Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

বিশ্বের নিষ্ঠুরতম মানুষ: আইভান দ্য টেরিবল

আইভান দ্য টেরিবল হঠাৎ ছেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে চুমো খেতে খেতে বললেন, ‘আমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছি, আমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছি।’

আইভান দ্য টেরিবল বা চতুর্থ আইভান ভেসিলিভিখ ছিলেন সম্পূর্ণ রাশিয়ার প্রথম জার।  ‘জার’ শব্দটি এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘সিজার’ থেকে যার অর্থ সম্রাট। তিনি নির্মমতা, নৃশংসতা ও উন্মত্তার জন্য কুখ্যাত ছিলেন ।

আইভান দ্য টেরিবল কে ছিলেন?

আইভানের বাবা তৃতীয় ভ্যাসিলি পরিচিত ছিলেন ভ্যাসিলি দ্য এডিকোয়েট নামে। তার রাজত্বকাল খুব একটা ঘটনাবহুল ছিল না, ছিল না কেলেঙ্কারিও। ভ্যাসিলির প্রথম স্ত্রী তাকে কোনো সন্তান দিতে পারেননি। বয়াররা (মধ্যযুগীয় রাশিয়ায় সমাজের উচ্চস্তরের পরিবারগুলো হচ্ছে বয়ার পরিবার) আগামী দিনের রাজা কে হবেন তা নিয়ে সঙ্কটের আশঙ্কা করতে শুরু করলেন। এর মধ্যে ভ্যাসিলি তার চেয়ে ৩১ বছরের ছোট তরুণী ও সুন্দরী এলেনা গ্লিনস্কায়াকে বিয়ে করলেন।

১৫৩০ সালের ২৫ শে আগস্ট এলেনা পুত্রসন্তানের জন্ম দেন, তার নাম রাখা হয় আইভান। আইভানের বয়স যখন তিন বছর তখন ভ্যাসিলি শিকারে যান। শিকারে গিয়ে ভ্যাসিলি মারাত্মক অসুস্থ পড়লেন, দুরারোগ্য ব্যাধিতে মারা গেলেন তিনি।

এ সময় শাসক পরিষদ শাসনকার্যের জন্য অত্যন্ত ছোট আইভানকেই ‘গ্র্যান্ড প্রিন্স অব মস্কো’ ঘোষণা করে। কারণ তিনিই একমাত্র রাজপুত্র। তবে অভিভাবক হিসেবে দেশ পরিচালনার দায়িত্ব চলে যায় আইভানের মা এলেনার কাঁধে।

রাজপ্রতিনিধি হিসেবে এলেনার পাঁচ বছরের শাসনকালে রাশিয়ায় ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে বয়ার পরিবারগুলোর সাথে। এলেনা ছেলেকে বেশিদূর এগিয়ে দিয়ে যেতে পারেননি; ১৫৩৮ সালে মাত্র ২৮ বছর বয়সে তার মৃত্যু হলো। আইভান তখন আট বছরের এতিম বালক। এলেনাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছে এমন রটনা আছে। কিছু ধরপাকড় করা হলেও তা প্রমাণিত হয়নি।

মা মারা যাবার পর আইভানের অভিভাবকের দায়িত্ব পায় বয়াররা। সংবেদনশীল এবং মেধাবী আইভানের ভাবলেশহীন নির্দয় ব্যক্তিতে পরিণত হবার পেছনে এ পর্যায়ের অভিভাবকদেরও অবদান রয়েছে। তারা আইভানের সাথে যথেষ্ট খারাপ ব্যবহার করতো। অবহেলিত হতে হতে একসময় তাদের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেন আইভান। কথিত আছে, হতাশা দূর করতে বালক আইভান প্রায়ই বিড়াল, কুকুর এবং অন্যান্য পোষা প্রাণীর উপর অত্যাচার চালাতেন!

