মৃত্যুর পর প্রিয়জনের অস্তিত্বকে পুরোপুরি মুছে ফেলা নয়, বরং তাকে নিজের অংশ করে নেওয়া, এটাই ইয়ানোমামিদের বিশ্বাস। প্রিয়জনের আত্মাকে স্বর্গে পৌঁছে দিতে তারা বেছে নিয়েছে এক আশ্চর্য প্রথা, যা শুনলে গা গুলিয়ে উঠতে পারে, যেকারো। চলুন জেনে আসি সেই অবাক করা প্রথা সম্পর্কে।
পৃথিবীর প্রতিটি সংস্কৃতিতে মৃত্যুকে ঘিরে রয়েছে নিজস্ব বিশ্বাস, প্রথা এবং অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আয়োজন। কবর দেওয়া, চিতায় পোড়ানো কিংবা প্রকৃতিকে উৎসর্গ করা, এইসব রীতির সাথে আমরা কমবেশি পরিচিত। কিন্তু যদি শোনেন, এমন এক জনগোষ্ঠী আছে, যারা তাদের প্রিয়জন মারা যাওয়ার পর তার শবদেহ পুড়িয়ে সেই ছাই স্যুপের সাথে মিশিয়ে খায়?
শুনতে যতই অদ্ভুত বা ভয়ঙ্কর লাগুক না কেন, এটিই সত্যি। দক্ষিণ আমেরিকার আমাজন বনের গহীনে, ব্রাজিল এবং ভেনেজুয়েলার সীমান্তে বসবাসকারী ইয়ানোমামি (Yanomami) উপজাতির মধ্যে এই প্রথাটি শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচলিত। বাইরের বিশ্বের কাছে এটি এক ‘ভয়ংকর’ বা ‘অকল্পনীয়’ রীতি মনে হলেও, ইয়ানোমামিদের জন্য এটি হলো ভালোবাসা, শ্রদ্ধা এবং মৃতের আত্মার প্রতি দায়িত্ব পালনের সর্বোচ্চ নিদর্শন।
এই প্রথাটি নৃবিজ্ঞানের ভাষায় ‘এন্ডোক্যানিবালিজম (Endocannibalism)’ নামে পরিচিত, যার অর্থ হলো নিজের গোত্র বা গোষ্ঠীর মৃত সদস্যের অংশবিশেষ ভক্ষণ করা। কিন্তু ইয়ানোমামিরা কেন এমন একটি প্রথা পালন করে? এর পেছনে কি শুধুই অন্ধবিশ্বাস, নাকি লুকিয়ে আছে জীবন, মৃত্যু এবং আত্মার জগৎ নিয়ে তাদের কোনো গভীর দর্শন?
আজকের লেখায় আমরা ইয়ানোমামিদের সেই রহস্যময় জগতে প্রবেশ করব এবং তাদের এই অদ্ভুত রীতির পেছনে থাকা কারণগুলো সম্পর্কে জানবো।
কারা এই ইয়ানোমামি জাতিগোষ্ঠী?
ইয়ানোমামিরা দক্ষিণ আমেরিকার অন্যতম বৃহৎ এবং বিচ্ছিন্ন একটি আদিবাসী গোষ্ঠী। তারা আমাজন রেইনফরেস্টের প্রায় ৯.৬ মিলিয়ন হেক্টর এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা ২০০-২৫০টি গ্রামে বসবাস করে।
পৃথিবী অনেকদূর এগিয়ে গেলেও তাদের জীবনযাত্রা এখনো অনেকাংশেই প্রকৃতি-নির্ভর। মূলত পশুপাখি শিকার, মাছ ধরা এবং চাষাবাদ করেই তারা জীবিকা নির্বাহ করে। তাদের নিজস্ব ভাষা, সংস্কৃতি এবং এক অত্যন্ত সমৃদ্ধ এক আধ্যাত্মিক জগৎ রয়েছে, যা বাইরের আধুনিক বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
তাদের জীবনযাত্রার মতোই, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস ও রীতিনীতি অত্যন্ত জটিল। এই জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা বিশ্বাস করে, এই জগতের পাশাপাশি আরও একটি অদৃশ্য আধ্যাত্মিক জগৎ বিদ্যমান, যেখানে বাস করে বিভিন্ন আত্মা বা ‘হেকুরার’ দল। এই আধ্যাত্মিক জগতের সাথে সংযোগ স্থাপন করেন তাদের ধর্মীয় গুরু বা শামানরা। মৃতদেহের ছাই ভক্ষণের বিষয়টিও তাদের আধ্যাত্মিক বিশ্বাসের সাথে সম্পর্কিত৷
ইয়ানোমামিদের মৃত্যু দর্শন: আত্মার অনন্ত যাত্রা
ইয়ানোমামিদের এই ছাই খাওয়ার প্রথাটি বুঝতে হলে, প্রথমে মৃত্যু এবং আত্মাকে নিয়ে তাদের বিশ্বাসকে বুঝতে হবে। তারা মনে করে, মৃত্যু জীবনের শেষ নয়, বরং এটি আত্মার এক নতুন যাত্রার শুরু মাত্র।
তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী, প্রতিটি মানুষের মধ্যে ‘বোরে’ (bore) বা আত্মা থাকে। মৃত্যুর পর, এই ‘বোরে’ বা আত্মা ভৌত জগত ছেড়ে আধ্যাত্মিক জগতে প্রবেশ করে। কিন্তু এই যাত্রাটি সহজ নয়। কারণ মৃত্যুর পরে এই আত্মাটি অত্যন্ত দুর্বল এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় থাকে। যদি মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সঠিকভাবে সম্পন্ন না করা হয়, তবে এই আত্মা চিরতরে ভৌত জগতে আটকা পড়ে যেতে পারে, যা জীবিত এবং মৃত, উভয়ের জন্যই অত্যন্ত ক্ষতিকর।
এছাড়াও, তারা বিশ্বাস করে, শত্রুপক্ষ বা অশুভ শক্তি মৃতের আত্মাকে বন্দী করে ফেলতে পারে, যা তাদের জন্য চরম অপমানজনক, তাছাড়া এর ঝুকিপূর্ণ দিকও আছে। তাই, মৃতের আত্মার মুক্তি এবং তার নিরাপদ স্বর্গযাত্রা নিশ্চিত করাই হলো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার প্রধান উদ্দেশ্য।
ইয়ানোমামি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া: দুই ধাপের এক জটিল প্রক্রিয়া
ইয়ানোমামিদের শেষকৃত্যের প্রথাটি বেশ দীর্ঘ এবং সময়সাপেক্ষ একটি বিষয়। এই প্রথাটি কার্যকর করতে তাদের দুটি প্রধান ধাপ সম্পন্ন করতে হয়।
প্রথম ধাপ: শবদাহ এবং শোক প্রকাশ
যখন ইয়ানোমামি গোত্রের কোনো সদস্য মারা যায়, তখন তার মৃতদেহটি পাতা এবং গাছের ছাল দিয়ে মুড়িয়ে গ্রাম থেকে কিছুটা দূরে জঙ্গলের একটি নির্দিষ্ট স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে দেহটিকে কয়েক সপ্তাহ বা এক মাসেরও বেশি সময় ধরে রেখে দেওয়া হয়, যাতে পোকামাকড় এবং পশুপাখি তার মাংসল অংশগুলোকে খেয়ে ফেলে।
এই সময়ে পুরো গ্রামজুড়ে এক গভীর শোকের আবহ তৈরি হয়। ইয়ানোমামিরা তাদের শোক অত্যন্ত আবেগপ্রবণভাবে প্রকাশ করে। তারা উচ্চস্বরে কাঁদে, গান গায় এবং মৃতের স্মৃতিচারণ করে। এই শোক প্রকাশ তাদের সামাজিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে তোলে।
নির্দিষ্ট সময় পর, যখন মৃতদেহে শুধু হাড় এবং শুকনো অংশ অবশিষ্ট থাকে, তখন গ্রামের লোকেরা সেই দেহাবশেষ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। এরপর একটি বিশাল চিতা সাজিয়ে সেই হাড়গুলোকে পোড়ানো হয়। এই শবদাহ প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত পবিত্র বলে মনে করে ইয়ানোমামি জাতিগোষ্ঠীর মানুষেরা। এটি সম্পন্ন হওয়ার পর, অবশিষ্ট ছাই এবং হাড়ের গুঁড়ো সংগ্রহ করে একটি শুকনো লাউয়ের খোলে বা পাত্রে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: ছাই ভক্ষণ বা এন্ডোক্যানিবালিজম
শবদাহের প্রায় এক বছর পর বা গ্রামের কোনো বড় উৎসবকে কেন্দ্র করে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার চূড়ান্ত এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পর্বটি আয়োজন করা হয়। এই অনুষ্ঠানটিকে বলা হয় ‘রেহো’ (reahu)।
এই অনুষ্ঠানে, সংরক্ষিত ছাই এবং হাড়ের গুঁড়োগুলোকে কলাগাছের কন্দ থেকে তৈরি এক ধরনের স্যুপ বা পোরিজের সাথে মেশানো হয়। এরপর, গ্রামের সবাই, বিশেষ করে মৃতের নিকটাত্মীয়রা, সেই ছাই-মেশানো স্যুপটি পান করে।
এই প্রক্রিয়াটি যেকোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের কাছে অত্যন্ত অস্বস্তিকর মনে হতে পারে, কিন্তু ইয়ানোমামিদের জন্য এটি হলো এক গভীর আধ্যাত্মিক এবং ভালোবাসার কাজ।
এই অদ্ভুত প্রথার পেছনে থাকা বিশ্বাস ও দর্শন
ইয়ানোমামিরা কেন তাদের প্রিয়জনের ছাই খায়? এর পেছনে কয়েকটি গভীর বিশ্বাস জড়িত:
