Image default
রহস্য রোমাঞ্চ

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি ও আজমির শরিফের অজানা গল্প

কখনো কি শুনেছেন, কোনো মুসলিম দরগাহ বা সুফি মাজারকে ঘিরে দাবি উঠেছে যে সেটি নাকি একসময়ের হিন্দুদের শিব মন্দিরের উপর নির্মিত হয়েছিল? কিন্তু ঠিক এমনই এক বিতর্ক চলছে আজমির শরিফ দরগাহকে ঘিরে।

ভারতের রাজস্থানের আজমির শহরে দাঁড়িয়ে আছে এক আধ্যাত্মিক পীঠস্থান, খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ। আটশো বছরেরও বেশি সময় ধরে এই দরগাহ শুধু ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের কাছে নয়, হিন্দু, শিখ, এমনকি অন্য ধর্মের মানুষের কাছেও সমান শ্রদ্ধার জায়গা। এখানে প্রবেশাধিকার আছে নারীদেরও, যা দক্ষিণ এশিয়ার অনেক ধর্মীয় স্থানে দেখা যায় না। এজন্যই একে বলা হয় সম্প্রীতি, উদারতা আর আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্র।

আজকের লেখায় আমরা এই আজমির শরিফ নিয়ে নানা জানা অজানা গল্প। 

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি কে ছিলেন

আজমির শরিফের সঙ্গে যে নামটি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে, তিনি হলেন খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। তিনি সাধারণ মানুষের কাছে “গরীব নওয়াজ” নামে পরিচিত ছিলেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশতি ১১৪২ সালে, ইরানের সানজার শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে পড়াশোনা শেষ করেই, তাঁর মন টেনেছিলেন আধ্যাত্মিকতার দিকে। সেখান থেকেই শুরু তাঁর সুফিবাদের যাত্রা। এরপর গুরু খাজা ওসমান হারুনির শিষ্য হয়ে তিনি শুধু ধর্মীয় শিক্ষা নেননি, বরং শিখেছিলেন মানবিকতা, সহমর্মিতা আর ভালোবাসার পাঠ।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি তাঁর জীবনকালে বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। বাগদাদ, হেরাত থেকে শুরু করে লাহোর, দিল্লি অনেক স্থান ঘুরে অবশেষে ভারতের আজমির শহরে এসে স্থায়ী হন। ১১৯২ সালে, তরাইনের যুদ্ধের পর ভারতের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মুসলিম শাসনের সূচনা হলে, সেই সময়ই আজমিরে এসে পৌঁছান খাজা মইনুদ্দিন চিশতি। আর এখানেই তিনি মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেন শান্তি আর ভ্রাতৃত্বের বাণী। তাঁর শিক্ষা ছিল, মানুষকে শান্তিপ্রিয় হতে হবে, কিন্তু অন্যায়ের সামনে মাথা নত করা যাবে না। সত্যের পাশে দাঁড়ানোই প্রকৃত মানবিকতার পরিচয়।

অদ্ভুত বিষয় হলো, সে সময় রাজা থেকে কৃষক সবাই তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল। তাঁর দরবারে সবাই সমান সম্মান পেত। ধর্ম, জাত, ধনী-গরীবের ভেদাভেদ যেন সেখানে গলেই যেত। আর এভাবেই ধীরে ধীরে আজমির হয়ে উঠল সুফিবাদের কেন্দ্র।

আপনি যদি ভেবে থাকেন, আজমের শহরকে বেছে নেওয়া পিছনে শুধু কাকতালীয় বিষয় আছে তাহলে আপনি ভুল করছেন। এর পেছনেও ছিল বিশেষ কারণ। এই অঞ্চল প্রাচীনকাল থেকেই হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র স্থান হিসেবে পরিচিত ছিল। তখন এখানে ছিল ব্রহ্মার মন্দির, যার জন্য দূরদূরান্ত থেকে তীর্থযাত্রীরা আসতেন। পরে সুফি সাধক খাজা মইনুদ্দিন চিশতি এখানে আসন গ্রহণ করলে, আজমির ধীরে ধীরে পরিণত হয় হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ের তীর্থস্থলে, যা একে আধ্যাত্মিক সম্প্রীতির অনন্য প্রতীক বানায়।

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি

কথিত আছে, দিল্লি সালতানাতের প্রতিষ্ঠাতা শামসুদ্দীন ইলতুৎমিশ একদিন নিজেই এই সুফি সাধকের দরবারে এসে হাজির হয়েছিলেন। সেসময় একজন সম্রাটের কোন সাধুর শিষ্য হতে চাওয়ার বিষয়টি কেবল আধ্যাত্মিক শক্তির অসীম প্রভাবকেই নির্দেশ করে। 

