‘তাঁর রচনার জগতে ঢুকলেই পাঠক বুঝতে পারেন—এটা নিছক হাসির গল্প নয়, বরং গভীর এক দার্শনিক ফ্যান্টাসির জগৎ, যা আমাদের চিন্তাভাবনার সীমাকে একটা ধাক্কা দেয়।’
এখনকার ব্রেইনরট (brainrot) কনটেন্টের সাথে আমাদেরকে শতবছর পূর্বেই পরিচয় করিয়েছেন সুকুমার রায়। ব্রেইনরট কনটেন্ট বলতে এমন কিছু যা যুক্তিহীন, অদ্ভুত এবং মাঝে মাঝে এতটাই অবাস্তব যে তা হঠাৎ করে আমাদের চিন্তার সীমাকে আঘাত করে; কল্পনা করতে বাধ্য করে যে, আমরা স্বাধীন তা তাঁর সৃষ্টিই আমাদের প্রথম দেখিয়েছে। কল্পনা বাস্তবের বাইরেও আমরা করতে পারি। তা অ্যাবসার্ড, যুক্তিহীন বা অবাস্তব হোক, কিন্তু তা আমাদের কল্পনার এক অন্য জগৎ যেখানে বিচরণ করতে আমাদের কোন মানা নেই। এটাই কল্পনার সুপার পাওয়ার।
বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে যাঁরা একাধারে লেখক, শিল্পী, চিন্তক ও সংস্কৃতির ধারক, সুকুমার রায় তাঁদের শীর্ষে অবস্থান করেন। শিশুসাহিত্যকে তিনি যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন, তা কেবল সাহিত্য নয়, কল্পনা এবং এবসার্ডিটির এক অভিনব মিশ্রণ। আমাদের কল্পনায় এক নতুন বিস্তার দিয়েছেন যে ব্যক্তি তিনি হলেন সুকুমার রায়। তাঁর রচনার জগতে ঢুকলেই পাঠক বুঝতে পারেন—এটা নিছক হাসির গল্প নয়, বরং গভীর এক দার্শনিক ফ্যান্টাসির জগৎ, যা আমাদের চিন্তাভাবনার সীমাকে একটা ধাক্কা দেয়। তাঁর এই রচনার জগৎ কোনোভাবেই একটা লাইফ চেঞ্জিং অভিজ্ঞতার কম নয়। এইজন্যেই তিনি ‘ননসেন্স লিটারারি’ এর প্রবর্তক হিসেবে বিশ্ববিখ্যাত।
সুকুমার রায়ের জীবন ও সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
সুকুমার রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালে, এক সমৃদ্ধ পরিবারে। তাঁর পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী যিনি নিজেও ছিলেন সাহিত্যিক ও চিত্রকর। তিনি এমন এক পরিবেশে বড় হয়েছেন যেখানে তিনি বিজ্ঞান, সাহিত্য, চিত্রকলা ও মুদ্রণকলায় পারদর্শিতা অর্জন করেন। কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে অনার্স শেষ করার পর ইংল্যান্ড থেকে ফটোগ্রাফি ও প্রিন্টিং টেকনোলজিতে উচ্চশিক্ষা নিয়ে আসেন, যা পরে তাঁর শিল্পধারায় ফুটে ওঠে।
সুকুমার রায় তাঁর পিতা উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত ‘সন্দেশ’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করে শিশু-কিশোরদের জন্য মানসম্পন্ন সাহিত্য উপস্থাপন করেন। সাহিত্যিক হিসেবে সুকুমার রায়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তাঁর ভাষার খেলা—শব্দের রূপান্তর, নতুন শব্দ সৃষ্টি, ছন্দ ও ধ্বনির মেলবন্ধন। তাঁর লেখায় যেমন রয়েছে ব্যঙ্গ, তেমনি রয়েছে সূক্ষ্ম দার্শনিক ইঙ্গিত।
