এই সমুদ্র পথ দিয়ে গেলে আর কোনও জাহাজ ফিরে আসে না। উড়ন্ত বিমানও নাকি চোখের পলকে উধাও হয়ে যায়। না, বারমুডা ট্রায়াঙ্গেল নয়। এটি জাপানের ড্রাগন ট্রায়াঙ্গেল। লোকে বলে, এই পথে রয়েছে অশুভ শক্তির আনাগোনা। তাই একে ‘ডেভিল সি’-ও বলা হয়ে থাকে।
ভয়ংকর বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কথা কমবেশি সবারই জানা আছে যেখানে জাহাজ বা বিমান ঢুকে পড়লেই অদৃশ্য হয়ে যায়! বারমুডা ট্রায়াংগেলের অজানা রহস্য মীমাংসা করতে না করতেই আরেকটি বিস্ময়কর স্থানের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। সেই স্থানটিও অনেকটা বারমুডা ট্রায়াংগেলের মতই। তবে এখানে বিমানের চেয়ে বেশি নিখোঁজ হয় মানুষভর্তি জাহাজ আর নৌকা। অত্যন্ত বিপজ্জনক এই অঞ্চলটির অবস্থান জাপানে, যেটিকে সবাই চেনে ‘ড্রাগন’’স ট্রায়াঙ্গেল’ নামে।
প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে এক রহস্যময় এলাকা—জাপানের ডেভিল ট্রায়াঙ্গেল বা ড্রাগন’স ট্রায়াঙ্গেল। এটি এমন এক অঞ্চল যেখানে শত শত জাহাজ ও বিমান রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হয়েছে।
ড্রাগন’স ট্রায়াঙ্গেলের ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য, ইতিহাস, রহস্যজনক সব ঘটনা, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও জনপ্রিয় মিথ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আজকের এই লেখায়।
Berডেভিল ট্রায়াঙ্গেলের ভৌগোলিক পরিচয়
এই স্থানের আয়তন নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কিছু নথিতে বলা হয়, ড্রাগন’স ট্রায়াংগেল জাপানের পূর্ব উপকূল থেকে ১১০ কিলোমিটার দূরে, আবার কোথাও বলা হয় জাপান থেকে বারোশ কিলোমিটার দূরে আয়োজিমা দ্বীপের কাছে এই সাগর অবস্থিত। কিন্তু জাপানের বো নিন দ্বীপ থেকে ফিলিপাইন সাগরের সিংহভাগ অঞ্চল ডেভিল’স সি নামে পরিচিত।
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জাপানের দক্ষিণে টোকিও থেকে ১০০ কি.মি দূরে এই রহস্যময় স্থান অবস্থিত। এটি মূলত জাপানের উপকূল থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে অবস্থিত, যেখানে ফিলিপাইন সাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশ ও মারিয়ানা ট্রেঞ্চের কিছু অংশ অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।
বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের মতো, এই অঞ্চলটিও একটি কাল্পনিক ত্রিভুজ হিসেবে বিবেচিত হয়। জাপান ও ফিলিপিন্সের সীমান্তে জাপানের ইয়োকাহামা থেকে ফিলিপিন্সের গুয়াম পর্যন্ত, গুয়াম থেকে মারিয়ানা, আবার সেখান থেকে ইয়োকাহামা পর্যন্ত এই ‘মা নো উমি’ বা ‘ডেভিল সি’-র ড্রাগন ট্রায়াঙ্গলে নাকি অশুভ আত্মারা রয়েছে, অনেকেই এমনটা বলে থাকেন।
ড্রাগন’স ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যময় ইতিহাস
