Image default
জীবনীজীবনী

দ্য রেড মাওলানা-আবদুল হামিদ খান ভাসানী

মাথায় তালের আঁশের টুপি, পড়নে সাধারণ লুঙ্গি-পাঞ্জাবী, কিন্তু প্রাণে তার জনগণ জন্য অসামান্য ভালোবাসা !! এমনই ছিলেন লাল মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী

“অন্যায়ের প্রতিবাদ করো।
জুলুমকে রুখিয়া দাঁড়াও, যদি কাহাকেও শাসাইতে হয় তাহার সম্মুখে
বীরের মতো বলো।
ভীরু কাপুরুষের মতো অজ্ঞাতে কিছু বলিও না।”

কথাগুলো কে বলেছিলেন জানেন? হ্যাঁ, ঠিকই বলেছেন। কথাগুলো বলেছেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তিনি এমন একজন মানুষ ছিলেন, যিনি পুরো জীবনটা কাটিয়েছেন গরিব, শোষিত আর নিপীড়িত মানুষের জন্য। তিনি সবার কাছে “মজলুম জননেতা” হিসেবে পরিচিত ছিলেন। সাধারণ মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা বলতে তিনি কখনোই পিছপা হন নি।

অসাধারণ ব্যাপার হলো, তার বয়স যতই বাড়ুক না কেন, তার লড়াই থেমে থাকেনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি তার প্রাণশক্তি ও লড়াকু মানসিকতা নিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে গিয়েছেন।

মাওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত জীবন

মাওলানা ভাসানীর বাড়ি

মাওলানা ভাসানীর জন্ম ও পরিবার

মাওলানা ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর, সিরাজগঞ্জ জেলার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পুরো নাম আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তার পিতার নাম হজরত শারাফত আলী এবং মায়ের নাম মোসাম্মৎ মাজেদা খাতুন। তার বাবা পেশায় ছিলেন একজন কৃষক। তাই ছোটবেলা থেকেই দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়াই করে তাকে বেড়ে উঠতে হয়েছিল।

মাওলানা ভাসানীর ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কে খুব বেশি তথ্য পাওয়া যায় না। তবে, পারিবারিক জীবনের তিনি তিন স্ত্রী ও সাত সন্তান পিতা ছিলেন। 

শিক্ষা জীবন

মাওলানা ভাসানীর প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি গ্রামের মক্তবে। তিনি মাদ্রাসায় পড়া ছাড়া অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীতে উচ্চতর ইসলামী শিক্ষার জন্য তিনি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে তিনি বিদ্যার শিক্ষার চেয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামী চেতনায় বেশি মনোযোগী হয়ে পড়েন। পরবর্তীতে তার ধর্মীয় জ্ঞান এবং মানুষের প্রতি সহানুভূতির কারণে তাকে “মাওলানা” উপাধি দেওয়া হয়।

কর্মজীবন

মাওলানা ভাসানীর কর্মজীবনের শুরু টাঙ্গাইলের কাগমারির এক প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরবর্তীতে তিনি ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের কালা গ্রামের এক মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। 

সাধারণ জীবনধারা

মাওলানা ভাসানী অত্যন্ত সরল ও সাধারণ জীবনযাপন করতেন। তিনি সর্বদা সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশতেন। তাদের দুঃখ-কষ্ট ভাগ করে নেওয়ার চেষ্টা করতেন। তার পোশাক-পরিচ্ছদ ছিল অত্যন্ত সহজ। যা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে মানানসই। ধনী-গরিবের ভেদাভেদ তিনি কখনো মেনে নেননি। তিনি বিলাসিতা থেকেও দূরে থাকতেন। 

মাওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক জীবন

সাম্রাজ্যবাদ  আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী যে দুটি পর্যায়ে ভূমিকা রেখেছিল তা হচ্ছে ১৯১০ থেকে ১৯৪৭ এবং ১৯৪৭ থেকে ১৯৭১ সাল।

ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম

মাওলানা ভাসানী ব্রিটিশ শাসনের সময় থেকেই রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ১৯১৯ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রাথমিক সদস্য হন। সে সময় তিনি ব্রিটিশবিরোধী অসহযোগ আন্দোলন এবং খেলাফত আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন।

খেলাফত আন্দোলন

কংগ্রেসে যোগদান ও ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তাকে দশ মাস কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এটি ছিল তার প্রথমবারের মতো কারাবাসের অভিজ্ঞতা। এই কারাবাসের সময়ই তিনি অনেক খ্যাতিমান রাজনৈতিক কর্মী ও নেতার সংস্পর্শে আসেন। ১৯২০-এর দশকে, ভাসানী “কৃষক প্রজা পার্টি” গঠন করেন। যা বাংলার কৃষকদের অধিকার রক্ষা ও  আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে কাজ করেন।

তিনি ১৯৩২ সালে ডিসেম্বরের সিরাজগঞ্জের কাওয়ালীতে বঙ্গ আসান প্রজা সম্মেলন নামে একটি ঐতিহাসিক কৃষক সমাবেশ আয়োজন করেছিলেন। ওই সম্মেলনে জমিদারি উচ্ছেদ ,খাজনা রাশ, নজর সেলামি বাতিল, মহাজনের হার নির্ধারণ সহ বহুবিধ প্রস্তাব গৃহীত হয়। যার ফলে ১৯৩৬ সালে “বঙ্গীয় কৃষি খাদক আইন” পাস হয়েছিল এবং ১৯৩৭ সালে “ঋণ সলিডি বোর্ড” তৈরি হয়েছিল।

আসাম আন্দোলন 

ভাসানী ১৯৩৭ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। সংসদের বাইরেও রাজপথে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। আসামের কুখ্যাত “লাইন প্রথার” (ব্রিটিশ শাসনামলে চা বাগানের শ্রমিকদের উপর আরোপিত একটি শোষণ ব্যবস্থা) বিরুদ্ধেও তিনি সংগ্রাম করেন। তার এই সংগ্রামকে দক্ষিণ আফ্রিকার মহাত্মা গান্ধীর বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে তুলনা করা হয়।

পাকিস্তান আন্দোলনে ভূমিকা

মুক্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ১৯৩০ সালে মাওলানা ভাসানী মুসলিম লীগে যোগ দিয়েছিলেন। তিনি পূর্ব বাংলায় এর প্রভাব বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কিন্তু দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান জন্মের দুবছরের মধ্য তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা পূর্ব বাংলার মানুষের প্রতি অবহেলা ও শোষণের নীতি গ্রহণ করছে। তারা বাংলার জনগণকে নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি, অর্থনীতি, এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করতে চায়।

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা

গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৪৯ সালে মাওলানা ভাসানী আওয়ামী মুসলিম লীগ (পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলটি পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করতে থাকে। মাওলানা ভাসানী ছিলেন দলটির প্রথম সভাপতি। আওয়ামী লীগের মাধ্যমে তিনি ভাষা আন্দোলন এবং বাঙালির সাংস্কৃতিক অধিকার রক্ষার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন।

ভাষা আন্দোলনে ভূমিকা

মাওলানা ভাসানী ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার নেতৃত্বে কৃষক, শ্রমিক, যুবক এবং বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ভাষা আন্দোলনের লড়াই করেছিল। তিনি সর্বদলীয় ভাষা সংগ্রাম পরিষদেরও সভাপতি ছিলেন।

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে কয়েকজন ছাত্র নিহত হন। ভাসানী এর কড়া প্রতিবাদ করেন। যার কারনে ২৩ ফেব্রুয়ারি তাকে তাঁর গ্রামের বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। রাজনৈতিকভাবে ভাসানী এতে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।

যুক্তফ্রন্ট প্রতিষ্ঠা

পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ভাসানী তখনকার পাঁচটি বিরোধী দল নিয়ে যুক্তফ্রন্ট নামে একটি মোর্চা গঠন করেন। এ মোর্চার নেতা ছিলেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান ও হাজী মোহাম্মদ দানেশ। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। 

মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান

আওয়ামী মুসলিম লীগের ভূমিকা

মাওলানা ভাসানী ভাষা ও ধর্মের সাম্প্রদায়িকতার ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল গঠন অত্যন্ত জরুরি। তাই তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ দেওয়ার পক্ষে ছিলেন। তার উদ্যোগেই পরবর্তীতে দলের নাম থেকে “মুসলিম” শব্দটি বাদ পড়ে। 

বামপন্থী রাজনীতির যাত্রা শুরু

মাওলানা ভাসানী  ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বের হয়ে আসেন। কারণ হিসেবে তিনি কুমিল্লার রূপসা সম্মেলনে স্পষ্টভাবে জানান যে, তিনি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও অবিচারের বিরুদ্ধে আরো কঠোর অবস্থান নিতে চান। যা আওয়ামী লীগের মধ্য থেকে সম্ভব নয়। 

ভাসানী বলেছিলেন, “শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার জন্য বামপন্থী ধারায় রাজনৈতিক সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।”

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা ও আঞ্চলিক সাহিত্য শাসনকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় করে তিনি পরবর্তীতে রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) প্রতিষ্ঠা করেন। এই দলের মাধ্যমে তিনি বামপন্থী আদর্শের দিকে যাত্রা শুরু করেন। তিনি কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষের স্বার্থে কাজ করার প্রত্যয় নিয়ে এক নতুন আন্দোলন শুরুর চেষ্টা করেন। তাঁর দল কৃষকদের অধিকার, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, কৃষি উৎপাদন বাড়ানো এবং অর্থনৈতিক সমতা প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করত।

গণমানুষের নেতা

মাওলানা ভাসানীকে “মজলুম জননেতা” বলা হয়। কারণ, তিনি শোষিত, বঞ্চিত ও অবহেলিত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। সবসময়ই তিনি সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তার ছিল দৃঢ় অবস্থান। যা তাকে গণমানুষের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে স্থান করে দিয়েছে।

তার বিখ্যাত একটি স্লোগান “ভোটের অধিকার কেড়ে নেব”। গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলনে প্রান্তিক মানুষের মাঝে এই স্লোগান বিশেষভাবে তাকে জনপ্রিয় করে তোলে। এই স্লোগান কেবল একটি প্রতিবাদ নয়, বরং, বঞ্চিত মানুষের জন্য শক্তির প্রতীক হয়ে ওঠে।

পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি

১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তুলে ধরেন। সেখানে তিনি পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও বৈষম্যের নীতির বিরুদ্ধে তিনি তীব্র সমালোচনা করেন। এই বক্তব্য তার রাজনৈতিক আদর্শ এবং জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে এক নতুন দিক নির্দেশনা দেয়।

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান

১৯৬৮ সালে ছাত্র অসন্তোষকে কেন্দ্র করে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে আন্দোলনের সুত্রপাত হয়। যা দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল শহর এবং গ্রামে। শ্রমিক, কৃষক, নিম্ন আয়ের পেশাজীবী সহ বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষের মধ্যে এরকম আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ৬৮ এর ছাত্র আন্দোলন পরবর্তীতে গণআন্দোলনের রূপান্তরিত হয়।

এই আন্দোলনে মাওলানা ভাসানী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) মাওলানা ভাসানী এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন। লাখো মানুষ এই সভায় অংশগ্রহণ করে। সেখানে ভাসানীকে তাদের আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসেবে সমর্থন জানানো হয়। এই অভ্যর্থনা তাঁকে আরও শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যায়।

স্বাধীনতার আভাস

১৯৭০ সালের ২৩শে নভেম্বর পল্টনের ময়দানে মাওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের ঘোষণা দেন। ভাসানী তাঁর ভাষণে স্পষ্টভাবে বলেন, “যদি পাকিস্তানের শাসকরা পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায্য অধিকার না দেয়। তবে পূর্ব বাংলার জনগণ আলাদা পথ বেছে নিতে বাধ্য হবে।” 