নিজেদের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে ক্ষমতাশালী বয়াররা এতো ব্যস্ত হয়ে পড়েন যে তাদের গ্র্যান্ড প্রিন্স আইভান নিজেই লিখেছেন যে তাকে বহুদিন অনাহারেও থাকতে হয়েছ, জীর্ণ পুরোনো পোশাক পরতে হয়েছে। প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা তখনই তার মনে জাগে; বয়ারদের প্রতি তার আমৃত্যু ঘৃণার শুরুটা এভাবেই।

আইভান দ্যা টেরিবল

আইভানের শাসনকাল

১৬ বছর বয়সে আইভান কেবল ‘গ্র্যান্ড প্রিন্স অব মস্কো’তে সন্তুষ্ট থাকতে চাইলেন না, হতে চাইলেন সমগ্র রাশিয়ার জার। জার হিসেবে তার শাসনকাল ১৫৪৭ থেকে ১৫৮৪। 

তরুণ জারের একজন সঙ্গিনী জারিৎসাও প্রয়োজন। তিনি বিয়ে করবেন জানার পর ১৫০০ সুন্দরী তরুণীকে তার সামনে হাজির করা হলেও তিনি বেছে নিলেন আনাস্তাসিয়া রোমানোভাকে। আনাস্তাসিয়া তার জীবনের শ্রেষ্ঠ পছন্দ এবং শ্রেষ্ঠ সিদ্ধান্ত।

আইভানের অভিষেকের বছরই দ্য গ্রেট মস্কো ফায়ার এ শহরটি তার চোখের সামনে পুড়ে গেল। ৪০০০ মৃত্যু হলো, ঘরশূন্য হলো ৮০ হাজার মানুষ।

কিছুকাল পর আইভান ভয়ঙ্কর অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বয়াররা ঠিক করলেন আইভানের চাচাতো ভাই ভ্লাদিমিরকে জার নিযুক্ত করবেন। কিন্তু সকলকে অবাক করে আইভান সুস্থ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং এবার ভিন্ন চেহারায়। প্রতিশোধের চেহারা। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা বয়ারদের সরাতে শুরু করলেন, যুদ্ধ শুরু করে দিলেন সকল নিকট ও কখনো দূরবর্তী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধেও। তিনি সাম্রাজ্য সীমানা বাড়াবেন।

‘অ্যাবসলুট পাওয়ার’ লাভ করে তিনি হয়ে উঠলেন ভয়ঙ্কর। নতুন ক্ষমতায় তিনি সৃষ্টি করলেন কালো পোশাকের ৬০০০ গোপন পুলিশের সংগঠন। এই পুলিশি রাজত্বের নাম ‘অপ্রিচনিনা।’ আদেশ পেলে তারা আইভান দ্য টেরিবলের জন্য ভয়ঙ্কর সব সহিংসতার ঘটনা ঘটাবে। যে বয়ারগণ তাকে সর্বময় ক্ষমতা দিয়েছে তারাই হলেন আইভানের প্রথম বলি। 

অপ্রিচনিনা

‘আইভান দ্যা টেরিবল’ হয়ে ওঠার গল্প

আইভানের কুখ্যাত হওয়ার পেছনে রয়েছে একটি বিশেষ পটভূমি। এই পটভূমি সম্বন্ধে খুব একটা জানা যায় না । তবে শৈশবে বাবাকে হারানো এর একটি বড় কারণ। অন্যদিকে শিশুকাল থেকেই মার সঙ্গ না পেয়ে (যিনি আইভানের অভিভাবক হিসেবে রাজ্য পরিচালনা করেছিলেন) এবং গৎবাধা রাজকীয় জীবনের যান্ত্রিকতায় আইভান হয়ে ওঠেন খিটখিটে স্বভাবের। জটিল মানসিকতার আইভান মেধাবী হলেও শৈশব থেকেই ঘন ঘন ক্রোধে উন্মাদ হয়ে যেতেন। শিশুর স্বভাবসুলভ কোমলতাও যেন আইভানের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল!

