আপনার চিরচেনা বাড়িটির যদি দিনে দিনে কিছু কিছু পরিবর্তন আনতে আনতে পুরো বাড়িটাই যদি একদিন বদলে দেন; তবে এটাকে কি নতুন বাড়ি বলবেন নাকি পুরাতন বাড়িই? মাথায় গোলমাল লেগে গেলো?
হ্যা, কারণ এই প্রশ্ন কোন নিছক প্রশ্ন নয়, দর্শনশাস্ত্রের অধিবিদ্যক প্রশ্ন। আর এই চিন্তার সূত্রপাত ‘থিসিয়াসের জাহাজ’ দিয়ে শুরু হলেও আধুনিক প্রযুক্তি, চিকিৎসা ইত্যাদি ক্ষেত্রের উপরও বর্তায়।
চলুন দেখা যাক –
থিসিয়াসের জাহাজের গল্প
থিসিয়াস ছিলেন প্রাচীন গ্রিসের এথেন্সের যুবরাজ। তাঁকে তাঁর মা যুবক না হওয়া অবধি রাজ্য থেকে দূরে সরিয়ে রাখেন। যুবক হবার পর তাকে জানানো হয় যে, সে এথেনিয়ান সিংহাসনের যোগ্য উত্তরাধিকারী। এরপর এই দাবি আদায়ের জন্য থিসিয়াস এথেন্সে উপস্থিত হন।
সেখানে যেয়ে থিসিয়াস দেখতে পেলেন এজিয়াস(এথেন্সের তৎকালীন রাজা, থিসিয়াসের পিতা) ক্রিটের রাজা মিনোসের কাছে করুনভাবে নতি-শিকার করছেন। শুধু তাই নয়, এজিয়াস শর্ত মোতাবেক মিনোসের উদ্দেশ্যে সাতটি মেয়ে ও সাতটি ছেলে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছেন।
এখন, ক্রিটে থাকতো হিংস্র দানব মিনোটর, যার দেহটি অর্ধেক মানব ও অর্ধেক ষাড়। মিনোটরের শিকার হিসাবেই এজিয়াস এই ছেলে-মেয়েদের পাঠাতে উদ্যোত হন। গল্পের এ জায়গায় থিসিয়াস স্ব-ইচ্ছায় ঐ সাত ছেলের মধ্যে একজন হয়ে ক্রিটে যাত্রা করেন। থিসিয়াসের লক্ষ্য ছিলো যেভাবেই হোক মিনোটোরকে হত্যা করা এবং বাকি ছেলে-মেয়েদের বাঁচানো। এমতাবস্থায় এজিয়াস তাঁর পুত্র থিসিয়াসের জন্য খুবই দুঃখিত ছিলেন, কারণ এ যাত্রা নির্ঘাত মৃত্যুর পথে যাত্রা।
থিসিয়াস বীরদর্পে একটি কাঠের জাহাজ নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। থিসিয়াস তার বাবার বিচলিত দৃষ্টি দেখে বাবাকে প্রতিশ্রুতি দেন যে, যদি তিনি ফিরে আসেন তবে জাহাজটিতে সাদা পাল উড়বে। আর যদি তিনি মারা যান তবে পাল কালোই থাকবে।
এরপর ক্রিটে যেয়ে থিসিয়াস মিনোটরকে মারতে সক্ষম হন। কিন্তু মিনোটোরকে বধ করে এথেন্সে আসার সময় জাহাজে সাদা পাল উড়াতে ভুলে যান। এদিকে জাহাজের পাল কালো দেখে রাজা এজিয়াস দুঃখে,শোকে পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে আত্মাহুতি দেন। এরপর এথেন্সে নেমে থিসিয়াস তাঁর বাবার মৃত্যুতে খুব দুঃখ পান এবং সিংহাসনে আরোহন করেন। এই ছিলো থিসিয়াসের কাহিনী।
থিসিয়াসের জাহাজটির সৃষ্ট চিন্তা
এরপর এথেন্সের একটি জাদুঘরে সংরক্ষিত ছিলো থিসিয়াসের জাহাজ। এরপর সময়ের সাথে সাথে জাহাজের কিছু কাঠ অকেজো হতে শুরু করে এবং নতুন কাঠ লাগানো হয়। এখন এভাবে ধারাবাহিকভাবে সব কাঠ বদলে নতুন কাঠ লাগিয়ে দিলে, জাহাজটি কি আগের জাহাজই থাকবে নাকি নতুন কিছু হবে? এই প্রশ্ন তথা চিন্তার জন্ম দেন গ্রিক লেখক, চিন্তাবিদ প্লুটার্ক। এভাবে এই জাহাজটি পরবর্তীতে একটি “জাতীয় সম্পদ” হয়ে উঠে এবং সৃষ্টি করে যুগান্তকারী ‘এক দার্শনিক চিন্তা’র!