তাঁর এই বক্তব্য পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশের আন্দোলনের জন্য একটি দিকনির্দেশনা হয়ে ওঠে। 

স্বাধীনতা সংগ্রামে ভূমিকা

১৯৭১ সালের মার্চে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বর্বর অভিযানের সময় মাওলানা ভাসানী তার টাঙ্গাইলের সন্তোষের বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। ক্র্যাকডাউনের পর তিনি বাড়ি ছেড়ে যমুনা নদী পেরিয়ে সিরাজগঞ্জে যান। সেখানে তিনি ন্যাপ (মোজাফফর) গ্রুপের কর্মী সাইফুল ইসলাম ও মোরাদুজ্জামানের সঙ্গে দেখা করেন। সেখান থেকে তাদের দুজনের সাথে তিনি নৌকায় করে আসামের দিকে রওনা হন।

দুর্ভাগ্যবশত, কিছুদিন পরই পাকিস্তানি সেনারা তার সন্তোষের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে অবগত না থাকায়, ভাসানী লন্ডনে গিয়ে একটি অস্থায়ী সরকার গঠনের পরিকল্পনা করেছিলেন। তার প্রধান পরিকল্পনা ছিল নদীপথের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তার ব্যবস্থা করা।

মুক্তিযুদ্ধকালীন ভারতে থাকা অবস্থায় মাওলানা ভাসানী সেখানে নজরবন্দী ছিলেন। তবুও তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন করেছিলেন; সাথে সাধারণ মানুষকেও অনুপ্রাণিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

স্বাধীন বাংলাদেশে কর্মজীবন

স্বাধীনতার পর মাওলানা ভাসানী দায়িত্বশীল বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে চেয়েছিলেন। প্রগতিশীল শক্তি তার নেতৃত্বে একত্রিত হয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিকে (ন্যাপ) যুক্ত হয়। কাজী জাফর আহমেদকে ন্যাপের সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তবে শীঘ্রই প্রগতিশীলদের মধ্যে মত পার্থক্য দেখা দেয়, যা ভাসানীর অবস্থানকে দুর্বল করে তোলে।

স্বাধীনতার পর থেকে ভাসানী আওয়ামী লীগ ও বাকশাল সরকারের স্বৈরাচারী নীতির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে তার সরকারের দুর্নীতি ও রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার বিরুদ্ধেও সতর্ক করেছিলেন। তবে তেমন কোনো লাভ হয়নি।

১৯৭৫ সালে শেখ মুজিবের হত্যাকাণ্ড ভাসানীকে গভীরভাবে মর্মাহত করে। মুজিবের প্রতি ছিল তার পিতৃস্নেহপূর্ণ মনোভাব। তাই মুজিবের মৃত্যুর খবর শুনে তিনি কেঁদে ওঠেন এবং প্রার্থনা করতে নিজের প্রার্থনা কক্ষে চলে যান। এই ঘটনা তার ব্যক্তিগত দুঃখ ও মুজিবের প্রতি ভালোবাসার প্রতিফলন।

ফারাক্কা বাঁধ বিরোধী লংমার্চ

১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার কাছে গঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত হয়। এই বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করা হয়ছিল। যার ফলে বাংলাদেশের পানি প্রবাহে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।  

মাওলানা ভাসানী বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন যে, ফারাক্কা বাঁধের ফলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে পানির অভাব দেখা দেবে। যা কৃষি উৎপাদন, পরিবেশ, এবং মানুষের জীবন-জীবিকার জন্য হুমকির বিষয়। তিনি এ বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরতে চেয়েছিলেন।

তাই ১৯৭৬ সালের মে মাসে মাওলানা ভাসানী গঙ্গার পানির ন্যায্য বণ্টনের দাবিতে একটি বিশাল লং মার্চের নেতৃত্ব দেন। সেখানে ভাসানী এই বাঁধ ভেঙে ফেলার দাবি জানান।