১৫৬০ সালে তার স্ত্রী আনাস্তাসিয়ার মৃত্যু হলে তিনি সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়লেন। তার আচরণ হয়ে উঠল ভয়ঙ্কর। তার মা এবং স্ত্রী হত্যার পেছনে বয়ারদের ষড়যন্ত্র রয়েছে বলে তার ধারণা। তিনি নিজেও প্যারানয়াগ্রস্ত হয়ে উঠলেন। গুরুত্বপূর্ণ অভিজাতদের হত্যা করতে শুরু করলেন। তার নাম হয়ে গেল ‘আইভান দ্য টেরিবল’। স্ত্রীর মৃত্যুর কবছর পর তিনি হঠাৎ মস্কো ছেড়ে চলে এলেন। ক্রেমলিনে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দিলেন, তাতে বললেন বিশ্বাসঘাতক বয়াররা রাষ্ট্রের অর্থ লুটপাট করছে এ অবস্থায় তার পক্ষে শাসন করা সম্ভব নয়। 

এটি ছিল তার সাজানো নাটক, তিনি জানতেন মস্কো তার পক্ষে এবং তিনি সরে গেলে বয়াররা জনগণের পিটুনি খেয়ে দিশেহারা হয়ে যাবে। সুতরাং তারাই এসে নতজানু হয়ে তাকে ক্ষমতা না ছাড়ার আমন্ত্রণ জানাবে। তাই হলো তিনি শর্ত দিলেন ফিরে যেতে রাজি আছেন যদি তাকে সর্বময় ক্ষমতা মঞ্জুর করা হয়। তাই মঞ্জুর হলো তিনি বিশ্বাসঘাতকদের জেলে পাঠানো, হত্যা করা এবং তাদের সম্পত্তি নিজের জন্য বাজেয়াপ্ত করার ক্ষমতা প্রাপ্ত হলেন। 

আইভান দ্য টেরিবল শর্ত পূরণ করে ক্ষমতায় ফিরে ২৪ বছর ধরে রাশিয়ায় এক ভয়ংকর স্বৈরশাসন চালান। আইভান প্রশাসনের দায়িত্ব থেকে নিজেকে সরিয়ে কিছু অনুগতদের দিয়ে রক্তপাতের রাজনীতি চালু করেন। দুর্নীতি, অত্যাচার ও হত্যা ছিল এই সময়ের প্রধান চিত্র।

১৫৭০ সালে আইভান রাশিয়ার উত্তর পশ্চিমে একটি প্রশাসনিক শহর নভগরদ অপ্রিচনিকি দ্বারা আক্রমণ করেন। প্রায় এক হাজার মানুষের বসতি নভগরদ সম্পূর্ণ মাটির সাথে মিশিয়ে দেয় অপ্রিচনিকি। সে শহরে ছিল অধিকাংশ বয়ারশ্রেণীর লোকদের বসবাস যারা কেউই অপ্রিচনিকির হাত থেকে রক্ষা পায়নি। এ সময় মস্কোতেও তিনি বয়ারদের উপর অত্যাচার চালানো শুরু করেন। বিভিন্নভাবে রাষ্ট্রদ্রোহ ও অন্যান্য মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে আইভান একে একে প্রভাবশালী বয়ারদের হত্যা করতে থাকেন। তাদের মধ্যে অনেককে প্রকাশ্যে বর্বরতম পন্থায় হত্যা করা হয়। আইভানের এই বর্বরতার সময় ৩ হাজারের অধিক মানুষ হয় বয়ার হবার জন্য, নয়তো বিরুদ্ধাচরণের জন্য নিষ্ঠুরভাবে খুন হয়েছেন।

