জিহ্বা, গাল এবং পিঠ ভেদ করে ঢোকানো হয়েছে ধারালো ত্রিশূল, তবুও ভক্তদের মুখে নেই কোনো ব্যথার চিহ্ন! থাইপুসাম বিশ্বের অন্যতম বিস্ময়কর হিন্দু উৎসব, যেখানে বিশ্বাস আর ভক্তি জয় করে নেয় শারীরিক যন্ত্রণাকে।
কল্পনা করুন, হাজার হাজার ভক্তের এক বিশাল শোভাযাত্রা। তাদের মুখে ভগবান মুরুগানের নাম, বাতাসে কর্পূর আর ধূপের সুগন্ধ, আর চারদিকে ঢাকঢোলের উন্মাদনা। কিন্তু এই শোভাযাত্রার যা সবচেয়ে বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করে, তা হলো ভক্তদের আত্মত্যাগের এক চরম দৃশ্য। কারো গাল বা জিহ্বা ভেদ করে চলে গেছে এক দীর্ঘ ধাতব ত্রিশূল, কারো পিঠে বড়শির মতো হুক দিয়ে আটকানো রশি দিয়ে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে বিশাল রথ, আবার কারো সারা শরীরে বিদ্ধ করা হয়েছে শত শত ছোট ছোট বর্শা।
দৃশ্যটি দেখতে যতই ভয়ঙ্কর বা কষ্টকর মনে হোক না কেন, সবচেয়ে অবাক করা বিষয় হলো এই ভক্তদের মুখে ব্যথার কোনো চিহ্ন নেই! তাদের চোখ বন্ধ, শরীর এক অদ্ভুত ঘোরের মধ্যে দুলছে, আর তারা অবিরাম মন্ত্র উচ্চারণ করে এগিয়ে চলেছে। এটিই থাইপুসাম, বিশ্বের অন্যতম নাটকীয় এবং বিস্ময়কর এক হিন্দু ধর্মীয় উৎসব।
এই উৎসবটি দেখলেই মনে প্রশ্ন জাগে, কীভাবে এটা সম্ভব? ভক্তরা শরীর বিদ্ধ করেও কেন কষ্ট পায় না? এটি কি শুধুই কোনো ঐশ্বরিক ব্যাপার, নাকি এর পেছনে লুকিয়ে আছে কোনো গভীর মনস্তাত্ত্বিক বা বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা?
থাইপুসাম উৎসবের ইতিহাস ও পৌরাণিক তাৎপর্য
থাইপুসাম মূলত একটি তামিল হিন্দু উৎসব, যা প্রতি বছর তামিল ‘থাই’ মাসের (জানুয়ারি/ফেব্রুয়ারি) পূর্ণিমার দিনে, যখন ‘পুসাম’ নক্ষত্রটি আকাশে সবচেয়ে উজ্জ্বল থাকে, তখন পালিত হয়। এই উৎসবটি ভগবান শিব ও দেবী পার্বতীর পুত্র, যুদ্ধের দেবতা ভগবান মুরুগান (কার্তিক বা সুব্রহ্মণ্য নামেও পরিচিত)-কে উৎসর্গ করা হয়।
এর পেছনের পৌরাণিক কাহিনীটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিংবদন্তি অনুযায়ী, একসময় সুরপদ্ম নামক এক ভয়ংকর অসুর দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়িত করে মহাবিশ্বে অত্যাচার চালাচ্ছিল। দেবতারা তখন ভগবান শিবের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন। দেবতাদের রক্ষা করার জন্য, দেবী পার্বতী তার নিজের শক্তি থেকে একটি ঐশ্বরিক বর্শা বা ‘ভেল’ (Vel) তৈরি করে তার পুত্র মুরুগানের হাতে তুলে দেন। এই ‘ভেল’ ছিল জ্ঞান, শক্তি এবং অশুভ বিনাশের প্রতীক। এই পবিত্র দিনে মুরুগান সেই ভেল গ্রহণ করে অসুর সুরপদ্মকে পরাজিত করেন এবং মহাবিশ্বে শান্তি ফিরিয়ে আনেন।
এই পৌরাণিক ঘটনাকে স্মরণ করেই থাইপুসাম উৎসব পালিত হয়। এটি অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ শক্তির জয় এবং ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস ও ভক্তির এক প্রতীকী উদযাপন।
শরীর বিদ্ধকরণ: আত্মত্যাগ ও কৃতজ্ঞতার এক চরম তপস্যা
থাইপুসাম উৎসবের সবচেয়ে আলোচিত দিকটি হলো এর কষ্টকর তপস্যা বা ব্রত, যার মধ্যে শরীর বিদ্ধকরণ একটি প্রধান অংশ। কিন্তু ভক্তরা কেন স্বেচ্ছায় এই চরম কষ্টকে বরণ করে নেন?
