পরিবেশের সংকট তীব্র হতে থাকে।

মানবিক ও সামাজিক প্রভাব

এই পরিবেশগত পরিবর্তনের সাথে সাথে স্থানীয় জনগণ বাধ্য হয়ে তাদের বসতি স্থান পরিবর্তন করতে শুরু করে। কৃষি ও পশুপালন ব্যবস্থা আর্থিক ও সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করে। যার ফলস্বরূপ পুরনো জনপদ এবং বাণিজ্যক শহরগুলো পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে।

পশু-পাখির প্রভাব 

উট, ছাগল, ভেড়া ও অন্যান্য গবাদি পশুদের জন্য যেসব প্রাকৃতিক ঘাস ও খাদ্য সংগ্রহস্থল ছিল সেগুলো হারিয়ে যাওয়ার কারণে স্থানীয় জনগণের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়। কৃষি, পশুপালন এবং বাণিজ্য ভেঙে পড়লে জনসংখ্যার অনেক অংশ স্থানান্তরিত হয় এবং ছোট ছোট গ্রামগুলি ধীরে ধীরে জনশূন্য হয়ে পড়ে।

সবুজ সৌদি আরবের পতনটি শুধুমাত্র পরিবেশগত কারণেই নয় বরং রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কারণে দ্রুততর হয়ে ওঠে। এভাবেই জন্ম হয় আমাদের আজকের পরিচিত ‘মরুভূমি সৌদি’।

আধুনিক অনুসন্ধান ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা

বিজ্ঞানীরা আজ সৌদি আরবের নিচে বিশাল ভূগর্ভস্থ নদী, প্রাচীন ফারাওনিক খাল ও জলাশয় আবিষ্কার করছেন। ‘গ্রিন অ্যারাবিয়া’ প্রকল্পে অংশ নিয়ে গবেষকরা বলছেন, ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ধারায় এই অঞ্চল আবারও আর্দ্র হতে পারে।

সৌদি সরকার ‘Green Saudi’ ও ‘Middle East Green Initiative’-এর মাধ্যমে এই হারানো সবুজ ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে কাজ করছে। গাছ রোপণ, পানি সংরক্ষণ এবং আধুনিক কৃষির সম্ভাবনা নিয়ে। তাদের স্বপ্ন মরুভূমিতে আবারো সবুজ ফসলের ঢেউ।

ভবিষ্যতের সৌদিতে কি ফিরতে পারে সবুজ দিনগুলো?

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে আবারও সৌদি আরবে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়তে পারে। বিজ্ঞানীরা বলছেন সঠিক ব্যবস্থাপনা, পানি সংরক্ষণ, ও নতুন কৃষি প্রযুক্তির মাধ্যমে আবারও সৃষ্টি হতে পারে একটি সবুজ সৌদি।

প্রশ্ন রয়ে যায় আমরা কি ইতিহাসের সেই চাকা আবার ঘুরিয়ে দিতে পারবো?

এই হারিয়ে যাওয়া সবুজ সৌদি আমাদের শেখায় প্রকৃতি বদলায়, সভ্যতা গড়ে ওঠে, আবার পতনও ঘটে। কিন্তু আশার কথা হলো এই ইতিহাস ভবিষ্যতের অনুপ্রেরণা হতে পারে। হয়তো একদিন মরুভূমির বুক চিরে আবারও গমের ঢেউ উঠবে, খেজুরগাছে ভরে যাবে শহর আর মানুষ ফিরিয়ে আনবে হারানো কৃষিসভ্যতার গৌরব।

তথ্যসূত্র-

Related posts

নিউ ইয়ার রেজ্যুলুশন সত্যি নাকি মিথ !!

এডগার অ্যালান পো-এর মৃত্যু রহস্য: দুর্ঘটনা, হত্যা নাকি ষড়যন্ত্র?

পৃথিবীর প্রথম ভিডিও গেমের গল্প

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More