আইভানের ছেলেকে হত্যা

পত্নীশোকে বাতুল বনে যাওয়া আইভানের ক্রোধ থেকে রক্ষা হয়নি তার নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্রেরও! ১৫ নভেম্বর ১৫৮১ আইভান দ্য টেরিবল ভয়ঙ্কর খারাপ মুডে ছিলেন। তার সামনে দিয়ে গর্ভবতী পুত্রবধু যথাযথ পোশাক পরে না যাওয়ার অজুহাতে চিৎকার কওে ওঠে আইভান এবং আঘাত করেন। জারেভিচ দ্রুত সেখানে পৌছে বাবাকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু শশুরের আঘাতে তার গর্ভপাত হয়ে যায়। জারেভিচ চিৎকার করে বলে উঠেন, ‘তুমি আমার প্রথম স্ত্রীকে অকারণে কনভেন্টে পাঠিয়েছে, আমার দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথেও তাই করেছ। এখন তুমি আমার স্ত্রীর গর্ভের পুত্রসন্তানকে হত্যা করলে।’

বাবা ও ছেলের সম্পর্ক এতোটাই খারাপ হয়ে যায় যে তা প্রশমন করার কোনো সুযোগ থাকে না। আইভান দ্য টেরিবল প্রসঙ্গ বদলে ছেলেকে বলেন যে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহী, পসকোভ অবরোধে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। জারেভিচ  অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, পসকোভের জনগনের স্বাধীন থাকার অধিকার রয়েছে।

রাগে উন্মত্ত আইভান দ্য টেরিবল হাতের ভারী রাজদন্ড দিয়ে সজোরে ছেলের মাথায় আঘাত করলেন। মাথা ফেটে গেল, জারোভিচ মাটিতে পরে গেলেন, মাথা থেকে রক্ত ঝরতে থাকলো, আইভান দ্য টেরিবল হঠাৎ ছেলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে চুমো খেতে খেতে বললেন, ‘আমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছি, আমি আমার ছেলেকে হত্যা করেছি।’

অল্পসময়ের জন্য জারোভিচের জ্ঞান ফিরলে বাবার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘একজন অনুগত পুত্র ও সামান্য ভৃত্য হিসেবে আমি মারা যাচ্ছি।’ তিনি আবার অজ্ঞান হয়ে গেলেন। তখনও প্রাণ ছিলো। আইভান দ্য টেরিবল অলৌকিক ফলাফলের আশায় পুত্রের জীবন ফিরে পেতে প্রার্থনা শুরু করলেন। চতুর্থ দিন জারেভিচ চিরদিনের জন্য বিদায় নিলেন।

আইভানের ছেলেকে হত্যার প্রতীকী ছবি

আইভানের মৃত্যু

১৫৮১-তে নিজের ছেলেকে হত্যা করার পর থেকেই ভীত হয়ে পড়েন আইভান। সর্বদা মৃত্যুর কথা ভাবতে লাগলেন তিনি। এ সময় তিনি এতোটাই ভীত হয়ে পড়লেন যে প্রতিদিন ভবিষ্যদ্বক্তাদের দ্বারা নিজের মৃত্যুর সময় জানার চেষ্টা করেন। এমনকি ডাকিনীর সহায়তায় আয়ু বৃদ্ধি করার চেষ্টা করেন বলেও জানা যায়!

অবশেষে ১৫৮৪ সালের ১৮ মার্চ স্ট্রোক থেকে মৃত্যুবরণ করেন আইভান দ্য টেরিবল। সেই সাথে শেষ হয় তার দীর্ঘকালের স্বৈরাচারী শাসন।

তথ্যসূত্রঃ

Related posts

সাম্রাজ্যবাদী রবার্ট ক্লাইভ ও তাঁর মৃত্যু রহস্য

আবু সালেহ পিয়ার

বাংলার ভূত: মেছোভূত থেকে নিশির ডাক

রাশিচক্র কি ছদ্মবিজ্ঞান নাকি ভবিষ্যৎ জানার মাধ্যম?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More