খাজা মইনুদ্দিন চিশতি ১২৩৬ সালে মৃত্যুবরণ করেন। পরে, তাঁর সমাধির উপরই আজমির শরিফের দরগাহ নির্মিত হয়। প্রথমদিকে এটি ছিল সাধারণ কাঠের তৈরি একটি কাঠামো, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি উন্নত এবং বৃহত্তর আকার পেতে থাকে। দিল্লির সুলতানরা প্রথম এই দরগাহকে গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। পরবর্তী সময়ে মালওয়ার খিলজি এবং তুঘলক শাসকরা দরগাহকে আরও মজবুত ও সুসজ্জিত করেন। 

আজমির শরিফের দরগাহ

১৫৩২ সালে নির্মিত হয় এই দরগাহর দৃষ্টিনন্দন বিশাল গম্বুজ। ইন্দো-ইসলামিক স্থাপত্যের অনন্য নিদর্শন হিসেবে এই গম্বুজ আজও দাঁড়িয়ে আছে। পদ্মের অলঙ্করণ এবং সোনার মুকুট দিয়ে সজ্জিত এই গম্বুজ কেবল সৌন্দর্যই বৃদ্ধি করেনি, বরং দরগাহর মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক গুরুত্বও বাড়িয়েছে। এটি একটি প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে যা মানুষকে শান্তি, ভক্তি এবং আধ্যাত্মিকতা শেখায়।

আজমির শরিফ দরগার গম্বুজ

কিন্তু আজমির শরিফকে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করে তোলেন সম্রাট আকবর। ১৫৬২ সালে সন্তানের আশায় ফতেপুর সিক্রি থেকে খালি পায়ে হেঁটে আজমিরে আসেন তিনি। শুধুমাত্র ব্যক্তিগত মানত পূরণ নয়, সম্রাট আকবর দরগাহকে আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তিনি এখানে আকবরী মসজিদ নির্মাণ করেন এবং দরগাহকে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় ও ঐক্যের কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করেন। আকবরর মতো সম্রাটের আগমন দরগাহকে সর্বজনীন মর্যাদা প্রদান করে এবং সমাজে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দেয়। পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহানও এখানে একটি মসজিদ নির্মাণ করেন। 

আজমির শরিফ দেখতে সত্যিই মনোমুগ্ধকর। এখানে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে চোখে পড়ে বৃহৎ দরজা ও লাল ইটের দেয়াল, যা প্রথম মুহূর্তেই প্রাঙ্গণকে বিশেষ মর্যাদা দেয়। প্রাঙ্গণ ভরে থাকে ভক্তদের ভিড়, আর ফুল ও রঙিন চাদর দিয়ে সাজানো স্টলগুলো যেন উৎসবমুখর পরিবেশ সৃষ্টি করে।

মাজারের মূল স্থানে রয়েছে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির সমাধি, যা সাদা পাথরে তৈরি এবং রঙিন চাদর ও ফুলে মোড়া। সমাধির ওপর দেখা যায় দৃষ্টিনন্দন সবুজ বা সোনালি গম্বুজ, চারপাশে মিনারগুলো ঐতিহ্যবাহী সুফি স্থাপত্যের ছাপ ফুটিয়ে তোলে। আর ভেতরে আছে কাওয়ালি হল, যেখানে প্রতিদিন সুফি গান পরিবেশন করা হয়।

মইনুদ্দিন চিশতির কবর

আজমির শরিফের দরগাহ শুধু আধ্যাত্মিকতার কেন্দ্রই নয়, বরং কাওয়ালি সঙ্গীতের অমর ধারাকে ধারণ করে রেখেছে। এই সঙ্গীতের সঙ্গে সবচেয়ে গভীরভাবে যুক্ত সুফি সাধক আমির খুসরো, যিনি কাওয়ালির সূচনা করেছিলেন। সন্ধ্যার পর দরগাহর প্রাঙ্গণে কাওয়ালি আসর বসে, যেখানে গায়করা ভক্তি ও ঈশ্বরপ্রেমের সুর পরিবেশন করেন। কাওয়ালির সুর, তাল এবং ভক্তি, ভক্তদের হৃদয়ে এক অদ্ভুত প্রশান্তি ও গভীর আবেগ জাগিয়ে তোলে। মানুষের চোখের নীরবতা, মনে শান্তি, আর আত্মার সঙ্গে ঈশ্বরের মিলনের অনুভূতি জাগে। এমনকি বিশ্বখ্যাত শিল্পীরা, যেমন নুসরাত ফতেহ আলি খান, সাবরি ব্রাদার্স এর মত তরুণ প্রজন্মের শিল্পীরাও, আজমির শরিফকে তাদের সঙ্গীত যাত্রার অনুপ্রেরণা হিসেবে দেখেছেন। 