সুকুমার রায়ের চরিত্র নির্মাণ
সুকুমার রায়ের তৈরি সবগুলো চরিত্রই ছিল সাধারণ পরিচিত ধরনের চরিত্রের বাইরে। যেমন ‘পাগলা দাশু’ চরিত্রটি ধরুন—সে অদ্ভুত, ব্যতিক্রমী, সমাজ-স্বীকৃত শিষ্টাচারের তোয়াক্কা না করেও যেন একধরনের ‘লজিক্যাল ইলজিক’ নিয়ে আসে। আবার ‘হযবরল’-এর চরিত্রগুলো—যেমন হুঁকোমুখো হ্যাংলা, বকচ্ছপ, গাবগুবি ইত্যাদি—তাদের নাম যেমন স্বাভাবিকতাকে ভেঙে ফেলে, তাদের অস্তিত্বও তেমনি বিকল্প বাস্তবতার প্রতিনিধি।
তিনি এই ধরনের চরিত্র তৈরির মাধ্যমে আমাদেরকে ভাবাতে শেখায় যদি আমরা বাস্তবতার বাইরে আচরণ করি তাহলে কেমন হতো ব্যাপারটা। সমাজের যেগুলোকে আমরা অতি সাধারণ বাস্তবতা ভেবে রাখি, যেগুলো অন্যায় হলেও আমরা মেনে নিই অথবা বলা যায় যে অন্যায়গুলোকে আমরা নরমালাইজ করি। আবার যে সাধারণ জিনিসগুলোকে সমাজে অন্যায় বলে আখ্যায়িত করা হয় এই সকল জিনিসকে নিয়ে তিনি আমাদের ভাবিয়েছেন। সমাজের বিভিন্ন ইলজিক্যাল লজিকগুলোকে তিনি আমাদের সামনে খুব ভিন্ন শব্দচয়নের তুলে ধরেছেন।
‘আবোল তাবোল’: এবসার্ডিটি ও ফ্যান্টাসির জয়গান
১৯২৩ সালে প্রকাশিত ‘আবোল তাবোল ‘ বাংলা সাহিত্যে ফ্যান্টাসির প্রথম সুসংগঠিত প্রয়োগ হিসেবে বিবেচিত হয়। এখানে যেসব চরিত্র আমরা দেখি—খাঁ খাঁ দাড়িওয়ালা যমরাজ, হিঙে খাওয়া বাবাজী, উল্টো রাজার সভা—সবই বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন, অথচ আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়মগুলোকে বিদ্রুপ করে।
এখানে এবসার্ডিটিকে সাহিত্য হিসেবে সুকুমার রায় চমৎকারভাবে ব্যবহার করেন। যুক্তিহীন পরিস্থিতি সৃষ্টি করে তিনি সমাজের প্রথা ও কৃত্রিম নিয়মকে ব্যঙ্গ করেন।
সুকুমার রায়ের কিছু বিখ্যাত চরিত্র বিশ্লেষণ
১. পাগলা দাশু – যুক্তিহীনতার মধ্যে লুকোনো সামাজিক চেতনা
“পাগলা দাশু”। তিনি “পাগল” হলেও শিশুদের কাছে নায়কসুলভ। কারন সে সবসময় তার যেটা প্রয়োজন করার বা সে যেটা চায় সে সেটাই করছেন। এই করতে গিয়ে তার সিদ্ধান্ত সবসময় যুক্তির বাইরে হয়েছে, অথচ একরকম লজিকও অনুসরণ করে। সে যেন সবসময়ই সবার যে এক ধাপ উপরে থাকে।
পাগলা দাশু বাস্তবতার গণ্ডি ভেঙে ফেলে—সে যেমন “ওড়া” বা “স্কুল চালানো” নিয়ে কথা বলে, তেমনি সমাজের কাঠামোগত অযৌক্তিকতাকেও মজা করে উন্মোচন করে। শিশুর চোখে সে এক ফ্যান্টাসি হিরো, কিন্তু পাঠকের মনে সে কাঠামোগত ব্যঙ্গের প্রতীক।
এখানে এবসারডিটি যুক্তিহীনতায় নয়, বরং অতিরঞ্জিত বাস্তবতায়—যা পাঠককে প্রথমে হাসায়, পরে ভাবায়।
২. গঙ্গারাম –যুক্তিবহ ব্যঙ্
