Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

কেন জাপানে ১ লাখের কাছাকাছি মানুষ ১০০ বছরের বেশি বেঁচে আছেন?

বিশ্বের আর কোনো দেশে এত শতবর্ষী মানুষ নেই! জাপানে কেন প্রায় এক লক্ষ মানুষ ১০০ বছরের বেশি বাঁচেন? এটি কোনো জেনেটিক গুন নয়, বরং তাদের জীবনযাত্রার মধ্যেই লুকিয়ে আছে দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের গোপন সূত্র।

একবিংশ শতাব্দীতে এসে, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থা এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু বিশ্বজুড়েই বেড়েছে। কিন্তু একটি দেশ এই দৌড়ে বাকি সবাইকে অনেক পেছনে ফেলে দিয়েছে তা হলো জাপান। ২০২৩ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জাপানে ৯০,৫২৬ জন মানুষের বয়স ১০০ বা তার বেশি, যা একটি বিশ্ব রেকর্ড। অর্থাৎ, জাপানের প্রতি ১,৪৫০ জন মানুষের মধ্যে একজন হলেন শতবর্ষী!

কীভাবে এটি সম্ভব? জাপানিদের কাছে কি দীর্ঘ ও সুস্থ জীবনের কোনো জাদুকরী সূত্র আছে? এটি কোনো জেনেটিক্স বা বংশগতির গুন নয়। বিজ্ঞানীরা বহু বছর ধরে গবেষণা করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন যে, জাপানিদের এই অবিশ্বাস্য দীর্ঘায়ুর পেছনে লুকিয়ে আছে তাদের খাদ্যাভ্যাস, জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি এবং দর্শনের এক অসাধারণ সমন্বয়।

বিশেষ করে, জাপানের দক্ষিণাঞ্চলীয় দ্বীপপুঞ্জ ওকিনাওয়া, যা বিশ্বের অন্যতম ‘ব্লু জোন’ (Blue Zone) হিসেবে পরিচিত, সেখানকার মানুষেরা যেন দীর্ঘ জীবনের এক জীবন্ত পাঠশালা। 

সুষম খাদ্যাভ্যাস

জাপানিদের দীর্ঘায়ুর রহস্যের সবচেয়ে বড় অংশটি লুকিয়ে আছে তাদের ঐতিহ্যবাহী খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে। তাদের খাবার শুধু সুস্বাদুই নয়, এটি পুষ্টিগুণে ভরপুর এবং অত্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ।

  • মাছ, সয়াবিন এবং শাকসবজি: জাপানিদের প্রধান খাবার হলো ভাত, মাছ, সয়াবিন এবং বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি শাকসবজি। তারা প্রচুর পরিমাণে সামুদ্রিক মাছ খায়, যা ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের এক চমৎকার উৎস। এই ফ্যাটি অ্যাসিড হৃৎপিণ্ডকে সুস্থ রাখে এবং মস্তিষ্কের কার্যকারিতা বাড়ায়। লাল মাংস (Red Meat) এবং দুগ্ধজাত খাবারের (Dairy) ব্যবহার তাদের খাদ্যতালিকায় খুবই কম, যা হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। টফু, মিসো স্যুপের মতো সয়াবিন-ভিত্তিক খাবার তাদের খাদ্যতালিকার একটি অপরিহার্য অংশ, যা প্রোটিন এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি জোগায়।
টেবিলে সাজানো জাপানি খাবার
  • সামুদ্রিক শৈবাল (Seaweed): ওয়াকামে এবং নোরির মতো বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক শৈবাল জাপানিদের প্রতিদিনের খাবার। এগুলোতে রয়েছে আয়োডিন, ফাইবার এবং প্রচুর পরিমাণে খনিজ পদার্থ, যা থাইরয়েডের স্বাস্থ্য এবং সামগ্রিক সুস্থতার জন্য অত্যন্ত উপকারী।
  • ‘হারা হাচি বু’ (Hara Hachi Bu) দর্শন: এটি ওকিনাওয়ার শতবর্ষী মানুষদের দীর্ঘ জীবনের অন্যতম প্রধান গোপন সূত্র। এই কনফুসিয়ান প্রবাদটির অর্থ হলো “পেটের ৮০ শতাংশ পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত খাও।” অর্থাৎ, পুরোপুরি পেট ভরে না খেয়ে, কিছুটা ক্ষুধা রেখে খাওয়া শেষ করা। এই অভ্যাসটি অতিরিক্ত ক্যালোরি গ্রহণ থেকে বিরত রাখে, যা স্থূলতা, ডায়াবেটিস এবং অন্যান্য বয়সজনিত রোগের ঝুঁকি নাটকীয়ভাবে কমিয়ে দেয়।
  • গ্রিন টি-এর জাদু: জাপানিরা প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে গ্রিন টি বা সবুজ চা পান করে। গ্রিন টি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে ভরপুর, যা কোষকে ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে, বার্ধক্যের প্রক্রিয়াকে ধীর করে এবং হৃদরোগ ও বিভিন্ন ধরনের ক্যান্সারের ঝুঁকি কমায়।