এর পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে:
১. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ: অনেক ভক্ত মানত করেন যে, যদি ভগবান মুরুগান তাদের কোনো মনস্কামনা (যেমন অসুখ থেকে মুক্তি, সন্তানের জন্ম বা ব্যবসায় সাফল্য) পূর্ণ করেন, তবে তারা থাইপুসামের দিন নিজেদের শরীরকে কষ্ট দিয়ে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন।
২. পাপমোচন ও আত্মশুদ্ধি: আবার অনেকে বিশ্বাস করেন যে, এই কঠোর তপস্যার মাধ্যমে তারা তাদের অতীত জীবনের পাপমোচন করতে পারেন এবং আধ্যাত্মিকভাবে নিজেদের শুদ্ধ করতে পারেন।
এই তপস্যার অংশ হিসেবে ভক্তরা বিভিন্ন ধরনের ‘কাবাড়ি’ (Kavadi) বহন করেন। ‘কাবাড়ি’ শব্দের অর্থ ‘কাঁধে ভার বহন করা’। এটি হতে পারে দুধের পাত্র বা ফুলের মালা দিয়ে সাজানো একটি সাধারণ কাঠের কাঠামো, অথবা হতে পারে শত শত বর্শা এবং হুক দিয়ে সজ্জিত এক বিশাল, ভারী লোহার খাঁচা, যা ভক্তের শরীর ভেদ করে আটকানো থাকে।
- ভেল বিদ্ধকরণ: সবচেয়ে সাধারণ দৃশ্য হলো গাল বা জিহ্বার মধ্যে দিয়ে একটি ছোট বা বড় ত্রিশূল বা ‘ভেল’ প্রবেশ করানো। জিহ্বা বিদ্ধ করার একটি প্রতীকী অর্থ হলো, ভক্ত তার কথা বলার ক্ষমতাকে ঈশ্বরের কাছে উৎসর্গ করছেন এবং নীরবতার মাধ্যমে তপস্যা করছেন।
- হুক ও রথ: কিছু ভক্ত তাদের পিঠের চামড়ায় বড়শির মতো হুক বিদ্ধ করে, সেই হুকের সাথে বাঁধা দড়ি দিয়ে বিশাল এবং ভারী রথ টেনে নিয়ে যান, যা তাদের সহনশীলতার এক চূড়ান্ত পরীক্ষা।
ব্যথাহীনতার রহস্য: কীভাবে সম্ভব এই অবিশ্বাস্য কীর্তি?
এখন আমরা সেই মূল প্রশ্নে আসি, এতটা যন্ত্রণা সত্ত্বেও ভক্তরা কেন ব্যথা অনুভব করেন না বা তাদের শরীর থেকে কেন খুব কম রক্তপাত হয়? এর উত্তর লুকিয়ে আছে আধ্যাত্মিক বিশ্বাস এবং বিজ্ঞানের এক জটিল সমন্বয়ে।
১. আধ্যাত্মিক এবং মনস্তাত্ত্বিক প্রস্তুতি:
থাইপুসামের এই কঠোর তপস্যা কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়। এর জন্য ভক্তরা প্রায় ৪৮ দিন বা তারও বেশি সময় ধরে এক কঠিন প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে যান।
- কঠোর উপবাস: এই সময়ে তারা শুধুমাত্র নিরামিষ বা সাত্ত্বিক খাবার গ্রহণ করেন এবং অনেকেই দিনে একবার মাত্র আহার করেন।
- ব্রহ্মচর্য পালন: তারা জাগতিক সুখ এবং শারীরিক সম্পর্ক থেকে নিজেদের দূরে রাখেন।
- নিরন্তর প্রার্থনা ও ধ্যান: প্রতিদিন তারা ভগবান মুরুগানের প্রার্থনা, মন্ত্র জপ এবং ধ্যানের মাধ্যমে নিজেদের মনকে প্রস্তুত করেন।
এই দীর্ঘমেয়াদী শারীরিক এবং মানসিক প্রস্তুতি তাদের মনকে এক অন্য স্তরে নিয়ে যায়। তারা জাগতিক অনুভূতি, বিশেষ করে ব্যথা এবং ভয়ের ঊর্ধ্বে ওঠার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হতে থাকেন।
২. ট্রান্স বা ঘোরের অবস্থা (Trance State):
উৎসবের দিন, ঢাকঢোলের একটানা শব্দ, মন্ত্রের অনুরণন এবং কর্পূরের তীব্র গন্ধ; এই সবকিছু মিলে এক সম্মোহনী পরিবেশ তৈরি করে। এই পরিবেশে, দীর্ঘ প্রস্তুতির পর, ভক্তরা এক ধরনের ট্রান্স বা ঘোরের (Trance) মধ্যে চলে যান।