গঙ্গারাম হলো এই কবিতার মূল চরিত্র, যাকে নিয়ে বিয়ের প্রস্তাবের কথাবার্তা চলছে। কিন্তু ‘সৎ পাত্র’ হওয়ার দাবির পেছনে তার যা যা “যোগ্যতা” তা আসলে পুরোপুরি বেমানান ও ব্যঙ্গাত্মক। গঙ্গারাম উনিশবার ম্যাট্রিক ফেল করেছে। এটাই তার ‘অধ্যবসায়ের প্রমাণ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তার পরিবারে আছে পাগল, গোঁয়ার, জাল নোটের অপরাধী ও যাত্রাদলের তবলাবাদক তাদের অবস্থাও ব্যঙ্গের বিষয়। সে নিজে পিলের জ্বর ও পাণ্ডু রোগে ভোগে,তবুও বলা হয় সে ‘মন্দ নয়’। “কংসরাজের বংশধর” এর জাতীয়ত্ব ও বংশগৌরব দিয়েই সব অপূর্ণতা আড়াল করার চেষ্টা করা হয়েছে।
এখানে কিছু ব্যঙ্গাত্মক ফ্যান্টাসির উপাদান রয়েছে। যেমন “উনিশবার ম্যাট্রিক ফেল”, কিংবা “কংসরাজের বংশধর” হওয়ার দোহাই। কিন্তু এখানে যে গুণগুলো থাকলে আসলে পাত্রটি অযোগ্য হওয়ার কথা সেখানে তার এক বংশপরিচয় খোদ বাকি দোষ ঢেকে ‘সৎ পাত্র’ করে তুলছে। এখানে আমাদের বাস্তব সমাজের অনেক বড় একটি এবসারডিটি ফুটে উঠেছে। সমাজের চোখে যোগ্য পাত্রের বৈশিষ্ট্যের যে আসলে কোনো যুক্তি নাই বা তা নিতান্তই এক এবসার্ড স্ট্যান্ডার্ড তা তিনি দেখিয়ে দিয়েছেন।
৩. ‘কাতুকুতু বুড়ো’ – একটি হাস্যকর অথচ ভয়ংকর সত্তা
‘কাতুকুতু বুড়ো’-র অস্তিত্ব যেন শিশুর কল্পনার ভয়ঙ্কর এক দানব, কিন্তু সে দানব আবার মজা করেই আক্রমণ করে। তিনি একজন রহস্যময় বুড়ো যার কাছে গেলে তিনি গল্প না শুনায় ছাড়েন না। সে এমন সব গল্প শোনায় যার কোনও মাথামুণ্ডু নেই, এবং জোর করে শুনতে বাধ্য করে। শুধু তা নয়, তার কাছে গল্প শুনে হাসতে হবে। না হাসা পর্যন্ত তিনি ছাড়বেন না। দরকারে তিনি শরীরে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসতে বাধ্য করে।
এই কবতায় কাতুকুতুর কুলপি’ বা ‘লম্বা ডিম’ কিংবা ‘কচুর গায়ে আলপনা’ এসব কাল্পনিক উপাদান দিয়ে একটি রাজ্য তৈরি করা হয়েছে। যেখানে এবসারডিটি ফুটে উঠেছে তার গল্পে, তার হাসানোর পদ্ধতিতে এবং ‘হাসতেই হবে’ এই অযৌক্তিক আদেশে। যেখানে গল্প শোনার মতোই জিনিস, সবাই গল্প করতে ও শুনতে ভালোবাসে সেখানে এই কবিতায় সবাই গল্প শুনতেই ভয় পাচ্ছে।
এভাবে তিনি এমন একটা জগৎ তৈরি করতেন তার লেখা মাধ্যমে যেখানে সব কিছুই ভিন্ন ভাবে হয়, যেন এক ভিন্ন জগৎ; বাস্তবতার একদম বাইরে। কিন্তু সেই বাস্তবতার বাইরের জগতে আমাদের বাস্তব জগতের মত কাজগুলো কেন হচ্ছে না তা নিয়েও ভাবিয়ে তুলতেন তিনি পাঠককে। অর্থাৎ এই ফ্যান্টাসির দুনিয়ায় কেন এই এবসার্ড কাজগুলো হচ্ছে তা ভাবার মাধ্যমে পাঠকের মনে বাস্তব সমাজের এবসার্ডিটি নিয়ে প্রশ্ন তৈরি হয়।
সুকুমার রায়ের ফ্যান্টাসি সাহিত্য বিশ্লেষণ
