এটি বিশ্বের সবচেয়ে অপরাধ প্রবণ এলাকা। চোরাচালান, মাদক ব্যবসা, অর্থ পাচার থেকে শুরু করে এমন কোন অপকর্ম নেই যা এখানে ঘটে না।
মাফিয়াদের স্বর্গরাজ্য খ্যাত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। নামটি শুনলেই যেন চোখের সামনে ভেসে ওঠে একটি রহস্যময়, বিপজ্জনক এবং রোমাঞ্চকর গা ছমছমে অঞ্চলের দৃশ্য, যেখানে পাহাড়, নদী এবং সীমান্ত জুড়ে চলে মাদক, মাফিয়া ও অস্ত্রের দাপট।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল এর অবস্থান
১৯৭১ সালে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের একজন কর্মকর্তা এই অঞ্চলটির নামকরণ করেন গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল’। মিয়ানমার, লাওস এবং থাইল্যান্ডের সীমান্তে অবস্থিত এই অঞ্চলটির আনুমানিক আয়তন ৯ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গকিলোমিটার। তিনটি দেশের সীমান্ত একত্রিত হয়ে ত্রিভুজ আকৃতির হওয়ায় একে “গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল” বলা হয়।

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কুখ্যাত এই অঞ্চলটির এক পাশে রয়েছে মেকং নদী তো অন্য পাশে রয়েছে রুয়াক নদী। পাহাড়ি এই অঞ্চলটি একসময় সোনার মতো উর্বর ভূমি হিসেবে পরিচিত ছিল। তবে সময়ের সাথে সাথে এটি হয়ে উঠে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অপরাধের সাম্রাজ্যে। বলা হয়ে থাকে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই এই স্থানটি মাফিয়াদের কাছে বেশ জনপ্রিয়।
কিভাবে তৈরি হলো গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গাল
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের ইতিহাস মূলত আফিমের ইতিহাসের সাথে জড়িত। জানা যায়, ১৮ শতকে ব্রিটিশ ভারতের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম আফিম চাষ শুরু করে। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তাদের চাষকৃত এই আফিমকে চীনসহ পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ গুলোতে রপ্তানি করতে থাকে।
১৯৫০-এর দশকে চীনের সরকার আফিমকে সম্পূর্ণ ভাবে নিষিদ্ধ করলে; চীনের অনেক ব্যবসায়ী, সৈনিক এবং কৃষক চীন থেকে পালিয়ে মিয়ানমার ও থাইল্যান্ডের এই সীমান্তবর্তী এলাকা গুলোতে চলে আসে এবং এই এলাকা গুলোতেই গড়ে তোলে তাদের আফিম চাষের নতুন সাম্রাজ্য।

এমনকি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার ফলে সেখানকার স্থানীয় কৃষকরা বেশি মুনাফা লাভের আশায় ঝুঁকে পড়ে এই আফিম চাষের দিকে। আর সেসময়ই মিয়ানমারের শান প্রদেশ, থাইল্যান্ডের উত্তরাঞ্চল এবং লাওসের কিছু অংশে আফিমের ক্ষেত তুলনামূলক দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে থাকে।
দ্রুত ছড়িয়ে পড়া এই আফিম ক্ষেতগুলোকে “হোয়াইট গোল্ড ফিল্ড” বা সাদা সোনার জমি বলা হতো। মিয়ানমারের পাহাড়ি অঞ্চলে বিশেষ করে “শান স্টেটে”, বিশাল আকারে পপি ফুল চাষ হতো। আর পপি ফুল থেকেই তৈরি করা হতো আফিম। তৈরিকৃত এসব আফিম পরবর্তীতে রপ্তানি করা হতো ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র সহ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে।
১৯৬০ থেকে ১৯৮০ সাল ছিলো মাদক ব্যবসার স্বর্ণযুগ। ঠিক এই সময়েই আফিমের রাজধানী খ্যাত গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল বিশ্বে সবচেয়ে বড় আফিম উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবে সারা বিশ্বে পরিচিতি পায়। মাদক উৎপাদনের এই ব্যবসায় শুধু সাধারণ কৃষকেরা জড়িত ছিল না, বরং এতে শক্তিশালী মাফিয়া, স্থানীয় সেনা দল, এমনকি অনেক সরকারি কর্মকর্তারাও জড়িত ছিল। যারা লাখ লাখ ডলারের মুনাফার লোভে যুক্ত হয়েছিল মাদকের এই অন্ধকার জগতে।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের অন্ধকার ইতিহাসে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা CIA (সিআইএ) এর নাম সবচেয়ে বেশি বিতর্কিত। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুদ্ধে বিপর্যস্ত মানুষের কাছে নামেমাত্র মানবিক সাহায্য পৌঁছে দেবার জন্য সিআইএ “এয়ার আমেরিকা” নামের একটি গোপন বিমান সংস্থা চালু করেছিল। তবে, পরবর্তীতে জানা যায় মানবিক সাহায্যের আড়ালে CIA এসব বিমানগুলোকে ব্যবহার করত আফিম ও হেরোইন মতো মাদক দ্রব্য পরিবহনের কাজে। আর এভাবেই ধীরে ধীরে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল হয়ে উঠল বিশ্ব মাদক ব্যবসার এক কেন্দ্রে; যেখানে রাজনীতি, গুপ্তচরবৃত্তি আর অপরাধের সীমারেখা মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছিল।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের ইতিহাস বলতে গেলে যার নাম না নিলেই নয় সে হলো “খুন সা” (Khun Sa), “দ্য কিং অব দ্য গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল। খুন সা একজন শক্তিশালী মাদক সম্রাট। শান উপজাতির এই মাদক সম্রাট নিজেই একটি সেনাবাহিনী গঠন করে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের বিশাল অংশ দখল করেছিল। তার সেনাবাহিনীতে প্রায় ২০,০০০ মতো সশস্ত্র সৈন্য ছিল। তার “হিরোইন সাম্রাজ্য” এত টাই বড় ছিল যে, একসময় বিশ্বের প্রায় ৭০% হেরোইন সরবরাহ আসত তার নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকা থেকে।