এই ঘোরের অবস্থায়, তাদের চেতনা এক ভিন্ন মাত্রায় অবস্থান করে। তাদের মস্তিষ্ক বাইরের জগৎ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং তারা শুধুমাত্র তাদের আরাধ্য দেবতা ভগবান মুরুগানের উপর মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করে। এই তীব্র ফোকাস বা একাত্মতার ফলে, তাদের মস্তিষ্ক শারীরিক ব্যথার সংকেতগুলোকে আর আগের মতো গ্রহণ করে না বা সেগুলোকে উপেক্ষা করে। তারা তখন আর নিজেদের শরীরকে একটি ভঙ্গুর বস্তু হিসেবে দেখে না, বরং দেখে ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি নিবেদনের একটি মাধ্যম হিসেবে।
৩. বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা: এন্ডোরফিনের খেলা
আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের পাশাপাশি, এই ব্যথাহীনতার একটি শক্তিশালী বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও রয়েছে।
- এন্ডোরফিনের নিঃসরণ: যখন শরীর কোনো চরম চাপ বা আঘাতের সম্মুখীন হয়, তখন আমাদের মস্তিষ্ক এন্ডোরফিন (Endorphin) নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থ নিঃসরণ করে। এন্ডোরফিনকে বলা হয় ‘প্রাকৃতিক ব্যথানাশক’ (Natural Painkiller)। এটি মরফিনের চেয়েও অনেক বেশি শক্তিশালী এবং এটি ব্যথার অনুভূতিকে ব্লক করে দেয়। থাইপুসামের সময় শরীর বিদ্ধকরণের মুহূর্তে, ভক্তদের মস্তিষ্ক থেকে বিপুল পরিমাণে এন্ডোরফিন নিঃসৃত হয়, যা তাদের ব্যথার অনুভূতিকে প্রায় পুরোপুরি অসাড় করে দেয়।
- অ্যাড্রেনালিন রাশ: একই সাথে, উৎসবের উত্তেজনা এবং শারীরিক কষ্টের কারণে শরীর থেকে অ্যাড্রেনালিন (Adrenaline) হরমোনও নিঃসৃত হয়। এই হরমোন শরীরকে ‘ফাইট অর ফ্লাইট’ মোডে নিয়ে যায়, যেখানে বেঁচে থাকাটাই মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় এবং ব্যথার মতো অনুভূতিগুলো সাময়িকভাবে চাপা পড়ে যায়।
- রক্তপাতহীন বিদ্ধকরণ: অভিজ্ঞ বিদ্ধকারকরা (যারা এই কাজটি করেন) এবং ভক্তদের গভীর বিশ্বাস দুইয়ে মিলে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, বিদ্ধ করার সময় খুব কম রক্তপাত হয়। বলা হয়, তীব্র মানসিক ফোকাসের কারণে ত্বকের কৈশিক জালিকাগুলো (capillaries) সংকুচিত হয়ে যায়, যা রক্তপাত কমায়। এছাড়া, বিদ্ধ করার আগে ভস্ম বা ছাই ব্যবহার করা হয়, যা রক্ত শুষে নিতে সাহায্য করে।
থাইপুসাম উৎসব হলো মানব মনের অসীম ক্ষমতার এক জীবন্ত প্রদর্শনী। এটি আমাদের দেখায় যে, বিশ্বাস এবং ভক্তি কতটা শক্তিশালী হতে পারে, যা শারীরিক যন্ত্রণার মতো এক মৌলিক অনুভূতিকেও অতিক্রম করতে পারে। এটি আধ্যাত্মিকতা এবং বিজ্ঞানের এক সংযোগস্থল, যেখানে ট্রান্স, এন্ডোরফিন এবং ঈশ্বরের প্রতি গভীর আত্মসমর্পণ সবকিছু মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়।
ভক্তদের জন্য, এটি কোনো অলৌকিক ঘটনা নয়, এটি তাদের ভক্তিরই এক স্বাভাবিক বহিঃপ্রকাশ। তাদের কাছে, ভগবান মুরুগানই তাদের শক্তি দেন এবং সব যন্ত্রণা থেকে তাদের রক্ষা করেন। আর বিজ্ঞানীদের কাছে, এটি মানুষের মস্তিষ্ক এবং শরীরের মধ্যে থাকা সেই অবিশ্বাস্য সংযোগের এক চরম উদাহরণ, যা আমাদের আজও অবাক করে।
তথ্যসূত্র –
- https://www.numberanalytics.com/blog/thaipusam-ultimate-guide
- https://www.omastrology.com/indian-festivals/thaipusam-festival/
- https://www.oddbangla.com/2020/03/the-unknown-facts-about-thaipusam.html?m=1
- https://bangla.bdnews24.com/blog/181802
- https://yohomobile.com/bn-BD/thaipusam-festival?srsltid=AfmBOoophEz8PdHCe4O51y1XaWyPyhYAH4tdyIsLc-rw07Qhr2RkbLRs