ফ্যান্টাসির মূল গুণ হলো কল্পনাশক্তির মুক্ত প্রকাশ। সুকুমার রায়ের গল্পের ফ্যান্টাসি উপাদানগুলো বাস্তবতার এক বিকল্প চিত্র আঁকে। উদাহরণস্বরূপ, হযবরল বা পাগলা দাশু-তে দেখা যায় চরিত্ররা নিয়ম ভাঙে, যুক্তিকে উল্টো করে দেয় কিন্তু তার মাঝেই ফুটে ওঠে সামাজিক ন্যায়-অন্যায়, যুক্তির সীমাবদ্ধতা এবং এই বাস্তবতায় আটকে থাকা আমরা।
আমদের কাছে এই রচনাগুলো শুধু নিছক হাস্যরস নয়, বরং সমাজের মানবিক মূর্খতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে এক রূপকধর্মী প্রতিবাদ। আর এখানেই সুকুমার রায়ের লেখা ব্যঙ্গ ও কল্পনার মিশ্রণ অনন্য হয়ে ওঠে।
সুকুমার রায়ের কবিতায় এবসার্ডিটি বিশ্লেষণ
আধুনিক সাহিত্যতত্ত্বে এবসার্ডিটির মূল উদ্দেশ্য হল মানুষের অস্তিত্বগত জটিলতা ও অর্থহীনতা তুলে ধরা। সুকুমার রায় শিশুদের জন্য লেখার মধ্য দিয়েই তাঁর দার্শনিকতা তুলে ধরেছেন। এইভাবেই তিনি আবোল তাবোল বা হযবরল-এ যুক্তিহীনতা (absurdity), উলটোপালটা কাহিনি, অসামঞ্জস্যপূর্ণ চরিত্রগুলোর মাধ্যমে তিনি এবসার্ড সাহিত্যের ভিত্তি স্থাপন করেন বাংলায়। এইসব কবিতায় বিষয়বস্তু তুচ্ছ মনে হলেও, এগুলো অনেক সময়ই সমাজব্যবস্থার অযৌক্তিকতাকে ব্যঙ্গ করে।
সুকুমার রায় এবং বাংলা শিশু সাহিত্যে হাস্যরস
বাংলা সাহিত্যে হাস্যরস বরাবরই একটি শক্তিশালী উপাদান, তবে সুকুমার রায় সেটিকে শিশুসাহিত্যের কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তিনি তার দার্শনিকতাকে হাস্যরসের মাধ্যমে খুব সূক্ষ্মভাবেই ছোটদের পড়ার উপযোগী করে তাঁর লেখায় লিখেছেন। এগুলো শুধু তাদেরকে নতুন এক কাল্পনিক জগতে বিচরণ করায়নি, বরং তাদেরকে ছোটবেলা থেকেই ভাবতে শিখিয়েছে। এর মাধ্যমেই তিনি শিশুদের কল্পনাশক্তি বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
তাঁর ‘লুইক গুইক’ জাতীয় অদ্ভুত শব্দের পেছনে আছে এক গভীর শিল্পবোধ। শব্দের অদ্ভুত প্রয়োগ, অর্থহীন বাক্য, যুক্তিবিচ্যুত অবস্থা—সব মিলিয়ে এটি পরিণত হয় এক বিশেষ ঘরানার সাহিত্যিক কৌশলে। সুকুমার রায়ের এই কৌশলকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে আধুনিক সাহিত্যে একে “Absurd Literature” বা “Nonsense Verse” ধারা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
এই শব্দগুলোর প্রয়োগ অচেনা কিন্তু এক আনন্দময় অনুভূতি সৃষ্টি করে। প্রথম প্রথম পড়লে এগুলোকে অর্থহীন মনে হলেও সুকুমার রায় তার লেখায় এই শব্দগুলো প্রয়োগের মাধ্যমে পাঠককে নতুন অর্থের সম্ভাবনা চিনতে শেখায়। যেমন “যেই গোঁফে রোদের ঘ্রাণ, সেই গোঁফে পেঁয়াজের টান”—এমন বাক্য বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, এখানে বাস্তবতাকে ভেঙে কল্পনার ফ্রেমে পুনর্গঠন করার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিশোর সাহিত্যে সুকুমার রায়ের অবদান