তবে ১৯৯০-এর দশক থাইল্যান্ড ও মিয়ানমার সরকার আফিমের বিরুদ্ধে শুরু করে কঠোর এক অভিযান। আফিম ক্ষেত পুড়িয়ে দেওয়া সহ মাদক ব্যবসায়ীদের আটক করার মতো অভিযানের ফলে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল কিছুটা দুর্বল হতে থাকে। ১৯৯৬ সালে খুন সা’র মতো মাদক ব্যবসায়ীরা আত্মসমর্পণ করলেও তাদের সাম্রাজ্য তখন ও শেষ হয়নি। তাদের রেখে যাওয়া নেটওয়ার্ক যেন আজও ছড়িয়ে আছে গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেলের সেই অন্ধকার জঙ্গলে।
গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গালের বর্তমান অবস্থা
সময় বদলেছে; ১৯৯০-এর পর থেকেই আফিমের চাহিদা কিছুটা কমলেও, মাদক ব্যবসা পুরোপুরি বন্ধ হয়নি। অতীতের সেই আফিমের জায়গা বর্তমানে নিয়েছে “মেথামফেটামিন” বা “ইয়াবা”। জাতিসংঘের মাদক নিয়ন্ত্রণ দপ্তরের (UNODC) মতে, বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সিনথেটিক ড্রাগ অর্থাৎ ইয়াবা, উৎপাদিত হয় এই গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলেই। মিয়ানমারের ওয়া স্টেট, শান স্টেট এবং লাওস সীমান্তের গোপন কারখানায়, আজও কোটি কোটি ট্যাবলেট উৎপাদিত হয়, যা পরে থাইল্যান্ড, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া এমনকি অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশ গুলোতে যায় ।
মাদক ব্যবসার পাশাপাশি এই অঞ্চলটিতে মানব পাচার, অস্ত্র বাণিজ্য, এমনকি অর্থপাচারের মতো অপরাধ গুলোও বেশ সক্রিয়। মাদক ব্যবসার মাধ্যমে উপার্জিত অর্থ পরবর্তীতে থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর এবং হংকং-এর ব্যাংকিং সিস্টেমে পাচার হয়। ফলে, গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল বর্তমানে আন্তর্জাতিক মানি লন্ডারিং ও অস্ত্র বাণিজ্যের হটস্পট হিসেবেও বিবেচিত। গোল্ডেন ট্রায়াঙ্গেল “মানব সভ্যতার” এক অন্ধকার আয়না, যেখানে আমরা দেখি, ক্ষমতা, অর্থ আর নেশার জন্য মানুষ কতদূর যেতে পারে।
রেফারেন্স:
- https://www.britannica.com/topic/opium-trade/The-Opium-Wars
- https://bn.wikipedia.org/wiki/%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A7%80_%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%9C_(%E0%A6%A6%E0%A6%95%E0%A7%8D%E0%A6%B7%E0%A6%BF%E0%A6%A3-%E0%A6%AA%E0%A7%82%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AC_%E0%A6%8F%E0%A6%B6%E0%A6%BF%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%BE)
- “Guide to Investigating Organized Crime in the Golden Triangle”