১. আত্মার মুক্তি নিশ্চিত করা: ইয়ানোমামিদের সবচেয়ে বড় ভয় হলো, মৃতের আত্মা যেন এই পৃথিবীতে ভূত হয়ে ঘুরে না বেড়ায়। তারা বিশ্বাস করে, মৃতের শেষ চিহ্নটুকুও যদি পৃথিবীতে অবশিষ্ট থাকে, তবে তার আত্মা পুরোপুরি মুক্তি পাবে না। তাই, ছাই ভক্ষণ করার মাধ্যমে তারা মৃতের সমস্ত অস্তিত্বকে পৃথিবী থেকে মুছে ফেলে এবং এর মাধ্যমে তার আত্মার অনন্ত ও শান্তিপূর্ণ যাত্রা নিশ্চিত করে।
২.প্রিয়জনকে নিজের মধ্যে ধারণ করা: এটি তাদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধার সর্বোচ্চ প্রকাশ। ছাই খাওয়ার মাধ্যমে তারা মনে করে, প্রিয়জনের আত্মা এবং তার শক্তি তাদের নিজেদের শরীরের অংশ হয়ে গেল। এভাবে, মৃত ব্যক্তি তাদের কাছ থেকে হারিয়ে যায় না, বরং সে তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যেই চিরতরে থেকে যায়। ছাই খাওয়ার মাধ্যমে জীবিত এবং মৃতের মধ্যে একটি আধ্যাত্মিক সংযোগ স্থাপিত হয় বলে তারা বিশ্বাস করে।
৩. শত্রুর হাত থেকে আত্মাকে রক্ষা করা: ইয়ানোমামিদের মধ্যে আন্তঃ-গোত্র সংঘাত একটি সাধারণ ঘটনা। তারা বিশ্বাস করে, যদি মৃতের কোনো অংশ, এমনকি তার ছাইও শত্রুর হাতে পড়ে, তবে তারা সেই আত্মাকে জিম্মি করে ফেলতে পারে বা তার ক্ষতি করতে পারে। তাই, ছাই ভক্ষণ করে তারা তাদের প্রিয়জনের আত্মাকে শত্রুর নাগালের বাইরে নিয়ে যায়।
৪. শোককে অতিক্রম করা: সম্মিলিতভাবে ছাই ভক্ষণের অনুষ্ঠানটি তাদের শোক প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে। তারা মনে করে, ছাই ভক্ষণের মাধ্যমেই তারা মৃত আত্মীয়কে পুরোপুরিভাবে বিদায় জানাতে পারে। কারণ এর মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি এখন তাদের সাথেই, তাদের সত্তার অংশ হিসেবে বেঁচে আছে।
ইয়ানোমামিদের কাছে এই প্রথাটি তাই কোনো বর্বরতা নয়, বরং প্রিয়জনকে গভীর ভালবাসার বহিঃপ্রকাশ।
তথ্যসূত্র –
- https://annews.in/index.php/2025/08/14/in-which-country-in-the-world-do-indigenous-people-live-by-eating-the-ashes-of-dead-people/
- https://www.digibangla24.com/%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%A7/%E0%A6%AE%E0%A7%83%E0%A6%A4%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B9-%E0%A6%B8%E0%A7%8E%E0%A6%95%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%8F%E0%A6%B0-%E0%A6%85%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AD%E0%A7%81%E0%A6%A4-%E0%A6%AF%E0%A6%A4/
- https://bengali.boldsky.com/insync/the-story-of-yanomami-tribal-people-who-drink-human-soup-000666.html
- https://www.dw.com/bn/%E0%A6%86%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%9C%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%96%E0%A6%A8%E0%A6%BF-%E0%A6%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%A8%E0%A7%8B%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE%E0%A6%BF-%E0%A6%86%E0%A6%A6%E0%A6%BF%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%83%E0%A6%96/g-68090079
- https://bangla.asianetnews.com/international/world-news/yanomami-tribe-funeral-rituals-endocannibalism-eating-deceased-relatives-bdd/articleshow-nlg8kcf