বাংলা কিশোর সাহিত্য বলতে আমরা অনেকেই প্রথমেই ‘ফেলুদা’ বা ‘টেনিদা’র কথা ভাবি, তবে সেগুলোর অনেক আগে থেকেই সুকুমার রায় শিশু ও কিশোর পাঠকদের জন্য তৈরি করেছিলেন এক বিস্ময়কর কল্পনার জগৎ। যেখানে বাস্তবের বালুকাবেলায় পা ডুবিয়ে তারা চলে যেতে পারে জাদুকরী জগতে।
তাঁর সাহিত্য শুধু বিনোদন নয়, বরং এক মনস্তাত্ত্বিক অনুশীলন। যা শিশুর কল্পনাশক্তি বাড়ায়, সমাজ নিয়ে চিন্তা করতে শেখায়। তাঁর রচনায় বিনোদন কেবল বাইরের আবরণ। এর ভেতরে ছিল শিশুর কল্পনাশক্তিকে উসকে দেওয়ার জাদু, যুক্তিবোধকে উল্টেপাল্টে দেখার খেলা, আর সমাজের নানা বিষয় নিয়ে ভাবনার সূক্ষ্ম বুনন। “আবোল তাবোল”, “পাগলা দাশু” কিংবা “হযবরল”-এর প্রতিটি চরিত্র ও পরিস্থিতি যেন একটি বিকল্প বাস্তবতার দরজা খুলে দেয়।এই কারণে, ত্যুর শত বর্ষ পরেও তিনি বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে জনপ্রিয় শিশুসাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম একজন।
সুকুমার রায়ের আর্ট ও শিল্পধারা
লেখালিখির পাশাপাশি সুকুমার রায় ছিলেন একজন দক্ষ শিল্পী। সন্দেশ পত্রিকায় তিনি নিজেই অনেক ছবির স্কেচ তৈরি করতেন। তাঁর আর্টও ছিল ‘অবাস্তব বাস্তব’-এর এক চিত্ররূপ। অদ্ভুতদর্শন প্রাণী, উলটোপালটা বস্তু, অসম্ভব সংমিশ্রণ—সবই যেন তাঁর লেখা ও ছবির মধ্য দিয়ে বাস্তবতার সীমা ভেঙে দেয়।
তাঁর শিল্পধারা প্রকৃত অর্থে বাংলায় ‘ডাডা’ বা ‘সাররিয়ালিজম’-এর পূর্বাভাস দিয়ে যায়। এই কৌশলই পরবর্তীতে আরও অনেক শিল্পমাধ্যমে প্রভাব ফেলেছে।
ফ্যান্টাসি বাংলা সাহিত্য: উত্তরাধিকার ও বিস্তার
বাংলা ফ্যান্টাসি গল্পের প্রথম দিককার উদাহরণ হিসেবেই সুকুমার রায়ের নাম আসে। পরবর্তীতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, সত্যজিৎ রায় প্রমুখ লেখকদের লেখাতেও ফ্যান্টাসির ছোঁয়া দেখা যায়। তবে সুকুমার রায়ের ফ্যান্টাসি ছিল অদ্বিতীয়, কারণ তা কেবল মনোরঞ্জনের জন্য নয়—বরং একটি দার্শনিক অনুসন্ধানের জন্য।
সুকুমার রায়ের সাহিত্য মানে নিছক ‘আবোল তাবোল’ নয়। তাঁর ফ্যান্টাসি মানে বাস্তবকে নতুন চোখে দেখা। যুক্তিকে প্রশ্ন করা, প্রচলিত সমাজকে প্রশ্ন করা। তাঁর লেখা প্রমাণ করে, শিশুসাহিত্যও হতে পারে দার্শনিক এবং প্রতিবাদী। কিশোর সাহিত্যে তাঁর অবদান এবং বাংলা সাহিত্যে এবসার্ডিটির সূচনা বাংলা সাহিত্যকে দিয়েছে নতুন এক উচ্চতা।
তাঁর কবিতা, গল্প, আর্ট ও ব্যঙ্গ সব মিলিয়ে গড়ে উঠেছে এক এমন জগত—যেখানে কল্পনা ও এবসার্ডিটি হাত ধরাধরি করে হাঁটে, আর পাঠক বিস্ময় নিয়ে বলে ওঠে, “এ যে এক অদ্ভুত দুনিয়া!”