ঐতিহাসিক ফারাক্কা লং মার্চ

বাংলাদেশ সরকার অনানুষ্ঠানিকভাবে এই লং মার্চকে সমর্থন করে। তৎকালীন নৌবাহিনী প্রধান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খান এর রসদ সর্বোচ্চ সহায়তা করেন। ১৯৭৬ সালের ১৬ মে সকালে রাজশাহীর মাদ্রাসা ময়দানে ভাসানী জনসমাবেশে ভাষণ দেন। সেখান থেকেই লং মার্চ শুরু হয়।

লাখো মানুষ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এতে অংশ নিতে রাজশাহীতে জড়ো হয়। কয়েকদিন ধরে হাজারো মানুষ প্রায় ১০০ কিলোমিটার হেঁটে কানসাট পর্যন্ত পৌঁছায়। এই স্থানটি ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে অবস্থিত। এই লং মার্চ বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা ভারতের বিরুদ্ধে পানির ন্যায্য বণ্টনের প্রথম জনপ্রিয় আন্দোলন হিসেবে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়। ভাসানীর নেতৃত্বে হওয়া এই আন্দোলনের স্মরণে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১৬ মে ফারাক্কা লং মার্চ দিবস পালিত হয়।

কেন মাওলানা ভাসানী কে লাল মাওলানা বলা হয়

মাওলানা ভাসানীকে “লাল মাওলানা” উপাধি দেওয়া হয়েছিল তার বামপন্থী রাজনীতি ও সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা জন্য। তিনি শোষিত ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে সবসময় সোচ্চার ছিলেন। তিনি সাম্যের আদর্শে গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন। অন্যায়, শোষণ ও জুলুমের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থানই তাকে এই উপাধি এনে দিয়েছিল। 

মৃত্যু 

ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর হৃদরোগের সমস্যার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে ভর্তি হন। পরে ১৩ নভেম্বর হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে ‘খোদা-ই-খিদমতগার’ সম্মেলনে যোগদানের জন্য টাঙ্গাইলের সন্তোষ যান। সেখানে তিনি জীবনের শেষ ভাষণ দেন। সম্মেলন শেষে ওই দিনই ঢাকায় আসেন এবং পুনরায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকেন। 

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৭ নভেম্বর রাত ৮.২০ মিনিটে তিনি মারা যান। ১৮ নভেম্বর টাঙ্গাইলের সন্তোষে তার গড়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদ এলাকায় পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাকে দাফন করা হয়। তার মৃত্যুতে এক সপ্তাহের জাতীয় শোক পালন করা হয় । 

ভাসানীর মাজার

রাজনীতি ছিল তার প্রথম ভালোবাসা। 

রাজনীতি সম্পর্কে তিনি বলতেন, “রাজনীতি হলো এমন একটি মহৎ কর্ম, যার লক্ষ্য সমাজ থেকে অন্যায়, অত্যাচার, শোষণ ও নির্যাতন দূর করে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কল্যাণ নিশ্চিত করা। এটি ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, বাকস্বাধীনতা এবং গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার পথে কাজ করে।” 

দীর্ঘ ৭৫ বছরেরও বেশি সময়ে জাতীয় এমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা নেই যেখানে ভাসানীর সক্রিয় ভূমিকা ছিল না। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন ও ২১ দফা দাবির স্বেচ্ছাচারবিরোধী সংগ্রাম, ১৯৬২ সালের শিক্ষা কমিশনবিরোধী আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের আইয়ুব বিরোধী গণআন্দোলন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৭৬ সালের ফারাক্কা লং মার্চে তিনি লক্ষ কোটি মানুষকে উজ্জীবিত করেন।

সূত্র 

Related posts

উর্দুভাষী সোহরাওয়ার্দী ও বঙ্গপ্রেম

যোগেন মন্ডল- রাজনীতির হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্র

অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদের জীবন ও অর্জন

Leave a Comment

Table of Contents

    This website uses cookies to improve your experience. We'll assume you're ok with this, but you can opt-out if you wish. Accept Read More