তাদের খাদ্যাভ্যাসটি প্রক্রিয়াজাত খাবার, অতিরিক্ত চিনি এবং অস্বাস্থ্যকর চর্বি থেকে প্রায় মুক্ত। তারা প্রতিটি কামড়ের স্বাদ নিয়ে খায়, যা হজমে সাহায্য করে এবং অতিরিক্ত খাওয়া প্রতিরোধ করে।

‘ইকিগাই’ (Ikigai): বেঁচে থাকার কারণ খুঁজে নেওয়া

শারীরিক স্বাস্থ্যের পাশাপাশি, জাপানি সংস্কৃতি মানসিক স্বাস্থ্যের উপরও সমান গুরুত্ব দেয়। তাদের দীর্ঘ ও সুখী জীবনের একটি বড় রহস্য হলো ‘ইকিগাই’-এর ধারণা।

‘ইকিগাই’ একটি জাপানি শব্দ, যার কোনো সরাসরি ইংরেজি বা বাংলা অনুবাদ নেই। এর ভাবার্থ হলো “বেঁচে থাকার কারণ” বা “সকালে ঘুম থেকে ওঠার আনন্দ”। এটি হলো সেই কাজটি, যা আপনি ভালোবাসেন, যা আপনি ভালো পারেন, যার জন্য আপনি পারিশ্রমিক পেতে পারেন এবং যা বিশ্বের প্রয়োজন – এই চারটির এক সুন্দর সমন্বয়।

বাগান করছেন একজন জাপানি বৃদ্ধ

জাপানি সংস্কৃতিতে, অবসর গ্রহণ বা রিটায়ারমেন্টের ধারণাটি পশ্চিমা বিশ্বের মতো নয়। একজন মানুষ তার পেশাগত জীবন শেষ করার পরেও তার ‘ইকিগাই’ খুঁজে বেড়ায়। এটি হতে পারে বাগান করা, নাতি-নাতনিদের দেখাশোনা করা, স্থানীয় কমিউনিটির জন্য কাজ করা, বা কোনো নতুন শখ তৈরি করা।

এই উদ্দেশ্যমূলক জীবনই তাদের মানসিকভাবে সক্রিয় এবং উজ্জীবিত রাখে। যখন একজন মানুষের জীবনে একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য থাকে, তখন সে হতাশা এবং একাকিত্ব থেকে দূরে থাকে। ওকিনাওয়ার শতবর্ষী মানুষদের প্রায় প্রত্যেকেরই নিজস্ব ‘ইকিগাই’ রয়েছে, যা তাদের প্রতিদিন সকালে বিছানা ছেড়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে। এই মানসিক শক্তিই তাদের শারীরিক সুস্থতার অন্যতম প্রধান কারণ।

সামাজিক বন্ধন এবং ‘মোয়াই’ (Moai): একাকিত্বের প্রতিষেধক

জাপানি সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ওকিনাওয়াতে, সামাজিক বন্ধন এবং কমিউনিটির গুরুত্ব অপরিসীম। তারা বিশ্বাস করে, মানুষ একা বাঁচার জন্য জন্মায়নি। এই দর্শনেরই এক চমৎকার উদাহরণ হলো ‘মোয়াই’ (Moai)

‘মোয়াই’ হলো ওকিনাওয়ার একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা, যেখানে ছোটবেলাতেই কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি সামাজিক গ্রুপ বা দল তৈরি করা হয়। এই দলের সদস্যরা আজীবন একে অপরের সুখে-দুঃখে পাশে থাকে। তারা নিয়মিত একসাথে আড্ডা দেয়, খেলাধুলা করে, এবং প্রয়োজনে একে অপরকে আর্থিক ও মানসিক সহায়তা প্রদান করে।

এই ‘মোয়াই’ সিস্টেমটি তাদের একাকিত্ব এবং বিচ্ছিন্নতা থেকে রক্ষা করে। আধুনিক বিশ্বে যেখানে একাকিত্ব একটি বড় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, সেখানে ওকিনাওয়ার এই সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনী তাদের মানসিক চাপ কমাতে এবং সুখী থাকতে সাহায্য করে। বিজ্ঞানীরা দেখেছেন যে, শক্তিশালী সামাজিক সংযোগ মানুষের আয়ু বাড়াতে সরাসরি সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