ডেভিল’স সি-কে কেন্দ্র করে বহু চীনা পৌরাণিক কাহিনী প্রচলিত আছে। তারা মনে করে এই অঞ্চলের পানির নিচে ড্রাগন বাস করে। এরাই ক্ষুদ্র জাহাজগুলো গিলে খায়। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর আগে থেকেই তাদের মধ্যে এই উপকথা চলে আসছে। ফলে বোঝা যায় অতি প্রাচীন কাল থেকেই এই সাগরে নানা ধরনের অলৌকিক ঘটনা ঘটত।
প্রাচীন নাবিকদের মতে, সাগরের নিচে লুকিয়ে থাকা ড্রাগনরা সমুদ্রের গভীর থেকে উঠে এসে জাহাজ ও নাবিকদের টেনে নিয়ে যেত। অনেকেই বিশ্বাস করতেন, সমুদ্রের গভীরে কোনো অজানা শক্তির উপস্থিতি রয়েছে যা জাহাজকে টেনে পানির নিচে নিয়ে গায়েব করে ফেলে।
১৮০০ শতকের দিকে লোকমুখে প্রায়ই শোনা যেতো, এই এলাকার অনেকেই জাহাজে করে এক রহস্যময় নারীকে প্রদক্ষিণ করতে দেখেছেন।
ড্রাগন’স ট্রায়াঙ্গেলের ভয়ংকর যত ঘটনা
চেঙ্গিস খানের নাতি কুবলাই খান ১২৭৪ সালে এবং ১২৮১ সালে জাপান আক্রমণ করেন। কিন্তু দুবারই তিনি ব্যর্থ হন। কারণ ডেভিল’স সি এলাকায় মারাত্মক টাইফুনের কবলে পড়ে তার বাহিনী। কুবলাই খানের বেশ কয়েকটি জাহাজ এবং প্রায় ৪০ হাজার সৈন্য এ সাগরে হারিয়ে যায়।
১৯৪০ এবং ১৯৫০ এর দশকে বহু মাছ ধরার নৌকা এবং পাঁচটি সামরিক জাহাজ এই সাগরে নিখোঁজ হয়। ১৯৫২-১৯৫৪ সালে নাকি পরপর বেশ কয়েকটি জাহাজ হারিয়ে যাওয়ার সময় প্রায় ৭০০ জন সেনাও গায়েব হয়ে যান। কারও আর খোঁজ মেলেনি। এ ছাড়া দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও নাকি ৫০০টি বিমান, ১০টি যুদ্ধজাহাজ, ১০টি নৌ-যান ওই এলাকাতেই ধ্বংস হয় বা হারিয়ে যায়।
সেসময় আবহাওয়া একেবারেই প্রতিকূল ছিল না, কিন্তু তারপরেও নাকি ওই এলাকার আশপাশে এলেই জাহাজ নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু রেডিও সিগন্যালে নাকি বার্তা পাওয়া যায়নি।
রহস্য সন্ধানে কায়ো মারু নামে একটি জাহাজ পাঠিয়েছিল জাপান। এই স্থানের রহস্য ভেদ করতে জাহাজে রাখা হয় শুধু বিজ্ঞানীদের। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস! রহস্যভেদ করতে গিয়ে তারা নিজেরাও রহস্য হয়ে আর ফিরে আসেননি। ৩১ জন বিজ্ঞানীর খোঁজ না মেলার কথা রটে যাওয়ার পর থেকেই সবাই বলতে থাকেন সমুদ্রের তলদেশে রয়েছে মানুষখেকো ড্রাগন।
এই ঘটনার পর পুরো জাপান জুড়ে চাঞ্চল্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। ফলশ্রুতিতে, জাপান সরকার সমুদ্র যাতায়াত এবং পণ্য পরিবহনের জন্য অঞ্চলটিকে বিপজ্জনক ঘোষণা করে।
১৯৭০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের কিছু সাবমেরিনও এই এলাকায় নিখোঁজ হওয়ার রিপোর্ট পাওয়া যায়।
নিখোঁজ হওয়ার সম্ভাব্য কারণ নিয়ে আলোচনা
ডেভিল ট্রায়াঙ্গেলের অজানা রহস্যের পেছনে অনেক ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছেন গবেষক ও বিজ্ঞানীরা। ১৯৮৯ সালে চার্লস বার্লিৎজ নামে এক লেখক ‘দ্য ড্রাগনস ট্রায়াঙ্গল’ বইয়ে লেখেন পঞ্চাশের দশকে জাহাজডুবি ও সেনা নিখোঁজের কথা। ১৯৯৫ সালে ল্যারি কুশে নামে এক লেখক বলেন, কায়ো মারু ১৯৫২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর ধ্বংস হয়, পরে অবশ্য ধ্বংসাবশেষ মিলেছিল।