এই চিন্তা এত বিখ্যাত হয়ে পড়ে যে প্রখ্যাত দার্শনিক টমাস হবস এই তত্ত্ব নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন।
দার্শনিক বৃহৎ প্যারাডক্স ও থিসিয়াস
প্রথমে দেখা যাক এই প্যারাডক্স জিনিসটা কি? দর্শনতত্ত্বে প্যারাডক্স হলো, এমন একটা বিবৃতি যা স্ববিরোধী, আবার অযৌক্তিক দেখাবে। কিন্তু আপনি এটাকে হেয়জ্ঞানও করতে পারবেন না। কেননা আর যাইই হোক, এটা দ্বারা সত্য প্রকাশিত হয়। আর আমাদের চিন্তাভাবনাকে আরও প্রসারিত করবার সুযোগও দেয়। একটা উদাহরণ দিলে বোঝা সহজ হবে।
প্যারাডক্সের উদাহরণ- “এই বিবৃতিটি মিথ্যা”
এখন, এই বিবৃতিটাকে যদি মিথ্যা ধরেন, তাহলে এটি সত্য হবে। আর যদি সত্য হিসাবে ধরেন, তাহলে এটি মিথ্যা হবে। এখন, যেভাবেই দেখেন না কেন এর মধ্যেকার অযৌক্তিক, স্ব-বিরোধী, জিলাপির প্যাঁচে আপনাকে পড়তেই হবে।
থিসিয়াস জাহাজ ও এর পেছনের দার্শনিক চিন্তাটাও দর্শনশাস্ত্রে প্যারাডক্সিকাল বা আরেকটা জিলাপির প্যাঁচ। এবার এই প্যাঁচটা দেখা যাক-
এখানে থিসিয়াসের জাহাজ হলো একটি দার্শনিক চিন্তা, যা ধারাবাহিকতার আঙ্গিকে বস্তুর পরিচয় ও পরিবর্তনকে অনুসন্ধান করে। অর্থাৎ, কাঠগুলোর ধারাবাহিক পরিবর্তন কি জাহাজের পরিচয় বদলে দেয় নাকি দেয় না এটা অনুসন্ধান করে?
এই অনুসন্ধানে যদি রহস্যের আরও গভীর থেকে গভীরে চলে যাই তবে, প্রথমত আপনি একটু চিন্তা করুন তো যদি এমন হয় যে, থিসিয়াসের কিছু পরিত্যক্ত কাঠ দিয়ে আরেকটি জাহাজ তৈরি হলো। তাহলে এবার এক্ষেত্রে কি এই নতুন জাহাজকে থিসিয়াসের জাহাজ বলবেন?
ধরে নেয়া যাক, কেউ একজন নতুন তক্তাগুলো সরিয়ে থিসিয়াসে পুনরায় আগের পুরাতন কাঠগুলোই সেট করলো। এখন এখানে থিসিয়াসের জাহাজ দুইটা হলো,
ক) আগের নতুন কাঠের থিসিয়াসের জাহাজ,
খ) মূল তক্তা দিয়ে পুনরায় সেট করা থিসিয়াসের জাহাজ।
এখন, এখানে আসল থিসিয়াসের জাহাজ বলবেন কোনটাকে?
আবার ধরেন, ঐ জাহাজে একজন নাবিক ছিলেন যার খুব শখ ছিলো নিজস্ব একটা জাহাজের। কিন্তু তার সামর্থ্য নেই। সে থিসিয়াসের পরিত্যক্ত কাঠের টুকরাগুলো দিয়ে নিজে একটা জাহাজ বানালেন।
এখন তার বানানো এই জাহাজকে আপনি কি বলবেন? থিসিয়াসের জাহাজ নাকি নতুন কিছু?