সক্রিয় জীবনযাত্রা: ব্যায়াম নয়, নড়াচড়াই মূল

জাপানিদের দীর্ঘায়ুর আরেকটি বড় কারণ হলো তাদের সক্রিয় জীবনযাত্রা। তবে এর মানে এই নয় যে, তারা সবাই জিমে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যায়াম করে। বরং, তাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কাজেই হাঁটাচলা এবং শারীরিক পরিশ্রম অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত।

  • হাঁটার অভ্যাস: জাপানে গাড়ি থাকা সত্ত্বেও, বেশিরভাগ মানুষই পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে এবং স্টেশন পর্যন্ত হেঁটে যায়। বয়স্ক মানুষরাও তাদের দৈনন্দিন বাজার করা বা প্রতিবেশীর সাথে দেখা করার জন্য নিয়মিত হাঁটেন।
  • বাগান করা: বাগান করা জাপানিদের, বিশেষ করে বয়স্কদের, অন্যতম প্রিয় একটি কাজ। এটি শুধু একটি শখই নয়, এটি একটি চমৎকার শারীরিক ব্যায়ামও বটে।
  • মেঝেতে বসা: ঐতিহ্যবাহী জাপানি বাড়িগুলোতে চেয়ারের পরিবর্তে মেঝেতে বসা বা শোয়ার অভ্যাস রয়েছে। বারবার মেঝে থেকে ওঠা-বসা করলে শরীরের ভারসাম্য এবং পায়ের শক্তি বজায় থাকে, যা বার্ধক্যে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমায়।
বাসে উঠে যাতায়াত করছে জাপানি বৃদ্ধ

এই নিরন্তর এবং স্বাভাবিক নড়াচড়াই তাদের শরীরকে সচল এবং রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। তাদের জীবনযাত্রায় ব্যায়াম কোনো আলাদা ‘কাজ’ নয়, এটি জীবনেরই একটি অংশ।

উন্নত এবং সহজলভ্য স্বাস্থ্যসেবা

জাপানের বিশ্বমানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাও তাদের দীর্ঘায়ুর পেছনে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।

  • প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা: জাপানের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা চিকিৎসার চেয়ে রোগ প্রতিরোধের উপর বেশি জোর দেয়। মানুষ নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা করায়, যা প্রাথমিক পর্যায়েই যেকোনো বড় রোগ শনাক্ত করতে এবং তার চিকিৎসা শুরু করতে সাহায্য করে।
  • সহজলভ্যতা: জাপানের স্বাস্থ্য বীমা ব্যবস্থা অত্যন্ত শক্তিশালী। দেশের সকল নাগরিকই এই বীমার আওতায় থাকে, তাই ব্যয়বহুল চিকিৎসার খরচ নিয়ে তাদের খুব বেশি চিন্তা করতে হয় না।

এই পাঁচটি স্তম্ভ সুষম খাদ্যাভ্যাস, উদ্দেশ্যপূর্ণ জীবন, শক্তিশালী সামাজিক বন্ধন, সক্রিয় জীবনযাত্রা এবং উন্নত স্বাস্থ্যসেবা; একসাথে মিলেই জাপানিদের জন্য এক দীর্ঘ, সুস্থ এবং সুখী জীবনের পথ তৈরি করেছে।

জাপানের প্রায় এক লক্ষ শতবর্ষী মানুষের গল্প আমাদের এটাই শেখায় যে, দীর্ঘ জীবন কোনো লটারি বা জেনেটিক্সের দান নয়; এটি আমাদের প্রতিদিনের ছোট ছোট অভ্যাস এবং জীবনযাপনের দর্শনেরই ফল। 

আমাদের হয়তো জাপানের মতো খাদ্যাভ্যাস বা সামাজিক কাঠামো নেই, কিন্তু তাদের জীবনযাত্রার মূল নীতিগুলো আমরা প্রত্যেকেই আমাদের নিজেদের জীবনে প্রয়োগ করতে পারি। ‘হারা হাচি বু’র মতো পরিমিতি বোধ, ‘ইকিগাই’-এর মতো একটি উদ্দেশ্য খুঁজে নেওয়া, এবং প্রিয়জনদের সাথে সময় কাটানো এই ছোট ছোট পরিবর্তনগুলোই হয়তো আমাদের জন্য এক দীর্ঘ এবং আরও অর্থপূর্ণ জীবনের দরজা খুলে দেবে।

তথ্যসূত্র –

Related posts

দাশত-ই লুত: পৃথিবীর উষ্ণতম মরুভূমি

কবর নাকি গোপন ষড়যন্ত্র: জন এফ কেনেডির সমাধি

ঢাকার আকাশে কাকের অভাব: কোথায় গেল এই চেনা পাখি?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More