ল্যারিই বলেন, এই অঞ্চলে মৎস্যজীবীদের নৌকা নিখোঁজ হয়েছিল, জাহাজ নয়। ল্যারি বলেন, অগ্ন্যুৎপাত ছাড়াও ভূমিকম্পের প্রবণতাও রয়েছে এই সব এলাকায়। সব মিলেই ‘অশুভ আত্মা’র কথা রটে গিয়েছিল। আর ছোট মাছ ধরার নৌকা গভীর সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়ার ঘটনা খুবই স্বাভাবিক। সমুদ্রের ঢেউয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্সের কথাও উল্লেখ করেন কিছু বিজ্ঞানী। এর ফলে অনেক সময়ই ছোট দ্বীপও উধাও হয়ে যেতে পারে। আবার নতুন দ্বীপের জন্মও হতে পারে, দাবি তাদের।
ইভান টি স্যান্ডারসন বলেন, এটি বিশ্বের ১২টি ভাইল ভর্টেক্সের অন্যতম। ১৯৭২ সালে লন্ডনের সাগা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত ‘দ্য টুয়েলভ ডেভিল’স গ্রেভ ইয়ার্ডস অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ বলছে, পৃথিবীতে মোট ১২টি জায়গায় তীব্র চৌম্বকীয় আকর্ষণ অনুভূত হয়। আর `ডেভিলস সি` ড্রাগন ট্রায়াঙ্গলও তাই।
সায়েন্টিফিক আমেরিকানের তথ্য অনুযায়ী, ড্রাগন ট্রায়াঙ্গলের এই স্থানটিতে প্রায় ৩৭ হাজার মাইল এলাকা জুড়ে গভীর সামুদ্রিক খাদ রয়েছে এবং এখানে প্রচুর পরিমাণে গরম লাভা ও কার্বন ডাই অক্সাইড রয়েছে। এছাড়াও ৫০-এর দশকে রেডিও সিগন্যাল ব্যবস্থা শক্তিশালী ছিল না। তাই ওই ঘটনাগুলো রটে যায়।
১৯৭৩ সালে ল্যারি কুশ এবং আসাহি সিম্বুন (জাপানের একটি সংবাদপত্র) এর সহ-সম্পাদক শিগেরু কিমুরার যৌথ প্রয়াসে লেখা বই থেকে মায়োজিনশো নামক সক্রিয় আগ্নেয়গিরি সম্পর্কে জানা যায়। মারু নামক জাহাজটি যেখানে নিখোঁজ হয়েছিল এই আগ্নেয়গিরির অবস্থানও নাকি ঠিক সেখানেই।
পরিবেশবিদদের একাংশের মত, এমন অগ্ন্যুৎপাত বা ভূমিকম্পের কারণে সেখানকার প্রাকৃতিক পরিবেশ প্রতিনিয়ত বদলায়। এ ছাড়াও মাছ ধরার ছোট নৌকা হারিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে, রেডিও ট্রান্সমিটার না থাকার কথাও বলেছেন বিজ্ঞানীরা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি আর্টিকল অনুযায়ী, ১৯৫৫ সালের ১৬ জানুয়ারি ওই এলাকার একটি জাহাজ থেকে রেডিও সিগন্যাল এসে পৌঁছনোর খবরও রয়েছে। এর আগে একবার ইউএফও-র কথাও শোনা গিয়েছিল এই এলাকা ঘিরে। বিজ্ঞানীরা যদিও এই ভিনগ্রহী যানের তত্ত্ব মানতে একেবারেই রাজি নন।
জাপানের উপকূলরক্ষী বাহিনীর কাছে নাকি এ রকম কোনও খবরই নেই, এমনটাই লিখেছিলেন ল্যারি কুশে। তাই ২ লাখ টনের সামরিক জাহাজ বা ৭০০ সেনা নিয়ে জাহাজ উধাও হয়ে যাওয়ার মতো খবরগুলো একেবারেই ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন তিনি।
ডেভিল ট্রায়াঙ্গেল: বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নাকি অতিপ্রাকৃত কাহিনি?
বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা
ডেভিল ট্রায়াঙ্গেলের রহস্য উন্মোচনের জন্য বিজ্ঞানীরা যেসব গবেষণা করেছেন তার কিছু বিশ্লেষণ দেওয়া হলো-
১. মিথেন হাইড্রেট বিস্ফোরণ তত্ত্ব
সমুদ্রের তলদেশে প্রচুর মিথেন হাইড্রেট জমা রয়েছে, যা হঠাৎ বিস্ফোরিত হলে জলীয় বুদবুদ সৃষ্টি করে এবং জাহাজের ভাসমান ক্ষমতা নষ্ট করে দিতে পারে। এই কারণে অনেক জাহাজ ডুবে যেতে পারে, এবং এদের ধ্বংসাবশেষও বেশিরভাগ সময় খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়। তাই সমুদ্রের তলদেশে অশুভ শক্তির আনাগোনা থাকার বিষয়টি ভিত্তিহীনই বলা যায়।
২. চৌম্বকীয় বিভ্রাট তত্ত্ব
পৃথিবীর চৌম্বক ক্ষেত্র ডেভিল ট্রায়াঙ্গেলের মতো কিছু অঞ্চলে অস্বাভাবিক আচরণ করে।
এই অঞ্চলে কম্পাস এবং নেভিগেশন সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ না করলে, জাহাজ ও বিমান ভুল পথে চলে যেতে পারে এবং হারিয়ে যেতে পারে। তাই বেশিরভাগ সময় নাবিকেরা এই অঞ্চল পার হওয়ার সময় ভুল পথে চলে যান এবং ফলস্বরূপ হারিয়ে যান, স্রোতের অতল গহ্বরে।
তাই কোন অতিপ্রাকৃত শক্তি তাদের বিভ্রান্ত করছে এমন আশংকা একেবারেই বিজ্ঞানসম্মত নয়।
৩. ভূমিকম্প ও সাবমেরিন আগ্নেয়গিরি
বিজ্ঞানীরা বলছেন, প্রশান্ত মহাসাগরের তলদেশে সক্রিয় ভূমিকম্প প্রবণতা এবং সাবমেরিন আগ্নেয়গিরি রয়েছে। আকস্মিক ভূমিকম্প বা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি করতে পারে, যা জাহাজ ও সাবমেরিনকে নিমজ্জিত করতে সক্ষম। তাই একটা জাহাজকে ডুবিয়ে দিতে সমুদ্রতলের কাল্পনিক ড্রাগনদের কোন ভূমিকা নেই।
৪. প্রবল সমুদ্রস্রোত ও টাইফুন
বিজ্ঞানীদের ভাষ্যমতে, ডেভিল ট্রায়াঙ্গেল অঞ্চলে প্রশান্ত মহাসাগরের শক্তিশালী সমুদ্রস্রোত এবং টাইফুন প্রায়ই সৃষ্টি হয়। তাই জাহাজ এবং বিমান হারিয়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে হঠাৎ ঝড়ের কবলে পড়া এবং প্রবল সমুদ্রস্রোতে ভেসে যাওয়া, কোন শয়তানের শক্তি এখানে কাজ করছে বলে মনে করার কারণ নেই।
পৃথিবীর জলে স্থলে অসংখ্য জায়গায় লুকিয়ে রয়েছে নানান রহস্য। বিজ্ঞান কিংবা যুক্তি দিয়ে এসবের ব্যাখ্যা হয় না। পৃথিবীর বুকে এমনই এক রহস্য ঘেরা জায়গার নাম ডেভিলস সি বা শয়তানের সাগর। তাই যতই বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালানো হোক না, এই ভয়ংকর স্থান নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা থাকবেই। তার সাথে জন্ম নেবে বিভিন্ন কিংবদন্তি ও সত্য-মিথ্যার উপাখ্যান।
প্রশান্ত মহাসাগরের এই অঞ্চলের পৌরাণিক কাহিনী বা বৈজ্ঞানিক গবেষণা কোনটিই এই স্থানের রহস্য উন্মোচন করতে পারেনি। তবে এই রহস্য থেকে এটি নিশ্চিত যে প্রকৃতিতে এমন অনেক বিষয় আছে যা মানুষের বোধগম্যতার বাইরে। আর এ কারণেই বৈচিত্র্যময় এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকা এতটা রোমাঞ্চকর!