আজমির শরীফে কাওয়ালি

আজমির শরিফের আরও গভীর গুরুত্ব প্রকাশ পায় মাজার এর উরস এর সময়। প্রতি বছর ইসলামি চন্দ্র ক্যালেন্ডারের রজব মাসে উদযাপিত হয় এই ‘উরস’। যদিও এটি হজরত খাজা মইনুদ্দিন চিশতির মৃত্যুবার্ষিকী হিসেবে পালিত হয়, কিন্তু ভক্তরা একে ‘ঈশ্বরের সঙ্গে মিলনের দিন’ হিসেবে অভিব্যক্ত করেন। উরস উপলক্ষে দরগাহ সোনালি আলোয় সেজে ওঠে। লক্ষাধিক ভক্ত বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে এখানে ভিড় করেন। মেলার আয়োজন হয়, দিন-রাত ধরে দরগাহর প্রাঙ্গণে কাওয়ালি চলতে থাকে, আর ভক্তরা খাজা মইনুদ্দিন চিশতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে মাজারে চাদর পেশ করে।

আজমির শরিফ নিয়ে নতুন বিতর্ক 

তবে, সম্প্রতি আজমির শরিফকে কেন্দ্র করে নতুন বিতর্ক উত্থিত হয়েছে। হিন্দু সেনার সভাপতি ভিষ্ণু গুপ্তা দাবি করেছেন, এই দরগাহ একসময়ের শিব মন্দিরের উপর তৈরি হয়েছিল। আর মামলাকারীর এই দাবির ভিত্তি হলো, হরবিলাস সারদার লেখা একটি বই। হরবিলাস সারদা ১৯১১ সালে ‘আজমির: হিস্টোরিকাল অ্যান্ড ডেসক্রিপ্টিভ’ নামে  ২০৬ পাতার একটি বই  লিখেছেন। 

যেখানে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির দরগাহ নিয়েও একটি অধ্যায় আছে। বিশেষভাবে সেই বই এর ৯৭ নম্বর পাতায় উল্লেখ আছে, দরগাহর ভেতরে মহাদেবের মন্দির ছিল এবং সেখানে এক ব্রাহ্মণ পরিবার প্রতিদিন চন্দন রাখত। এর এই কাহিনীর ভিত্তিতেই মামলাটি দায়ের করা হয়েছে।

অন্যদিকে দরগাহের উত্তরাধিকারী সৈয়দ নাসিরুদ্দিন চিশতি এই দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আজমির শরিফ নিয়ে যত ইতিহাস বই আছে, তাদের লেখক হিন্দু হোক বা মুসলমান, এধরনের কোনো কাহিনী তারা উল্লেখ করেননি। বিশ্বের হিন্দু ও মুসলমান সবার কাছেই আজমির শরিফ এক আস্থার ও বিশ্বাসের স্থান। ফলে, হরবিলাস সারদার বইয়ের তথ্য কতটা প্রামাণ্য, তা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। 

আজমির শরীফ দরগাহ- এ ভক্তরা চাদর দিচ্ছে

আজমির শরিফ শুধু একটি দরগাহ নয়, এটি অবিভক্ত ভারতের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সুফিবাদ এবং মানবতার প্রতীক। খাজা মইনুদ্দিন চিশতির শিক্ষা আমাদের শেখায় যে মানুষের প্রতি ভালোবাসাই সর্বোচ্চ ধর্ম। তিনি বলেছিলেন, “শান্ত থেকেও অত্যাচারের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো যায়।” আজ, যখন সমাজে বিভাজনের রাজনীতি তাণ্ডব চালাচ্ছে, তখন আজমির শরিফের ইতিহাস আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সত্যিকারের শক্তি এবং শক্তিশালী ঐক্য একতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে।

রেফারেন্স:

Related posts

ভৌতিক গ্রাম কুলধারা: বাস্তবতা নাকি নিছক গল্প!

লালবাগ কেল্লার সুড়ঙ্গ কি আসলেই মৃত্যুর ফাঁদ? রহস্যে ঘেরা ইতিহাস

মৃত্যু সম্পর্কে অন্যান্য প্রাণীর ধারণা: প্রাণীদের কাছে মৃত্যু কী?

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More