হয়ে গেলো না জিলাপির প্যাঁচ! এজন্যই এই তত্ত্বের আরেক নাম ‘থিসিয়াসের প্যারাডক্স’।
এর দার্শনিক প্রভাব কতোটুকু?
এই প্যারাডক্সটির গুরুত্ব অপরিসীম। বলা চলে এটি আমাদের চিন্তার পথ তৈরি করে এবং জ্ঞানের বিকাশ ঘটায়। এই প্যারাডক্স সামগ্রিকভাবে বস্তুর পরিচয় নিয়ে গভীর গভীর সব প্রশ্ন উত্থাপন করে, তা হলো-
- আসলে কোন জিনিসটা বস্তুর পরিচয়? এর ইতিহাস,রূপ, উপাদান নাকি অন্যকিছু?
- পরিবর্তন ও এর ধারাবাহিকতা কি বস্তুকে একদম নতুনে বদলে দেয়? নাকি পরিবর্তনের কারণে মূল যে জিনিসটা সেটার পরিচয় ঠিকই থাকে?
- বস্তুর কি মৌলিক কোন বৈশিষ্ট্য থাকে যেটা থাকলে বস্তু বস্তুর পরিচয়েই থাকে?
দার্শনিকরা এক্ষেত্রে কি বলেন?
এক্ষেত্রে দর্শনের বিভিন্ন শাখা অনুসারে দার্শনিকদের ভিন্ন ভিন্ন মত লক্ষ্য করা যায়।
মৌলিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মতে,
এখানে দার্শনিকরা যুক্তি দেন যে থিসিয়াসের জাহাজটির যতোই কাঠ বদলানো হোক, এর মূল অংশ বা ডিজাইন অপরিবর্তিত আছে, এটাই আসল। তাই পরিবর্তনের ফলে পরিচয় বদলায় না বলে তারা মনে করেন।
অর্থাৎ, যতোই কাঠ বদলান থিসিয়াসের জাহাজ থিসিয়াসের জাহাজই থাকবে।
বস্তুবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মতে,
জাহাজের প্রতিটা কাঠ তার মূল অংশেরই একটা অংশ।এখন কাঠ যদি বদলায় তাহলে মূল অংশ আর অপরিবর্তিত থাকলো কোথায়! এক্ষেত্রে জাহাজটির যে বস্তুগত পরিচয় তা মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায়।ঐ বস্তু আর আগেরটা থাকেনা।
অর্থাৎ, একটা কাঠ তো কি, একটা ছোট্ট টুকরা বদলালেও থিসিয়াসের জাহাজ থিসিয়াসের জাহাজ থাকবে না।
ধারাবাহিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি মতে,
এই আদর্শের দার্শনিকরা মনে করেন, ধীরে ধীরে পরিবর্তন করলে বস্তুর পরিচয় বদলায় না। কিন্তু এই ‘মূল থেকে পরিবর্তন’ এর মাঝে যদি কোন ইতিহাস যুক্ত থাকে তবে এটাকে আবার পরিবর্তিত বলা যাবে।
বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গি মতে,
এখানে আবার কাঠের আলাপ বাদ। এখানে বড় বিষয় হলো, এখানে পর্যবেক্ষক ব্যক্তিটি।পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিভঙ্গি ও বিবেচনা এই জাহাজের পরিচয় বলে দিবে যে এটা নতুন নাকি পুরাতন থিসিয়াস।
অর্থাৎ,একজন পর্যবেক্ষক যদি মনে করেন জাহাজ থিসিয়াসের জাহাজই আছে, তো আছে।যদি ভাবেন নাই, তো নাই।
থিসিয়াসের জাহাজটির এক ধারণা, এক দার্শনিক চিন্তা কতকিছুর সাথে যুক্ত হয়ে গেল! দার্শনিক চিন্তা এভাবে পথ সৃষ্টি করে হাজারো পথের এবং সত্যানুসন্ধান করে।